এসো শব্দহীন পায়ে পর্ব ১২ মিশু মনি

0
293

এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ১২
মিশু মনি

নিয়াজ তিতাসের তাঁবুতে এসে দেখে ছোট্ট বিছানায় দুজনে পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছে। যেন একজন আরেকজনের যুগ যুগান্তরের চেনা। ওদের মাঝে বাগড়া দেয়ার ইচ্ছে মোটেও হলো না। দ্রুত সেখান থেকে ফিরে এলো নিয়াজ। চারিদিকে ঝলমল করছে রোদ। গাছের পাতায় রোদ লেগে ঝিকমিক করছে। আজকে দিনটা বড় সুন্দর। ওদিকে দুজন তরুণ তরুণী কত সুন্দর খোশ গল্পে মেতেছে। শুধু নিয়াজের কাছে সময়টাকে অর্থহীন মনে হচ্ছে।

ফ্রেরীহা তিতাসের ক্যামেরা ঘাঁটতে গিয়ে একটা ছবি দেখিয়ে বললো, ‘বাড়িটা অনেক সুন্দর। স্পেশালি এই জানালাটা। ‘জনি ডিপ’ এর ‘সিক্রেট উইন্ডো’ হা হা। এখানে একটা মেয়ে থাকলে দারুণ হতো না?’
তিতাস ওর ফোন বের করে আরেকটা ছবি দেখালো। শিউলী গাছের ডালে ঘেরা একটা ঘরের চাল। মাঝখানে একটা জানালা। জানালার গ্রিলের ফাঁকে একটা মিষ্টি মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছে। অস্পষ্ট, কিন্তু সুন্দর। ফ্রেরীহা মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘ওয়ান্ডারফুল!’

ফ্রেরীহা ফোনের স্ক্রিনে অনেক্ষণ চেয়ে রইলো। আঙুলের স্পর্শে ছবিটাকে আদর করে বললো, ‘মডেলটা প্রফেশনাল নাকি? ভালো লুক দিয়েছে তো।’
– ‘ওটা মডেল নয়।’
– ‘নয়?’
তিতাস ফোন নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর মুচকি হেসে বললো, ‘শি ইজ মাই প্রিন্সেস।’

নড়েচড়ে বসে ফ্রেরীহা উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো, ‘গার্লফ্রেন্ড?’
– ‘না। আমার প্রেম।’
– ‘প্রেম? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই প্রেম? ইউ সেইড, শি ইজ নট ইউর গার্লফ্রেন্ড।’

তিতাস উত্তরে বললো, ‘প্রেম হলে কি গার্লফ্রেন্ড হতেই হবে নাকি? সব গল্প একরকম হয় না। তেমনই একটা গল্প আছে আমাদের। খুব চমৎকার একটা গল্প।’
– ‘শোনাবে?’
– ‘আজ রাতে শোনাবো। এখন প্রচন্ড খিদে পেয়েছে।’

রাতের কার্যকলাপ শেষে যে যার মত শুতে চলে গেছে। নিয়াজ ফোনে প্রেমিকার সাথে কথা বলছে। ফ্রেরীহা তিতাসকে জেঁকে বসেছে ওর প্রেমের গল্পটা শোনার জন্য। ফ্রেরীহার আগ্রহ দেখে তিতাসও আর না বলে পারলো না।
গল্পটা শুনে ফ্রেরীহা হতাশ হয়ে বললো, ‘শিট ম্যান। ইউ ফাকিং বিচ।’
তিতাস অট্টহাসি হেসে বললো, ‘আমাকে গালি দিচ্ছো কেন?’
– ‘সো? এভাবে মেসেজটা না দিয়েই চলে এলে? আমি হলে সোজা ওর বাসায় গিয়ে সরাসরি বলে দিতাম। এভাবে রেগে চলে আসার কোনো মানে হয়?’

তিতাস হেসে বললো, ‘সারা রাত আরেকজনের বাসায় জেগে থাকতে গিয়ে আমার মেজাজ একেবারে গরম হয়ে গিয়েছিলো। বিশ্বাস করো। নিজেকে মনে হচ্ছিলো আমি একটা ছেঁচড়া ছেলে। তাই সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি। ফিরে গিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। আমার এসব আধিখ্যেতা, পিছে ঘোরা, প্রেম পিরিতি একেবারে ভালো লাগে না।।’
– ‘আমারও তোমার চলে আসাটা ভালো লাগলো না। এর জন্য পরে তোমাকে পস্তাতে হবে।’
– ‘কি বলো! মাত্র এক মাসের ব্যাপার। ফিরে গিয়েই মাকে পাঠাবো। এই একটা মাস আমি শুধু ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেই কাটাতে চাই।’

ফ্রেরীহা দুই হাত দুদিকে মেলে দিয়ে উদ্ভট কিছু প্রকাশ করে বললো, ‘পাগল বাঙালী। ইমোশন তোমাদেরকে খেয়ে দিয়েছে।’

এরপর খানিক্ষণ মাথাটা নিচু করে থেকে মৃদু স্বরে বলল, ‘অবশ্য আমার মায়ের থেকে ভালো ডিসিশন নিয়েছো।’
– ‘মানে!’
– ‘নাথিং।’

ফ্রেরীহা উঠে চলে যেতে যেতে দূর হতে ‘গুড নাইট’ জানালো। তিতাস একাই বসে রইলো। আকাশটা কালো, সেখানে ঝুলে আছে অসংখ্য নক্ষত্র। সব মিটমিট করছে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে তিতাস বললো, ‘দূরে নই। পৃথিবীর দু’প্রান্তে আছি বলে ভেবো না দূরে আছি। আছি তো দুজনে একই আকাশের নিচে। চোখ বুজলেই তোমাকে দেখতে পাই। হৃদয়ে বসে আছো, চাইলেই হৃদয়ের দরজা খুলে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। এরচেয়ে বেশি কি চাও বলো?’
নিয়াজ তিতাসের পাশে এসে দাঁড়াল, ‘কি হলো তিতু? ঘুমাতে যাবে না?’
– ‘যাবো। খুব তো বলেছিলেন গার্লকে আর কক্ষনো ফোন দেবেন না। নতুন নাম্বারটাও দেবেন না। পারলেন না তো।’
– ‘হা হা, প্রেম করবা যখন, তখন বুঝবা। দূরে থাকা যায় না রে। যায় না।’

নিয়াজ ভাইও চলে গেলো। তিতাস আনমনে ভাবতে লাগলো, ‘আসলেই তাই। দূরে থাকা যায় না। এত দূরে এসেও আমি তাঁর কথা ভাবছি। রাতের আকাশ দেখে ধরে নিচ্ছি সেও আমার মত আকাশ দেখছে। একই আকাশের নিচে দুজনেই আছি। আকাশ তাকে আমার মনের বার্তা পাঠাবে।

দুদিন পর ছোটমামা হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালো। রূপসার চাচা বাসায় বেড়াতে এসেছেন। এই সুযোগে বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলবে কি না?
তিতাস মেসেজ দেখে মুচকি হেসে রিপ্লাই পাঠিয়ে দিলো। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে দেখে বাইরে জোরেসোরে রান্নাবান্না চলছে। ফ্রেরীহা আফ্রিকান ছেলেটার সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। কি অদ্ভুত ধরণের সুন্দর লাগছে দুজনকে। একজন ধবধবে সাদা, একজন মিশমিশে কালো। অথচ দুজনের ভেতরে একই রং, একই অস্থি মজ্জায় গড়া। দুজনেরই মন আছে, বিবেক আছে। চাইলেই মিলেমিশে থাকা যায়। তবে কেন দুনিয়াজুড়ে বর্ণবাদ নিয়ে এত দাঙ্গা হাঙ্গামা? ওদেরকে একসাথে দেখতে তো চমৎকার লাগছে। সারা দুনিয়ার মানুষ কেন এভাবে একসাথে হাসতে পারে না? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তিতাস।

ফ্রেরীহা ওকে ডেকে বললো, ‘হেই তিতাস, জয়েন উইথ আস।’
– ‘শিওর।’
তিতাস এগিয়ে গেলো ওদের দিকে। আজকের দিনটা সত্যিই চমৎকার।

১৪
চাচা বাড়িতে ফেরার পর থেকে রূপসার দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। এখনো তো কিছুই জানা গেলো না। অথচ গত কয়েকটা দিন রূপসা একদমই ঘুমাতে পারে নি। সারাক্ষণ ছটফট করেছে। ও প্রতীক্ষায় আছে চাচা তিতাসের বাসা থেকে ভালো কোনো সংবাদ নিয়ে আসবেন। হয়তো বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যই সেখানে গিয়েছেন। সত্যি কোনটা ও জানেনা, তবুও মনে একইসাথে আশা ও শঙ্কা।
মা ও বাবার মাঝে যখন কথাবার্তা চলছিলো রূপসা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। মা বলছেন, ‘মেয়া বিয়ে দেওয়া নিয়া কোনো মাথাব্যথা নাই আপনের? বড় হইছে বোঝেন না?’
– ‘কই বড় হইছে। এখনো তো ছোটো।’

মা বললেন, ‘সে আপনের লাগে। মাইনসের লাগে না। একটা ভালো প্রস্তাব আসছে যখন, তখন আর না করার দরকার কি? ছেলে তো দেখছেন। ভদ্র, নম্র। উচাঁয় লম্বায় একেবারে মেয়ার সাথে মানানসই। শহরে মানুষ। ভালো ঘরের ছেলে। এমন পাত্র আর পাইবেন না।’
– ‘ছেলেটা আসুক, আমিও চিন্তা ভাবনা করে দেখি।’

রূপসা যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে ও। হাঁটু রীতিমতো কাঁপছে। ওর ধারণা কিভাবে মিলে গেলো! তিতাসকে আপন করে পেতে যাচ্ছে এই আনন্দে পাগল হয়ে যাচ্ছে যেন। কত প্রতীক্ষার পর! উফফ!

বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলো। খুশির জোয়ারে মন উতলা হয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হে আকাশ, তাকে খবর দিও। বলে দিও, তার অপেক্ষায় আমার ঘুম আসে না। সে যেন তারাতাড়ি আসে।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here