#ফুপু_শ্বাশুড়ি
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
#পর্ব: ৭
সাকিকে পুলিশ আটক করার পর আহু আর নিশাদ থানায় গিয়েছিল, থানায় গিয়ে পুলিশকে বলল, দশ মিনিটের জন্য সাকিদের সাথে, ওদের দুজনকে জেলে ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু পুলিশ এমনটা কখনোই করবে না। রেশমী নিশাদ আর আহুকে অনেক ভাবে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠায়।
আজ যদি নিশুকে সবাই ফিরে পেয়ে থাকে তবে সেটা একমাত্র রেশমীর কারণে। রেশমী বহু বছর পুলিশ হিসাকে দেশ সেবায় নিয়োজিত থাকায় ও জানে কখন কী ব্যবস্থা নেয়া দরকার! সেদিন রেশমীর বুদ্ধির জোড়েই নিশুর খোঁজ করা সম্ভব হয়েছিল। নয়ত হয়ত নিশু নামের মেয়েটার সাথে খুব বাজে কিছু হয়ে যেতো।
!!১৩!!
নিশুর রুম থেকে বের হয়ে আহু চুপচাপ নিজের বাড়ি চলে গেলো। কারো সাথে কোন রকমের কথা বলল না। এমনকি যাবার পর দুদিন নিশুর সাথে কোন কথা বলল না।
নিশু আহুর বাবাকে ফোন দিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিলো। তিনি কারণ জানতে চাইলে নিশু কিছুই বলল না। নিশু বিয়ে ভেঙে দিয়েছে শুনেও আহু চুপ ছিলো। নিশুর বাড়ির লোক নিশুকে বুঝাচ্ছিল। কিন্তু নিশুর এক কথা ও কাউকে বিয়ে করবে না।
আজ সকালে নিশুর সাথে দেখা করতে অনু আসল। প্রথমে নিশাদের রুমে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখল, নিশাদ আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের জলন্ত সিগারেটটা নিজে নিজেই জ্বলতে জ্বলতে আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নিশাদের নিজের আঙুলের জ্বালা পোড়ায় কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। অনু নিশাদের হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে পাশে থাকা গ্লাসে নিশাদের আঙুলটা চুবিয়ে বলল,
_খেয়াল কোথায় তোমার? আঙুল যে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছো! জ্বলানী অনুভব হচ্ছে না নাকি!
_মনের জ্বলানীর কাছে এ জ্বলানি কিছু না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনু নিশাদের কাঁধে হাত দিয়ে বিছানায় বসালো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে অ্যান্টিবায়োটিক অয়েন্টমেন্ট নিশাদের আঙুলে লাগাতে লাগাতে বলল,
_হাত পোড়ালে বুঝি মন পোড়ানোর কষ্ট কমবে?
_যদি কমে!
_নিজেকে কষ্ট দিলে কখনো মনের কষ্ট কমে না।
_তবে কি করব অনু! আমার ছোট্ট বোনটাকে ওভাবে দেখে আমার কেমন লাগছে তা তোমাকে বোঝাতে পারব না।
অনু নিশাদের হাতদুটো ধরে বলল,
_নিশু তোমার একার না আমারও বোন।
নিশাদ বসা অবস্থায় অনুর কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বলল,
_আমি কিছু বুঝতে পারছি না অনু। আমার নিশুকে আমি এভাবে দেখতে পারছি না।
অনু নিশাদের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে নিশাদের মাথায় চুমো একে বলল,
_সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি চিন্তা করো না। আমাদের নিশু আবার আগের মত হয়ে যাবে।
বেশ কিছুক্ষন অনু এভাবে নিশাদকে জড়িয়ে রাখল। নিশাদ অনুকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায়ই বলল,
_অনু!
_হুম
_নিশু নিজের কোন কথা তোমার কাছে লুকায় না। আমি ভাই তাই হয়ত বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো আহুর সাথে ওর কী সমস্যা হয়েছে? এভাবে বিয়ে কেন ভাঙল!
_আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি টেনশন করো না। আল্লাহ ভরসা।
!!১৪!!
বেশ খানিক সময় অনু নিশুকে বুঝাল। ওসব ঘটনা ভুলে যেতে। এভাবে র্নিজীব না হয়ে আগের নিশু হয়ে যেতে। নিশু শুধু অনুর কথার প্রতিউত্তরে হু হা জবাব দিলো। অনু নিশুকে বিভিন্ন ভেঙে পড়া মানুষ যারা কিনা ঘুরে দাড়িয়েছে তাদের কথা শোনাচ্ছিল। আর বলছিল তারা যদি ঘুরে দাড়াতে পারে তবে নিশু কেন পারবে না। নিশু তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল,
_অনু আপু আমরা সবসময় অপরকে উপদেশ দি। তাদের বড় বড় মহান ব্যক্তিদের বানী শোনাই। বিভিন্ন মানুষ যারা কিনা ভেঙে পড়েও উঠে দাড়িয়েছে তাদের বানী শোনাই কিন্তু অনু আপু ওসব বানী বই পুস্তকে খাটে, বাস্তব জীবনে নয়! নয়ত ওসব বানী অপরকে শোনান খুব সহজ কিন্তু নিজের বেলায় প্রয়োগ করা খুব কঠিন। এখন তো আমার সেসব মেয়েদের কথা মনে করে হাসি পাচ্ছে যাদের কিনা একসময় আমি বড় বড় কথা বলে ঘুড়ে দাড়াতে বলতাম। তাদের অবস্থা দেখে তখন কষ্ট হতো কিন্তু তাদের ভিতরের ঝড় বোঝার মত সামার্থ্য আমার ছিলো না। শুধু আমি কেন পৃথিবীতে কেউই অন্যের মনের ঝড় বুঝতে পারে না, শুধু একটু বোঝার ভান করে মাত্র। আমার সাথে ঘটার পর আমি বুঝতে পারছি মেয়ে গুলোর মনের অবস্থা কী হয়েছিল! তুমি বুঝতে পারবে না অনু আপু।
_তারা কী তোর বলা মোটিভেশনাল কথা শুনে একটুও মোটিভেট হয়নি? একজনও কী ঘুরে দাড়ায়নি তাদের জীবনে!
_হ্যাঁ দাড়িয়েছে। প্রায় ৭০% শতাংশ দাড়িয়েছে।
_তাহলে!
_কিন্তু ৩০% শতাংশ দাড়াতে পারেনি। আর আমি বোধয় ঐ ৩০% শতাংশে পড়েছি।
নিশুর এমন কথা শুনে অনু একটু রাগ করে বলল,
_বাজে কথা বলিস না নিশু। এসব ন্যাকামি কথায় আমাদের নিশুকে মানায় না। আর তুই আহুকে কী বলছিস? তোর এখান থেকে যাবার পর থেকে ও কারো সাথে কথা বলেনি। ঘর থেকে বের হয়নি। কী হয়েছে তোদের মাঝে?
_ওকে সত্যিটা বলে দিয়েছি।
_কী সত্যি?
_এই যে আমার রেপ হয়নি তবে রেপের থেকে কম কিছু হয়নি।
_মানে?
_মানে রেপ বলতে তোমরা বোঝ ভার্জিনিটি চলে যাওয়া। হ্যাঁ আমি এখনও ভার্জিন। তবে মলেস্ট বা রেপ বলতে শুধু ভার্জিনিটি চলে যাওয়াকে বুঝায় না। অনেক কিছু বোঝায় আপু অনেক কিছু।
_মানে
_সাকি সেদিন আমার সারা শরীর স্পর্শ করেছে। নোংড়া নোংড়া কথা বলছে। আমার ঠোঁটে ওর নোংড়া ঠোঁট ছুঁয়েছে। বিশ্বাস করো আপু তারপর থেকে নিজের শরীরটাকে ঘৃণা লাগে। মনে হয় শরীরের যেখানে যেখানে ও স্পর্শ করেছে সেখানটা কেটে ফেলি। কিন্তু পারি না। মানসিক ভাবে ও প্রতি সেকেন্ড টর্চার করছে আমায়। ওর বিচ্ছিরি হাসি, নোংড়া কথা, অশ্লীল স্পর্শ সব প্রতি নিয়ত আমার মনে মাথায় ঘুরছে। আর প্রতি নিয়ত নিজেকে ধর্ষিতার মত লাগছে।
আমি আহুকে এটাই বলেছিলাম যে মেয়েকে তুমি চার বছরের অধিক সময় ভালোবেসেও, তার সাথে সম্পর্কে থেকেও তাকে ছুঁয়ে দিতে পারোনি সে মেয়ের সারা শরীরর একটা কুকুর ছুঁয়ে দিয়েছে! পারবে তুমি তেমন মেয়েকে নিয়ে সারা জীবন সংসার করতে! তার সাথে সারা জীবন কাটাতে গিয়ে এটাতো মনে হবে না তোমার আগে তাকে অন্য কেউ তাকে ছুঁয়েছে।
_তো আহু কী বলছে?
_কোন কথা বলেনি, কতক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেছে।
_কী?
_হ্যাঁ আপু। আপু বললাম না বড় বড় ডায়লগ দেয়া সোজা কিন্তু কাজে খাটানো সহজ নয়।
_তোর কী মনে হয় আহু তাদের দলে?
_নাহ্ আমার আহু তাদের দলে না। আমি জানি ও ফিরবে, কিন্তু আমি চাই না ও ফিরুক। পরিস্থিতি বর্তমানে আমাদের পক্ষে না।
_পরিস্থিতি মাই ফুট। এসব ফ্লিল্মি ডায়লগ মারা বন্ধ কর নিশু। আর আহুকে এক্ষুনি ফোন কর।
_সরি আপু সম্ভব নয়। আমি আহুর বাবাকে ফোন করে বলে দিয়েছি বিয়ে হবে না।
_তো! তুই বিয়ে ভাঙছিস অন্য কেউ তোর সাথে একমত না। সবাই চায় বিয়েটা হোক।
_বিয়ে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয় আপু! জীবনে আরো অনেক কিছু আছে।
_ঠিক আছে তবে করিস না বিয়ে। বিয়ে বাদ দিয়ে নিজের লক্ষ্যে এগো। তাও ঘর বন্দী হয়ে থাকিস না।
_আপু প্লিজ এসব কথা বলো না ভালো লাগছে না। তুমি যাও ভাইয়ার সাথে গল্প করো আমার ঘুম পাচ্ছে ঘুমাব।
অনু আর কোন কথা বলল না। চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে গেলো। অনু বের হওয়া মাত্রই নিশাদ অনুকে বলল,
_কী হলো, কিছু বলছে ও?
_হুম!
_কী?
_নিশাদ ওকে কিছুদিন সময় দেয়া দরকার। একটা ভয়ানক ঝড় গেছে মেয়েটার উপর। সেটা থেকে ওকে আগে নিজেকে গুছিয়ে উঠতে দাও। আগে নিজেকে বুঝতে দাও।
_কিন্তু অনু, এভাবে একা একা রুম বন্ধ থাকা কোন সলিওশন নয়।
_হুম তা জানি। তবে ওকে কোন মোটিভেশনাল বানী দিয়ে লাভ হবে না। কারণ নিজেই মোটিভেশন দেয়ার রানী।
_তবে কী করব?
_চলো নিশু স্টাইলে কিছু করি।
_মানে?
_নিশু বলে না, মানুষকে শিক্ষা হোক বা মোটিভেশন দুটোই তাকে দিয়ে দেয়ারত হয় যাকে সে ভয় পায়।
_নিশু কাকে ভয় পায়! উল্টো পুরো এলাকা, আত্মীয় স্বজন ওকে জমের মত ভয় পায়।
অনু হেসে বলল,
_নিশু একমাত্র রেশমী আন্টিকে ভয় পায়। দেখা যাক সে কী করতে পারে!
_সে কি রাজি হবে!
_আলবাৎ হবে।
!!১৫!!
রেশমী বসে আছে নিশুর ঠিক সামনে। একটা বড় পার্কের মাঠের মধ্যখানে মুখোমুখি বসে আছে দুজন। রেশমীর হাতে বড় একটা ডান্ডা। রেশমী ডান্ডাটা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
_অন ডিউটি থাকা কালীন বহু আসামীকে ডান্ড মেরে ঠান্ডা করেছি। আর তোমার মত পুচকে মেয়েকে পারব না! যে মেয়ে কিনা আমাকে ব্যাঙ, টিকটিকি, ইদুরের ভয় দেখিয়েছিল! ব্যাংকে বসে থার্ড, ফোর পেপার বুঝিয়েছে। তোমার নামে তো ইভটিজিং কেস করা দরকার। মেয়ে হয়ে মেয়েদের টিজ করো। কেন ছেলেরা কী দোষ করছে!
জানো তোমার বয়সে আমি কত ছেলেকে টিজ করেছি। নিশু চোখ বড় বড় করে রেশমীর দিকে তাকাল। রেশমী বলল, ওভাবে তাকিও না। সত্যি সত্যি ইজ করেছি। শুনবে কী কী করেছি?
নিশু মাথা কাত করে সম্মতি দিলো।
তিনি আয়েশ করে ঘাসের উপর বসে বলা শুরু করল,
_কলেজে যাবার পথে এলাকার ছেলেদের গায়ে বেলুনে পানি ভরে তা ছুড়ে মারতাম, সাইকেলের হাওয়া বের করে দিতাম, বেশি তেড়িবেড়ি করলে চাকাসহ খুলে নিয়ে আসতাম। একবার নদীর পাড়ে ঘুরতে গেলাম, দেখলাম আমাদের কলেজের কিছু ছেলে জামা কাপড় খুলে আধা ন্যাংটা হয়ে গোসল করছে। বাস ওদের কাপড় চুরি করে এনে পুরাতন কাপড়ের দোকারে তিন ভাগের এক ভাগ দামে বিক্রি করে দিয়েছিলাম।
নিশু রেশমীর কথা শুনে হা হা করে হেসে লুটিয়ে পড়ে বলল,
_আন্টি আপনি তো আমার থেকে বড় পাজি ছিলেন।
রেশমী বলল,
_জানো তোমার মধ্যে সবচেয়ে কোনগুনটা বেশি ভালো লাগে আমার!
_কী?
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।
চলবে______