হলুদ_খামে #পর্ব_১

0
1184

পাঁচ আঙ্গুলের লালচে ছাপ স্পস্ট আমার হাতে বসে গেছে। এতো জোড়ে আমার হাত চেপে ধরে রাখাতে রক্ত জমাট বেঁধে হাতটা আমার অবশ হবার উপক্রম। কোনো ভাবেই আমি তামিমের হাত থেকে আমার হাতটা ছাড়াতে পারছি না। ব্রেসলেটটা বোধহয় তার হাতের চাপে ভেঙ্গেই গেছে। গাড়ি থেকে নেমেই আমার হাত শক্ত করে সেই যে ধরেছে এখন পর্যন্ত ছাড়ার নাম নেই। এ দোকান থেকে সে দোকান, এক প্রকার দৌড়ে দৌড়ে আমি তার সাথে পাল্লা দিচ্ছি। এদিকে আমার পা বার বার শাড়ির কুচিতে লেগে বেঁজে যাচ্ছে। এক হাতে শাড়ির কুচি ধরে আমি আহাম্মকের মতো দৌড়েই যাচ্ছি!
🍁

আমার হাজার মানা করা সত্তেও তামিমের সাথে আমার বিয়েটা দু’সপ্তাহ্ পরই হচ্ছে। কোনো ভাবেই আমি এ বিয়েটা আটকাতে পারছিনা। বাবা-মা আমাকে তামিমের কাছে বিয়ে দিতে এক পায়ে খাড়া, তাই তাদের কাছে আমি তামিমের যতই দোষ ত্রুটি তুলে ধরি না কেনো তাদের চোখে তামিম সব সময়ই ধোঁয়া তুলসি পাতা। আমার কোনো কথাই তারা কানে তুলছে না।
🍁

প্রায় দশ মিনিট পুরো শপিংমলের এ’দোকান সে দোকানে দৌড়ানোর পর আমার হাত ছেড়ে দিলো তামিম। এ দিকে শাড়ির কুচি খুলে আমার হাতে পড়ে আছে। হাতের লালচে যায়গায় ঘষবো নাকি শাড়ির কুচি ঠিক করবো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। মনে মনে তামিমকে হাজারো গালি দিচ্ছি, এভাবে কেউ কারো হাত ধরে নিয়ে আসে? নিজে তো একেকটা কদম হাল্কের মতো ফেলবে, পাশের জন কি অবস্থায় আছে তার দিকে কোনো খেয়ালই নেই জনাবের। রাগে আমার মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। বাম হাতে কুচি ধরে আমি একবার তামিমের দিকে তাকাচ্ছি তো আরেকবার আমার ডান হাতের দিকে। নাহ্ আমি যে তার দিকে তাকিয়ে আছি তাতে জনাবের কোনো পাত্তাই নেই। সে তার মন মতো লেহেঙ্গা পছন্দ করতে ব্যস্ত। নিজের ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই করবে তাতো মেনে নেয়া যায় না। যেই না তাকে কিছু বলতে যাবো তখনই তামিম একটা লেহেঙ্গা হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকায়।

— কি হলো? পছন্দ হয়েছে? আমার তো এটা দারুন লাগছে, আমার বউকে যা মানাবে না এটা পড়লে ওফফ্ আমি তো এখনই কল্পনা করে ফেলছি।

তার এমন কথায় আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে, কোথায় আমি শাড়ির কুচি ধরে আছি আর সে কিনা কল্পনা করতে ব্যস্ত! আমার মুখ দেখে বোধহয় তামিম কিছু একটা বুঝতে পেরে আমার হাতের দিকে তাকালো। নিজের হাতের লেহেঙ্গাটা পাশে রেখে আমাকে আড়ালে নিয়ে গেলো।
🍁

— শাড়ি সামলাতে না পারলে শাড়ি পড়ো কেনো? কুচি ধরে হাঁটতে বুঝি তোমার খুব ভালো লাগে জান? হা করে কি দেখছো কুচিটা দাও আমার হাতে!

কি আশ্চর্য কি আশ্চর্য, আমার এই অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ি অথচ আমাকেই এখন কথা শোনাচ্ছে! আর আমিও আহাম্মকের মতো তার বকা শুনেই যাচ্ছি, কি স্টুপিড আমি। তানহা তোর কি লজ্জা নেই? এই ঝগড়ুটে ছেলের কাছ থেকে তুই কথা শুনেই যাচ্ছিস শুনেই যাচ্ছিস। তুই তো ছেড়ে দেয়ার মেয়ে না, তবে কি হলো তোর?

আমি তামিমের হাত থেকে কেড়ে নেয়ার আগেই সে আমার কোমড়ে শাড়ির কুচি গুজে দেয়। এক মুহূর্তের জন্য পুরো শরীর কেঁপে উঠলেও পর মুহূর্তেই তাকে ধাক্কা দিয়ে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলাম।

নির্লজ্জ বেহায়া ছেলে, লজ্জা লাগে না আপনার একটা মেয়ের কোমড়ে হাত দিতে? আর কি যেনো বলছিলেন, ও হ্যাঁ কুচি হাতে নিয়ে হাটতে আমার ভালো লাগে কিনা? আমার এই করুন অবস্থার জন্য আপনি দায়ি। কে বলেছিলো ওই ভাবে বড় বড় পা ফেলে হাঁটার? আপনার সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে গিয়েই তো আমার শাড়ির এই দশা হলো। সে খেয়াল তো রাখবেন না, শুধু কিভাবে একটু ঝগড়া করা যায়, কিভাবে একটু আমাকে জব্দ করা যায় সেই চিন্তা মাথায় ঘুরে তাইনা? এখন কুচি ঠিক করে সাধু সাজা হচ্ছে? লাগবে না আপনার হেল্প, আমি নিজেই সামলে নিতে পারবো! ওফফ্ হাতটাও এমন ভাবে ধরেছেন যেনো ছাড়লেই পালিয়ে যাবো আমি? যত্তসব…

আমার কথা শুনে ভদ্র লোক চুপষে গেলেন মনে হচ্ছে! যাক গে ভালোই হয়েছে, সব সময় নিজের যা ইচ্ছে তাই করবে নাকি? আমার নামও তানহা, আমিও চুপ চাপ সব কিছু সহ্য করার মেয়ে নই।

কিছুক্ষন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তামিম আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে আমি বার বার ঢোক গিলছি, কে জানে কি করে বসে। এই ছেলেকে আমার বিন্দু মাত্র বিশ্বাস নেই। হুট করেই রেগে যায় আবার সাথে সাথেই শান্ত হয়ে যায়। বাবা-মাও যে কোন বুদ্ধিতে আমাকে তামিমের সাথে একা পাঠালো কে জানে? পেছনে পা ফেলতে ফেলতে আমার দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে গেছে। নিঃশ্বাস আমার দ্রুতগতিতে চলছে, তামিমের ঠোঁট আমার কান ছুঁই ছুঁই করছে। দু’হাত দিয়ে আমার দু’পাশ আবদ্ধ করে ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বলছে অথচ আমি কিছুই শোনার অবস্থায় নেই।

— নিজেকে সামলাতে তুমি সেদিনও পারো নি জান। আজও পারবে না, তোমাকে শুধু মাত্র আমিই সামলাতে পারব। তাইতো শত বাঁধা পেরিয়ে আমাদের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে যাচ্ছে। সেদিন আমিই ছিলাম তোমার পাশে, আজও আছি এবং সারাজীবন থাকতে চাই। তুমি না চাইলেও এখন আমার আর কিছু করার নেই। বিয়ে তোমার আমাকেই করতে হবে। যে ভাবেই হোক যখনই হোক, বউ শুধু তুমি আমারই হবে জান।

কথাগুলো বলেই তামিম আমার কানের কাছ থেকে মুখ সরিয়ে নিলো। এক হাত আমার গালে রেখে স্লাইড করতে থাকলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে, নেশা ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওফফ্ কি অসহ্যকর মুহূর্ত। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার, সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে নিলাম আমি। কিছুক্ষন পর মনে হলো সব কিছু স্বভাবিক হয়ে আছে। দম বন্ধ করা মুহূর্তটা আর নেই। চোখ খুলে দেখি তামিম আমার পাশে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এক পা দেয়ালের সাথে ঠেশে দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে চোখ বন্ধ করে মাথা উপরের দিকে তুলে মুচকি হাসছে। সেই পুরোনো অসহ্যকর হাসি, যে হাসি থেকে গত দু’বছর পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমি।

চোখ বন্ধ রেখেই তামিম বললো-
বিয়েটা তুমি ভাঙ্গার যতই চেষ্টা করো না কেনো জান তাতে কোনো ভাবেই তুমি সফল হবে না। কিছুতেই আমি বিয়েটা ভাঙ্গতে দেবো না মনে রেখো।
🍁
🍁

বিয়ের এক গাদা শপিং করে আমি আর তামিম বাসায় ফিরে যাচ্ছি। তার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই তবুও না চাইতেও বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে। হ্যাঁ কিংবা না এর বেশি কোনো কথাই আমার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। আমার কাছে আসার কোনো সুযোগ আমি তামিমকে দিচ্ছি না। স্বইচ্ছায় তামিমের সাথে গাড়ির সামনে বসেছি, সিট বেল্টাও নিজেই বেঁধেছি। জানতাম এসবের বাহানায় একটু ছুঁয়ে দেয়ার প্রয়াস সে চালাবেই।

কোনো কিছুতেই যখন আমার সাথে পারছিলো না তখন বার বার তামিম আমার দিকে তাকিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি জানালার দিকে মুখ করে মুচকি হাসছি। আমার কোনো পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে হুট করেই তামিম আমার হাত শক্ত করে ধরে বসে।

এটা কি হলো? হাত ধরলেন কেনো আপনি আমার?

— আমার হবু বউয়ের হাত আমি ধরবো তাতে তোমার কি?

কি, কে আপনার হবু বউ? দেখুন মিস্টার…

— দেখা দেখি সবই বিয়ের পর হবে জান, কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে আপনি করে বলাটা বাদ দাও। কতোবার তোমাকে বলেছি আমাকে আপনি করে বলবে না, কথা শোনো না কেনো আমার?

হাত ছাড়ুন, ভালো হবে না কিন্তু।

— আচ্ছা, তাই নাকি? কি হবে তাহলে?

আরো শক্ত করে আমার হাত ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে তামিম। আমি আমার সবটুকু শক্তি দিয়ে তামিমের হাতে কামড় দিলাম। দাঁত গুলো প্রায় চামড়া ভেদ করেই ফেলবে ঠিক তখনই আমার হাত ছেড়ে দিলো।

— কামড়া কামড়ির অভ্যেসটা তোমার আদৌ গেলো না জান! চিন্তা করো না, বিয়ের পর যেখানে ইচ্ছে সেখানে কামড়াতে দেবো তোমায় হা হা হা। তবে কামড়ে হোক কিংবা দাঁত বসিয়ে আমার হাতে তোমার ভালোবাসার চিহ্ন দু’বছর পর আবার বসে গেলো।

বার বার সে কথা মনে না করিয়ে দিলে হয় না? আমি দু’বছর আগের কোনো কথা কিংবা স্মৃতিই আর মনে করতে চাই না।

চলবে…

#হলুদ_খামে
#পর্ব_১
#Adharer_Musafir (ইফ্ফাত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here