ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে #রোকসানা_রাহমান পর্ব (১৫)

0
386

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৫)

রিপ্তি বাবাকে পিছু হটাতে পারবেনা দেখে বললো,,

“” সেটা কি করে? আমি হোস্টেলে থাকতে পারবোনা।””
“” সমস্যা নেই। মোহাম্মদপুরে আমার ছোটবেলা বন্ধু আছেন। ওখানে থাকবে,ওর একটা তোমার বয়েসী মেয়েও আছে। তারসাথে থাকবে।””

রিপ্তি বাবার হাত সরিয়ে ফেললো। কঠিন গলায় বললো,,

“” আমি এখান থেকে গিয়ে পড়বো। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিনা। যদি এতে তোমার সম্মতি থাকে তবেই আমি ভর্তি হবো। নাহলে না।””
“” এটা কেমন কথা রিপ্তি? নরসিংদী থেকে ঢাকা যাতায়াত অনেক বেশিই সময়ব্যয় হবে।””

রিপ্তির একরোখা জবাব,,

“” হলে হবে,আমি এখান থেকে পড়বো মানে এখান থেকেই। তুমি আমাকে একদম জোর করবেনা,বাবা!””

কবির সাহেব কোমলকন্ঠে বললেন,,

“” বোঝার চেষ্টা কর মা,এখান থেকে ঢাকা ট্রেণপথে দুঘন্টার রাস্তা। বাসে গেলে আরো বেশি। তারমধ্যে তোর ক্লাসটাইম,টুকিটাকি আরো অনেক কিছু মিলিয়ে সারাটাদিন রাস্তায় কেটে যাবে। এতো জার্নি পেরে উঠবিনা।””
“” সে পরে দেখা যাবে।””
“” পরেরটা পরে নয়,আগে ভাবতে হয়,মা। তারমধ্যে টাইমটেবিলের একটু ভুল-ভ্রান্তি হলে তোর বাসায় ফিরতে মাঝরাতও হতে পারে।””

বাবা যে দুশ্চিন্তাগ্রস্তে ভুগছেন তা তার কন্ঠেই টের পাচ্ছে রিপ্তি। তবুও নিজের জেদে অটল থেকে বললো,,

“” আমি কিছু জানিনা। তুমি যদি চাও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তাহলে এখান থেকেই পড়বো। না চাইলে ভালো,আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। বেশি সমস্যা হলে পড়বোইনা!””

রিপ্তি নিজের মতামত জানিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। মেয়ের জেদের উপর রাগ হলেও তার মন খুশিতে ভরে উঠছে। তার মুড়িয়ে পড়া মেয়েটা আবার সেই জেদকে কুড়িয়ে নিচ্ছে। শুকনো ফুল তবে কি সতেজতার পূর্ণ রুপটা ধারণ করেই ফেললো??

কবির সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন,,

“” অমন একটা নতুন শহরে তুই একা একা যাতায়াত করতে পারবি?””

রিপ্তি দাড়িয়ে পড়লো,বাবার দিকে ঘুরে চুপ করে রইলো। লম্বা নিশ্বাস টেনে মৃদুসুরে বললো,,

“” শহরটা আমার জন্য নয় বাবা,আমিই শহরটার জন্য নতুন!””

রিপ্তি চলে গেলো। বাবার জন্য নতুন ভাবনা রেখে!

~~~

ভাদ্র মাসের দুপুর বেলা! তীর্ষকরশ্মি মাখা সূর্যের তাজ আকাশে। ঝকঝকে রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে আছে রিপ্তি। খোলা ছাদের গরম অনুভূতিতেও রিপ্তির কাছে সব পানসে। তার মনে হচ্ছে আজ পানসে দুপুর। যে দুপুরে নেই সূর্যের তাপ,কাঠফাটা গরম,গাছের পাতার ঝনঝন শব্দ! নেই কিছু নেই,বিরক্ত নেই,ভালো লাগা নেই,কিছু নেই। শুধু আছে পানসে পাতার পানসে দুপুর!

গরমে রিপ্তির ভেজা চুল শুকিয়ে আবার ভিজে উঠছে,নাকপাশাটায় বিন্দু বিন্দু ঘামে ডুবে আছে। তবুও সে ছাদ থেকে নামছেনা। নেমে কি হবে?? কি করবে? তার তো কিছু করতে মন চাচ্ছেনা। তাহলে কেন করবে?? রিপ্তির হাজারও অহেতুক,কাল্পনিক ভাবনার মাঝে ভাবী এসে ডেকে গেলেন। রিপ্তি একরকম অনিহা নিয়ে খাবার রুমে পৌছুলো। চেয়ার টেনে বসলো না। টেবিলে রাখা ডালের দিকে তাকিয়ে বললো,,

“” ডালে মুরগি দাওনি?””

তরকারীর বাটিটা টেবিলে রেখে মিন্মি বললো,,

“” মসুরডালে মুরগির মাংস?””
“” হুম!””

মিন্মি কিছুটা চমকালো। ভ্রূদুটো কুঁচকে বললো,,

“” মসুরডালে মুরগির মাংস? আমি তো বাপের জন্মেও শুনিনি!””

রিপ্তি উৎসাহ নিয়ে বললো,,

“” তুমি তো এখন বাপের জন্মে নেই ভাবী। তোমার জন্মে আছো। আর এই জন্মে শুধু মসুর ডালে কেন,সবকিছুতেই মুরগির মাংস দেওয়া যায়। তুমি চাইলে আমি তোমাকে মুরগির মাংসের ভর্তা বানিয়ে খাওয়াতে পারি।””

মিন্মি চোখদুটো বড়বড় করে বিস্ময় নিয়ে বললো,,

“” মুরগির মাংসের ভর্তা?””

রিপ্তি মহাজ্ঞানী ভাব নিয়ে বললো,,

“” হুম,তুমি খাওনি?””
“” আমি তো নামই শুনিনি,খাবো কখন?””
“” এটা তো একদম সহজ রেসিপি ভাবী। আমি তোমাকে শিখিয়ে দিবো।””

কবির সাহেব এতক্ষণ চুপ করে মেয়ে আর ছেলে বউয়ের কথোপকথন শুনছিলেন। এবার মুখ খুললেন,,

“” রিপ্তি মা,তোর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তুই পাকা রাধুনী৷ রান্নার উপর ডিগ্রী অর্জন করেছিস। কোথায় শিখলি রান্না? নানি শিখিয়েছে?””

রিপ্তি ঠোঁট কামড়ালো। লজ্জায় চোখ বুঝলো। কপালে ভাজ তুলে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,,

“” আমি রান্না করতে পারিনা,বাবা। কিন্তু রান্নার নিয়ম বলতে পারি!””

কবির সাহেব মাথাটা হালকা ঝাকালেন,গভীরসুরে বললেন,,

“” তা কি কি রান্না বলতে পারো শুনি!””

রিপ্তি জ্ঞানীভাব নিয়ে বললো,,

“” এখন বলতে ইচ্ছে করছেনা,বাবা। আরেকদিন শুনাবো।””

রিপ্তি কথা শেষ করে উল্টো পথে হাঁটা ধরতেই কবির সাহেব আদেশিসুর তুললেন,,

“” রান্না পরে শুনাবে ভালো কথা,কিন্তু খাবারটা যে এখনি খেতে হবে!””

রিপ্তি মন খারাপ নিয়ে বসে আছে। সামনে একথালা ভাত। ভাতে আঙুল নাড়তে নাড়তে বাবার দিকে তাকালো,সে কি করে বুঝাবে,পানসে দুপুরে খেতে নেই। খেলে যে গলায় আটকে থাকে,বুকে ভার নামে! তার যে এখন পানসে দুপুরের ঢেউ নেমেছে। কিছু ভালো লাগেনা। কিছুনা! শুধু থেকে থেকে কান্না পায়,কেন পায় জানে না। তবে সে কান্নার অশ্রু ঝরেনা। ব্যথারা ঝরে!

~~~

“” তোর মাথার নাকি একটা তার ছিড়ে গিয়েছে?””

আকস্মিক কারো কন্ঠ পেয়ে রিপ্তি জানালার শিকের সাথে বারি খেলো। ছোট্ট আহত শিষ ছেড়ে পেছনে তাকালো। তৃণা এসেছে। এক হাতে পেয়ারা আরেকহাতে লবণমরিচের গুড়ো। তৃণা রিপ্তির পাশে হাত-পা মেলে মেঝেতে বসে পড়লো। রিপ্তির মুখের দিকে সরুচোখে তাকিয়ে বললো,,

“” এই সন্ধ্যাবেলা ঘুমাচ্ছিলি? তাও বসে বসে,জানালায় হেলান দিয়ে? ব্যাপার কি বান্ধুবী? রাতে ঘুম হয়না নাকি?””

রিপ্তি চোখ মুছলো। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললো,,

“” কে বললো ঘুম হয়না? অবশ্যই হয়!””

তৃণা পেয়ারায় লবণ মরিচের গুড়ো মেখে রিপ্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,

“” তুই মিথ্যে বলছিস,তোর চোখের নিচের কালি বলছে তুই শুধু কাল নয়,তার আগের কালগুলোও নির্ঘুৃমে কাটিয়েছিস!””

রিপ্তি ভড়কে গিয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। লুকিয়ে চোখের নিচটা পরিষ্কার করে বললো,,

“” তুই জ্যোতিষী নাকি? চোখ দেখে বুঝে নিচ্ছিস আমার ঘুমের কাহিনি!””

তৃণা মিটিমিটি হেঁসে বললো,,

“” বান্ধুবী সত্যি কইরা কও কার প্রেমে পড়ছো? তোমার মতিগতি সুবিধার লাগছেনা। আর সেটা শুধু আমার না তোমার ভাবীর চোখেও কিন্তু পড়েছে। হাটে কাঁঠাল ভাঙার আগে আমাকে বল,আমি সামলে নিবো। তোকে সাহায্য করবো!””
“” তুই আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাবি। এখনি!””

তৃণা রিপ্তির দিকে ঝুকে এসে বললো,,

“” তোর এই কড়া চাহনি বলছে তুই প্রেমরোগে ব্যাধী। ভাইরাসটা কে? অনুভব ভাইয়া?””

অনুভব নামটা কানে বাজতেই রিপ্তির কড়া চোখ সহজ হয়ে এসেছে। বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ছে। মুখের আবরণে ফুটছে স্নিগ্ধ,কোমলতা! তার মনে হলো সারাদিনের ভালো লাগেনা একঘেয়েমিটা এক নিমিষেই শেষ। তার এখন সব ভালো লাগছে সব। রিপ্তি আচমকা তৃণার হাত থেকে পেয়ারা কেড়ে নিলো। একগাদা লবণমরিচের গুড়ো মেখে দাঁতের শক্ত কামড় বসালো।

“” তারমানে আমার ধারণা ঠিক?””

রিপ্তি পেয়ারা খাওয়া বন্ধ করে বললো,,

“” না। অনুভব লাল ব্যাঙ হতে পারে কিন্তু প্রেমের ভাইরাস নয়!””
“” ওকে তাহলে এখনি প্রমাণ হবে!””
“” কি?””
“” তোর ভাইরাসকারীর নাম!””
“” কিভাবে?””
“” চোখ বন্ধ কর!””
“” কেন?””
“” আগে তো কর!””

রিপ্তি চোখ বন্ধ করলো। মানুষ সাধারণত চোখ বন্ধ করলে কালো আর হলুদ রঙ মিশ্রিত এক অদ্ভুত ধোয়া দেখতে পায়। কিন্তু রিপ্তি শুধু লাল ধোয়া দেখতে পাচ্ছে। চারধারে লালকালো অন্ধকারে সে ডুবে যাচ্ছে। তৃণা বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,,

“” কি দেখতে পাচ্ছিস?””
“” লাল..””
“” লাল ব্যাঙ?””

রিপ্তি চট করে চোখ মেলে বললো,,,

“” তুই জোর করে আমার মধ্যে লাল ব্যাঙকে ঢুকাতে চাচ্ছিস। এই খেলা বাদ।””

তৃণা দ্রুততার সাথে বললো,,

“” আরে না না। ওকে আমি কিছু বলবোনা। তুই বলবি আমি শুনবো!””
“” সিউর?””
“” হুম!””

রিপ্তি আবার চোখ বুঝলো। আগেরবারের থেকে এবার লাল অন্ধকারটা আরো বেশি গাঢ়। রিপ্তির বন্ধ চোখের ভেতরে মনিগুলো নড়ছে। চারপাশ ঘুরছে। ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,,,

“” লাল অন্ধকারে গাঢ় লালের তিল দেখতে পাচ্ছি! তিলটা হাঁসছে,কিন্তু দাঁত দেখা যাচ্ছেনা। চোখও দেখা যাচ্ছেনা। কারণ ও চোখ বন্ধ করে হাঁসছে।””

তৃণা বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,,

“” আর কি দেখতে পাচ্ছিস?””

রিপ্তি কাঁপছে। ওর ঠোঁট কাঁপছে। আচমকা তৃণার একহাত চেপে ধরলো। চোখ বন্ধ করেই বললো,,

“” তিলটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আমাকে খেয়ে ফেলবে। তৃণা ওকে থামা! আমাকে সত্যি সত্যি খেয়ে ফেলবে।””

রিপ্তির কথায় তৃণা ভয় পেয়ে গেলো। সে তো শুধু মজা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু রিপ্তি এগুলো কি ভুলভাল বলছে? তিল কি কখনো হাঁসে? মানুষকে খেতে পারে??? তৃণা ভাবনার মাঝখানেই রিপ্তি অস্পষ্টসুরে বললো,,

“” প্রিয়াঙ্গিনী! রাগিনী! মায়াকন্যা! জোসনাকন্যা! মায়াক্ষী!!!….””

রিপ্তি একের পর এক অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছে। তৃণা ভয়ভয় নিয়ে মৃদুস্বরে রিপ্তিকে ডাকলো। রিপ্তি চোখ মেলছেনা। সে তারমতো শব্দ উচ্চারণে ব্যস্ত। তৃণা হাতের লবণমরিচের গুড়ো ঝেড়ে ফেললো। দুহাতে রিপ্তির কাধ চেপে ধরলো। জোরে ঝাকি দিয়ে চিৎকার করে ডাকলো,,

“” রিপি!””

রিপ্তির চোখ খুলে গিয়েছে। নির্লিপ্তে চেয়ে আছে তৃণার দিকে। মুখে কোনো শব্দ নেই। হাবভাবে মনে হচ্ছে ওর এখানে থাকার কথা না ভুল করে চলে এসেছে!

“” কিরে! এভাবে কি দেখছিস? স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছে?””

তৃণার কথায় রিপ্তি হালকা শিউরে উঠলো। চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। কিছু একটা খুজছে। কিন্তু কি?

তৃণা ঠোঁট টিপে হেঁসে ফিসফিসিয়ে বললো,,,

“” অনুভব ভাইয়া তাহলে সত্যি তোর হৃদয়হরণ করেছে?””

তৃণা এবার শব্দ করে হেঁসে উঠলো। রিপ্তির ভ্রম কেটে গিয়েছে। তবে এখনো কোনো শব্দ আউড়ায়নি। আগের মতোই নিরব আছে। তৃণা মহা উৎসাহ নিয়ে কোমড় থেকে ফোন বের করলো। ফোনের লক খুলতে খুলতে বললো,

“” অনুভব ভাইয়াকে খবরটা জানাতে হবে। এখনি। উফ! আমার তো তর সইছেনা।””

রিপ্তি ছো মেরে ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। কঠিনসুরে বললো,,

“” তুই আমাকে বাবুওয়ালা মেয়েবন্ধু বানানোর জন্য,এভাবে উঠেপরে লেগেছিস কেন? উনার গার্লফ্রেন্ড হওয়া মানেই প্রেগন্যান্ট। নষ্ট শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ছি! উনি এসে আমার হাতে-পায়ে ধরলেও আমি উনার গার্লফ্রেন্ড হবোনা।””
“” ভেবে বলছিস তো?””
“” তুই আমার রুম থেকে যাবি নাকি ধোলাই খাবি?””
“” হাজার প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের মাঝে বন্ধু-বান্ধুবীরাই ধোলাই খায়। আমিও নাহয় একটু খেলাম!””

রিপ্তি দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ বুঝাচ্ছে। এতে তৃণা খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠলো। রিপ্তি আর সহ্য করতে না পেরে ওকে রুম থেকে বের করে দিলো। দরজা আটকাতে নিলে তৃণা বাধা দিচ্ছে। একজন লাগানোর চেষ্টায় আছে আরেকজন খোলার। এই লড়াইয়ের মাঝেই তৃণা বললো,,

“” আমার ব্ল্যাকমেইলিং গিফটটা তাড়াতাড়ি পাঠাস নাহলে তোর হৃদয়হরণকারীর বিয়ে হবেনা!””

~~~

কোনোপ্রকার সাজসজ্জা ছাড়াই রিপ্তি নবীনবরণে উপস্থিত। সাথে বাবাও এসেছেন। তবে বাবা এই মুহুর্তে তার সাথে নেই। কোনো জরুরী কাজে অন্যত্র গিয়েছেন। নবীনবরণ উপলক্ষে বেশ ভালো সাজানো হয়েছে। গাছের ফুল,কাগজের ফুল,রঙিন কাগজ,বেলুন,কেক কিছুই বাদ পড়েনি। সবকিছুর মাঝে এক তীব্র সুবাস রিপ্তির মাথা ধরে গিয়েছে। তার সামনেই বিশেষ বিশেষ ভাষণ চলছে। সে মাঝামাঝিতে আছে। মাথা নিচু করা। সামনে কি চলছে তা দেখবেনা। কোনো প্রকারেইনা। দেখলেই তার শেষ,সব শেষ!

রিপ্তি অসস্থি আর অস্থিরতায় কুকড়ে যাচ্ছে। যতটা পারছে নিজেকে আড়াল করায় ব্যস্ত। নিশ্বাস আটকে নিচ্ছে। রজনীগন্ধার তীব্র গন্ধ কপালের দুপাশে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করছে। রিপ্তির অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির মাঝেই এক মেয়ে বলে উঠলো,,,

“”নীলশার্ট পড়া যে স্যার,উনি আমাদের ডিপার্টমেন্ট হ্যাড না? ইশ! কন্ঠ শুনেছিস? আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো। আমি তো শুনেছি উনি এখনো অবিবাহিত!””

পাশ থেকে আরেকজন বললো,,

“” হুম,আমিও তাই শুনেছি। উনি আমাদের ক্লাস নিবে তো?””
“” কেন? ক্লাস নিলে কি হবে?””

মেয়েটির কন্ঠ পরিবর্তন হয়ে গেলো। লাজুকভঙ্গিতে বললো,,,

“” তাহলে রোজ রোজ দেখতে পারতাম!””

দুজনের আহ্লাদী কথাবার্তার মাঝেই রিপ্তি গর্জে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছে। চিৎকার করে বললো,,,

“”” গলায় ঝুলে পড়লেই তো হয়,রোজ রোজ কেন? সেকেন্ডে সেকেন্ডে দেখতে পারবে। আমার কাছে এসো,আমি তোমাকে টাই বানিয়ে দিবো। তারপর উনার গলায় বেধে বসে থেকো। উনার কন্ঠে আগুন ঝরবে আর তুমি বসে বসে পুড়বে। যত্তসব! এসব ঢং করতে এখানে ভর্তি হয়েছো? এখনো ক্লাস শুরু হয়নি,এর মাঝেই কে বিবাহিত,কে অবিবাহিত তাই নিয়ে গড়াগড়ি! আশ্চর্যের বাটখারা সব। সর সামনে থেকে আমি বেরোবো!””

মেয়ে দুজন ভয়ে ভয়ে সরে গেলো। পুরো ক্লাসজুড়ে উপস্থিত সকলের চোখগুলো রিপ্তিনামক ঘুর্ণিঝড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো!

রিপ্তি শব্দসহিত জোরে জোরে পা ফেলছে। খোলা আকাশ প্রয়োজন,মুক্ত বাতাস প্রয়োজন। চোখে কি সে কম দেখছে?? সবকিছু এমন ঘোলাটে লাগছে কেন? মাথার যন্ত্রণাটা বেড়েই চলেছে। এই যন্ত্রণা কমাতে হলে তার মাটির ধুলো প্রয়োজন। রিপ্তি প্রাণপণে ছুটছে। যত দুরে যাবে তত রজনীগন্ধার গন্ধটা তাকে ছেড়ে যাবে।

রিপ্তি নাক টেনে গন্ধ শুকলো। না আর গন্ধ লাগছেনা। মাথা ব্যথাটা কমছে। কিন্তু চোখের ঝাপসা ভাবটা এখনো কাটেনি। বাবা কোথায়? এখনো এলোনা যে? বলেছিলো এখানেই থাকবে। রিপ্তির মনে হলো সে হারিয়ে গিয়েছে। যাকে বলে মেলায় হারিয়ে যাওয়া! বাবাকে আর কখনো ফিরে পাবেনা। রিপ্তির গলা ধরে আসছে,চোখগুলোও ভিজলো বুঝি! সে কি চিৎকার করবে?? বাবার কানে ডাক পৌছাবে তো??? রিপ্তির এই দোটানা ভাবনার মাঝে অপরিচিত কন্ঠ,,,

“” এক্সকিউজ মি!””

রিপ্তি পেছন ঘুরলো। ছাই রঙের টি-শার্ট সাথে হলদেটে ভাবের প্যান্ট পড়া। মাথায় চুলের পরিমান অল্প,মুখ গোলাকার,দুগালে হালকা দাড়ির উপস্থিত। রিপ্তি সুক্ষনয়নে ছেলেটিকে পর্যক্ষণ করে বুঝতে পারলো,এই ছেলেকে সে চেনানা। অবশ্য এখানের কাউকেই তার চেনার কথা না!

“” আপনি কি বিবাহিত?””

রিপ্তি অন্যমনস্কতাসহিত মাথা নাড়িয়ে না বুঝাতেই ছেলেটির মুখে হাসি ফুটলো। পাশ থেকে আরো একগাদা ছেলে এসে হাজির। দুটো মেয়েও আছে। চোখের সামনে এমন পালবাহিনি তৈরী হতে রিপ্তি বেশ বিচলিত। মনের অজান্তেই ছোট্ট শব্দ বেরিয়ে এলো,র্যাগিং!

রিপ্তি চুপচাপ ঘুরে দাড়াতে মেয়েটি সামনে এসে দাড়ালো। স্বাভাবিকভাবেই বললো,,

“” তোমার নাম্বারটা দাও তো!””

রিপ্তি কি বলবে বুঝতে পারছেনা। মনে মনে বাবাকে খুজছে। এই মুহুর্তে তার নিজেকে পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা মনে হচ্ছে। যে বাবাকে ছাড়া চলতে পারেনা। খেলতে গিয়ে মার খেয়ে এসে বাবার কাছে অবাধ্যে কান্না করে আর নালিশ করে।

“” তুমি ফেসবুক চালাওতো?””
“” না!””
“” হোয়াটস অ্যাপ!””
“” না!””
“” তাহলে নাম্বার দাও!””
“” আমার ফোন নেই।””

সকলে একে অপরের দিকে তাকালো। তার কথা যে বিশ্বাসযোগ্য নয়,তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। এবার ছেলেটি বললো,,

“” তাহলে ঠিকানা দাও!””

রিপ্তি হা করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলো
তারমাঝেই পেছন থেকে গানের কন্ঠ ভেসে এলো,,,

মার ঝাড়ু মার
ঝাড়ু মেরে ঝেটিয়ে
বিদেয় কর!
যত আছে নোংরা সবি
ঠেঙিয়ে দুর কর!!!

রিপ্তি হাওয়া বেগে পেছন ঘুরলো,অত্যাশ্চর্যিত নিয়ে বললো,,

“” লাল ব্যাঙ! আপনি এখানে??””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here