এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ১৫
মিশু মনি
বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলো। ধানের মৌসুম পেরোলেই বিয়ে। এখনো রূপসার চাচার ধান ঘরে ওঠে নি। সে কারণেই বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করতে বিলম্ব হচ্ছে।
অনেক রাত পর্যন্ত মেহমানদের সাথে গল্প, আড্ডা চললো। রূপসা তার ঘর থেকে বের হয় নি। ঘর হতেই মাঝেমাঝে সাহিলের গলা শোনা গেলো। তার গল্প শুনে মুরুব্বীরা হাসছেন। রূপসা শুয়ে আছে একদম নির্লিপ্ত হয়ে। মনটা খারাপ নাকি ভালো বুঝতে পারছে না। উদাস লাগছে। প্রতিদিন এই সময়ে শুয়ে কল্পনা করাটাই ছিল ওর একমাত্র কাজ। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। আজকে সেই কল্পনার রঙিন রাজ্য থেকে বেরিয়ে বাস্তবে এসে সবকিছু খুব পানসে ও কঠিন বলে বোধ হচ্ছে। যেন পৃথিবী, এই যে সবুজ গাছ, তারা ভরা আকাশ সবকিছুই বড় নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। অথচ গতকালকেও সব রঙিন, সুমধুর ছিলো। কিংবা সবকিছু আগে থেকেই এমন নিষ্ঠুর ছিল, রূপসার চোখে ছিল কল্পনার রঙিন চশমা।
মা এসে বললেন, ‘সাহিল বারান্দায় বসি রইছে। তোর সাথে কথা বলতি চায়। মাথায় ওড়না দিয়া যা।’
রূপসা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মা কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘আড়ালে ডাকলে যাবি না। গায়ে হাত দিতে চাইলে মানা করবি। বলবি এইসব বিয়ার আগে চলবে না।’
রূপসা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। বাকরুদ্ধ হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা মানুষের চিন্তা ভাবনা কি করে এতটা নোংরা হতে পারে ওর জানা নেই। ওর দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ চিন্তার মানুষ এই মানুষটা। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে…
মা বললেন, ‘শকুনের মত তাকায়া আছিস ক্যান? শোন। পুরুষ মানুষের বিশ্বাস নাই বুঝলি?’
– ‘যার প্রতি বিশ্বাস নাই তার সাথে মেয়ে বিয়া দিতেছো ক্যান?’
– ‘বাপ ছাড়া আর কাউরে বিশ্বাস করা যায় না রে মা। জীবনের তো কিছুই দেখলি না। বুঝবি কি করে?’
– ‘মা, এসব বাজে চিন্তা কেন করো? যে মানুষটা আজকে এসেছে, আজকে বিয়ের কথা হয়েছে, সে কেন এমন নোংরা কাজ করবে। এত বড় দুঃসাহস কোনোদিনও হবে না। তুমি এইসব খারাপ চিন্তা আর কক্ষনো আনবা না।’
মা রেগে বললেন, ‘আমি খারাপ চিন্তা করি?’
– ‘হ করো। জানো আমি তোমার এসব সহ্য করতে পারি না। কোনোদিনও বলি নাই। আজকে বললাম। বিয়ার পর আর কোনোদিনও এই গ্রামে আসবো না। মরলেও না।’
মা অনেক্ষণ রূপসার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। চেহারায় কি রাগ ফুটে উঠেছে। অথচ কখনো মায়ের মুখের উপর কিছু বলার সাহস হয় নি। বিয়ে পাকা হয়ে গেছে তো, এখন পরের ঘরটাকেই বেশি আপন মনে হচ্ছে।
রূপসা বলল, ‘মানুষটা অনেক ভালো। কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়। তাকে নিয়া উল্টা পাল্টা ভাববা না।’
মা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দুনিয়ার সব মানুষ ই বাইরে ভালো রে মা। ভিতরটা না দেখলে বুঝন যায় না।’
রূপসা এবার কোনো উত্তর দিলো না। মা রূপসার পাশে বিছানায় এসে বসলেন। রূপসার হাত ধরে বললেন, ‘তোরে একটা কথা কই। খারাপ মনে করিস না। আমার বিয়ার আলাপ হওনের পর একদিন রাইতে তোর বাপ দরজা কেমনে জানি খুইলা আমার ঘরে ঢুকছে। আমি আছিলাম খুব ভীতু। ভয়ে জড়োসড়ো হই গেছিলাম। সে আমারে মিষ্টি কইরা বললো, তোমারে দেখতে আসছি। কিন্তু আচার আচরণে অন্য কিছু করতে চাইতেছিল। আমি চিল্লানী দিয়া বাড়ির সবার ঘুম ভাঙাই দিছি। বলছি, এই লোক যেন আর কোনোদিনও এইখানে না আসে। কিন্তু আমার আব্বা আমার কথা শুনলো না। লোক জানাজানি হইলে মান সম্মান শেষ হই যাবে এইসব বইলা তোর দাদাকে ডাইকা নিয়া তোর বাপের সাথে আমার বিয়া পড়াই দিলো। আমি এত কাঁনছি, মন চাইছিল বিষ খাইয়া মইরা যাই। এই লোকরে কিছুতেই বিয়া করতাম না। বাপের পাও ধরছি। মেয়া মানুষ তো, কান্দনের কোনো দাম নাই। বিয়া হইয়া গেলো।’
শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করতে গিয়ে মায়ের চেহারায় একটা করুণ রূপ ফুটে উঠলো। রূপসার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জীবনের সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে বসে থাকা কারো সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনলে সব কেমন স্থবির হয়ে যায়। সহজে গ্রহণ করা যায় না। নিজের কানকেই অবিশ্বাস্য লাগছে ওর। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলেন। বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘দুনিয়াটা বড়ই পাষাণ রে মা।’ রূপসার হৃদয়টা ভেঙে গেছে। ভগ্নহৃদয় নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
সাহিল বসতে বললে সামনের চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে রইলো রূপসা। সাহিল বললো, ‘আমি জানিনা কে কি ভাবছে। গ্রামের লোকজন তো। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তোমাকে ডাকলাম। আমার মন বলছিল তুমি ঘরে মন খারাপ করে বসে আছো। তাই কথা বলতে চাইলাম। আশাকরি তোমার মনটা ভালো হয়ে যাবে।’
রূপসা অনেক্ষণ চুপ থাকার পর উত্তর দিলো, ‘আপনি কি ভালো মানুষ?’
আচমকা এরকম প্রশ্নে হকচকিয়ে গেছে সাহিল। তারপর হেসে বললো, ‘কি মনে হয় তোমার?’
– ‘আমার কি মনেহয় তা দিয়া তো আপনার কাজ নাই। আপনি কেমন মানুষ সেটা আপনি সবার থেকে ভালো জানবেন।’
সাহিল বলল, ‘আমি মানুষটা ভালো কি না জানিনা। ভালো মানুষ হওয়াটা দুনিয়ার কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি। তবে আমি মানুষটা খারাপ না।’
রূপসার মনে হলো সে তার উত্তর পেয়ে গেছে। এখন কিছুটা হালকা বোধ করলো। সহজ গলায় বলল, ‘শুনে খুশি হলাম। আপনি বই পড়তে পছন্দ করেন?’
এবার অবাক হয়েছে সাহিল। যতদুর জানে এই বাড়িটা অতি রক্ষণশীল পরিবারের অন্যতম। সেখানকার একটি মেয়ের মুখে এমন প্রশ্ন সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। ও বলল, ‘হ্যাঁ করি। আগে প্রচুর বই পড়তাম। নতুন চাকরি নেবার পর থেকে আর সময় হয়ে ওঠে না।’
– ‘কার বই বেশি পড়েন?’
সাহিল এবারও অবাক হলো। বলল, ‘যখন যা পাই।’
– ‘সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম পড়েছেন?’
– ‘না পড়ি নি।’
– ‘সোনালী দুঃখ পড়েছেন?’
– ‘না এটাও পড়িনি।’
– ‘মেমসাহেব?’
– ‘হ্যাঁ এটা পড়েছি।’
– ‘সাতকাহন পড়েছেন?’
সাহিল হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। তুমি তো অনেক বই পড়ে ফেলেছো দেখছি।’
– ‘হুম। আমার একটা স্বপ্ন আছে। কি জানেন?’
– ‘কি?’
– ‘আমার বিয়ের পর আমি যে ঘরে থাকবো, ওই ঘরে একটা লাইব্রেরি দেবো। সংসারের কাজ করতে তো বড়জোর তিন/ চার ঘন্টা লাগে। বাকি সময়টা খালি বই পড়বো।’
সাহিল মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘বাহ! কি চমৎকার স্বপ্ন তোমার! আমি ইমপ্রেসড। বাড়িতে লাইব্রেরি করো নি কেন?’
– ‘সেটা অন্য সময় বলবো। এখন বলা যাবে না।’
– ‘আচ্ছা ঠিকাছে। কার বই বেশি পড়ো?’
রূপসা বলল, ‘জাফর ইকবালের অনেক বই পড়ছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সারাজীবন স্কুলের লাইব্রেরির বই ছাড়া আর খুব একটা বই পড়া হয় নাই। যে দু চারটা নাম বললাম এগুলা বান্ধবীদের থেকে চুরি করে নিয়েছিলাম। স্কুলের লাইব্রেরির চেয়ে বাইরের বইয়ে বেশি মজা। কিন্তু সুযোগ পাই নাই।’
– ‘তবুও অনেক পড়ে ফেলেছো। চিন্তা কোরো না। সে সুযোগ ইনশাআল্লাহ আমি করে দেবো।’
রূপসা খুশি হলো কি না বোঝা গেলো না। বললো, ‘আপনি তো অনেক ভালো। আমি তো ভাবছিলাম শহরের মানুষরা বুঝি ভালো হয় না।’
– ‘এটা ভুল ধারণা। তবে এটা সত্যি যে শহরের বেশিরভাগ মানুষ অন্যকে দাম দিতে চায় না। এটা সমস্যার কিছু না। যে তোমাকে গুরুত্ব দেবে না, তুমি তাকে এড়িয়ে চলবে ব্যস।’
– ‘সুন্দর কথা বলেছেন তো।’
– ‘আমি নিজেও এটা বিশ্বাস করি। পৃথিবীতে অনেকেই আছে যারা আমাকে গুরুত্ব দেবে। আমি তাদেরকে নিয়ে চলবো। যে আমাকে দাম দেয় না, আমার কিসের ঠেকা পড়েছে তাকে নিয়েই পড়ে থাকবার?’
রূপসার মনটা হঠাৎ করে খুব ভালো হয়ে গেলো। ও মুগ্ধতা নিয়ে বললো, ‘আসলেই। কথাটা অনেক চমৎকার। কোথাকার কোন এক মানুষ, বড়লোক, হ্যান্ডসাম, ছবি তোলে। আমার দিকে একটু তাকাইলো, আর আমি ভাবলাম সে আমাকে ভালোবাসে।’
– ‘হা হা হা। এসব ছোটখাটো ভুল হতেই পারে। আমার মনে হচ্ছে কি জানো? সে তোমার জন্য নয়। কিংবা তুমি তার জন্য নও।’
– ‘মানে!’
সাহিল বলল, ‘যে অনেক হ্যান্ডসাম, বড়লোক, ইত্যাদি ইত্যাদি। সে তার মত একটা মেয়েকেই পছন্দ করবে। পিছিয়ে পড়া মফস্বলের একটা মেয়েকে দেখে ধুম করে পাগল হয়ে যাবে না। হলেও সেটা নিশ্চয় সাময়িক মোহ। মানুষের উচিত তার নিজের সমান কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা। বেশি বড় কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আবার ছোট কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলে প্রকৃতি তার হতে দেবে না। আমাদের উচিৎ নিজেদের মত কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা। তাহলে দুঃখ পেতে হয় না।’
রূপসা মুগ্ধ হয়ে সাহিলের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ইচ্ছে করছে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে। এত সুন্দর করে এর আগে কেউ ওকে বলে নি। মানুষটা জ্ঞানী, ভালো। সম্মান করতে ইচ্ছে করছে। ও বলল, ‘আমার মন ভালো হয়ে গেছে।’
– ‘আচ্ছা। তাহলে ঘরে যাও।’
রূপসা উঠে দাঁড়ালো। তারপর কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো, ‘আপনার সাথে আমার বিয়ে হলে বিয়ের রাতে এই কথাটার জন্য আমি আপনার পায়ের কাছে বসে সেবা করবো।’
কথাটা বলেই রূপসা ঘরে চলে গেলো। সাহিল বসে রইলো অবাক হয়ে। রূপসাকে বাইরে থেকে যতটা সংসারী মেয়ে মনেহয়, ভেতরে ততটাই আলোয় ভরা। জ্ঞানার্জনের অসীম ক্ষুধা আছে ওর। এটা সত্যিই সাহিলের প্রত্যাশার বাইরে ছিল। সারপ্রাইজ বলা যায়। সাহিল মুচকি হাসলো।
চলবে..