#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড
পর্ব:5
মাথার উপরে ঘটঘট আওয়াজ করে ফ্যান চলছে।চারদিকে কড়া ফিনাইল টাইপ ওষুধের গন্ধ। বাইরে লোকজনের চিৎকার চেচামেচিতে কান ভারি হয়ে উঠেছে। অধরা পিটপিট করে চোখ খুঁলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলো। পাশে একজন নার্স বসে আছে। মস্তিষ্কে সকালবেলার ঘটনাটা ঘুরছে। অজ্ঞান হওয়ার আগে ও স্পষ্ট জুবায়েরকে দেখেছিল। ঠিক আগের মতোই আছে। অধরা দ্রুত উঠে বসলো। মাথা ভার হয়ে আছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অধরা সেসব নিয়ে ভাবছে না। পাশের টেবিলের উপরে ওর ব্যাগ আর ফোনটা রাখা আছে। অধরা উঠতেই পাশ থেকে নার্সটা দ্রুত ওকে আটকে দিয়ে বলল,
> আপনি উঠছেন কেনো? আঘাত বেশ গুরুতর। ঠিক হতে টাইম লাগবে। তাছাড়া আপনার বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে এখুনি চলে আসবে।
মেয়েটা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা উত্তেজিত হয়ে বলল,
> আমাকে এখানে কে এনেছে আপনি কিছু জানেন? সেই ভদ্রলোক কি চলে গেছে?
এতদিন পর দেখা হলো অথচ লোকটা ওকে চিনতে পারলো না। অধরার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অভিমান হচ্ছে। মাথামোটা সুলতান জুবায়ের ফারুকী শুধু হম্বিতম্বি করতে জানে। কাছে পেয়েও বউকে চিনতে পারলো না। আধর ঠিক বুঝেছে জুবায়ের ওকে ভূলে গেছে। অধরা চোখের পানি মুছে নিয়ে মেয়েটার দিকে জিঞ্জাসু চোখে তাঁকিয়ে আছে। এর মধ্যেই একজন ডাক্তার কক্ষে প্রবেশ করলো। অধরার কিছু বলার আগে ডাক্তার বলল,
> আপনাকে যিনি নিয়ে এসেছিলেন উনার মেয়ে আজ জার্মান থেকে ফিরছে। তাই উনি চলে গেছেন। যাওয়ার আগে বলে গেছেন সুযোগ পেলে আপনাকে দেখতে আসবেন।
ডাক্তারের কথা শুনে অধরার মাথায় কাজ করছে না। জুবায়ের ওকে ফেলে আবারও বিয়ে করেছে।
একটা মেয়েও আছে কিভাবে সম্ভব? সুলতান বংশের ছেলেদের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কোনো বাঁধা নিষেধ ছিল বলে ওর মনে পড়ছে না। হতে পারে জুবায়েরের ড্যাড ওকে আবারও ভুলভাল কিছু খাওয়ানোর পরে সব ভুলিয়ে দিয়ে আবার বিয়ে দিয়েছে কিন্তু সুলতানরা তো কহিনুরের মূল্য বোঝে তাহলে সেটা ভূলে ওরা কিভাবে নিজেদের মতো চলছে? অধরার মনে নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো। অধরা আর ভাবতে পারছে না। জুবায়ের ওর জীবনে ফিরে আসুক বা না আসুক সেটা ওকে ভাবাচ্ছে না। কহিনুরকে বাঁচাতে হলে নিজেকে গোপন রাখা খুব জরুরি। অধরা বেড থেকে নেমে বলল,
> আমার বাচ্চাটা বাড়িতে একা আছে। ওর কাছে পৌঁছনোর দরকার। দয়াকরে অনুমতি দিন। সামান্য লেগেছে আমি ঠিক আছি।
ডাক্তার ছেলেটা ভ্রু কুচকে বলল,
> কিন্তু আপনার বিশ্রামের দরকার ছিল। কপালে তিনটা সেলাই নিয়ে বাড়িতে যাওয়া কি ঠিক হবে?
অধরা চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রস্তুত করে একদমে বলল,
> আমার যাওয়াটা খুব জরুরি। বাচ্চাটা কথা বলতে পারে না। কিছু দরকার হলে বলতেও পারবে না। আশাকরি বুঝবেন।
অধরার কথা শুনে ডাক্তার কিছু বলতে পারলো না। তবে দারোয়ানকে বলে দিলেন ওকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে।মেয়েটাকে যেই ভদ্রলোক ভর্তি করিয়েছেন তিনি অনেক রিকুয়েস্ট কযেছিলেন ওর খেয়াল রাখতে। তাছাড়া চৌধুরী সাহেবকে ফোন করা হয়েছে। উনি আসছি বলেও লেটা করছে। কথাগুলো ভেবে উনি দির্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
_______________
ডাইনিং রুমের সোফায় মাথায় হাত রেখে বসে আছে অধরা। বাড়ির মেহমানরা কেউ বাড়িতে নেই।ওরা সকাল সকাল রিসোর্ট পরিদর্শনে বেরিয়েছে। চৌধুরী সাহেব হাসপাতালে গেট থেকে অধরাকে নিয়ে এসেছে। ওর সঙ্গে কি কি হয়েছে সবটা বলে দিয়েছে। ডালিয়া হক অধরার কথা শুনে রেগে আগুন। জুবায়ের ফারুকীর মেয়ে আছে শুনে উনি জ্বলে উঠে বললেন,
> আমি যা বলেছিলাম ঠিক মিলে গেলো। শোন ছেলেদের আমি খুব ভালো করে জানি। বউ মরলে ওরা ভাগ্যবানের খাতায় নাম লিখিয়ে আবার বিয়ে করে। প্রয়োজনের কাছে ভালোবাসা হার মেনে যায় তখন। আর তুই এতো দূরে আসার পরেও তোর বর অপেক্ষা করবে ভাবতে পারছিস কি অবাস্তব বিষয়?
অধরার এখন বিরক্ত লাগছে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলে ফেলেছে এখন আফসোস হচ্ছে। তাছাড়া জুবায়ের এমন কিছু করবে না ওর বিশ্বাস আছে। ও ডালিয়া হকের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
>আন্টি সেসব ছাড়ো। আত্মীয় এসেছে অথচ দুপুরের রান্না হয়নি ওরা খাবে কী? রান্নার বন্দবস্ত করো।
ডালিয়া হক মুখটা গম্ভীর করে বলল,
> কথা এড়াতে চাইছিস ভালো কথা। তবে শুন পাত্র আমার বোনের ছেলে। ভীষন ভালো দেখতে। প্রথম জীবনে এক মেয়ের থেকে ধোকা খেয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিল এখন প্রচুর টাকা পয়সা আছে কিন্তু বিয়ে করেনি। ও গতবার এসে তোকে পছন্দ করেছিল। মেয়ে নিয়ে ওর সমস্যা নেই। মা আমার, রাজি হয়ে যা। এমন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিস না।
ডালিয়া হক উত্তরের আশা না করে কথাগুলো বলে চলে গেলেন। অধরা বুঝতে পারলো এতদিন ধরে ওকে বিয়ের কথা বলে এমন বিরক্ত করার কারণ কি? ওর আর এই বিষয়ে ঝামেলা করতে মন চাইছে না।কাজের মেয়ের সাহায্যে কক্ষে গেলো। কহিনুর পাশের কক্ষে বই পড়ছে। দরজা থেকে অধরা উঁকি দিয়ে দেখেছে। অধরা ভেবে নিয়েছে আজ থেকে ও ঘর বন্ধি থাকবে। আর কহিনুরকেও তাই করবে। মেয়েটা ওর একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন।
*********
সমুদ্রের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আদি। গতকাল রাতে বাংলাদেশের এসেছে বাবা মায়ের বিশেষ অনুরোধে। কিন্তু এখানে ওর মন টিকছে না। বারবার ঐশ্বর্যের কথা মনে পড়ছে। মেয়েটাকে ও বড্ড বেশি ভালোবাসে। তাছাড়া এমন রূপ আর প্রতিপত্তি থাকলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া বেশ কঠিন।কি নেই মেয়েটার? সব আছে। বাবার প্রিয় রাজকন্যা। আদির সঙ্গে মেয়েটার পরিচয় ইউনিভার্সিটি থেকে। প্রথম দেখাই ভালো লাগা তারপর কয়েক মাস ঘুরে মেয়ের মন জয় করে সম্পর্ক তৈরী করা। আদি কথাগুলো ভেবে পেছনে ফিরলো। ভাইবোনেরা সব হাসাহাসির করে লুটপাট হচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে সবাই মিলে মিষ্টিকে খেপাচ্ছে। আদি বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল,
> সবাই মিলে বাচ্চা মেয়েটাকে বিরক্ত কেনো করছিস? এখুনি গাড়িতে বস সবাই। বাড়িতে ফিরবো।
আদির ধমক শুনে আরও এক দফা হাসির রোল পড়লো। মিষ্টি ঠোঁট উল্টে ছলছল চোখে বলল,
> ভাইয়া আমাকে বাচ্চা কেনো বললে? ভালো করতে গিয়ে দিলে তো খারাপ করে। ওরা এখন আমাকে বাচ্চা বলে ডাকবে। তোমরা কেউ ভালো না। আমি এখনে থাকবোনা। আমাকে শুধু কহিনুর ভালবাসে। আমি ওর কাছেই যাচ্ছি।
মিষ্টি রাগ করে হাটা ধরলো। সকলে ছুটলো এবার মিষ্টির রাগ ভাঙাতে। আদি বিরক্ত হলো ভাইবোনদের এমন আজব বিহেবিয়ার দেখে। সবগুলো এক।কথাট ভেবে ও বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
হঠাৎ ফিসফিস করে সন্ধ্যা থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সারাদিন ঘুরাঘুরির জন্য সকলে ক্লান্ত ছিল তাই দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছে। অধরার জ্বর এসেছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমে বিভোর। আদি বেলকনিতে বসে আছে চেয়ারে হেলান দিয়ে।হঠাৎ বাগানের দিকে ওর নজর গেলো। ঘোমটা টেনে একজন মহিলা চুপচাপ বাড়িতে প্রবেশ করছে। পেছনের গেট দিয়ে হয়তো প্রবেশ করেছে। বজ্রপাত হচ্ছে মাঝেমাঝে। চোর ভেবে আদি দ্রুত বেরিয়ে আসলো।ও আগে থেকে ডাইনিং রুমে গিয়ে চোরের জন্য অপেক্ষা করবে ভাবলো।হাতে নাতে ধরে পুলিশে দিবে চোরকে। ও ভাবনা অনুযায়ী অনেক সময় বাইরে অপেক্ষা করেও যখন কেউ আসলো না তখন নিরাশ হয়ে উপরে আসলো। কিন্তু সিঁড়ির শেষে পা রাখতেই কারো সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলো। কারেন্টে নেই। ডাইনিং রুমের আবছা আলোতে সব আবছা লাগছে। আদি দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে। পা পিছলে পড়ে গিয়ে কোমরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। কার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে তাকে বকার জন্য পকেট থেকে ফোন বের করে টর্চ অন করেই চমকে গেলো। কহিনুর পানির পট হাতে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদি বুঝতেই পারছেনা এই বাড়িতে এই অপরূপা মেয়েটা কি করছে? অদম্য কৌতূহলে ও যন্ত্রণা প্রায় ভেলে গেলো। মেয়েটার পা থেকে মাথা অবধি সৌন্দর্য খেলা করছে। কহিনুর ওকে চমকে দিয়ে পেছন ফিরে দৌড়ে চলে গেলো। মেয়েটা হয়তো পানি নিতে এসেছিল। আদির এবার রাগ হলো। মেয়েটা ওকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেলো এমন সাহস পেয়েছে কোথায়?
****
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে জুবায়ের। উদ্দেশ্য মেয়েকে নিতে এসেছে। মেয়েটা এতদিন বাংলাদেশের নাম শুনলে নাক ছিটকাতো কিন্তু হঠাৎ কি হয়েছে সে দুমাসের জন্য বাংলাদেশের আসছে। জুবায়ের তাঁতেই খুশী। মেয়েটাকে ও প্রচণ্ড ভালোবাসে। জুবায়েরের ধ্যান ভাঙলো দূর থেকে মেয়ের ডাক শুনে। দূরে একটা মেয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার ডান গালে মায়ের মতো টোল পড়ে। জুবায়ের হাত বাড়িতে দিলো মেয়েটার উদ্দেশ্যে।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। কহিনুরের নায়ক ভেবে আদিকে কিন্তু কেউ পছন্দ করবেন না। যখন তখন মা*র্ড*র হয়ে যাবে তখন আমাকে দোষা*রোপ করবেন এটা মানবো না। তাই আগে থেকেই সাবধান করলাম।