#মেঘনিবাসী
#Part-2
#Esrat_Jahan
নীলাম্বরে দল বেঁধে পুঞ্জিভূত হয়ে আছে শুভ্র মেঘমল্লার দল। ঊর্ধ্বগগনে রাতের অন্ধকার আরেকটু ঘনীভূত হতেই আকাশে সৃষ্টি হলো প্রলয়ঙ্কারী কৃষ্ণবর্ণ মেঘ। ইতোমধ্যেই ফিনফিনে বাতাস বেশ জোরে বইতে শুরু করেছে। যেন বৃষ্টি নামি নামি করছে। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন রাত দশটা। মেহরাব তীক্ষ্ণ চোখে জানালা দিয়ে বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলো। বন্ধু ইভানের বাসায় এসেছিল দরকারি কাজে। কিন্তু বাইরে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব দেখে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে ডায়াল করল মায়ের নম্বরে। আরিয়ার শরীরটা কয়েকদিন যাবৎ অসুস্থ। প্রেশার ফল করেছে। দু’বার রিং হয়ে কেটে গেলো। মেহরাব আবারও ডায়াল করলো, ওপাশ থেকে নো রেসপন্স! মেহরাব এবার চিন্তিত হয়ে ফোন লাগালো বাড়ির ড্রাইভার মকবুলের নাম্বারে। সেকেন্ড পেরুতেই ওপাশ থেকে মকবুল ফোন রিসিভ করে মেহরাবকে সালাম দিলো। উত্তর দিয়ে মেহরাব ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘মকবুল বলছো?’
‘জে স্যার।’
‘মা কোথায়? ফোন ধরছে না কেন? শরীর ঠিক আছে তো?’
মকবুল গদগদ কন্ঠে বলল, ‘জি স্যার, আম্মা বাসায়ই আছে। শরীর ভালাই আছে আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু আমারে কইছে এহন গাড়ি বাইর করতে। কই জানি যাইবো।’
মেহরাব ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, ‘এত রাতে কোথায় যাবে? কোত্থাও যাওয়া যাবে না। অসুস্থ শরীর নিয়ে এই ওয়েদারে বাইরে বেরোনোর কোনো দরকার নেই।’
মকবুল নিচু স্বরে বলল, ‘আমি সেইটা কইছিলাম স্যার। কিন্তু আম্মা আমারে ধমক মারছে।’
মেহরাব গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ধমক দেওয়ায় তুমিও এত রাতে মা’কে স্টেশনে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছ, এম আই রাইট?’
‘হ স্যার। আম্মার কোন ভাইয়ের মেয়ে না কে জানি ঢাকা আসতাছে, ইস্টিশনে তারেই আনতে যাইতে কইছে।’
বিরক্তিতে চোখদুটো কুঁচকে এলো মেহরাবের। কেউ যদি একা একা যদি চলাচল না-ই করতে পারে তাহলে ঢাকা শহরে আসছে কেন? তারপর মকবুলকে বলল, ‘আচ্ছা, কোথাকার কোন মেয়ে, সে কী একা আসতে পারে না? মা’কে কেন যেতে হবে? তাছাড়া সে যদি না-ই আসতে পারে, তবে তুমি নিজে গিয়েই তো আনতে পারো।’
মকবুল ওর কথার সাথে তাল মিলালো,
‘আমি হেইডাই কইছিলাম স্যার। আম্মা রাজি হয় নাই, তিনি নিজে গিয়ে আনবেন বলে ঠিক করছে। আমি কী করমু?’
মেহরাব বিরক্তির সুরে বলল, ‘দেখি মা’কে ফোনটা পাস করো।’
মকবুল বাধ্য ছেলের মতো উত্তর দিল, ‘জে স্যার। এক্ষুনি দিতাছি৷ খাঁড়ান।’
…..
‘হ্যালো কে?’
চিন্তিতমুখে বসে ছিলো মেহরাব। ফোনের ওপাশ থেকে মায়ের গলা শুনতে পেয়ে ওর সম্বিৎ ফিরে এলো। তারপর গম্ভীর গলায় জবাব দিল,
‘আমি মেহরাব বলছি।’
আরিয়া বলল, ‘ওহ তুই? কোথায় আছিস?’
‘আছি বাইরে কোথাও। তোমাকে বলা যাবে না।’
‘তো ফোন করেছিস কেন?’
মায়ের প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে মেহরাব বলল, ‘তুমি আমার কথা অমান্য করে এত রাতে কার না কার মেয়েকে আনতে স্টেশনে যাচ্ছো? আমি আসার সময় বলে আসি নি সাবধানে থাকবে? কোথাও যাবেনা? কে হয় ওই মেয়ে তোমার? তোমায় কেন যেতে হবে?’
আরিয়া অভিমানী কন্ঠে বলল, ‘তো কী করবো? এত রাতে মেয়েটা বাসা না চিনে আসবে কীভাবে? তুই গিয়ে নিয়ে আয় না-হয়!’
‘আমার ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে। আমি কোথাও যেতে পারবো না৷ আর তুমিও যাবে না। ওই মেয়েকে একা একা আসতে বলে দাও। ভূত-প্রেত তো আর উঠিয়ে নিয়ে যাবে না!’
আরিয়া ছেলের কেয়ারলেস দেখে অবাক হলেন। তারপর ব্যগ্র কন্ঠে বললেন, ‘তুই বললেই সব হবে নাকি? একটা মেয়ে এতদূর থেকে আমার ভরসায় আসছে, আর আমি নিশ্চিন্তে বাসায় বসে থাকবো? আমাকে এতটাই অবিবেচক মনে হয় তোর!’
‘আমি একবার বলে দিয়েছি একা একা তুমি কোথাও যাবে না। তাছাড়া আবহাওয়া ভালো নয়।’
‘একা কোথায়? মকবুলকেও নিয়ে যাচ্ছি।’
মেহরাব এবার তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি কোথাও যাবে না, ব্যস।’
মেহরাবে’র কথা শুনে চুপ করে রইলো আরিয়া তাবাসসুম। তারপর গলা খাকারি দিয়ে তিনি বললেন, ‘তুই সারারাত বাইরে কাটাতে পারিস আর আমি একটা মেয়েকে আনতে স্টেশনে যেতে পারি না? শোন, আমি তোর মা। আমাকে শেখাতে আসবি না কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। তোর কমনসেন্স নেই বলে কী আমিও তোর মতো হয়ে যাব! রাখছি, বাই!’
মেহরাবের কোনো কথা না শুনেই আরিয়া ফোন কেটে দিলো৷ মায়ের কথা শুনে মেহরাবের প্রচন্ড রাগ হলো। এত রাতে বাইরে বেরুনোটা যে কতটা রিস্কি তা মা জানে না। কত শত্রু যে ওর চারপাশে ঘুরঘুর করছে মাকে এটা বলতেও পারবে না সে। যে মা মেহরাবের সঙ্গে কখনো উঁচুস্বরে কথা-ই বলে নি, তিনি আজ কোথাকার কোন মেয়ের জন্য ওকে কত কঠিন কথা শুনিয়ে দিলো! দরজায় প্রচন্ড জোরে একটা লাথি দিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বন্ধু ইভানের বাসা থেকে। পেছনে থেকে ইভান ডাকলো ওকে, কিন্তু মেহরাব তাকালো না। বাড়ি ফিরতে হবে। অসুস্থ মাকে কোথাও যেতে দেওয়া যাবে না। পৃথিবীর সবাই একদিকে, আর মা একদিকে। দ্রুতগতিতে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরলো মেহরাব। গাড়ি থেকে নেমে দারোয়ান সাইদুলকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো তার মা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে মিনিট বিশেক আগে। কথাটা শুনেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো রাগ মেহরাবের মাথায় চেপে বসলো। এই মুহূর্তে ওই মেয়েটাকে সামনে পেলে কপালে দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিতো মেহরাব। যত্তসব উটকো ঝামেলা!
Continue..