#মেঘনিবাসী
#Part-3
#Esrat_Jahan
প্রায় মিনিট পঁচিশ হলো বিভা কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবলভাবে আলোড়িত হচ্ছে স্টেশনের বহির্দেশের বৃক্ষরাজি। শনশন শব্দ তুলে গাছের পাতা বিছিয়ে পড়ছে মাটিতে। রাতের অন্ধকার ক্রমশই ঘন হচ্ছে। দু-একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার পায়তারা করছে। স্টেশন প্রায় খালি। ব্যাগপত্র নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে রইলো বিভা। আরিয়াকে ফোন করেছিল ও, তাঁর আসতে একটু সময় লাগবে। বিভাকে সাবধানে বসে থাকতে বলেছেন। কিন্তু অপরিচিত একটা জায়গায় একা একা বিভার খুব ভয় লাগছে, এখন যদি কেউ ওকে তুলে নিয়ে যায়, কী করবে তাহলে? মনে মনে বিপদের সূরাসমূহ আওড়াচ্ছে ও। ঘুম পাচ্ছে প্রচুর, ইচ্ছে করছে বেঞ্চেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়তে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘুমানো সম্ভব না। বাংলাদেশের মতো একটা দেশে এই কাজটা করতে গেলেই রাতারাতি পাগলের খাতায় নাম ওঠে যাবে ওর। বিভা নিরুপায় চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো আরিয়ার জন্য! এর আগে আরিয়ার সাথে ওর খুব বেশি দেখা হয় নি। দু’বার দেখা হয়েছে, তাও আবার চাচাতো বোনের বিয়েতে। আরিয়া নামক ফুফুটি একদম নরম মনের মানুষ। দারুণ সুন্দরী। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙের সাথে সাথে গলার স্বরটাও ভীষণ মিষ্টি। অথচ অনেকের ধারণা সুন্দরীদের ভোকাল কর্ড কাকে’র মতো হয়। বিভার সাথে যতবারই আরিয়ার দেখা হয়েছে ততবারই তিনি মেহেরকে খুব স্নেহ করেছেন। অদ্ভুত এক কারণে বিভাও খুব পছন্দ করে আরিয়াকে। ভাবনায় মশগুল থাকাকালীনই কারো ডাকে ওর ধ্যান ভাঙে। সামনে তাকাতেই আরিয়া তাবাসসুমের মিষ্টি হাসির মুখটা মেহেরের চোখে ধরা পড়ে। বিভা তাঁকে দেখতে পেয়ে ওঠে দাঁড়ালো। হালকা নীল রঙের শাড়িতে আরিয়াকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছিলো। বিভাকে দেখতে পেয়েই তিনি বুকে জড়িয়ে নিলেন। গদগদ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছিস মা? আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?’
‘আমি ভালো আছি ফুপি। আসতে কোনো সমস্যাই হয়নি।’
আরিয়া শুকনো গলায় বললেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে বসে আছিস না? দেখতো কত দেরি করে ফেললাম। আসার পথে একটা কাজে আটকে পড়েছিলাম।’
‘থাক না ফুপি। শেষ পর্যন্ত যে আসতে পেরেছেন এটাই অনেক। আমি তো ভাবছিলাম আপনি যদি না আসেন তাহলে আমি এখন কী করব! যদি কোনো গুন্ডাপান্ডা তুলে নিয়ে যেত? ঢাকা শহরটা সবসময়ই অদ্ভুত।’
আরিয়া ওর কথা শুনে হেসে ওঠে। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘বাসায় যাবি চল। এগারোটা বেজে গেছে বোধহয়। দেরি হলে আর রক্ষে নেই।’
ভ্রু কুঁচকে বিভা জিজ্ঞেস করে, ‘কেন?’
আরিয়া স্মিত হেসে বলল, ‘যাচ্ছিস তো বাসায়। ক’দিন যাক। সব নিজের চোখে দেখিস। বুঝতে পেরে যাবি।’
বিভা আরকিছু জিজ্ঞেস করলো না। আরিয়াদের নিজস্ব গাড়ি আছে। তিনি ড্রাইভার মকবুলকে ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলতে বলে মেহেরকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসেন। আরিয়ার সাথে খুব বেশি পরিচিত না হলেও বিভা সহজেই তাঁর সাথে মিশে গেছে। ও এরকমই! যার সঙ্গে একবার দেখা হয় অতি সহজেই তাকে আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওর। এটা ওর একটা ভালো গুণ। গাড়ি ছুটে চলেছে ব্যস্ত মহানগরীর পিচঢালা পথ ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির ছাঁটে পাথুরে পথটুকু আরো কালচে দেখাচ্ছে। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বিভার। নিরব-নিস্তব্ধ ঢাকা শহর। চারদিকে অট্টালিকার ন্যায় বাড়িঘর। নানা রঙবেরঙের বাতি জ্বলছে একটা বিল্ডিংয়ের ফোর্থ ফ্লোরে। দেখেই বুঝা যায় এটা কোনো বড়সড় নামি-দামি রেস্টুরেন্ট। সুউচ্চ বিল্ডিংগুলোয় কেমন আভিজাত্যপূর্ণ ছাপ বহন করে চলেছে। বিভা নিভৃতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সামান্য বৃষ্টি হলেও আকাশে কোনো মেঘ দেখা যাচ্ছে না। এত অদ্ভুত কেন আজকের রাতটা? তমসাছন্ন রাত্রির নির্মল আকাশে আজ ফুটিফুটি তারা আছে, কিন্তু চাঁদ নেই। কেন নেই কে জানে?
…………
Continue..