🍁আরহাম🍁#The_Innocent_Boy
#Writer-ফারহানা আক্তার রুপকথা
#পর্ব(৩২)
_________
আজ বাড়ি ফিরে আরহাম কিচেনে ঢুকেছে মায়ের জন্য রান্না করতে। শত বারণের পরও সে ঢুকেছে। ছেলেকে বারণ শোনাতে না পেরে অগত্যা তিনিও কিচেন থেকে আপাতত বহিষ্কৃত আছেন। মায়ের পছন্দের মোরগ পোলাও রান্না করবে সে তাই মুরগিটা কেটে ধুয়ে নিচ্ছে আর সাথে কফির ব্যবস্তাও করে নিলো। যেন মা টিভি দেখতে দেখতে বোর না হয়। তখনই তার মোবাইলে মেসেজ টোনটা শোনা যায়। চোখ মেলে লকের ওপর থেকে হোমস্ক্রীণে নামটা দেখে নিলো ‘রোহান’। মেসেজের শুধু দুইটা ওয়ার্ডই শো হলো “মৃত্তিকে নিয়ে…..
আরহাম দ্রুত হাতের কাজ রেখে আগে মেসেজটা ওপেন করলো।
” মৃত্তিকে নিয়ে কি ভাবলি?””
মুডটাই খারাপ হয়ে গেল আরহামের। রোহান তাকে মেসেজ করেছে ওই সাইকো মেয়ের কি করবো সেটা জানতে?সেও রিপ্লাই করলো “কি ভাববো! সময় মতো ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো” মেসেজটা সেন্ড করে আরহাম কফিটা মগে ঢেলে মাকে দিয়ে এসে আবার রান্নায় মনোযোগ দিলো।আহনাফ কাল সকালেই হোস্টেলে চলে যাবে তাই একটু শপিং এ গিয়েছিলো টুকিটাকি দরকারি জিনিস কিনতে। এসে ভাইকে কিচেন দেখে রসিকতা শুরু করলো।
-ওয়াও ভাইয়া এখনি এগুলো শিখে নিচ্ছো ভাবি কে রান্না করে খাওয়াবে বলে? গ্রেট!
আরহামের মুড ভালো নেই বলে কোন জবাব দিলো না। আহনাফ আবারও বলল “দেখেছো মা কি মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে বউয়ের জন্য পারফেক্ট হওয়ার চেষ্টায় মত্ত।”
-“জাস্ট শাট আপ এন্ড গো ফ্রম হেয়ার” অনেকটা চিল্লিয়ে বলল।
আরহামের এহেন আচরণে আহনাফ আর তার মা দুজনেই অবাক হলেন কি এমন বলে ফেলেছে যার জন্য তার এত রাগ। আহনাফ মুখ ভার করে কিচেন থেকে সোজা নিজের রুমে চলে গেল মন খারাপ করে। এবার তার মা টিভি অফ করে সোফা থেকে উঠে কিচেনে আসলেন।
আলতো করে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন।
–তুই কি কোন কারণে ডিস্টার্ব আছিস বাবু? (মা)
–নাহ, আ’ম ওকে।
— মিথ্যা বলিস না তুই তো এমনি এমনি কখনো আহনাফ এর সাথে উঁচু স্বরেও কথা বলিস না ধমক দিয়ে তো দূরের কথা। (মা)
— তেমন কিছু না মা অফিসের কিছু কাজ নিয়ে ঝামেলায় আছি এই আরকি তাই….
–আচ্ছা এবার বের হ আমি রান্নাটা শেষ করছি। (মা)
-“না মা মুরগিটা হয়ে এলো প্রায় পোলাও আর ডিমের কোর্মাটা বেশিক্ষণ লাগবে না তুমি বরল সালাদটা কেটে দাও।” (আরহাম)
-না তুই বের হ অন্য একদিন রান্না করিস এখন একটু রেস্ট নিয়ে আহনাফের সাথে একটু কথা বলে নে। নয়তো মন খারাপ করেই থাকবে কাল তো আবার চলে যাবে।
আরহামের মুডটা সত্যিই খুব খারাপ হয়ে আছে তাই বেড়িয়ে গেল কিচেন থেকে । তারপর রুমে গিয়ে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে আহনাফের রুমে ঢুকলো। যা ভেবেছিলো তাই আরহামের পুরনো গিটারটা হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে তারগুলোতে আঙ্গুল টানছে আর এই টানে একটা দুটা টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে।মন খারাপের মুহুর্ত গুলোতে আহনাফ তার ভইয়ের এই গিটারটাকে সঙ্গী করে চুপচাপ বসে থাকে। এটাই একমাত্র গিটার যেটাতে আহনাফ কখনো সুর তোলে না এছাড়া গিটার বলতে ভাইয়ের মত সেও অজ্ঞান। বহু গিটার নষ্ট করেছে সে ক্লাস নাইন থেকে এখন পর্যন্ত অথচ এই গিটারটাকে কখনো সুর তুলতে ব্যবহার করে না পাছে তার ছিঁড়ে যায় ভেবে।
আরহাম পেছন থেকে এসে কাঁধে হাত রাখতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে দাড়ায় আহনাফ।
-স্যরি, একটু মুড অফ ছিলো অফিসের কোন বিষয়ে মেজাজটা খুব খারাপ ও ছিলো। তাই তোর মজা করাটাও সহ্য হচ্ছিলো না। এভাবে রাগ দেখানোটা আমার মোটেও ঠিক হয়নি।(আরহাম)
-না ভাইয়া আ’ম স্যরি, আমারও উচিত হয়নি হুটহাট মজা করাটা। আর তুমি এভাবে স্যরি বলোনা তুমি তো বড় বকা দিতেই পারো। (আহনাফ)
-তবুও…
-“কোন তবুও না ভাইয়া আমি একটুও মন খারাপ করি নি”একটু হেসে বলল আহনাফ।
-“আচ্ছা এই নে ধর” টাকা গুলো ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলো আরহাম।
-এতো টাকা কিসের ভাইয়া!
-কাল নাকি সকালে চলে যাবি আমার সাথে দেখা নাও হতে পারে তাই তোর পকেটমানি।(আরহাম)
-কিন্তু এতো টাকা কেন কক্সবাজার যাওয়ার সময় যা নিয়েছি সব খরচ হয় নি তো।(আহনাফ)
-থাক তবুও রাখ। আর এমনিতেও দু’মাস পর পরীক্ষা প্রয়োজন পড়তেও পারে রেখে দে।
-থ্যাংক ইউ ভাইয়া।
রোহান মৃত্তিদের বাড়ি এসেছে অনেকক্ষণ। আরহামের মেসেজের উত্তর পেয়ে মিরহাদকে বললো সে তিনমাস পরই মৃত্তিকে বিয়ে করবে কোন এনগেজমেন্ট এর দরকার নেই। মিরহাদও বলল এমনটাই হবে। কিন্তু তার মা তাদের জন্য কফি নিয়ে আসার সময় কথা গুলো শুনে রুমে ঢুকে বলে দিলেন “এমন কিছুই হবে না।”
রোহান আর মির দুজনেই হতবাক মিরের মায়ের কথা শুনে।
-আন্টি আরহাম আর মৃত্তির বিয়েটা এক্সিডেন্ট মাত্র। এই বিয়ে তারা দুজনের একজনও মেনে নিবে না। (রোহান)
-জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটা জিনিস পুরোপুরি আল্লাহর হাতে। আর বিয়ে সামাজিক বন্ধন হলেও এটা একটা পবিত্র সম্পর্ক। যেভাবেই হোক না কেন বিয়ে ভাঙা সহজ না।
-কিন্তু মা কেন বুঝতে পারছো না মৃত্তিকে রোহান ভালোবাসে আর মৃত্তি আরহামকে ভালোবাসে না আরহাম তো মৃত্তিকে সহ্য ও করতে পারে না। (মিরহাদ)
মিসেস মরিয়ম চোখ গরম করে তাকান ছেলের দিকে কিছুটা বলতেও নেন কিন্তু রোহানের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যান। ধীর গলায় শুধু এটুকু বলেন ” নিজে থেকে তোমরা ডিভোর্স নিয়ে কোন কথা বলবে না আল্লাহ যা করবেন তাই সহজভাবে মেনে নিতে শিখো” বলেই তার মা রুম থেকে চলে গেলেন। মিরহাদ কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু রোহান বসা থেকে উঠে গেল। মির কিছু বলার আগেই সে বিদায় নিলো। তার মনে যেই একটু আশা বাকি ছিলো সেটাও আজ মিরের মায়ের কথা শুনে শেষ হয়ে গেলো।
মিরও নির্বাক কি হচ্ছে তার সাথে এসব। বন্ধু কষ্ট পাচ্ছে সে নিজে কষ্ট পাচ্ছে শেষে তার বোনটাকেও কষ্ট পেতে হবে ।। ভালোবাসা কি এতোটাই অন্যায় যে শাস্তি পাওয়াটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল?
জিনিয়া আজ দু দিন ধরে ভার্সিটি যায় না পড়ালেখার প্রতিও মন বসাতে পারছে না। তাই একটু বই৷ নিয়ে বসেছিলো। কিন্তু তাতেও ব্যাঘাত ঘটলো একটা কল দেখে। সাদনান কল করেছে। নাম্বারটা সেইভ করা। এনগেজমেন্ট এর দিন সাদনান নিজে তার মোবাইলে নাম্বারটা সেইভ করে দিয়ে গেছিলো।কিন্তু এ দুদিনে একবারও কল করে নি। তবে এতে করে জিনিয়ারই ভালো হয়েছে দুটো দিন মন খুলে কাঁদতে পেরেছে না পেয়ে হারানো ভালোবাসার মানুষটার জন্য। কল বাজতে বাজতে কেটে গেল জিনিয়া রিসিভ করার আগেই। তারপর আবারও বেজে উঠল মোবাইলটা এবারও সাদনান কল দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করলো।
হাই,কেমন আছো কি করো এসবই প্রশ্ন ছিলো সাদনানের আর জিনিয়াও দায়সারা উত্তর দিলো। সাদনান হয়তো বুঝতে পেরেছে জিনিয়া কথা বলতে অস্বস্তি ফিল করছে তাই সেও তাড়াতাড়ি কথা শেষ করলো।আবারও কান্না আসছে জিনিয়ার কেন হলো এমন? পাঁচটা বছরের বেশি সময় হবে ওই একজন মানুষকেই সে ভালোবেসে আসছে। সেই মানুষটা তাকে ভালোবাসে কখনো না বললেও তার অধিকার বোধ আর শাসন করাটা তাকে এতোটুকু বোঝাতো এই মানুষটাই তার জীবনে থাকবে। কিন্তু কি হলো এটা ওই মানুষটা তো তাকে ভুল করেও নিজের করে পাওয়ার কথা বলেনি। উল্টো আজ অন্য একজনের জীবন সঙ্গী হতে হলো জিনিয়াকে।
মৃত্তি ঘুম ঘুম চোখে বসে আছে বারান্দায়। রাতের খাবারও খায় নি। আজ মাও একটা বার ডাকলো না তাকে খাওয়ার জন্য । এতো রাগ কিসের জন্য মায়ের সেটাই বুঝতে পারছে না মৃত্তি। ও তো নিজে থেকে কিছু করেনি সবটাই এক্সিডেন্ট।
কিন্তু এখন আর এগুলো ভেবেই বা কি লাভ। তবে মৃত্তি ভাবছে এখন যে করেই হোক শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে তাকে। বিয়ের পর বাবার বাড়ি থাকবে এটা কোন কথা হলো! তার ধারনা সবকিছুই সহজ ব্যাপার। একবার আরহামের বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলো আরহামকে দেখা যায় কিনা।
“নাহ, এই ব্যাটা আইজকা আর বারান্দায় আইবো না। আমি যদি হের চাঁন মুখখান দেইখা ফেলি তাই, হুহ।চান্দু আমি তোমার বউ হইয়া গেছি এহনও ভাব দেহাও একবার আইতে দাও আমারে শ্বশুড়বাড়ি। তারপর খবর নিমু তোমার হিন্দি সিরিয়ালের বউ গুলার মত” বলেই মৃত্তি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। একা একাই নিজের পুরো সংসার সাজিয়ে ফেলছে সে। তার এই অশান্ত, বোকা মনটা জানেই না বাস্তবতা কতো কঠিন। তার কাছে সবটা একটা ড্রামার মত মনে হয়।
কিন্তু আবার এও মনে পড়ে তার ভাই আর জিনিয়া কতোটা কষ্ট পাচ্ছে। নাহ কালই জিনিয়ার সাথে কথা বলবে ভার্সিটিতে না এলে তার বাড়িতেই চলে যাবে। প্রয়োজনে ওই সাদনানকেই খুন করে ফেলবে সে। তারপর বারান্দা থেকে উঠে ভাইয়ের রুমে যায়।
পুরো রুম অন্ধকার আর কেমন একটা বাজে গন্ধ। তবে বুঝতে বেশি সময় লাগে না গন্ধটা কিসের।
সিগারেট হ্যা সিগারেটের তীব্র গন্ধ আসছে বারান্দার দিক থেকে। মৃত্তি বারান্দায় গিয়ে ভাইকে সিগারেট হাতে দেখে বেশ অবাক হলো। কারণ, বাড়ির বাইরে সে সিগারেট খায় কিনা জানে না। তবে বাড়িতে কখনো দেখেনি সিগারেট হাতে। মিরহাদ হঠাৎ বোনকে দেখে চমকে যায়।
-তুই এখানে! কি হয়েছে?
-কিছু না ভাইয়া তুই সিগারেট খাইতাছোস ক্যান?
মিরের হুশ এলো সে দরজা না লাগিয়েই সিগারেট খেতে বসেছিলো। তাড়াতাড়ি করে হাতের সিগারেটটা নিচে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে দিলো।
মৃত্তি আরেকটু এগিয়ে ” তুই জিনিয়ারে মিস করতাছোছ তাই না আমিও” বলেই মুখটা গোমড়া করে ফেলল।
-আরে নাহ আমি ওকে কেন মিস করবো। আমি তো এমনিতেই ট্রাই করছিলাম সিগারেট খেতে কেমন লাগে জানতে। (মিরহাদ)
-“মিছা কথা বাদ,দে আমি বুঝি তো সব আইচ্ছা শোন আমি একটা আইডিয়া বাইর করছি” চটপটে কথা বলে মৃত্তি।
-“কিসের আইডিয়া!” আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে মির।
-কিসের আবার জিনিয়ারে তোর বউ করোনের। (মৃত্তি)
-কিহ, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এই তুই কি ভুলে গেছিস নাকি জিনিয়ার এংগেজমেন্ট হয়ে গেছে।(মিরহাদ)
-ধুর, বলদ পোলাপান ভুলমু ক্যান মনে আছে তাই তো কইছি আইডিয়া বাইর করছি সব ঠিক করমু। (মৃত্তি)
-“এই মৃত্যু বের হ আমার রুম থেকে তুই নিশ্চিত কোন নেশাদ্রব্য খেয়েছিস। আর না হয় পাগল হয়ে গেছিস” বলেই মির মৃত্তিকে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
-“এহ, এজন্যই কেউর উপকার করতে নাই শয়তান ভাই একখান। আমি বালা বুদ্ধি নিয়া আইলাম দিলো বাইর কইরা, হুহ” বলতে বলতে মৃত্তি নিজের রুমে চলে গেল।
কেন বুঝিস না বোন জিনিয়া অন্য কারো নামের হয়ে গেছে। আমি চাইলেও সে আর আমার হবে না আর সে হতেও চায় না তাই তো আমার কাছ থেকে লুকালো এনগেজমেন্ট এর কথাটা।
ভালো যদি বাসতো তবে ঠিকই আমাকে বলতো কিছু করতে তোকে বলতো না। তুই তো তোর চেষ্টা করেছিস কিন্তু সে নিজেই কিছু করতে চায় নি।
চলবে