#তিনি_আমার_সৎমা
পর্বঃ২
মিথিলা নিভা
ইদানীং ভদ্রমহিলা বড্ড আমাদের পরিবারের সব ব্যাপারে নাক গলানো শুরু করেছে যেটা আমার একদম পছন্দ হচ্ছেনা। তিনি আমার বাবার স্ত্রী, তার অধিকার আছে এই সংসারের উপর ঠিক আছে। কিন্তু আমি আর রনি উনার সন্তান নই। আমাদের ব্যাপারে এতো খবরদারি আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। রনির অনেক রকম অভ্যাস ছিলো, সে আগে ভাত খেতে চাইতো না একদম। আমার মা শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। রনি যা খেতে চাইতো তাই দিতো। কিন্তু আজকাল আমি বেশ অবাক হয়ে খেয়াল করছি নতুন ভদ্রমহিলা রনিকে ভাত খাওয়ায়, রনিও দিব্বি খেয়ে ওঠে। উনার এসব আচরণ আমার ঠিক সুবিধার লাগছে না কেনো জানি। এমনিতে উনাকে খারাপ লাগার কিছু নাই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে উনি আমাদের পরিবারের জন্য অনেক করছেন এবং আমাদের সাথে মিশে যেতে চাইছেন। সবাই এমনটাই বলবে উনাকে দেখে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে আমার ষষ্ঠইন্দ্রীয় বেশ প্রখর। আমি কথা কম বলি, তবে আমি বোকা নই। এমন অনেক কিছু আমি বেশ আগে থেকেই বুঝতে পারি যেটা কিনা কেউ ধারণাও করতে পারেনি ওই সময়। আমি জানিনা এটা কেনো হয়, আমি চাইও না এমন হোক আমার সাথে। আমি সবার মতো স্বাভাবিক হতে চাই, কিন্তু আমি না চাইতেই এসব আমার সাথে ঘটে। আমার মায়ের মৃত্যুর আগেও ঠিক এমন কিছু বুঝতে পেরেছিলাম আমি যা এখনো কাউকে বলতে পারিনি আমি।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি আমার ঘরে বসে পড়ছিলাম, পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। তাই একমনে বসে পড়ছিলাম আমি। খুট করে দরজা খোলার শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি। বইয়ের দিকে তাকিয়েই স্পষ্ট বুঝতে পারছি না উনি এসেছেন।
“আপনি আবার এসেছেন আমার ঘরে?” আমি বইয়ের দিক থেকে মাথা না তুলেই বললাম।
ভদ্রমহিলা বেশ আয়েশ করে আমার খাটের উপর পা তুলে বসলেন। উনার হাতে একটা বাটি।
“বাহ রে! আমার মেয়ের ঘরে আমি এসেছি, তার জন্য আবার কার অনুমতি নিতে হবে?”
আমি ঘুরে উনার দিকে তাকালাম। কতো বয়স হবে মহিলার? পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশ। মোটামুটি ফর্সা, ছোটখাটো গড়নের মহিলা। মুখে সবসময় হাসি, যে হাসির একটা মানে আছে। যা আমি বুঝতে চেষ্টা করছি।
“শোনো নীরা, আমি শুনেছি তোমার মায়ের অনেক লম্বা চুল ছিলো। তোমার চুলগুলোও অনেক সুন্দর। কিন্তু যত্নের অভাবে কেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এইযে বাটিতে নারকেল তেল এনেছি। তোমার চুলে লাগিয়ে দিবো এখন।”
“আশ্চর্য! আপনাকে কি বলেছি আমার চুলে তেল দেওয়ার দরকার? কেনো এসেছেন? দেখুন আমার সামনে পরীক্ষা। দয়া করে এভাবে ডিস্টার্ব করবেন না আমাকে।”
মহিলার মুখে তখনও হাসি। মিটমিট করে হাসতে হাসতে বললেন,”তোমার বাবার বন্ধু হাশেম সাহেব এসেছেন। তোমার বাবা ডাকছেন তোমাকে। যাও দেখা করে এসো।”
আমার চোখমুখ মুহুর্তেই রক্তশূণ্য হয়ে গেলো উনার কথা শুনে। হাত পা কাঁপতে শুরু করলো থরথর করে। আমার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে আবার একটু হাসলেন উনি।
“কি ব্যাপার নীরা? তোমার হাশেম আঙ্কেলের কথা শুনে এভাবে চুপ হয়ে গেলে যে? তোমার বাবা ডাকতে আসছেন তোমাকে।”
এই মুহুর্তে ওই মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো উনি আমার বিষয়ে অনেক কিছু জানেন।
আমি উনার দিকে শীতলচক্ষু দিয়ে তাকালাম। উনি নির্বিকার।
চোয়াল শক্ত করে বললাম,”কে আপনি?”
“কেনো? তোমার সৎমা।”
উনাকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই দরজায় টোকা পড়লো।
“নীরা, রুমে আছো?”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “জ্বি বাবা।”
বাবা ঘরে ঢুকে উনার দিকে তাকালেন।
“রুনা, তুমি এখানে কি করো?”
“এই এসেছিলাম মেয়ের সাথে একটু গল্প করতে।”
“যাই হোক, নীরা তোমার হাশেম আঙ্কেল এসেছেন। তোমাকে ডাকছেন।”
আমি চোখমুখ শক্ত করে বললাম,”আমি যাবো না। আমার পড়া আছে।”
“নীরা, তোমাকে আগে অনেকবার আমি বলেছি, মুখে মুখে তর্ক করা একদম পছন্দ না আমার। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসবে। সুন্দর করে সেজে। আমার যেনো আবার ডাকতে আসতে না হয়। আমি রেগে গেলে কি হতে পারে জানো তো?”
“আমি তো বললাম আমি যাবো না উনার সামনে। তোমার যা করার তুমি করতে পারো।”
বেশ কিছুক্ষণ বাবা কোনো কথা বললেন না। ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে কাহিনি দেখছেন আমাদের।
“নীরা, তুমি কি চাও তুমি যে শাস্তি গুলো পাও, রনিও তেমন শাস্তি পাক?”
আমি ভয়াবহভাবে কেঁপে বাবার দিকে তাকালাম। তার চোখ রক্তলাল। বাবা কি তবে আমাকে ব্লাকমেইল করছে? রনিকে শাস্তি দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে সব কাজ হাসিল করবে? এখন আমি কি করবো?
বাবা আমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললেন,”ইউ হ্যাভ অনলি ফাইভ মিনিটস, জাস্ট ফাইভ।”
এই বলে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে উনি চলে গেলো। আমি ধপ করে বসে পড়লাম। আমাকে এখন কে বাঁচাবে? তবে কি মায়ের সাথে যা হয়েছে, আমার সাথেও তেমন কিছু হতে চলেছে? বাবা তার সন্তান, নিজের রক্ত তার সাথেও এমনটা করবেন?
হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে আমি একটু চমকে উঠি। সন্তর্পণে চোখ থেকে আসা দুই ফোঁটা পানি মুছে ফেলি।
“কি তেল দিবে চুলে? দিয়ে দিবো?”
আমি কোনো কথা বললাম না। আমি জানিনা এই মহিলা কে? কি তার উদ্দেশ্য। তবে এই মুহুর্তে আমার নিজেকে বাঁচানোর জন্য উনার কথা শুনতে হবে।
ভদ্রমহিলা আমাকে জবজবে করে চুলে তেল লাগিয়ে দিলেন। আজ অসহ্য রকম কষ্ট হচ্ছে। খুব বেশি মনে পড়ছে আমার মা কে। মা নিজের জীবনটা নষ্ট করে দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছেন এতোদিন। কিন্তু এখন? কীভাবে বাঁচবো আমি এই নরক থেকে?
তেল দেওয়া চুল শক্ত করে খোঁপা করে দিলেন উনি। সস্তা একটা সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় ওড়না দিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু সাহস হলো আমার। আমাকে দেখতে খুবই খারাপ লাগছে। তবে আমি জানিনা কাজ হবে কিনা এতে। কারণ হাশেম নামক লোকটা একটা নরকের কীট। আমার মা এসব অনেক চেষ্টাই করেছে তার হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু কখনো কি পেরেছে? শেষ পর্যন্ত মৃত্যুটাকেই তার বেছে নিতে হলো।
“কি ভাবছো নীরা?” আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন উনি।
“আমার আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানার আছে। আমার মনে হয় না আপনি কিছু না জেনেই এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছেন। কে জানিয়েছে আপনাকে? কে আপনি?”
ভদ্রমহিলা আবারও সেই রহস্যের হাসি হাসলো। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই হাসি দেখলাম।
হঠাৎ বাইরের ঘর থেকে বাবার চিৎকার করে ডাক শুনে ধাতস্থ হলাম। উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,”উত্তর আপনাকে দিতেই হবে, আজ হোক বা কাল।”
“আগে নিজেকে বাঁচাও নীরা। আমি জানি তুমি তোমার মায়ের মতো বোকা নও, তুমি বুদ্ধিমতী। কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হবে খুব ভালো করেই জানো তুমি।”
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উনি আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,”রনি বা তোমার দাদীকে নিয়ে ভয় পেয়ো না। তোমার বাবা কিচ্ছু করতে পারবেন না ওদের।”
আমার কি উচিত হবে উনাকে ভরসা করা? কিন্তু এই মুহুর্তে তা না করা ছাড়া আমার কি-ই বা করার আছে?
বসার ঘরের দরজার সামনে এসে দোয়া ইউনুস পড়ে বুকে ফুঁ দিলাম। আমার মা আমাকে বিপদে এই দোয়া পড়তে বলেছেন। আস্তে করে পর্দা সরিয়ে ভিতরে তাকালাম। অসভ্য হাশেম আর আমার বাবা দুইজন মুখোমুখি হয়ে ভীষণ হাসিঠাট্টায় মগ্ন। এই নরকের কীটটাকে আমি প্রায় চারমাস পর দেখলাম। এই অসভ্যটার জন্য আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। শেষ দেখা হয়েছিলো, মায়ের মৃত্যুর দিনে। বড্ড শোক পালন করছিলো।
“আহা রে, এতো ভালো একজন মানুষ, কীভাবে আত্মহত্যা করতে পারলো? ছোট দুইটা মাসুম বাচ্চাকে ফেলে। আল্লাহ তুমি উনাকে জান্নাত দান করো গো, জান্নাত দান করো।”
সেদিন আমার ইচ্ছা করছিলো উনার সমস্ত শরীরে আগুন লাগিয়ে দিতে। সেদিন থেকেই উনার বিশ্রী নজরে পড়লাম আমি। এতোদিন যে নজরে উনি আমার মা কে দেখেছে। এরপর থেকে শুরু হলো উনার ফোন কল, বাজে বাজে টেক্সট, অশালীন কথাবার্তা। বাবাকে বলায় কোনো লাভ হয়নি। অবশ্য হবে কীভাবে? বাবা-ই যে সব কিছুর রচয়িতা। আমি এই লোকের জন্য মোবাইল ব্যবহার করাই ছেড়ে দিয়েছি। আজ নিজেই বাড়ি এসে হাজির। তবে কি, মায়ের মতো আমারও সর্বনাশ করতে চান উনি?
“কি ব্যাপার নীরা? বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভিতরে এসো। কতোদিন তোমাকে দেখিনা। আজ মন ভরে দেখবো।”
অসভ্যটার অশালীন কথায় গা জ্বলে গেলো আমার। আমি স্পষ্ট টের পেলাম আমার ভিতরের নিয়ন্ত্রণহীন রাগটা হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে, কারণ এই লোকের ছায়ায় আমার মায়ের করুণ মুখটা দেখতে পাচ্ছি।
(চলবে….)