এসো_করো_স্নান-01,02

0
719

ধারাবাহিক উপন্যাস।
কাছে আসার গল্প।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে।

#এসো_করো_স্নান-01,02
কলমে রোকেয়া পপি।
১ম পর্ব

রিকশা থেকে নামার সময় জয়ী খেয়াল করলো, তার খুব ভয় করছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে। হাতের তালু অকারণে ঘামছে।
সে জানে তার এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ওদের কাজের ছেলে জব্বার আজ রাজুর সাথে ওকে দেখে ফেলেছে।

জয়ী নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিলো, জব্বার হয়তো বাসায় এসে কিছুই বলেনি।
আর যদি বলেও থাকে, ইনভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে বাবা নিশ্চয় গায়ে হাত তুলবে না।

জয়ী ভয়ে ভয়ে গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো।
বসার রুমের দরোজা খোলা। এমন তো হবার কথা নয়।
ওদের বাসায় কখনো দরোজা হাট খোলা থাকে না।
জয়ী ভয়ে ভয়ে পর্দা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলো।

জয়ীর পুরো শরীর ভয়ে জমে গেছে। ওর মনে হচ্ছে যে কোনো সময় ও অজ্ঞান হয়ে যাবে।
আজ ওর বিচার সভা বসেছে।

জয়ীর বাবা প্রচন্ড রাগী মানুষ।তাকে ভয় পায় না, এমন মানুষ আশেপাশের চার পাঁচ গ্রামে পাওয়া যাবে না।
চেয়ারম্যান শরাফত আলীর নাম শুনলেই সবাই ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপে।

তিন ভাইয়ের আদরের একমাত্র ছোট বোন জয়ী।
দেখতে যেমন সুন্দরী, পড়ালেখায় সমান পারদর্শী।
যতোই সুন্দরী হোক, গ্রামের কোন ছেলের চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই।
এটাই এতো দিন জেনে এসেছে জয়ীর বাবা এবং ভাইয়েরা।

কিন্তু আজ জয়ীকে জব্বার নিজের চোখে দেখে এসেছে
একি গ্রামের স্কুল শিক্ষক জামাল মাস্টারের ছেলের সাথে হাতে হাত রেখে কথা বলতে।

শরাফত আলী তার গমগমে কন্ঠে আওয়াজ তুলে বললো, মা জয়ী রাজুর সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক?

জয়ী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের আঙ্গুল দিয়ে এমন ভাবে মাটি খোঁচাচ্ছে, যেন মাটি খোঁচানো তার একমাত্র প্রধান কাজ।

শরাফত আলী এবার ধমক দিয়ে বললেন কথা কানে যায় না?
আমি তোমাকে প্রশ্ন করছি।
উত্তর দাও না কেন?

জয়ী কেঁপে উঠলো। একবার চোখ তুলে চেয়েই আবার চোখ নামিয়ে ফেললো।
সে দেখলো তার বাবা এবং তিন ভাই তার মুখের দিকে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সে ফিসফিস করে বললো, কোন সম্পর্ক নেই আব্বাজান।

বাহ্।
এটা তো খুব ভালো কথা। কোন সম্পর্ক নাই। তাইলে ঐ পরপুরুষের হাতে হাত রাইখা কথা কওন লাগবো কেন আম্মাজান?

গ্রামের চেয়ারম্যানের একমাত্র মাইয়া হইয়া তুমি স্কুল মাস্টারের পোলার লগে হাত ধইরা কথা কও!
আমার আম্মা জানের তো বহুত উন্নতি হইছে।

আইজকা থন তোমার ঘরের বাইরে বাইর হওন নিষেধ।
ঢাকা থন বড়ো ঘর থাইকা তোমার সমন্ধ আসছে।
ছেলে বড়ো ব্যাবসায়ী। দেখতে শুনতে ভালই।
নিজেগো বাড়ি গাড়ি আছে।
দেশের বাইরে থন পড়াশোনার ডিগ্রি আনছে।

আমি ঠিক করছি এইহানে তোমার বিয়া দিমু।

আর কোন রকম তেরিবেরি করবার চেষ্টা করবা না
বুজছো আম্মাজান। তোমার
পেয়ারের রাজু এখন আমার হাতে বন্দী।
তুমি কোন উল্টা পাল্টা করলেই রাজুকে আর খুঁইজা পাওন লাগতো না।
তোমার বজানের ক্ষমতা সম্পর্কে আর নতুন কইরা কিছু কওনের দরকার নাই আশা করি।

অহন যাও।
হাত মুখ ধুইয়া খাওন দাওন করো।

জয়ীর পা দুটো বরফের মতো জমে ভারি হয়ে গেছে।
সে এক পাও উঁচু করতে পারছে না।
তার ধারণা যে কোন সময় সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
সে জানে তার বাবা মুখে যা বলেন, তাই করেন।
এর আগেও অনেক খুন, খারাপি এবং গুম করেছেন।
জয়ীর খুব ভয় করছে। রাজুর কোন ক্ষতি হবে না তো?

চলবে….

ধারাবাহিক উপন্যাস কাছে আসার গল্প।

#এসো_করো_স্নান_(২য় পর্ব)
রোকেয়া পপি।

জয়ীর রাতে ঘুম হয়নি।
ঘুম হয়নি বললে ভুল হবে, ইফতি ঘুমাতে দেয়নি।
বাসর রাতে নাকি ঘুমাতে নেই।
সারারাত মজা করে ইফতি এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

জয়ী শাড়ি নিয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে ঝড়না ছেড়ে দিয়ে চুপচুপ দাঁড়িয়ে রইল।
পানির ধারা ওকে ধুয়ে মুছে পবিত্র করে দিচ্ছে।
ওর চোখ দিয়েও বয়ে চলেছে অঝোর ধারায় ঝর্না।
দুই ঝর্নার পানি মিলে মিশে একাকার।

বিশাল ধুমধাম করে জয়ীর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে।
জয়ীর বাবা তার একমাত্র মেয়ের বিয়েতে খরচ করতে কোন কার্পন্য করেনি।

বরিশাল যেতে সমস্যা হবে জন্য ঢাকায় বিশাল বাড়ি ভাড়া নিয়ে জয়ীর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছেন।

বিয়ের পুরো অনুষ্ঠানে জয়ী এক ফোঁটা চোখের জল ও ফেলেনি।
এমনকি বিদায় বেলায় যখন জয়ীর বাবা এবং তিন ভাই জয়ীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিল।
জয়ীর চোখ তখন শুকনো খটখটে।

জয়ীর বাবা ইফতির হাতে মেয়েকে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় যখন বলছিলো, আমার মা মরা মেয়েটা বড়ো আদরের। ওকে তুমি দেখে রেখো বাবা।

তখন আশেপাশে দাঁড়ানো মহিলারা সবাই শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছছিলো, আর ফিসফিস করে বলছিলো, কি শক্ত মেয়েরে বাবা!
চোখে এক ফোঁটা পানি নেই!
কাজি সাহেব যখন কবুল বলতে বললেন, প্রথম বারেই তোতা পাখির মতো কবুল বলে দিলো।
এমন কঠিন মেয়ে বাপের জন্মে ও দেখিনি।

অথচ সেই শক্ত মেয়েটা এখন আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। দরোজার আড়াল হওয়া মাত্রই সব কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে চলে এসেছে।
ঘন্টা পার হয়ে গেছে, তবু ও জয়ী একভাবে ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ইফতি এসে দরোজা না ধাক্কালে হয়তো আরো ভিজতো। জয়ী কোন রকমে শাড়িটা শরীরে পেঁচিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বের হয়ে আসলো।

ইফতি বিরক্ত হয়ে বললো, তোমার সমস্যা কি?
সেই কখন থেকে ওয়াশ রুমে!
ঠান্ডা লাগিয়ে বিছানায় পড়তে চাও?

জয়ীর চোখ ভিজে উঠছে।
ওর সাথে কখনো কেউ এভাবে শক্ত করে কথা বলে না।
মাত্র একদিনের পরিচয়েই নতুন বউকে কেউ এভাবে কঠিন স্বরে কথা বলতে পারে জয়ীর তা জানা ছিল না।

ইফতি ওয়াশ রুমে ঢুকে যাওয়ার পর জয়ী ঝটপট নিজেকে একটু হালকা সাজে গুছিয়ে নিলো।
ক্ষুধায় ওর পেটের মধ্যে মোচরাচ্ছে। কাল ও তেমন কিছুই খেতে পারেনি।
এ বাসায় এসে ও সবার সাথে এক টেবিলে বসেছিলো খেতে। কিন্তু কোন খাবার গলা দিয়ে নামেনি।

ও ফ্রিজের দরোজা খুলে ভেতরটা চোখ বুলিয়ে নিলো, কোন খাবার পাওয়া যায় কিনা।
ফ্রিজ ভর্তি শুধু মিষ্টির প্যাকেট।
সাত সকালে ওর মিষ্টি খেতে একদম ভালো লাগে না।
ও মন খারাপ করে ফ্রিজের দরোজা বন্ধ করা মাত্র ইফতি ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসলো।
ইফতি ক্রকশ কন্ঠে বলে উঠলো, বাবার বাড়ি থেকে বিশাল সাইজের ফ্রিজ দিয়েছে জন্য কি এতো জোরে ফ্রিজের দরোজা বন্ধ করতে হবে!
মা নেই জন্য কি কিভাবে জিনিস পত্র যত্ন নিতে হয়, সেটা কেউ শেখায়নি!

জয়ীর মুখ লাল হয়ে গেছে। সে ভাবতেই পারছে না সামান্য একটা ফ্রিজ আটকানো নিয়েও কেউ রাগ দেখাতে পারে। তাও আবার নতুন বউয়ের সাথে।
তারই বাবার বাড়ি থেকে আসা জিনিস নিয়ে!

ইফতিদের বাসাটা ডুপ্লেক্স। নিচ তলায় ডাইনিং স্পেস। ইফতির ছোট বোন এসে ওদের নিচে নিয়ে গেলো নাস্তা খাওয়ার জন্য।

সবাই যেহেতু ওদের জন্য অপেক্ষা করছে, তাই আর দেরি না করে ওরা নিচে নেমে আসলো।

নিচে নেমে জয়ী সারপ্রাইজ।
এতো সকালে তার তিন ভাই হরেক রকম নাস্তা নিয়ে জয়ীর শশুর বাড়ি হাজির।

জয়ী সারপ্রাইজ হলেও সেটা মুখে প্রকাশ করলো না।
চেহারায় শক্ত একটা ভাব ধরে রাখলো।

জয়ীর শাশুড়ি মা এগিয়ে এসে জয়ীকে হাত ধরে টেবিলে নিয়ে বসালো।

দেখো তোমার ভাইরা কতো নাস্তা এনেছে। কাল তো কোন খাবার মুখে দাওনি।
আজ তোমার ভাইদের সাথে বসে একটু আরাম করে পেট ভরে খাও।

এরা বৌভাত করবে না এখন।
ইফতির বড়ো বোন‌ দেশের বাইরে থাকে। বিয়েতে আসতে পারেনি। বড়ো বোন যখন দেশে আসবে তখন রিসিপশন পার্টি দিবে।
তাই জয়ীর ভাইরা আজ জয়ী আর নতুন জামাইকে নিতে এসেছে।

ইফতি শশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু বেঁকে বসেছে জয়ী। সে কিছুতেই এখন ঐ বাড়ি যাবে না। কারণ হিসেবে বললো, তার শরীর ভালো লাগছে না।

জয়ীর অভিমান কোন জায়গায় সেটা ইফতি না বুঝলেও জয়ীর ভাইরা ঠিকই বুঝতে পারছে।
তাই জড়াজড়ি না করে ওরা জয়ীর শাশুড়ি মা কে বুঝিয়ে বললো, জয়ীর যখন যেতে মন চায় আমাদের খবর দিবেন। আমরা এসে নিয়ে যাবো।
ওরা এক রকম মন খারাপ করেই বিদায় নিলো।

প্রতি দিনের নিয়মে দিন চলে যাচ্ছে। জয়ীর চোখের নিচে কালি পড়েছে, গলার হাড় দেখা যায়।
যে কেউ এক দেখাতেই বলে দিতে পারে, জয়ী ভালো নেই।
ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটা দিন দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
তবুও তার সৌন্দর্য একটুও ম্লান হয়নি। জয়ীকে দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। এ বাড়ির বউ এতো সুন্দর।

মুগ্ধ হয় না শুধু ইফতি। মুগ্ধ হয় না, ইফতিদের বাড়ির কেউ। জয়ীর প্রতিটা কাজে দোষ ধরাই এদের একমাত্র প্রধান কাজ।

টিভি দেখার সময় চ্যানেল ঘোরালেও দোষ ধরা হয়।

জয়ীর শাশুড়ি মুখ অন্ধকার করে বলবেন, এতো টিপাটিপি করলে কি টিভিটা টিকবে? নষ্ট হয়ে গেলে কি তোমার বাপ এসে এ বাড়ির জিনিস কিনে দিয়ে যাবে?
বাপের নাকি এতো টাকা।
না যায় মেয়ে বাপের বাড়ি, না আসে বাপ মেয়েকে দেখতে।
ঈদের মধ্যে কিছু কাপড় চোপড় পাঠায় দিয়েই তেনার বাপ খালাস।
এমন একটা অকর্মার ঢেঁকি মেয়েকে কিভাবে যে আমার সোনার টুকরা ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিল।

জয়ী প্রচন্ড রকম চেষ্টা করছে সবার সাথে মানিয়ে চলতে।
কিন্তু কোন ভাবেই এরা জয়ীকে নিজের করে নিচ্ছে না।

প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হতো। এখন আর ওর মন খারাপও হয় না। জয়ী শিখে গেছে কিভাবে নিজেকে নিজের জগতে ব্যাস্ত রাখতে হয়।
ও এখন চাইলেই চলে যেতে পারে মনের বাড়ি সবুজ অরণ্যে। চারদিকে শুধু সমুদ্রের বিশালতা।
মাঝখানে সবুজ একখন্ড দ্বীপ।
সেখানে সে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়।

কখনো বা ইচ্ছে করলেই সে চলে যেতে পারে বরফে আচ্ছাদিত তুষারপাত ঘেরা কোন শীতের দেশে।
মন ভরে তখন সে তুষার স্নান করে।

বিয়ের পাঁচ বছরে ইফতির সাথে সম্পর্কের অবনতি এখন চরম পর্যায়ে।

প্রায় সময় ইফতি রাতে বাসায় ফিরে না।

জয়ীর শাশুড়ি আকার ইঙ্গিতে সবসময় বুঝিয়ে দেয় ইফতিকে তারা আবারও বিয়ে দিবে। পাঁচ বছরে যখন জয়ী মা হতে পারেনি, তখন আর পারবে ও না।

জয়ী এখন আর এসব গায়ে মাখে না।
তবে তার খুব বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে।
মাঝে মাঝেই জয়ীর বাবা ফোন করে মেয়ের সাথে কথা বলে। জয়ী বুঝতে পারে তার বাবার শরীর ইদানিং ভালো যাচ্ছে না।
কিন্তু মুখ ফুটে তার বাবা কিছুই বলে না।

মেয়ে যে ভালো নেই সেটা সে জানে।
এই কষ্টের ওপর নতুন করে আর কষ্ট দিতে মন‌ চায় না।

জয়ী যখন ইফতিকে বললো, আমি বরিশাল যেতে চাই।
বাবার শরীর ইদানিং ভালো যাচ্ছে না।

ইফতি তখন হো হো শব্দ করে হাসলো কিছুক্ষণ।
তারপর ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললো, তোমার বাবার বাড়ি আছে?
জানতাম না তো!

আচ্ছা ঠিক আছে যাবে যাও।
তুমি এ সংসারে একটা অপ্রয়োজনীয় আসবাবের মতো। থাকলেই কি? আর না থাকলেই কি?
যতোদিন ইচ্ছে থাকো বাবার বাড়ি।
ফিরে এসেই একটা চমক আছে তোমার জন্য।
অতএব চিন্তা করো
ফিরে এসে চমক পেতে চাও
নাকি আর ফিরে না আসতে চাও।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here