শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২ লেখক-এ রহমান শেষ পর্ব

0
967

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
শেষ পর্ব

বাইরের শীতের দাপট এবার ঘরেও প্রবেশ করেছে। এক দমকা হাওয়া এসে গায়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো। হাওয়ার তোড়ে ইভান কিছুটা কেঁপে উঠলেও তার চেহারার কোন পরিবর্তন হল না। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে আছে। রাগটা মাত্রাতিরিক্ত। চোখে মুখে রক্তিম আভা। ঈশা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ইভানের বুকের কাছে টি শার্ট খামচে ধরে আছে। ঠাণ্ডা বাতাসে কেঁপে উঠছে থেমে থেমে। ইভান বিষয়টা খেয়াল করেই কোল থেকে নামিয়ে দিলো ঈশাকে। ঈশা সোজা হয়ে দাড়িয়ে নিজেকে ঠিক করে নিলো। একবার ইভানের দিকে তাকাতেই তার পিলে চমকে গেলো। রাগের মাত্রাটা আন্দাজ করেই তার সাথে এই মুহূর্তে কি কি হতে পারে সেসবও আন্দাজ করে ফেললো। ইভান ধমকে উঠে বলল
–কেন উঠেছ চেয়ারে?

ঈশা কেঁপে উঠলো। অনেকদিন এমন ধমক খায়নি। ইভানের এই রূপটার সাথে পরিচিত হলেও অনেকদিন পর্যন্ত এমন আচরন দেখতে না পেয়ে ভুলেই গিয়েছিল সে। শুকনো ঢোক গিলে বলল
–ঐ এলবাম টা নামাতে।

ইভান আবারো ধমকে উঠলো।
–এতো কি জরুরী জিনিস ছিল ওটাতে? আমাকে বলা যেতো না? আমি বলিনি কোন কাজে আমাকে ডাকবে?

ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল
–কথা না শোনাটা আজকাল তোমার অভ্যেস হয়ে গেছে। আমি তোমার জন্য যতটা সহজ হয়ে যাই তুমি আমাকে ততটাই খারাপ হতে বাধ্য করো। ছাড় দিয়েছি বলে সেটার সুযোগ নিবে সেটা হবে না। আজ থেকে আমার অনুমতি ছাড়া তুমি বিছানা থেকে এক পাও নামবে না। মাথায় রেখো কথাটা। নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।

ঈশা কিছুটা ভয় পেলো। কারন ইভান যা বলে তাই সে করে। আর সে বারবার একটা কথাই বলেছে যে কোন প্রয়োজন হলে যেন সে ইভান কে ডাকে। কিন্তু ঈশা নিজেই তার কথা মাথায় রাখেনি। ভাবা উচিৎ ছিল তার। মৃদু সরে বলল
–সরি।

ইভান এক ধমক দিয়ে বলল
–সরি বললেই কি সব মাফ হয়ে যায়? এখন যদি চেয়ার থেকে পড়ে যেতে তাহলে কি হতো? বল কি হতো?

ঈশা ভীত কণ্ঠে বলল
–পড়ে যেতাম না। তুমি পেছন থেকে ডাকলে তাই তো ভয় পেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম।

ঈশার কথা শুনে ইভান আরও রেগে গেলো। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টেনে এক ধমক দিয়ে বলল
–যাও বিছানায়।

ঈশা দাড়িয়েই থাকলো। ইভান বলল
–কথা শুনবে নাকি আমি শুনতে বাধ্য করবো? তোমার ভালো কথা শুনতে ভালো লাগে না তাই না?

ঈশা মুখ ভার করে বিছানায় গিয়ে বসল। অসস্তি হচ্ছে তার। এভাবে সারাদিন ঘর আর বিছানায় বসে থাকতে একদম ভালোলাগে না। এই কথাটা কাকেই বা বোঝাবে? কেউ তো তার কথা শুনতে চায়না। ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান সেটাকে গুরুত্ব না দিয়েই বাইরে চলে গেলো। ফিরে এলো খানিকবাদে হাতে থালা ভর্তি ফল নিয়ে। ঈশার সামনে রেখে বলল
–খেয়ে নাও।

ঈশা মুখ ফিরিয়ে নিলো। ইভানের ভীষণ রাগ হল। কিন্তু বুঝতে পারলো যে ঈশা এখন কথায় কথায় রাগ করে। মুড সুইং এর জন্য এটা হবেই। ইভানের এভাবে কথায় কথায় রেগে গেলে হবে না। হিতের বিপরিত হবে। তাই নিজের রাগটাকে একদম গিলে ফেলে সামনে বসল। ফল নিয়ে ঈশার মুখের সামনে ধরে বলল
–আমার উপরে রাগ করে এসব না খেলে বেবি তো দুর্বল হয়ে যাবে। তখন কি হবে? ওকে সুস্থ রাখার জন্য হলেও তো খেতে হবে তাই না?

ঈশা আর কথা বলতে পারলো না। মুখে নিয়ে নিলো। ইভান খুব যত্ন করে তাকে খাইয়ে দিলো। ঈশা ইভানের এতো যত্ন আর ভালবাসা দেখেই রাগ করে থাকতে পারলো না। মনটা গলে গেলো। একটা মানুষ কিভাবে এতো ভালবাসতে পারে? কথাটা ভাবতেই মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ইভান সেটা খেয়াল করেই বলল
–হাসছ কেন?

ঈশা উত্তর দিলো না। দুই হাতে ইভান কে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–ভালোবাসি তোমাকে।

ইভান হেসে ফেললো। ঈশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

————-
সময়ের বিবর্তনে পেরিয়ে গেছে কয়েক ঋতু। মেঘহীন আকাশে সূর্যটা তেজ নিয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। গাছের পাতা নাড়ান দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানিয়ে দিলেও কোনভাবেই সেই অস্তিত্ব অনুভব করার উপায় হচ্ছে না। তীব্র গরমে প্রকৃতি যেন ঝলসে যাচ্ছে। সাথে রাস্তায় চলমান মানুষগুলোও। ইভান একটা কাজে বেরিয়েছে। একটু পরেই বাসায় যাবে। কাজ শেষ করে রিক্সার উদ্দেশ্যে এদিক সেদিক ফিরতেই ফোন বেজে উঠলো। ইফতির ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল
–ভাইয়া তুমি কোথায়? ভাবি আপু…। ভাবি আপু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

ইভান কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। ফোনের ওপাশ থেকে ঈশার তীব্র চিৎকারের আওয়াজে ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। অস্থির হয়ে উঠল শ্বাস প্রশ্বাস। হাত মুঠ করে নিয়ে বলল
–কি হয়েছে ঈশার?

ইফতি কিছু বলতে গিয়েও কারো ডাকে থেমে গেলো। সেদিকেই আওয়াজ দিয়ে বলল
–আসছি।

তৎক্ষণাৎ ফোনটা কেটে দিলো। ইভান শব্দ শুনেই বুঝতে পারলো ফোন কেটে দিয়েছে। সে বাসায় যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে একটা রিক্সায় উঠে গেলো। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। একটা জরুরী কাজেই বের হয়েছিলো। অবশ্য বের হওয়ার সময় বাসায় সবাই ছিল। ঈশার মা ইফতি সবাইকে রেখে তারপর বের হয়েছিলো। তবুও কেমন জানি মনের মাঝে একটা অজানা ভয় কাজ করছে। শেষ সময়টা বেশ সাবধানে থাকতে বলেছিল ইলহাম। এই সময় ইভান কোথাও বের হলেই কাউকে না কাউকে ঈশার দায়িত্ব সোপেই তবে বের হয়। একা রাখে না। তবুও বাইরে থাকা সময়টাতে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। আজ কি তাহলে কোন অঘটন ঘটে গেলো? ভাবতেই আবারো ফোন বেজে উঠল। ইফতির নাম্বার দেখে ভেতরটা কেঁপে উঠল। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোনটা ধরে বলল
–ঈশা ঠিক আছে তো?

ইফতি অসহায়ের মত বলল
–নেই। হাসপাতালে এনেছি। তুমি এখানে আসো।

ইভানের মাথার উপরে আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এলোমেলো হয়ে গেলো সবকিছু। ঈশার কিছু হলে সে কিভাবে বাঁচবে। আর যদি বাচ্চার কিছু হয় তাহলে ঈশা আর কখনো স্বাভাবিক হতে পারবে না। আর ঈশাকে ঐ অবস্থায় দেখে ইভান কখনো ভালো থাকতে পারবে না। বেঁচে থেকেও মরে যাবে। ইফতি অস্থির হয়ে বলল
–ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসো।

ইভান চোখ বন্ধ করে বলল
–আসছি।

রাস্তায় জ্যামের কারনে হাসপাতালে পৌছাতে অনেক সময় লেগে গেলো ইভানের। এই সময়টুকু তে নিজের শ্বাস আটকে রেখেছিল সে। হাসপাতালের পৌঁছে সামনেই পেয়ে গেলো সবাইকে। ইরা এগিয়ে এসে বলল
–ভাইয়া এতো দেরি করলে কেন? আপুকে অটি তে নিয়ে গেছে।

ইভানের হাত পা অসাড় হয়ে গেলো। অস্থির হয়ে উঠল সে। সায়ান এগিয়ে এসে তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। পিঠে হাত রেখে বলল
–ভাবিস না ঠিক হয়ে যাবে।

ইভান কোন কথা বলল না। ফ্লোরে নিজের দৃষ্টি স্থির করলো। গভীর ভাবে শ্বাস টানছে সে। তার অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই কি চলছে তার মনে। প্রায় ১ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির পর একজন নার্স বের হয়ে এলো। ফুটফুটে একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে। এগিয়ে এসে হাসি মুখে বলল
–ছেলে হয়েছে।

সবাই বেশ খুশী হল। ঈশার মা হাত বাড়িয়ে বাচ্চা কোলে নিলেন। ইভানের সামনে এনে ধরলেন। কিন্তু ইভানের পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হল না। নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে সে। একবারও মুখ তুলে দেখল না বাচ্চাটাকে। সেদিকে তাকিয়েই নার্স কে গম্ভীর আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো
–ঈশা কেমন আছে?

নার্স কিছু বলার আগেই আরেকজন নার্স বেরিয়ে এলো। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল
–আরও এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। আপনাদের মধ্যে কেউ কি আছেন ওনার ডোনার?

ইরিনার স্বামী রাজিব এগিয়ে এলো। বলল
–আমার সাথে ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করে। আমি দিতে পারব।

নার্স সময় নষ্ট না করে তাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সবাই সেদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের ব্যস্ততা দেখে আন্দাজ করে নিলো ভেতরের অবস্থা খুব ভালো নয়। বাচ্চাটা কাঁদছে অস্থির হয়ে। ঈশার মা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে পড়লেন চেয়ারে। ইভানের পাশেই। ইভান শক্ত করে চেয়ারের হাতল ধরে আছে। তার মনে হচ্ছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ধিরে ধিরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খানিকবাদেই হয়তো সে আর ঠিকভাবে বসে থাকতে পারবে না। ওভাবেই কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত। ইলহাম বের হয়ে এলো। সামনে এসে দাঁড়াতেই ইভান চোখ বন্ধ করে ফেললো। কোন রকম খারাপ খবর শুনতে প্রস্তুত না সে। সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে খবর শুনতে। ইলহাম ইভানের মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল
–কিছুক্ষনের মধ্যেই ঈশাকে কেবিনে দেয়া হবে। তখনই দেখা করতে পারবি। সব ঠিক আছে।

ইভান চোখ খুলে ফেললো। কিন্তু কোন কথা বলল না। তার ভেতরটা অনুভুতিশুন্য হয়ে গেছে। এখন ঠিক কি মনে হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না। তবে ঈশাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। কিছুক্ষন পরেই ঈশাকে অটি থেকে বের করে আনা হল। কেবিনে দেয়ার পর সবার আগে ঈশার মা বাচ্চা নিয়ে গেলো ভেতরে। সেখান থেকে বের হয়ে এসে ইভানের মাথায় হাত রেখে হাসি মুখে বলল
–ইভান ভেতরে যা বাবা।

ইভান চোখ তুলে তাকাল। অসহায় দৃষ্টি তার। উঠে দাঁড়ালো। ধির পায়ে ভেতরে ঢুকল। ঈশার হাতে ক্যানুলা লাগানো। এক পাশে বাচ্চাটা শুয়ে আছে। ঈশা সেদিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইভান একটু এগিয়ে গেলো। পায়ের শব্দ পেয়ে ঈশা চোখ মেলে তাকাল। চোখে মুখে রুগ্নতার ছাপ। ইভানের বেশ কষ্ট হল। কিন্তু ঈশার প্রশস্ত হাসি দেখেই সব কষ্ট মিলিয়ে গেলো। এগিয়ে গিয়ে ঈশার দুই গালে হাত রেখে গভীর ভাবে চুমু খেলো কপালে। ঈশার চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ইভান এক আঙ্গুলে পানি মুছে দিলো। সে ঠিক বুঝতে পারছে না কি বলবে। কথা তার গলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। ঠিক সেই সময় বাচ্চাটা চিৎকার করে কেদে উঠল। ইভান বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো। তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশার মা ভেতরে ঢুকে ইভানের কোলে বাচ্চা দেখে হেসে ফেললেন। বললেন
–দেখতে একদম তোর মতো হয়েছে।

ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–মেজ মা আমি কি ছোটবেলায় দেখতে এমন ছিলাম?

সেই সময় ঘরে সবাই ঢুকল। ইভানের কথা শুনে হেসে ফেললো। ঈশাও খিলখিল করে হেসে উঠল। ইভান মুগ্ধ হয়ে ঈশার সেই হাসি দেখছে। এই হাসিটার জন্য ইভান এতো বছর অপেক্ষা করেছে। অনেক কিছু করেছে যা ঈশা নিজেও জানে না। জানলে হয়তো মেয়েটা আগেই এমন মন খুলে হাসত। অবশেষে এতো বছরের অপেক্ষা পূর্ণ হল তার। শত কষ্টের মাঝে অবশেষে সুখের দেখা মিলল। এ যেন পূর্ণতা পেলো শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর।

সমাপ্ত

(অবশেষে শেষ হয়ে গেলো গল্পটা। শেষটা আপনাদের কেমন লেগেছে জানি না। তবে আমি চেষ্টা করেছি আপনাদের ভালো লাগার মতো করতে। গল্পের নাম করণের সার্থকতা ঠিক কতটুকু করতে পেরেছি সেটা জানিনা। আমি আসলে শুভ্র রঙ শান্তির প্রতিক হিসেবে দেখাতে চেয়েছি। আর নীল বেদনার প্রতিক হিসেবে। এই দুটো মিলেই মূলত তাদের জীবনের গল্প শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর। সিজন ১ নিয়ে যাদের অভিযোগ ছিল। এই সিজনে সেটা দূর করার চেষ্টা করেছি। দুই সিজন মিলে কেমন লেগেছে সেটা অবশ্যই জানাবেন গঠন মূলক মন্তব্যের মাধ্যমে। এতদিন সাথে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here