#এসো_করো_স্নান-11,12 last
রোকেয়া পপি
পর্ব-১১
রাজু চোখ বন্ধ করে পরে আছে।
ও বুঝতে পারছে না কে ওর মাথায় এতো সুন্দর করে বিলি কেটে পানি দিয়ে দিচ্ছে। ও জানে চোখ খুললেই তাকে দেখা যাবে।
কিন্তু এতোটাই আরাম লাগছে যে চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। যে ঢালে ঢালুক।
চোখ খুললেই সব আলো চোখের মধ্যে ঢুকে যাবে।
দাদা চোখ খোল। এখন মনে হয় জ্বর একটু কমেছে।
রাজু পিটপিট করে তাকিয়েই আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। আলোটা বড্ড চোখে লাগছে।
চোখ বন্ধ করেই বললো, সোমা তুই?
কখন এলি?
সোমা নাকের পানি, চোখের পানি এক করে বললো..
হ্যা আমি। কখন এলাম জেনে হবে কি শুনি?
আমি ঢাকা শহরে থাকতে মা আমাকে ফোন দিয়ে জানায় তুমি জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পরে আছো।
আসলে তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না।
ভালবাসলে তো আমাকে দেখতে যেতে মাঝে মধ্যে।
আমি ফোন দিলে তবে যাও।
তা না হলে এই ছোট্ট বোনটার কথা তোমার ভুল করেও মনে হয় না।
আহ্ সোমা এসেই শুরু করে দিছিস কান্না কাটি।
কখন থেকে তোমার মাথায় পানি ঢালছি তোমার হিসাব আছে? জ্বর কতো ছিল সেটাই কি জানো?
একশ পাঁচে উঠে গেছিলো জ্বর।
আমি এক ঘন্টার ওপরে তোমার মাথায় পানি ঢালছি। কি পরিমান ভয় পেয়েছিলাম তুমি যদি দেখতে।
সাত সকালে মায়ের ফোন পেয়েই কান্না শুরু করলাম। বাধ্য হয়ে শফিক অফিস যাওয়ার পথে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেল।
তোমার অবস্থা দেখে তো আমি পুরাই ঘাবড়ে গেলাম। একটা থার্মোমিটার পর্যন্ত নেই।
মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল।
তোমাদের বুয়াকে দিয়ে বাড়ি আলার বাসা থেকে থার্মোমিটার এনে জ্বর মেপে দেখি একশো
পাঁচ!
দাদা আমি তোমাকে আর এখানে রাখবো না।
তুমি আজকেই আমার সাথে আমার বাসায় যাবে।
এখন উঠে বসো তো।
উফ সোমা কি যে পাগলামি করিস না।
উঠে বসতে হবে কেন?
একটু স্যুপ খাবে। স্যুপ খেয়ে ওষুধ খাবে।
আমি ফুলির মাকে দিয়ে স্যুপের প্যাকেট আনায় স্যুপ রান্না করাইছি।
এখন কিছু খাবো না। মুখ তিতা হয়ে আছে। তুই আমাকে এক গ্লাস পানি আর নাপা দে।
আর আমি শুয়ে শুয়েই খেতে পারবো।
গলায় আটকে যাবে তো।
আটকাবে না। তুই দে।
উফ দাদা।
উঠো তো। উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসো। সুন্দর রোদ এসে পড়েছে তোমার বিছানায়। বসে দেখো ভালো লাগবে।
সোমা নিজেই রাজুকে ধরে উঠায় বসায় দিলো পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে।
তারপর বাটিতে করে স্যুপ নিয়ে খুব যত্ন করে একটু একটু করে খাওয়ায় দিলো ভাইকে।
রাজু খাওয়ার সময় ও চোখ বন্ধ করে বসে ছিল।
সোমা অভিমান করে বললো, দাদা চোখ বন্ধ করে রেখেছো কেন? কেমন বিশ্রি লাগছে দেখতে।
কথা বলে মজা পাওয়া যাচ্ছে না।
চোখ খোলো তো।
আলোটা চোখে লাগছে রে।
এই জন্যই চোখ বন্ধ করে রেখেছি।
আলো লাগবে না।
তুমি তাকাও। প্রথমে খারাপ লাগলেও একটু পরে দেখবে সয়ে গেছে।
এখন বলো দুপুরে কি খাবে?
আমি আজ সারাদিন তোমার সাথে থাকবো।
সন্ধ্যায় সফিক ফেরার পথে আমাকে আর তোমাকে নিয়ে যাবে।
আমাকে আর তোমাকে মানে কিরে?
আমি কোথাও যাচ্ছি না।
আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।
সোমা চোখের পানি আটকে রাখতে পারল না। চোখের পানি মুছে নাক টেনে টেনে বললো কেন যাবে না?
আমি তোমার কেউ না তাই না?
রাজু ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, তুই আর বড়ো হবি না রে পাগলি।
এখনো সেই কথায় কথায় চোখের পানি ফেলার অভ্যাস গেল না।
শোন পাগলি।
তুই আমার সব।
তোকে আমি কি পরিমাণ ভালোবাসি তুই সেটা কল্পনাও করতে পারবি না।
কিন্তু তুই বুঝিস না কেন?
তোর তো যৌথ পরিবার। সেখানে আমি ঘনো ঘনো গেলে তোর শশুর শাশুড়ি মোটেও ভালো চোখে দেখবেন না।
কে কোন চোখে দেখলো, আমার তাতে কাজ নেই।
আমার দাদা অসুস্থ আমি তাকে আমার কাছে নিয়ে সেবা করবো।
ব্যাস।
আর কোন কথা নেই।
জয়ী তার বাবা এবং ভাইদের ওপরে প্রচন্ড রকম বিরক্ত। প্রতিদিন কেউ না কেউ জয়ীকে দেখতে আসছে।
ওর কোন কথা কেউ শুনতে চাইছে না।
বাধ্য হয়ে জয়ী এখন না বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
যেখানে যেতে বলে লক্ষী মেয়ের মতো গিয়ে দেখা করে আসে। বাসায় ও মাঝে মধ্যে ছেলে পক্ষ এসে দেখে যাচ্ছে।
আজকে ও ছেলে পক্ষের আসার কথা।
যদিও কেউ জয়ীকে সে কথা বলেনি।
তারপরও ও বুঝতে পারছে।
জয়ীর ছোট খালা তিনটা বাজতে না বাজতেই এসে হাজির। উনি নিজেই সাথে দুই তিন আইটেম নিজ হাতে রান্না করে এনেছেন আইটেম বাড়ানোর জন্য।
খালাকে দেখেই জয়ী বুঝে ফেলেছে ঘটনা কি।
ইচ্ছে করে ছাদে চলে এসেছে।
আজ আর নিচে নামতে ইচ্ছে করছে না।
ছেলে পক্ষদের এভাবে একটার পর একটা মেয়ে দেখে বেড়ানো দেখে জয়ীর খুব খারাপ লাগে।
হয়তো এখান থেকে বের হয়ে আরেক মেয়ে দেখতে যাবে।
তারপর খুঁত বের করবে কোন মেয়ে কালো, কোন মেয়ের নাক চেপ্টা, কোন মেয়ে শর্ট।
এদের কি একটু লজ্জাও করে না, এভাবে একটার পর একটা মেয়ে দেখে বেড়াতে!
জয়ী যখন এসব চিন্তায় মশগুল
ঠিক তখন পেছন থেকে ছোট খালা এসে ডাক দিলো জয়ী এই ভর সন্ধ্যায় তুই ছাদে কি করছিস শুনি?
চল নিচে চল।
আমার কিছু মেহমান এসেছে, তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
তা তোমার মেহমানরা কি পাত্র পক্ষ?
এভাবে বলছিস কেন মা?
এই ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর।
একদম রাজপুত্র। তোর অপছন্দ হবে না।
বুয়েট থেকে পাশ করে বের হওয়া ইন্জিনিয়ার।
দেখিস এই ছেলের সাথে বিয়ে হলে তোর কপাল খুলে যাবে।
জয়ী ঠোঁট টিপে হাসলো।
মনে মনে বললো, আমার কপাল তোমরা অনেক খুলেছো খালা। আমার আর কপাল খোলার দরকার নেই।
মুখে বললো,
তাই নাকি!
তা তোমার রাজপুত্রের মতো ছেলে একটা ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করবে কেন?
মারে ছেলেটার একটা বিয়ে হয়েছিলো।
ছয় মাসের মাথায় রোড এক্সিডেন্টে বউটা মারা যায়।
তোর ও একবার বিয়ে হয়েছে, ছেলেও বিবাহিত।
বিবাহিত বিবাহিত কাটাকাটি।
তাছাড়া তুই বা দেখতে শুনতে কম কিসে।
খালা কিছু মনে করো না।
এই রোজ রোজ ছেলে পক্ষের সামনে আমি যেতে পারব না।
আমি আবার পড়াশোনা শুরু করবো।
আমাকে নিয়ে তোমাদের এতো না ভাবলেও চলবে। দয়া করে আমাকে একটু আমার মতো থাকতে দাও প্লিজ।
মা, সোনা, জাদু পাখি এভাবে বলতে নেই সোনা।
তোকে কিচ্ছুটি করতে হবে না।
তুই শুধু চা দিয়ে চলে আসবি।
আচ্ছা চলো।
চা কি আমাকে বানিয়ে দিতে হবে নাকি তোমাদের বানানো চা দেওয়ার পর বলবে
আমাদের জয়ীর নিজের হাতে বানানো চা।
ছোট খালা ফিক করে হেসে দিলো।
চল তো মা চল।
তোর মাথায় খালি দুষ্টু বুদ্ধি।
যেভাবে ছিলো, ঠিক সেভাবেই জয়ী চা নিয়ে বসার রুমে ঢুকলো।
জয়ী কে তারা এক দেখায় পছন্দ ও করে ফেললো।
এবং আগামী কাল সন্ধ্যায় ছেলে মেয়ের সাথে আলাদা করে কথা বলতে চায় কোন রেস্টুরেন্টে, ঘটক সেটা জানিয়ে দিলো।
ওরা আংটি পরিয়ে বিদায় নিলো।
ওরা চলে যাওয়ার পর জয়ী একসাথে পর পর দুইটা মিষ্টি কপকপ করে খেয়ে ফেললো।
জয়ীর খালা একটা হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো, যাক জয়ী তাহলে ছেলেকে পছন্দ করেছে।
ওর আপত্তি থাকলে আংটি পরতো না।
এভাবে খুশিতে মিষ্টি ও খেতো না।
চলবে…..
#এসো_করো_স্নান_(অন্তিম পর্ব)
রোকেয়া পপি
টেলিফোন বাজছে অনেকক্ষণ ধরে।
কিন্তু জয়ীর ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না।
জয়ী আপন মনে বিছানায় শুয়ে আকাশ দেখছে।
আকাশে এক খন্ড মেঘ সূর্য কে ঢেকে ফেলার প্রাণপন চেষ্টা করছে।
কিন্তু সূর্য ঠিক মেঘকে আড়ালে ফেলে উঁকিঝুঁকি মারছে।
জয়ীর বড়ো ভাবি এসে ফোনটা তুলে জয়ীর হাতে দিয়ে মিটমিট করে হাসছে।
জয়ী বিস্মিত হয়ে বললো হাসছো কেন ভাবি?
তুমি ফোন ধরছো না কেন?
তুমি ফোন ধরছো না জন্য আসিফ আমার নাম্বারে ফোন করে বলল ভাবি জয়ীকে একটু ফোনটা ধরতে বলবেন?
এখনি আবার ফোন করবে। ফোন আসলে ধরো কিন্তু।
ইস এখনি কতো প্রেম।
জয়ীর ভাবি হাসতে হাসতে বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ফোনটা আবার বেজে উঠল।
জয়ী ফোন ধরে বলল, হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
কি করছো জয়ী?
তেমন কিছু করছি না। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম।
তোমার কি আকাশ খুব প্রিয়?
হুম।
অনেক পছন্দ।
এই অবেলায় ফোন দেওয়ার কারণ জানতে পারি?
না না তেমন কোন কারণ নেই। তুমি কি বিরক্ত বোধ করছো।
না।
বিরক্ত বোধ করছি না। একটু আগে ও মনটা খুব বিষন্ন হয়ে ছিল।
এখন আপনার সাথে কথা বলতে বেশ ভালোই লাগছে।
আচ্ছা তাহলে আমি কি একটা রিকোয়েস্ট করতে পারি?
জি করুন।
আজকে তো বিকেলে আমাদের বাইরে বসার কথা ছিল।
আমি যদি সময় টা একটু এগিয়ে নিয়ে এসে তোমাকে লাঞ্চের দাওয়াত দেই, তুমি কি গ্রহণ করবে?
অবশ্যই করবো।
তাহলে ঝটপট রেডি হয়ে নিচে নেমে আসো।
আমি তোমাদের বাসার সামনে গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
জয়ী খুব অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। ঝটপট ড্রসটা চেন্জ করে, চুল আঁচড়ে, পাঁচ মিনিটের মাথায় বের হয়ে আসলো।
আসিফ অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল।
একটা মেয়ে না সেজেও এতো সুন্দর হতে পারে!
জয়ী হালকা আকাশি কালারের থ্রিপিস পরছে।
চোখে গাঢ় করে কাজল।
ঠোঁটে লিপগল্স।
এতেই এতো স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে।
আসিফ চোখ ফেরাতে পারছে না।
যে কোন ছেলেকে আজ জয়ীর দিকে একবার তাকালে আরেকবার ফিরে তাকাতে হবে।
ওরা তাওয়া রেস্টুরেন্টে বসলো।
জয়ীর খুব পছন্দের একটা জায়গা এটা।
জয়ীর পছন্দের সব খাবার অর্ডার দিয়ে আসিফ হালকা করে হাসলো জয়ীর দিকে তাকিয়ে।
জয়ীও প্রতি উত্তরে ঠোঁট টিপে হাসলো। আর মনে মনে বললো,
ছেলেটা সত্যিই দেখতে সুন্দর এবং হ্যান্ডসাম।
কথাও বলে বেশ মজা করে।
তারপর জয়ী তোমার অনার্সের রেজাল্ট কি?
আমি অনার্স পরীক্ষা দেইনি।
কেন দাওনি? ফেল্টু মার্কা ছাত্রী ছিলে?
জয়ী শব্দ করে হেসে ফেললো।
আশপাশের সবাই ঘুরে তাকাচ্ছে।
কিন্তু জয়ী হাসি থামাতে পারছে না।
আসিফ মুগ্ধ হয়ে জয়ীর হাসি দেখছে।
জয়ী কোন রকমে হাসি থামিয়ে বললো, পরীক্ষার আগ দিয়ে বাবা আমাকে ধরে জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন। তাই আর পড়াশোনা করা হয়নি।
ধরে বিয়ে দেন মানে? তুমি রাজি ছিলেনা?
রাজি থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।
আমি একজনকে খুব পছন্দ করতাম।
এরমধ্যে খাবার চলে এসেছে।
আসিফ খাবার মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললো, বাহ্ এদের খাবার তো খুব টেস্টি।
হুম।
রাজু ভাইয়ার খুব পছন্দ এখানকার খাবার। এই জন্যই আপনাকে নিয়ে আমি এখানেই আসলাম।
রাজু কে?
আমাদের গ্রামের। খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র।
ও আচ্ছা। তোমার রাজু ভাইয়ার এখানকার খাবার পছন্দ।
তোমার পছন্দ না?
রাজু ভাইয়ার সব পছন্দই আমার পছন্দ।
আচ্ছা জয়ী শুনো। তোমাকে নিয়ে আমার ছোট্ট একটা প্লান আছে।
আমরা লাঞ্চ শেষ করে মুভি দেখতে যাবো।
তারপর সন্ধ্যায় চা কফি যা খাও খেয়ে তোমাকে বাসায় দিয়ে আসব।
তোমার কোন আপত্তি নেই তো আমার সাথে এতো দীর্ঘ সময় থাকতে?
জয়ী আবারো ঠোঁট টিপে হাসলো।
আমার কোন আপত্তি নেই।
তবে আমার সিক্সথ সেন্স বলছে আপনার সাথে আমার বিয়েটা হবে না।
তখন আপনার খারাপ লাগতে পারে।
একজন সুন্দরী, মায়াবতী কন্যার সাথে সময় কাটিয়ে দেখা যাবে আপনার আর কোন মেয়েকেই মনে ধরেছে না।
আসিফ জয়ীর কথা শুনে বাক্যহারা হলো।
হতভম্ব ভাব কাটিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো, তা তোমার সিক্সথ সেন্স আর কি বলছে?
তোমার সেই রাজু ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে হবে?
বাহ্!
আপনার সিক্সথ সেন্স ও তো মারাক্তক।
জয়ী হাসছে।
খিল খিল করে হাসছে।
কে কি ভাবছে, সেদিকে ওর কোন খেয়াল নেই।
ও কোন ভাবেই নিজের হাসি থামাতে পারছে না। হাসতে হাসতে ওর চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো স্বচ্ছ টলটলে পানি গড়িয়ে পরছে।
ও মোছার কোন চেষ্টা করছে না।
শরাফত আলী মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছে ভর সন্ধ্যায়।
ছেলে পক্ষ গতোকাল আংটি পরিয়ে পাকা কথা বলে গেছে। একদিনের মধ্যেই কি এমন ঘটলো, যে ছেলে নিজে ফোন করে বিয়ে ভেঙে দিলো।
বাবা তোমার চা।
শরাফত আলী চমকে উঠলেন।
তাকিয়ে দেখেন জয়ী চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমি চা চাইনি তো মা।
তুমি চাওনি তাতে কি হয়েছে?
আমার খেতে ইচ্ছে হলো। তোমার সাথে এক কাপ চা খেতে পারি না?
অবশ্যই পারিস মা।
বোস, আমার পাশে বোস।
উনি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মুখে না দিয়েই বললেন, চা টা খুব ভালো হয়েছে রে মা।
বাবা তুমি এখনো মুখে দাওনি।
না খেয়েই বলে দিলে ভালো হয়েছে!
চেহারা দেখেই বোঝা যায় মা, ভালো হয়েছে যে।
তিনি তৃপ্তি নিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। মনে মনে একটু লজ্জাও পেলেন। মেয়েটার কাছ থেকে এতোটা দূরে সরে যাওয়ার জন্য।
তিনি মনে মনে বললেন, মেয়েটা বড়ো দুঃখি।
আমার উচিত মেয়েটাকে এভাবে দূরে ঠেলে না দিয়ে মাঝে মধ্যে গল্প করা।
না এখন থেকে আর এই ভুল হবে না।
এখন থেকে নিয়মিত মেয়েটাকে সময় দিতে হবে।
জয়ী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিল।
শরাফত আলী ডেকে বললেন, কিছু বলবি মা?
জয়ী চোখ নামিয়ে ফেললো।
ছলোছলো চোখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বাবা তুমি আর আমার জন্য ছেলে দেখো না।
আমাকে যদি আবারো বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়, তবে আমি রাজু ভাইয়া কেই বিয়ে করতে চাই।
আর নয়তো নতুন করে পড়াশোনা শুরু করতে চাই।
পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে চাই।
যেখানে গেলে আমার আর রাজু ভাইয়ার জন্য মন কাঁদবে না।
শরাফত আলী মেয়েকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন।
চোখের পানি মুছে বললেন, একবার আমার ইচ্ছে তোর ওপরে চাপিয়ে দিয়ে খুব ভুল করছি মা।
নতুন করে আর ভুল করতে চাই না।
তুই রাজুকে ফোন করে বল।
বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে ওর বাবা মাকে পাঠাতে।
জয়ী আনন্দে বাবাকে জড়িয়ে ধরে একটা চিৎকার দিলো। বাবার গালে চুমু দিতে দিতে বললো, বাবা তুমি খুব ভালো বাবা।
তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। আমি তোমাকে ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি।
মানুষের জীবন কি রহস্যময় চক্রের মতোই।
যেখান থেকে শেষ সেখান থেকেই আবার শুরু?
রাজুর মা মনোয়ারা বেগম ভেতরের বারান্দায় বসে আছেন।
আজ তার বড়ো আনন্দের দিন।
তার চোখের সামনে এতো ভালো একটা মেয়ে ছিল, অথচ তিনি বুঝতে পারলেন না।
মেয়েটা সত্যিই খুব সাহসী।
আমার বিশ্বাস, এই মেয়ে সারাজীবন আমার রাজুকে দেখে রাখবে। আমার আর কোন ভয় নেই।
এই মেয়ে যেন তেন মেয়ে নয়।
আমার রাজু তো মরতেই বসেছিলো।
এই মেয়ে রক্ষা না করলে আমার রাজুকে আর ফিরে পেতাম না।
মনোয়ারা বেগমের চোখে আজ আনন্দ অশ্রু।
তার জীবন যেখান থেকে শেষ হয়েছিলো, রাজুর জীবন সেখান থেকেই শুরু হলো।
ঠিক পঁয়ত্রিশ বছর আগে তিনি এমন জোৎস্না রাতে এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন।
সেই রাতে তার শাশুড়ি মাও এভাবে ভেতরের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে ছিলেন।
রাজুর বাবা তখন ফিসফিস করে আবেগীয় কন্ঠে বলেছিলো, কি চমৎকার জোৎস্না!
দেখেছো মনোয়ারা?
মনোয়ারা অপরিচিত সেই মানুষটির ভয়ে অস্থির হয়ে, কাঠ কাঠ হয়ে শক্ত ভাবে বসে ছিলো। তাদের ছিল এ্যারেন্জ ম্যারেজ। ভয় পাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
তারপর গমগমে মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনে মুখ তুলে তাকিয়েছিল।
খোলা জানালা দিয়ে এক ফালি আলো এসে ওদের দুজনকে মিষ্টি আলোয় মাখামাখি করে দিচ্ছিল।
রাজুর বাবা তখন আরো ফিসফিস করে বলেছিলো, চলো ছাদে যাই।
জোৎস্না স্নান করে আসি।
তখন তারা দুজন পা টিপে টিপে চোরের মতো ছাদে গিয়েছিল জোৎস্না স্নান করতে।
আজ ও রাজু আর জয়ী ঠিক একি ভাবে পা টিপে টিপে ছাদে উঠে গিয়েছে একটু আগে।
মনোয়ারা বেগমের চোখে আজ নোনা জলের বন্যা।
এ নোনা জল বড়ো আনন্দের।
শেষ