#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৬
সকালের কুয়াশা কেটে গিয়ে রোদ উঠেছে বেশ ঝাঁঝালো। বদ্ধ ঘরে তেমন গরম অনুভুত না হলেও বাইরে বেশ গরম আবহাওয়া। আরও বেলা গড়ালে হয়তো গরমটা আরও বেশী অনুভুত হবে। এই রোদ্রজ্জল ঝলমলে দিনেও ঘরটার মাঝে লাইট জ্বলছে। জানালা দরজা সব বন্ধ। ভেতর থেকে বিশেষ এক শুভ্র রঙের পর্দা দিয়ে আবৃত। যাতে বাইরে থেকে ভেতরে দেখা না যায়। ঘরটার আবহাওয়া ঠাণ্ডাই বলা চলে। ইলহাম খেয়াল করলো এই মোটামুটি ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও ইভান ঘামছে। বেশ অস্থির ভাবে শ্বাস পড়ছে তার। তাকে এমন বিচলিত হতে দেখে বলল
–না না। ঈশা আপাতত ঠিক আছে। এতো চিন্তার কিছু নেই। তবে…।
ইভান একটু সস্তি পেলেও ইলহামের কথার ধরন শুনেই বুঝে গেলো কিছু একটা সমস্যা আছেই। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমি বুঝতে পারছি ভাইয়া কোন সমস্যা আছে। তুমি আমাকে সবটা খুলে বল। কোন সমস্যা নেই।
ইলহাম মাথা নাড়ল। চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–ঈশার কেসটা খুব রেয়ার। আমি তোকে আগেই বলেছিলাম যে ট্রিটমেন্ট হওয়ার পর যে ঈশা পুরোপুরি সুস্থ হবে সেটার চান্স কিন্তু অনেক কম। মোটামুটি টুয়েন্টি পারসেন্ট ছিল। ঈশা সেই ক্যাল্কুলেশনের মধ্যে পড়ে যায়। আর কন্সিভ করে। কিন্তু মেইন প্রবলেম হবে এখন। ঈশার ট্রিটমেন্ট করার সময়ই আমি তোকে বলেছিলাম ওর হাই লেভেলের এনিমিয়া আছে। ঈশাকে প্রেগনেন্সি পিরিয়ডে ব্লাড দিতে হবে। তুই ডোনার রেডি রাখবি। আর তাছাড়াও ওর ইউট্রাস কন্সিভ করার জন্য রেডি হলেও সিস্ট কিন্তু পুরোপুরি ভাবে নির্মূল হয়নি। এর মাঝে প্রেগনেন্সি টা কিন্তু খুব রিস্কি। ওর ছোট ছোট বিষয়গুলো খুব ভালভাবে খেয়াল রাখতে হবে। খাবারের বিষয়টা বিশেষ করে গুরুত্ব দিতে হবে। টেনশন ফ্রি রাখতে হবে। কোনভাবে টেনশন করলে বা স্ট্রেচ নিলে কিন্তু অনেক ঝামেলা হবে। ঈশাকে সব সময় রিলাক্স রাখতে হবে। সেটা যে কোন ভাবেই হোক।
বলেই থামল। ইভান একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–কমপ্লিকেশন কি খুব বেশী?
ইলহাম স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–এখনো নয়। তবে হতেই পারে। ঈশাকে খুব ভালো করে নিজের খেয়াল রাখতে হবে। এই সময় অন্তত কোন রকম খাম খেয়ালি লাইফ রিস্ক হতে পারে। সহজভাবে বললে একটু অসচেতনতার কারনে মিস্ক্যারেজ হতে পারে। আর এরকম হলে ঈশার লাইফও রিস্কে পড়ে যাবে। খুব খারাপ কিছুও হতে পারে।
ইলহাম থেমে শ্বাস টেনে আবার বলল
–ঈশার বিষয়টা কোনভাবেই নরমাল প্রেগনেন্সি না। তাই আলাদাভাবে কেয়ার করতে হবে। খুব ছোট ছোট বিষয়ে অনেক কিছু মেনে চলতে হবে। সেটা না করলে খুব খারাপ কিছু হয়ে যাবে। এটা হতো না যদি প্রেগন্যান্ট হওয়ার আগে ঈশা ডক্টরের কন্সাল্টেশনে থাকতো। কিন্তু এখন তো আর কোন উপায় নেই। তাই ঈশাকে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে যাতে সে নিজের খেয়াল টা অন্তত ভালভাবে রাখতে পারে।
–ঈশাকে এসব কিছুই বলা যাবে না ভাইয়া।
ইভানের কথা শুনে ইলহাম স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। বলল
–ঈশাকে না বললে ওকে সুস্থ রাখা সম্ভব না। ঈশা জানবে তবেই তো নিজের খেয়াল রাখবে। না জানলে সে নরমাল প্রেগনেন্সি ভেবেই বিষয়টাকে গুরুত্ব দেবে না। তখন কি হবে বুঝতে পারছিস?
ইভান ভ্রু কুচকে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে গভীর ভাবে ভাবছে। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলল
–ঈশার খেয়াল আমার থেকে ভালো কেউ রাখতে পারবে না। ঈশা নিজেও না। আমিই ঈশার খেয়াল রাখবো। কিন্তু ওকে কিছুই জানাবো না। ঈশা যা জানবে পুরোটাই পজিটিভ। আমি ট্রিটমেন্টের ব্যাপারটাতেই ওকে কোন নেগেটিভ কিছু আন্দাজ করতে দেইনি। আর এখন তো কোনভাবেই দিব না।
ইলহাম ইভানের কথা শুনে বেশ বিরক্ত হল। বলল
–২৪ ঘণ্টা এভাবে তোর পক্ষে খেয়াল রাখা সম্ভব না। তোর অফিস আছে। দিনের বেলা সারাদিন তুই অফিসে থাকবি। সেই সময়টা তো অন্তত ঈশার উপরেই ছেড়ে দিতে হবে। তাছাড়া ঈশাকে সব কিছু জানালে সমস্যা কি সেটাই আমার মাথায় আসছে না।
ইভান বেশ শান্ত ভাবে বলল
–আমি ঈশাকে খুব ভালভাবে চিনি ভাইয়া। ওকে আমি কাল থেকে যতটা খুশী দেখেছি। ঠিক এভাবেই সব সময় দেখতে চেয়েছি। কিন্তু এতদিন ধরে আমি হাজার চেষ্টা করেও পারিনি ওকে খুশী রাখতে। এখন যদি এসব কথা ঈশা জানে। সে এসব নিয়ে টেনশন করবে। কোনভাবেই ভালো থাকতে পারবে না। আমি শুধু ওকে ভালো থাকতে দেখতে চাই। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। আর থাকলো ঈশার খেয়াল রাখার কথা সেটা আমার থেকে ভালো কেউ রাখতে পারবে না।
–কিন্তু ইভান…।
ইলহাম কে কথা শেষ করতে দিলো না ইভান। মৃদু হেসে বলল
–আমি সব ব্যবস্থা করে নিবো ভাইয়া। তুমি ভেবনা। আমি আছি তো। তুমি শুধু খেয়াল রেখো ঈশা যেন কোনভাবেই এসব না জানে। এমনকি ওর এনিমিয়ার কথাটাও নয়।
ইলহাম ইভানের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ভাবল। তারপর বলল
–যদি ব্লাড দিতে হয় তখন কি করবি?
ইভান মৃদু হেসে বলল
–সেই সব কিছু আমার উপরে ছেড়ে দাও। যখন যেরকম প্রয়োজন হবে আমি সেরকম ভাবেই সব কিছু গুছিয়ে নেবো। ঈশাকে ওর কমপ্লিকেশনের ব্যাপারে কিছুই জানতে দেবো না। তোমার কাছে আরেকটা অনুরধ। এই বিষয় টা তোমার আর আমার মধ্যেই থাকবে। অন্যকেউ কোনভাবে জেনে গেলে ঈশার কান পর্যন্ত চলে যাবে। আমি এটা কোনভাবেই চাই না ভাইয়া।
ইলহাম মাথা নাড়ল। ইভানের কথায় পূর্ণ সম্মতি দিলো সে। সে জানে না ইভান এই মুহূর্তে ঠিক কি ভাবছে। কিন্তু এটা জানে সে যে কোন ভাবেই ঈশাকে ভালো রাখবে। এটা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। ইভান নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল
–চলো। সবাই বাসায় বসে আছে।
ইলহাম বলল
–তুই যা আমি ঠিক সময় মতো চলে আসবো। আমার একটু কাজ আছে।
ইভান উঠে দাঁড়ালো। ইলহামের হাত টেনে ধরে বলল
–একদম না। তুমি আমার সাথেই যাবে। আর এখনই যাবে।
–প্লিজ ইভান। আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা কর।
ইলহামের কথা শুনল না ইভান। তাকে জোর করে টেনে নিয়ে বের হতে হতে বলল
–কাজ পরে করবে। আমি তোমাকে কোনদিন এভাবে জোর করিনি। কিন্তু আজ কোন কাজ করবে না। চলো আমার সাথে।
ইলহাম আর কথা বলতে পারল না। ইভানের সাথে বের হয়ে চলে গেলো।
————-
কুয়াশা ঘেরা সকাল। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। রুমের ভেতরে তেমন একটা ঠাণ্ডা না। ঈশা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ইভান এখনো ঘুমেই। কাল দিনভর আড্ডা দেয়ার কারনে রাতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে ঈশা। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। ইভান ঠিক কখন ঘুমিয়েছে সে জানে না। তাই আর ডাকল না। একটু ঘুমাক। অফিসের জন্য একটু পরে তো উঠতেই হবে। ঈশা ফ্রেশ হয়ে বাইরে গেলো। নাজমা রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছে। ইফতিও উঠে গেছে। সে সকাল সকাল টিভি তে খবর শুনছে বেশ মনোযোগ দিয়ে। ঈশা এসে সোফায় বসে বলল
–তুই কখন উঠেছিস?
ইফতি অলস ভঙ্গীতে বলল
–আর বল না। একটা ফোন এসেছিলো। সেই যে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো আর কোনভাবেই আসলো না। তাই আর কি করবো। উঠে টিভি দেখছি।
ঈশা হেসে ফেললো। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল
–আহা রে। কত কষ্ট তোর ইফতি। আমার খুব খারাপ লাগছে।
ইফতি ভ্রু কুচকে তাকাল। সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–ভাবী আপু তুমি কি কোনভাবে আমার সাথে মজা করছ?
ঈশা আবার হেসে ফেললো। বলল
–অসম্ভব! আমি কি সেটা করতে পারি?
ইফতি বুঝতে পারল ঈশা মজা নিচ্ছে। তাই অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল
–দেখো ভাবী আপু এটা কিন্তু মোটেই ঠিক হচ্ছে না।
ঈশা হাসতে হাসতে বলল
–চা খেয়েছিস?
ইফতি মাথা নাড়ল। সে খায়নি। ঈশা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল
–একটু দাঁড়া। আমি তোর ভাইয়াকে ডেকে আনি। অফিস আছে তো। এখনই উঠবে। তারপর একসাথে খাবো।
ইফতি মাথা নাড়ল। ঈশা ঘরে চলে গেলো। ইভান তখনও ঘুমাচ্ছে। আলতো করে মাথায় হাত রাখল। চুলের ভাজে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দিতেই ইভান চোখ খুলে ফেললো। কিছুক্ষন ঈশাকে দেখে নিয়ে বলল
–এতো তাড়াতাড়ি উঠেছ কেন?
ঈশা হাসল। তার হাসির আওয়াজে ইভানের মন ভরে গেলো। সেও মৃদু হাসল। ঈশা হাসি থামিয়ে বলল
–ঘুম ভেঙ্গে গেলে উঠবো না?
ইভান উঠে বসল। ঈশার কপালে পড়ে থাকা চূলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল
–ঘুম ভেঙ্গে গেলেই উঠতে হবে? শুয়ে থাকতে। বাইরে তো ঠাণ্ডা। এতো সকালে উঠলে ঠাণ্ডা লাগবে না?
ঈশা আবারো হাসল। বলল
–৮ টা বাজে। এখন অতটাও সকাল নেই। আর এই দেখো আমি শাল গায়ে দিয়েই বের হয়েছি। ঠাণ্ডা তেমন নেই।
ইভান মুচকি হাসল। ঈশা বলল
–এখন না উঠলে দেরি হয়ে যাবে। অফিসে যেতে হবে তো। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসো। ইফতি অপেক্ষা করছে। একসাথে খাবো।
কথা শেষ করেই ঈশা উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে পা বাড়াতেই ইভান ডাকল
–ঈশা।
ঈশা থেমে গেলো। পেছনে ঘুরে বলল
–কিছু বলবে?
ইভান একটু ভাবল। একটা শ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে বলল
–পরে বলবো। তুমি যাও। আমি আসছি।
ঈশা বের হয়ে চলে গেলো। ইভান ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ইফতি আর ঈশা খাবার খাচ্ছে। ইভান ঈশার পাশের চেয়ার টেনে বসল। ইফতি মুখে খাবার পুরে দিয়ে বলল
–ভাইয়া তুমি কখন অফিস যাবে? আমিও তোমার সাথে বাইরে যাবো।
ইভান খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বলল
–আমি অফিসে যাবো না।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কেন? যাবে না কেন? শরীর খারাপ নাকি তোমার?
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। বলল
–আমি রিজাইন দিয়েছি। চাকরি টা আর করবো না।
চলবে……
(রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)