#ফুপু_শ্বাশুড়ি
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
#পর্ব: ৮
_জানো নিশু তোমার কোন গুনটা আমার সব থেকে বেশি ভালো লাগে।
_কোনটা?
_তুমি নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখো। নিজ সত্ত্বায় স্থির থাকতে জানো তুমি। কিন্তু বর্তমানে তুমি নিজ সত্ত্বা হারাতে বসছো।
_আন্টি আমার এখন সব কিছু বিষাদময় লাগে।
_সামান্য একটা ঘটনায় এমন হলে? তাহলে আমার মত যন্ত্রনা পেলে কেমন করতে? তবে তো তুমি বৈরাগী বা বনবাসী হতে।
_আপনার মত যন্ত্রনা মানে? আন্টি আপনার সাথে কী আমার মত কোন ঘটনা ঘটেছিল?
_এমন নয়, তবে মানসিক প্রেশার তোমার মত ছিলো।
_আন্টি আমাকে বলা যাবে?
_এক শর্তে!
_কী?
_এ ঘটনা তুমি আমি ছাড়া তৃতীয় কেউ জানবে না। এমন কী আহুও না।
_ওকে ডান।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রেশমী বলল,
_জানো আমি বিয়ে কেন করিনি?
_হ্যাঁ দেশ সেবা করবেন বলে!
মৃদু হেসে রেশমী বলল,
_তেমন কিছু না। আমার সাথে বহু মহিলা আছে যারা সংসার সামলেও চাকরি করছে, দেশ সেবা করছে।
_তবে বিয়ে কেন করেননি!
_ছ্যাকা খেয়েছিলাম।
_কী?
_হ্যাঁ একজনকে ভালোবাসতাম তাকে পাইনি বলে বিয়ের কথা আর চিন্তা করিনি। কেন জানি মনে হতো তার স্থান অন্য কাউকে দেয়া সম্ভব নয়।
_কে সে?
_রিমনের বাবা।
_মানে আপনার বোনের স্বামী!
_হ্যাঁ।
_কিন্তু কিভাবে কী? পুরো ঘটনা বলুন না প্লিজ!
_হ্যাঁ বলছি। আমার বড় বোন রোজীনা আর আমি মাত্র বিশ মাসের ছোট বড় ছিলাম। একই সাথে একই ক্লাসে দুজন পড়তাম। বড় আপু ছিলো প্রচন্ড শান্ত মেয়ে আর আমাকে তো দেখোই কেমন। আমাদের দুজনকে মাইনুল স্যার মানে রিমনের বাবা বাসায় এসে পড়াতেন। তখনই আমি স্যারের প্রেমে পড়ে যাই। স্যারের বাবার সাথে আমার বাবার বন্ধুত্ব ভালো ছিলো। তারা দুজন মিলে বড় আপা আর স্যারের বিয়ে ঠিক করে ফেলে।
আমার তখন দম বন্ধ করা অবস্থা হয়েছিল। না পারছিলাম বাবাকে বলতে না স্যারকে। তাদের বিয়ে হবার দুদিন আগে অনেক সাহস করে স্যারকে নিজের মনের কথা বলছিলাম। স্যার শুনে কিছুক্ষন গম্ভীর থেকে বলেছিল, রেশমী তোমাদের দু-বোনকে আমি কখনো সে নজড়ে দেখিনি। তবুও বাবা যখন রোজিনার সাথে বিয়ে ঠিক করল তখন না করিনি। তুমি এখন না বলে আরো আগে বললে হয়ত তোমার বা আমার পরিবারকে কিছু বলা যেতো। যেটা এখন সম্ভব নয়। তুমি আমার চেয়েও ভালো কাউকে পাবে আশাকরি। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে। তোমাকে এ বিষয়ে বোঝানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
আমি অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। স্যারকে বলেছিলাম আমি জানি এখন কিছু হবার নয়। আমি শুধু চাই আপনি একবার আমায় ছুঁয়ে দিন। আপনার আগে যেনো আমায় কেউ স্পর্শ করতে না পারে! আপনার প্রথম স্পর্শ আমার স্বর্গীয় পাওয়া হবে।
স্যার আমার মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে বলেছিলেন বয়সটা আবেগের তাই আবেগী কথা বলছ। যখন আবেগটা কেটে যাবে তখন এই স্পর্শ অভিশাপ মনে হবে। যাও বাড়ি যাও।
আমি স্যারের কথা শুনিনি, ঝড়ের গতিতে স্যারকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদেছিলাম। স্বার্থপরের মত বলেছিলাম চলুন দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। যেখানে আমাদের কেউ জানবে না। স্যার সেদিন আমার মাথায় চুমো এঁকে বলেছিল, ছুঁয়ে দিলাম তোমায়। এর বেশি স্পর্শ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি আমার পরিবারের সম্মান নিয়ে খেলতে পারব না। স্যার সেদিন চলে গেলেন। আমি শুধু কেঁদেছিলাম। সত্যি সেদিন আবেগী হয়ে পড়েছিলা, নয়ত স্বার্থপরের মত নিজের বোনের ঘর ভাঙার কথা বলতে পারতাম না। লজ্জায় সেদিনের পর স্যারের সামনে সহজে যেতাম না। ভুল বসত তার সাথে দেখা হলেও কথা বলতাম না।
বড় আপু আর স্যারের সংসার সুখে চলছিল। বিয়ের দু’বছর পর আপু কনসিভ করে। আমি তখন সিভিল সার্ভিসের ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। বাসা থেকে বিয়ের কথা বললেও আমি না করে দিতাম। মনে মনে পণ করেছিলাম যে মন স্যার ছুঁয়েছে সে মনে অন্য কেউ কখনো স্থান পাবে না। আমার বয়স তখন আবেগের ছিলো কিন্তু সিদ্ধান্ত অটল ছিলো।
ট্রেনিং শেষে যেদিন বাড়ি ফিরছিলাম তখন পথে কিছু জটলা দেখে সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি স্যার একসিডেন্ট করে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। মন ঐ মুহূর্তে থেমে গিয়েছিল, কিন্তু মাথা ঠিকই কাজ করছিল। স্যারকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা বলল, বাঁচানো সম্ভব নয়। স্যার শেষ বারের মত আমাকে কিছু বলেছিলেন, স্যার খুব ধীরে ধীরে আমাকে বললেন, রেশমী আমার বিয়ের অনেক আগে থেকে তোমাকে ভালোবাসতাম কিন্তু কিছু ——– । বাকিটা স্যার বলতে পারলেন না। তবে স্যারের এতটুকো কথায় এটা বুঝেছিলাম সেদিন যখন স্যার আমার মাথায় চুমো খেয়েছিলেন সেদিন কেন তিনি কেঁদেছিলেন। তার কান্না করার কারণ জানতে পারলেও, আজও জানতে পারিনি কেন তিনি আমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও আপুকে বিয়ে করল। এই প্রশ্নটার অংকে বহু বছর যাবত মনের মধ্যে কষতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু প্রতিবার ব্যার্থ হয়েছি। এটা এমনই প্রশ্ন যার উত্তর আমি অন্য কারো কাছে জানতে চাইতে পারব না। প্রত্যেকের জীবনে কিছু কিছু উত্তরহীন প্রশ্ন থাকে! আমার জীবনের এ প্রশ্নের উত্তরটাও পাওয়া সম্ভব না। কারণ প্রশ্নটা যার সে তো নেই। আর প্রশ্নটাই এমন যা অন্য কারো কাছে আমি জিজ্ঞেস করতেও পারব না। তাই প্রশ্নটাকে প্রশ্ন হিসাবে রাখলাম এতগুলো বছর। কি মানসিক যন্ত্রনায় আর একাকিত্বে কাটিয়েছি তা কেবল আমি জানি। বন্ধুরা বলত বিয়ে করে নে।
কিন্তু আমি তো এমনি পণ করেছিলাম বিয়ে করব না! আর স্যার মৃত্যুর আগে যা বলল, তাতে বিয়ে করার প্রশ্নই উঠে না।
স্যারের মৃত্যুর শোক আপু নিতে পারল না। রিমন জন্মের সময় মৃত্যু হলো তার। ভেবেছিলাম কোন একদিন আপুকে স্যারের প্রশ্নটা করব। কিন্তু তা আর হলো না। আপু স্যার দুজনেই চলে গেলেন। আমার জন্য রেখে গেলেন প্রশ্ন! তবে তারা দুজনে আমাকে বেঁচে থাকার নতুন জ্যোতি দিয়ে গেলেন। আমার রিমনকে।
আমার পরিবার বিয়ের জন্য কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু রিমনের দিকে তাকালে মনে হত ও আপুর নয় আমার সন্তান। স্যার হয়ত কোন কারণে আমাকে বিয়ে করতে পারেন নি তবে ভালো তো বেসেছিলেন। আর তার ভালোবাসার একটা অংশ রিমন। আমার বেঁচে থাকার জন্য এতটুকোই যথেষ্ট।
বিয়ে না করলেও আমি আমার জীবনকে থামিয়ে রাখিনি। জীবনের সকল আনন্দ উপভোগ করেছি। হ্যাঁ একটু ভেঙে পড়েছিলাম তবে জীবনে উঠে দাড়িয়েছি। আবার হাসতে শিখেছি, ভালো থাকতে জানি আমি। জীবনটা কোন বস্তু নয় যে কেউ নাড়া না দিলে স্থির থাকবে। জীবনটা সাগরের ঢেউয়ের মত একটা ঢেউ ভাঙবে নতুন হাজারটা গড়বে। তেমনি কোন ব্যক্তি বা ঘটনার জন্য জীবন থেকে থাকতে পারে না।
জীবনকে সাগরের মত গড়ো যে বিশাল হবে, মহান হবে, নিজের মাঝে ঝড় তুফান জবে কিন্তু কিছুক্ষন পর শান্ত হবে। এবং সে সমুদ্রই থাকবে। সমুদ্রে ঝড় হবে বলে কী সে সমুদ্র থাকে না! হ্যাঁ খানিক ঝড়ে সমুদ্রে কিছুটা এলোমেলো হয় তবে কিছুক্ষন পর ঠিক শীতল হয়।
তোমার জীবনে একটা ঘটনায় তুমি থেমে গেছো অথচ তোমার ভালোবাসার মানুষগুলো তোমার কাছে। আর আমার জীবন সংগ্রামে ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলছি। পাশে হাত ধরে চলার মত তেমন কাউকে পাইনি। তবুও জীবনটাকে স্থির রাখিনি। আর তোমার নিজের মানুষটা তোমার পাশে আছে। তাছাড়া তোমার পরিবার সবাই তোমাকে সাপোর্ট করে। তবে তোমার কী ভয়! বলো?
_নিশু নিশ্চুপ।
_নিশু জীবনে অনেক মানুষই আসে যায় কিন্তু আহুর মত ভালোবেসে হাত ধরে রাখার মত সাহস সবাই করে না। তুমি জানো আমি প্রথমে তোমাদের বিয়ে ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম।
_কেন?
_প্রথম দিন তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম তুমিই সেই ব্যাংকের মেয়েটা। রাগ ছিলো তোমার উপর খুব।
_প্রথমদিন কী করে চিনলেন?
_তুমি বোরকা পরা ছিলে, মুখে নেকাব বাঁধা ছিলো কিন্তু তোমার ভ্রুর উপরের তিলটা ঠিকই দেখা যাচ্ছিল। তাই তো তোমাকে দেখেই চিনে ফেলছিলাম। বাড়ি গিয়ে আহুকে বললাম এ মেয়েকে বিয়ে করার কোন প্রয়োজন নেই। আহুই আমায় বলেছিল তোমাকে কয়েকদিন দেখে যেনো সিদ্ধান্ত নি। তোমার প্রতি ওর ভরসা অটল। তারপর তোমাকে দেখলাম জানলাম বুঝলাম। তাতে যা মানলাম তুমি ঠিক আমার অতীত। আমিও তোমার মত চঞ্চল ছিলাম। তোমার ভিতর যেনো নিজের ছায়াকে দেখলাম। যে হাসতে হাসাতে, ভাঙতে গড়তে ভালোবাসতে সব জানে। তবে হ্যাঁ তুমি যেমন পানির মত মিথ্যা বলো, আমি তেমন পারি না। হা হা।
_নিশু হাসল।
_তোমার যে অভ্যাস গুলোকে সবাই খারাপ ভাবে সেগুলোকে আহু ভালোবাসে। আর তুমি তাকে ছেড়ে দিচ্ছো! নিশু জীবনের পথে তোমার অভ্যাস গুলোকে খারাপ বলার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু সে অভ্যাসগুলোকে ভালোবেসে কেউ তোমাকে ভালোবাসতে চায় তার মানে সে সত্যি তোমাকে চায়। আর তুমি শুধু তাকেই ছেড়ে দিচ্ছো না, ছেড়ে দিচ্ছো নিজের জীবনটাকেও। নিশু জীবনটা খুব ছোট আর ছোট্ট জীবনের প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান। সামান্য একটা ঘটনায় জীবনটাকে থামিয়ে রাখা বোকামি কিনা বলো? তাও তোমার মত মেয়ের। তুমি তো অন্যের অনুপ্রেরণা। তুমি এমন ভেঙে পড়লে তোমার ভরসায় থাকা মানুষগুলোর কী হবে!
_তাহলে কী করব!
_রেশমী কিছুটা রাগ করে বলল, আমার মাথা করবে। গাঁধা যেনো কোথাকার। এতক্ষন কাকে কী বুঝালাম! সব ওয়েস্ট।
_ফুপু শ্বাশুড়ি আম্মা গাঁধা না গাঁধি হবে। আমি ফিমেইল।
_রেশমী একটু দুষ্টুমি করে বলল, কী প্রমাণ তুমি ফিমেইল!
_আপনার আহুর সাথে বিয়ে হবার এক বছরের মধ্যে আপনাকে পাক্কা দাদি বানিয়ে দিবো।
রেশমী হাসল। নিশু বলল,
_চলেন ট্রিট দিবেন আমাকে!
_আমি কেন ট্রিট দিবো ?
_বাহরে এতক্ষন আপনার বকবকানি শুনলাম তাই।
_ওরে পাজি মেয়ে একবার আমাদের বাসায় বৌ হয়ে আসো তখন বোঝাবো শ্বাশুড়ি কাকে বলে!
_আমিও বোঝাবো বৌ মা কাকে বলে শ্বাশুড়ি আম্মা। এমন অত্যাচার করব না যে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলবেন।
দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। নিশু বলল,
_আন্টি এই ডান্ডাটা কেন নিয়ে আসছেন!
_ভাবছিলাম আমার কথা না শুনলে তখন তোমাকে ডান্ডা মেরে বোঝাব। কিন্তু তুমি বুঝদার তাই ডান্ডার দরকার হয়নি!
_হি হি ডান্ডটা আমাকে ধার দিবেন!
_কেন?
_অনেকদিন কাউকে মারি না। বাড়ি ফেরার পথে কাউকে দু এক ঘা দিয়ে যাবো।
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।
চলবে______