মেঘনিবাসী #Part-4

0
213

#মেঘনিবাসী
#Part-4
#Esrat_Jahan

মেহরাব রাগে ফেটে পড়ছে। পরবর্তীতে নিজেই যেতে চাইলো স্টেশন, রওয়ানা হওয়ার আগে ড্রাইভার মকবুলকে ফোন করে জানতে পারলো মেয়েটাকে নিয়ে ওরা বাসায় ফিরছে। মেহরাবের আসার কোনো দরকার নেই। খবর পেয়ে শান্ত হলো ও। কিন্তু মেয়েটার ওপরও রাগ হচ্ছে অজ্ঞাত কারণেই। অথচ মেয়েটার সাথে ওর পরিচয় নেই। ভারী বিরক্ত মেহরাব নিজেকে শান্ত করতে রুমে এসে শাওয়ার নেওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে ঢুকলো, এতে যদি রাগ কিছুটা কমে। দীর্ঘক্ষণ ধরে শাওয়ার নিয়ে টাওয়াল পরে রুমে চলে এলো। কাবার্ড থেকে পোশাক নিয়ে চেঞ্জ করলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুলগুলোতে ব্রাশ চালিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো। অতঃপর তীক্ষ্ণ চোখে রুমটাকে একবার পরখ করলো। রুমের সবগুলো জানালা বন্ধ। কেমন গুমোট ভাব ছেয়ে আছে। মেহরাব এগিয়ে গিয়ে জানালাটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ছাঁটওয়ালা দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিলো তার সর্বাঙ্গ। চোখদুটো আপনাআপনিই বুজে এলো। নির্মল, শুদ্ধ, পবিত্র হাওয়ায় গা শিরশির করে উঠলো ওর। কপালে ভাঁজ পড়লো মেহরাবের। বৃষ্টি ওর সাংঘাতিক অপছন্দের। জানালাটা খোলা রেখে ডিভানে গিয়ে বসলো ও। অলস ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মেহরাব নিজের ল্যাপটপটা নিয়ে কাজ করতে বসলো। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার হলেও নানাবিধ কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত। কাজের বুয়া কফি তৈরি করে ঘরে দিয়ে গেল। ল্যাপটপের সামনে বসে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে কাজে মগ্ন হয়ে পড়লো ও। তখন বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে ইলশেগুঁড়ি রুপে মাটিতে ঝরে পড়ছে টুপটাপ করে। রাতের নীরবতা ভেদ করে ছন্দপতন ঘটানোয় ব্যস্ত শিশির ঝরানো মুক্তোদানার আদলে গড়া বৃষ্টিরাজি!

আচমকা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ল্যাপটপটা রেখে ফোন হাতে নিলো মেহরাব। ডায়াললিস্ট চেক করে ওর বিশ্বস্ত বন্ধু প্রয়াসের নম্বরে ফোন করলো। ওপাশের ব্যক্তিটি যেন ওরই অপেক্ষায় ছিলো। ফোন রিসিভ করেই বলল, ‘জানতাম তুই ফোন দিবি!’

মেহরাব বাঁকা হেসে বলল, ‘কাজের কথা বল!’

প্রয়াস বিগলিত কন্ঠে বলল, ‘অলরেডি ডান।’

‘সব ইনফরমেশন ঠিকঠাক?’

‘একেবারে খাঁটি খবর। আঙ্কেলের নামে যা যা শুনেছিলাম তার সব কয়টাই সত্যি। যুবক বয়সে তিনি এতোটাও ভালো ছিলেন না, এখন যেমনটা দেখায়!’

‘গুড ওয়ার্ক।’

‘থ্যাংকস।’

‘রুপপুর থেকে কখন ফিরলি?’

‘সন্ধ্যার ট্রেনে। বাসায় পৌঁছেছি একটু আগে। খাওয়াদাওয়া সেরেই তোকে ফোন করবো বলে ভাবছিলাম, কো-ইন্সিডেন্সলি তুই নিজেই আমাকে ফোন দিলি।’

‘এটাই জানার ছিল।’

‘কিন্তু আমার অনেককিছু বলার আছে। এতক্ষণ তো অফিশিয়াল কথাবার্তা সারছিলাম, এবার আন-অফিশিয়াল কথাগুলো সেরে নিই?’

মেহরাব ভ্রু কুঁচকালো। তাঁর অতিপ্রিয় বন্ধু যে ভনিতা করে কথা বলছে সেটা ওর সিক্স সেন্থ আগেভাগেই জানান দিচ্ছে। প্রয়াসের এমন ভনিতা করে কথা বলছে মানে কিছুক্ষণের মধ্যেই ও দুনিয়াবি উদ্ভট কথাবার্তা বলা শুরু করবে। যেখানে টপিক হিসেবে থাকবে, কার সাথে কার প্রেম হলো, কার বিয়ে হলো, কোন বন্ধু কয়টা গার্লফ্রেন্ড, নতুন কোন গান রিলিজ হয়েছে, কার মুভিটা হিট করেছে, সালমান খান সিঙ্গেল কেন? এর পেছনে মোটিভ কী? এসব হাবিজাবি। যেসব ব্যাপার ওর মোটেও পছন্দ নয়।। মেহরাব ধমক দিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো, ‘কী বলতে চাস তুই প্রয়াস?’

ধমক শুনে প্রয়াস মিনমিন করে বলল, ‘আরে ব্যাটা সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? তোর গলার এমন স্বর শুনলেই আমার হাঁটু কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায়। একটু আস্তে করে বলবি তো!’

‘তুই বলবি?’

‘বলছি দোস্ত। আজকে ট্রেনে করে ফেরার সময় এক আজব মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো আমার। কী ডেঞ্জারাস রে বাবা! মনে হয়, পাবনা মেন্টাল হসপিটালের প্যাশেন্ট, পালায়া আসছে!’

‘তাহলে আমাকে বলছিস কেন? মেন্টাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ কর, আমি তো ওই হসপিটালে চাকরি করি না।’

‘আরে ভাই, তোর সাথে তো সবই শেয়ার করি। তাই এটাও করলাম।’

মেহরাব প্রয়াসকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তো ওই মেন্টাল পেশেন্ট কী তোর সাথে কিছু করেছে?’

‘আরে না। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম নাম কী, কোথায় যাবেন তখন কিছুই বললো না। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো ট্রেন থেকে নামার সময়।’

মেহরাবের কপালে ভাঁজ পড়লো। জোরালো গলায় বলল, ‘মানে?’

প্রয়াস দম নিয়ে পুরো ঘটনাটা খুলে বললো ওকে। সব শুনে কী রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারলো না মেহরাব। এমন আজব মেয়ে হয়? ফোন ওপাশ থেকে প্রয়াস ওকে চুপ থাকতে দেখে উচ্চস্বরে হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘মজার না ব্যাপারটা?’

‘জানি না। ফোন রাখ।’

এসব ব্যাপারে মেহরাবে’র থেকে এমন রিয়েকশন পাওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রয়াসের ধারণা, এই ছেলেকে যে বিয়ে করবে নিশ্চিত সেই মেয়ে পোড়াকপালী। এত নিরামিষ কোনো ছেলে হয়? একটা মজার কথাতেও তার রিয়েকশন গম্ভীর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রয়াস বলল, ‘ওকে, রাখছি ফোন।’

ফোন কাটার আগে কিছু একটা চিন্তা করে মেহরাব বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘শোন, ওই মেয়েকে পাগলাগারদেই মানায়। দেখা হলে রেখে আসিস ওখানে। নয়তো আমাদের শহরকেও পাগলাগারদ বানিয়ে ফেলবে।’

মেহরাবের কথা শুনে, প্রয়াস অবাকের সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেলো। কী বলছে মেহরাব? স্বয়ং মেহরাব ওই মেয়ের ব্যাপারে কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছে? হাউ ইজ দিস পসিবল? এ পর্যায়ে এসে প্রয়াসের ধারণা হলো, ট্রেনের ওই অপরিচিতা মেয়েটার মধ্যেই কিছু একটা আছে। তার আচার-আচরণের অদ্ভুত ব্যবহার নিয়ে যে-কেউ দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য। কিন্তু, তাই বলে মেহরাব? যে ছেলে কোনোদিনও কাউকে নিয়ে, মেয়েদের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে ভালো-মন্দ আলোচনা করেনি। আর আজ সে, অপরিচিত এক মেয়েকে নিয়ে এরকম কমেন্টস করলো? যাকে ও দেখেওনি! আনবিলিভেবল! বেশিকিছু আর ভাবতে পারলো না প্রয়াস!

(৫)
ছোটখাটো একটা রাজপ্রসাদের সামনে যেন দাঁড়িয়ে আছে বিভা। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি আর ঝিরিঝিরি বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। কোলাহলপূর্ণ এই ঢাকা শহরের বুকে এত সুন্দর একটা বাড়ি থাকতে পারে তা ভাবতেও পারে নি মেহের। বাইরে থেকে দেখেই যদি এত সুন্দর লাগে, তাহলে এর ভেতরটা কেমন হবে? গাড়ি থেকে নামতে নামতে বিভার এমন বিস্মিতরুপ দেখে আরিয়া তাবাসসুম বললেন, ‘ভেতরে চল!’

বিভা বাস্তবে ফিরে আসে। আঁধার ঢাকা এই বর্ষণ রজনীতেও বাড়িটার আভিজাত্যপূর্ণ ছাপ ফুটে ওঠেছে কৃত্রিম আলোক বাতি’র দৌলতে। সুসজ্জিত বাগান থেকে ভেসে আসছে মনোমুগ্ধকর কামেনী, বেলি ফুলের সুঘ্রাণ। বিভা মুগ্ধ নয়নে সবকিছু দেখতে থাকে। তবে রাত হওয়ায় বেশিকিছু চোখে পড়লো না ওর।

গেইটের সামনে পাহারারত আছে একজন দারোয়ান। আরিয়া বিষন্ন মুখে তাঁকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতেই দারোয়ান মাথা নেড়ে তার উত্তর দিলো। বিমর্ষ ভাবটা কেটে গিয়ে স্বস্তি ফুটলো আরিয়ার চেহারায়। ওদের কথোপকথন বিভা শুনতে পেলো না। বিভাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন আরিয়া। দু’বার কলিংবেল বাজাতেই কাজের মেয়ে লুবনা এসে দরজা খুলে দিলো। বাড়ির সবাই ঘুমে বিভোর থাকায় আরিয়া সবাইকে জাগাতে বারণ করলো। আর বিভা ক্লান্ত থাকায় তিনি ওকে সোফায় বসে বিশ্রাম করতে বললেন। ফুফুর নির্দেশ পেয়ে বিভা তাঁর ক্লান্ত দেহখানি নিয়ে ধপ করে বসে পড়লো সোফায়। দু-চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে ওর। বুয়া শরবত নিয়ে এলো ওদের জন্য। আরিয়া বুয়াকে বললেন বিভার জিনিসপত্র সব নিয়ে ওর জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটাতে রাখতে। লুবনা তাঁর নির্দেশ মোতাবেক বিভার জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেলো। আরিয়া এবার লুবনার দিকে ফিরলেন। মেয়েটির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া হলো তাঁর। সারা সন্ধ্যার জার্নিতে শরীর ভেঙ্গে গেছে। আরিয়া ডাকলো, ‘বিভা মা? ক্লান্ত লাগছে খুব?’

বিভা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘একটু।’

‘তবে তুই হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে যা। তারপর ঘুমিয়ে পড়।’

‘আমি খাবো না ফুপি। পেট ভরা।’

আরিয়া কপট রাগ নিয়ে বললেন, ‘তা বললে তো চলবে না! আমার বাসায় এসেছিস আর বলছিস খাবি না? টালবাহানা না করে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আয় বলছি!’

‘সত্যি বলছি ফুপি। ট্রেনে এতকিছু খেয়েছি যে এখন আর ইচ্ছা করছে না। প্লিজ জোর করবেন না, আমার খুব ঘুম পেয়েছে। একটু ঘুমাতে চাই!’

আরিয়া অভিমান করলো। কিন্তু জোরাজুরি করেও বিভাকে খাওয়ানোর জন্য রাজি করানো গেলো না। অগত্যা তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। বিভা বাড়ির কোনোকিছু ঠিকঠাক চেনে না। আরিয়া ওকে রুমে পৌঁছে দিলেন। তখন রাত সাড়ে বারোটা। বিভা কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হঠাৎ করে এত ঘুম কোথা থেকে আসলো কে জানে! ঘুমাতে গিয়ে ওর মনে হলো মায়ের কথা। বাড়িতে ফোন দিয়ে জানানো দরকার যে ও ঠিকঠাক পৌঁছাতে পেরেছে। তড়িঘড়ি করে ফোন বের করে রুবাইদাকে ফোন লাগালো। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির রুবাইদা মেয়ের ফোন রিসিভ করেই নিশ্চিন্ত হলেন।। যাক, সুস্থভাবে পৌঁছাতে পেরেছে এতেই আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। মায়ের সঙ্গে অল্প কথা বলে ফোন রেখে আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দিলো বিভা। তখনই মনে পড়লো আরিয়ার ছেলের কথা। একটাই ছেলে তাঁর। বিভা কোনোদিনও দেখে নি তাকে, না ওর সম্বন্ধে বেশিকিছু জানে। তবে সে শুনেছে আরিয়ার ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টে পড়াশোনা করেছে, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। দেখতেও নাকি সুদর্শন। একবার দেখলেই নাকি ‘প্রেমে পড়া’ টাইপ ফিল আসে।
আত্মীয়দের মতে, এই ছেলের যেমন রাজপুত্রের মতো চেহারা, তেমনি বিভিন্ন কাজে পারদর্শী। বড় বড় লোকজনদের সাথে তার উঠাবসা, কাজকর্ম। তবে এই ছেলে নাকি ফ্যামিলি গ্যাদারিং পছন্দ করে না। রাগ হলে নাকি তুলকালাম কান্ড ঘটায় সে। বিভা মনে মনে ভাবে, এই ছেলে ভীষণ ইন্টারেস্টিং পার্সন বটে। একই বাড়িতে যখন থাকবে, তখন দেখাসাক্ষাৎও নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। না হলেও ক্ষতি নেই। তাতে বিভার কিছু যায়-আসে না। অতিরিক্ত সুদর্শন ছেলেদের প্রতি এলার্জি আছে ওর। এদের থেকে দূরে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয় বিভার। বাইরে তখন প্রগাঢ় হয় মধ্যরাতের অঝোর ধারায় বর্ষর্ণের সুর। বৃষ্টির মনোমুগ্ধকর রুমঝুম শব্দ শুনতে শুনতে বিভার চোখে এসে ভর করে তন্দ্রা। একসময় ঘুমের আবেশে ডুবে যায় সে!

Continue..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here