কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড ,পর্ব:৬

1
1120

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড
পর্ব:৬

দীর্ঘ কয়েক মাস পর মেয়েকে পেয়ে জুবায়ের ভীষণ খুশী তবে মন চনচল হয়ে আছে। কিছুতেই শান্তি অনুভব হচ্ছে না। তাইতো মেয়েকে বাড়ির সামনে নামিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটে চলেছে। গাড়ির নিচে ফেলে অপরিচিত মেয়েটাকে প্রায় মে*রেই ফেলেছিল। আল্লাহ সহায় ছিল তাই রক্ষা। জুবায়েরের কাছে মেয়েটার চোখ দুটো খুব পরিচিত মনে হয়েছিল। ওকে দুহাতে আগলে নিতেই অনমনে হেসেছিল কিন্তু কেনো? সুলতান জুবায়ের ফারুকীর চরিত্র হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করলো যে অপরিচিত কোনো মেয়েকে দেখে হৃদয়ে সুখ অনুভব হচ্ছে। কথাটা ভেবে জুবায়ের ভীষণ রকম বিরক্ত। এতগুলো বছরে যেটা হয়নি সেটাই হচ্ছে। ভদ্রমহিলাকে একবার দেখতে পারলে সব ঝামেলা মিটে যেতো। কোনো মেয়ের অনুমতি ছাড়া নেকাবে হাত দেওয়া বেয়াদবি হবে ভেবে দেখা হয়নি এখন আফসোস হচ্ছে। জুবায়ের হাসপাতালের গেটে গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে গেলো ভেতরে। মেয়েটার কেবিনে গিয়ে দেখলো খালি পড়ে আছে। জুবায়েরের কপালে চিন্তার রেখা ফুঁটে উঠলো। ও আর অপেক্ষা করলো না।ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারলো ভদ্রমহিলা বাড়িতে ফিরে গেছে। জুবায়ের ওর ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে আসলো। চৌধুরী বাড়িতে ওর আগে কখনও যাওয়া হয়নি তবে চৌধুরীর ছেলের সঙ্গে ওর পরিচয় আছে। জুবায়ের এখানে রিসোর্ট তৈরী করছে সেই জন্য দুবার সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। যদিও সেসব দেখাশোনা ওর ভাই জামসেদ ফারুকী করে। ভাইয়ের সঙ্গে ওর তেমন একটা ভালো সম্পর্ক নেই। দুভাই আলাদা থাকলেও ব্যবসার কাজকর্ম এক সঙ্গে জড়িত। সুলতান কোম্পানির একটা পয়সাও এদিক ওদিক করার উপাই নেই। ভোগ দখল করছে এটাইতো অনেক। কথাগুলো ভেবে জুবায়ের বাড়িতে ফিরে আসলো। ঐশ্বর্য এতোক্ষন বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। জুবায়ের আসতেই ঐশ্বর্য দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে বলল,
> ড্যাড তোমাকে কিছু বলার ছিল। আমি তো তোমার একমাত্র মেয়ে তাইনা? এমনকি সুলতান পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তাইতো তোমার সব কিছু আমার তাইনা?
মেয়ের কথা শুনে জুবায়ের চিন্তিত হলো। কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
> আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি ঐশ্বর্য। সুলতান পরিবারের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক বা এই বিশাল অর্থ সম্পদের মালিক তুমি কিনা এসব ছাড়ো। কি চাই তোমার সেটা বলো আমি ইনশাআল্লাহ পূরণ করবো। সুলতান জুবায়ের ফারুক তোমাকে কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দিবে না। প্রমিজ করেছিলাম তোমার মায়ের কাছে।
ঐশ্বর্য খুশী হয়ে সোফায় বসতে বসতে বলল,
> আমার একাউন্টে এক কোটি টাকা চাই ড্যাড। বন্ধুদের মধ্যে আমার প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।ওরা বলেছে আমার একাউন্টে কোনো টাকা নেই এমনকি তোমার নিজের একাউন্টেও না কিন্তু কেনো ড্যাড?
ঐশ্বর্যের কথা শুনে জুবায়ের ভ্রু কুচকে ফেলল। মেয়েটা এতোগুলো টাকা চাইছে শুধুমাত্র নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য। মেয়েটা কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে খোঁজ নিতে হবে। জুবায়েরকে চুপচাপ দেখে ঐশ্বর্য আবারও জিঙ্গাসা করলো। জুবায়ের ওকে কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না।এই বিশাল সম্পদের একমাত্র মালকিন কহিনুর। ওদের নামে যদি বড় কোনো অর্থ জমা হয় তবে ওটা ব্লাক মানি হয়ে যাবে। কোম্পানির একাউন্টে সব অর্থ জমা হয়। জুবায়ের কখনও ঐশ্বর্যকে কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি তবুও মেয়েটা এমন করে কেনো কে জানে। জুবায়ের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল,
> এতগুলো টাকা শুধু শুধু ফেলে রাখার মানে হয়না। আমি নতুন প্রজেক্টের জন্য বেশ কিছু টাকা ইনভেষ্ট করেছি। তাছাড়া প্রভাব প্রতিপত্তি দেখিয়ে বন্ধুত্ব করতে নেই মাম্মা। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো। এসব বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে না।
> কিন্তু ড্যাড আমার ইচ্ছে হচ্ছে আমার একাউন্টে এক কোটি টাকা থাকবে। আমার ইচ্ছেটা পূরণ করবে না বলো? তোমার কাছে এটা সামান্য টাকা কিন্তু।
জুবায়েরের ঐশ্বর্যের উপরে বিরক্ত হলো। তবুও প্রকাশ করতে পারলো না। চোখ বন্ধ করে বলল,
> সম্ভব হলে আমি নিশ্চয়ই তোমার ইচ্ছে পূরণ করতাম কিন্তু এটা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। তুমি কক্ষে ফিরে গিয়ে বিশ্রাম করো। বাচ্চাদের কাছে এতগুলো টাকা থাকলে বিপদ হতে পারে। তোমার ভালোর জন্য আমি এটা চাইছি না।
জুবায়ের আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত চলে আসলো নিজের কক্ষে। ঐশ্বর্য মুখ ভার করে বসে আছে। জার্মান থেকে আসার সময় শুনে এসেছে সুলতান পরিবারের সব সম্পত্তির মালিক জুবায়ের ফারুকীর একমাত্র কন্যার সেই হিসেবে ও এই সম্পত্তির মালকিন তবুও বাবা কেনো একে টাকা দিতে চাইছে না বুঝতে পারলো না। তাছাড়া ওর আঠারো বছর পেরিয়ে গেছে। ঐশ্বর্য সিদ্ধান্ত নিলো ও এবার নিজে কোম্পানির দায়িত্ব নিবে। জুবায়ের ছাড়া এই পরিবারের কেউ ওকে পছন্দ করে না। কারণ কী ওর জানা নেই আর জানতেও চাইনা। যারা ওকে অবহেলা করে ঐশ্বর্য তাদের কঠিন শাস্তি দিবে। সব কিছু যখন ওর হাতে চলে আসবে তখন ও কাউকে সহ্য করবে না। বাড়ি ছাড়া করবে। আরাম আয়েশ চিরতরে ঘুচিয়ে দিবে। কথাগুলো ভেবে ও মুখটা কঠিন করে ফেলল।

_________
চৌধুরী বাড়ির ছাদে আড্ডা বসেছে। গতকাল থেকে মিষ্টিকে সকলে বাচ্চা বলে ডাকছে। মিষ্টি মুখ ভার করে রেখেছে। মিঠি ওকে সাপোর্ট করছে। রিয়াদ হেসে লুটপাট হচ্ছে। আদি মুখ কাচুমাচু করে মিষ্টির দিকে তাঁকিয়ে আছে। কিছু বলার জন্য এদের এমন ফাজলামি ওকে সহ্য করতে হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে প্রশ্ন করতে পারছে না। অপেক্ষা করছে কখন সবাই শান্ত হবে। বেশ কিছুক্ষণ চলল এমন তান্ডব। উপাই না পেয়ে আদি বলে ফেলল,
> আমাদের বাড়িতে একটা মেয়ে আছে ওর পরিচয় আমাদের জানানো হয়নি কেনো মিষ্টি? মেয়েটা কে?
মিষ্টি আদির প্রশ্ন শুনে ঢোক গিলল। দাদু বারবার বলেছিল কহিনুরের কথা কাউকে না বলতে কিন্তু ভাই কিভাবে ওর খোঁজ পেলো বুঝতে পারছে না। তাই মিনমিন করে বলল,
> কোন মেয়ে ভাইয়া? আমাদের বাড়িতে আমরা ছাড়া কে আছে? তুমি ভূল দেখেছো।
আদি ভ্রু কুচকে ধমক দিয়ে বলল,
> মিথ্যা বলবি তো ছাদ থেকে সোজা নিচে চলে যাবি। মেয়েটার পরিচয় দিবি প্লাস মেয়েটাকে এখুনি আমাদের সামনে আনবি কথার খেলাপ করলে শাস্তির জন্য রেডি হয়ে যা।
আদির কথা শুনে মিষ্টি ঘাবড়ে গেলো। রিয়াদ বলল,
> তুমি কহিনুরকে কোথায় দেখেছো? মেয়েটা বোবা বধির আর খুব সরল। এখানে এতগুলো মানুষ দেখলে ভয় পাবে। তুমি ওকে আনতে বলোনা প্লিজ। খুব বাচ্চা মেয়ে।
রিয়াদের কথা আদির পছন্দ হলো না। বলল,
> মেয়েটার দোষ ঢাকতে ওকে বোবা বধির সাজানোর দরকার নেই। বেয়াদব মেয়ে আমাকে গতকাল ফেলে দিয়েছিল। ও এসে আমার কাছে ক্ষমা না চাইলে আমি এখুনি ফিরে যাবো।
আদি মুখটা কঠিন করে কথাগুলো বলল। মিষ্টি বারবার ঢোক গিলছে। বড়দের অনুমতি ছাড়া কহিনুর কে বাইরে আনা ঠিক হবে কি বুঝতে পারছে না কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়ে বাধ্য হলো কহিনুরকে আনতে যেতে। অধরার জ্বর কিছুটা কমেছে তবে পুরোপুরি সুস্থ না। মিষ্টি সকলের অগোচরে কহিনুরকে নিয়ে ছাদে উঠে গেলো। সকলের দৃষ্টি কহিনুরের উপরে গিয়ে পতিত হলো। মেয়েটা পা থেকে মাথা অবধি সাদা পোশাকে আবৃত।ওকে দেখে মনে হলো সাদা শুভ্র কোনো পরী পৃথিবীতে নেমে এসেছে। আদির দৃষ্টি সরছে না। মিষ্টি কহিনুরের হাত ধরে সকালের সামনে এনে বলল,
> ওর নাম কহিনুর, অধরা আন্টির মেয়ে। কথা বলতে পারেনা। আদি ভাইয়া তুমি ওকে ভুল ভুঝেছো। প্লিজ যেতে দাও ওকে। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি।
মিষ্টির কথা শুনে আদির ধ্যান ভাঙলো। এতো সুন্দর একটা মেয়ে কথা বলতে পারেনা শুনে কষ্ট হচ্ছে ওর। ভেবেছিলাম কিছু কড়া করে কথা শুনিয়ে দিবে কিন্তু হলো না। নিজেকে শান্ত করে বলল,
> ঠিক আছে। কিন্তু ওকে এভাবে লুকিয়ে কেনো রাখে বুঝলাম না। বোবা এই জন্য কি ওকে লুকিয়ে রাখা?
রিয়াদ উত্তর দিলো,
> এতো কিছু জানিনা। মিষ্টি ওকে নিয়ে যা। ওকে আর বাইরে আনবি না।
রিয়াদের বলতে দেরী হলো কিন্তু মিষ্টির যেতে দেরী হলো না। ও দ্রুত কহিনুর কে নিয়ে প্রস্থান করলো। আদির ইচ্ছে ছিল আরও কিছুক্ষণ মেয়েটাকে দেখার কিন্তু পারলোনা। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নিজেও ছাদ থেকে নেমে আসলো। সেদিনের মতো আড্ডার সমাপ্তি হলো।
__________
ডালিয়া হক নানারকম রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। সকাল থেকে কাজের মেয়েদের সঙ্গে উনি নানারকম আইটেমের খাবার তৈরী করছেন। বোনের ছেলে আসছে আধরাকে দেখতে। বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করে বিয়ে পড়িয়ে দিবেন ভেবে রেখেছেন। তারপর আবার বিখ্যাত কেউ একজন আসছে ছেলের বিজনেসের সঙ্গে জড়িত সে। ছেলের উদ্দামতা দেখে উনি বুঝেছেন লোকটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাড়ির মেহমান সঙ্গে বাইরের মেহমান দিয়ে মোটামুটি খাবারের জন্য বেশ আয়োজন করতে হচ্ছে। অধরা সুস্থ হয়ে উঠেছে। কপালের দাগটা কেবল রয়ে গেছে। ডালিয়া হক কাজের মেয়েকে পাঠিয়েছেন অধরাকে তৈরী করতে। মেয়েটা রাজি হবে কি বুঝতে পারছেন না। উনার ধ্যান ভাঙলো ফিসফিস আওয়াজ শুনে। অধরা উনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের একটা শাড়ি হাতে করে। মুখে বিরক্তির চিহ্ন। মেয়েটা ফিসফিস করে বলল,
> আন্টি আমি শাড়ি পরিনা তুমি জানো। তারপর আবার কালো রঙ কখনও না। এসব কেনো করছো? এই বয়সে আমার এসব মানায় না। ভালো লাগছে না।
ডালিয়া হক মাছের পিচ কড়াইয়ে ভাজতে দিতে দিতে বলল,
> তোর ভালোর জন্য আমি সব পারি। কথা না বলে এখুনি রেডি হতে যা। ওরা চলে আসবে।আমি কিছু শুনবো না। তোর যা পছন্দ তাই পর তবুও যা মা।
অধরা নিরাশ হয়ে ফিরে গেলো। জুবায়ের জানলে ওরে পি*টাবে সঙ্গে যে লোক ওকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে তার জান নিয়ে টানাটানি বাঁধিয়ে দিবে এটা নিশ্চিত । অধরা এটা ভেবেই ভয় পাচ্ছে। কেউ তো জানেনা সুলতান জুবায়ের ফারুকী কেমন রাগচটা। বেই*মানি করা মৃ*ত গার্লফ্রেন্ডের ক*ব*রে বো*ম মা*রার পরিকল্পনা করতে পারে তার দ্বারা অনেক কিছুই সম্ভব। অধরা হাতের শাড়িটা ছুড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। বাইরের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। আত্মীয়রা চলে এসছে।
অন্যদিকে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চৌধুরী বাড়ির দরজায় পা রাখলো জুবায়ের । আজ এখানে আসার ইচ্ছে ছিল না তবুও মেয়ের জন্য আসতে হলো। এই বাড়ির কোন এক ছেলের সঙ্গে মেয়ের প্রণয়ঘটিত ব্যাপারটা শুনে ও স্থির থাকতে পারেনি। ছেলে পছন্দ হলে সমস্যা নেই। তাছাড়া চৌধুরীর ছোট ছেলের সঙ্গে ওর পরিচয় আছে। গতকাল রাতে নিজে যেচে নিমন্ত্রণ নিয়েছে। আজ এই বাড়ির মেয়েকে দেখতে আসবে সেটাও ভদ্রলোক ওকে জানিয়ে দিয়েছে। কেমন উৎসব উৎসব পরিবেশ। জুবায়ের একপা একপা করে ভেতরে প্রবেশ করছে ততই বুকের মধ্যে কেমন ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। এটা ভয় নাকি উত্তেজনা বুঝতে পারলো না।সামনে কি হতে চলেছে ওর জানা নেই।

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। আগেই বলেছিলাম দ্বিতীয় খণ্ড রহস্যে ঘেঁরা থাকবে। আর ঐশ্বর্যের পরিচয় বিশেষ মূহুর্তে প্রকাশ করবো ইনশাআল্লাহ।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here