#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৪)
“” আমার স্ত্রী!””
রিপ্তি হাওয়াবেগে ডানপাশে ঘুরলো। পলকহীনভাবে চেয়ে আছে সামনে থাকা মানুষটির দিকে। কতযুগ পরে দেখা পেলো এই মানুষটাকে?? শতাব্দিও কি পেরিয়ে গিয়েছিলে? রিপ্তি অদ্ভুত উত্তেজনায় সামনে পা ফেলছে। এইতো আর কয়েককদম ফেললেই অনুভবের মুখোমুখি হবে। চোখে চোখ রেখে বলবে,কোথায় ছিলেন লাল ব্যাঙ?
অনুভবের সামনে থাকা নার্সটি ভরাট গলায় বললো,,
“” আপনার মেয়ে হয়েছে।””
বাচ্চাটিকে অনুভবের দিকে ধরে আছে। মায়া দৃষ্টি নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকা শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে অনুভব। হাতদুটো উচু করতে চেয়েও পারছেনা। এক অজানা ভয়ে শরীরজুরে শিরশির অনুভব হচ্ছে। কিন্তু কেন? এমন তো নয়,এই প্রথম কোনো বাচ্চাকে কোলে নিচ্ছে। তাহলে? নার্সটি নরমসুরে বললো,,
“” এটা বুঝি আপনাদের প্রথম সন্তান?””
অনুভব এক পলক তাকালো সাদা শাড়ী পরিহিতা মাঝ বয়সী মহিলাটির দিকে। আনমনে মাথা নিচু করে বললো,,
“” হুম।””
“” এই জন্যই কোলে নিতে ভয় পাচ্ছেন। এতো ভয়ের কিছু নেই। নিন,ধরুন!””
কাঁপা কাঁপা হাতদুটো দিয়ে বাচ্চাটিকে আকড়ে ধরে অনুভব। বুকের সাথে এমনভাবে মিশিয়ে নিচ্ছে যে মনে হচ্ছে,বুক থেকে একটু আলাদা হলেই বাচ্চাটি টুপ করে পড়ে যাবে। বাচ্চাটির দিকে স্নেহদৃষ্টি রেখে বললো,,
“” লিনা কেমন আছে?””
সাথে সাথে পাশ থেকে আরেকটা মৃদু সুর ভেসে এলো,,
“” লিনা!””
অনুভব মাথা ঘুরে তাকিয়েই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। অকল্পনীয় কিছু ঘটে গিয়েছে এমনভাবে চেয়ে আছে। অবাকরাঙা চোখদুটির স্থির দৃষ্টি। বিস্ময় নিয়ে বললো,,
“” রিপ্তি!””
রিপ্তির ক্লান্ত চাহনি অনুভবের বুকের সাথে ল্যাপ্টে থাকা শিশুটির উপর। পা দুটো মেঝের সাথে আটকে আছে।হাঁটতে পারছেনা সে। অথচ আর দুকদম এগুলোই অনুভবকে ছুতে পারবে। হাত বাড়িয়ে! চোখ সরিয়ে অনুভবের দিকেও রাখতে পারছেনা। তার বুঝি এই দুনিয়ার সকল শক্তি হারিয়ে গিয়েছে। নিস্ব সে। এই দুনিয়াবি শক্তিছাড়া সে বেঁচে আছে কেন? আসলেই কি বেঁচে আছে? রিপ্তি কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছেনা। কন্ঠনালীটা বিমুখ করে আছে। তবুও সে বহু কসরৎ চালাচ্ছে কিছু বলার জন্য। গলা ছিড়ে যাওয়া উপক্রম হলেও কিছু বলতে পারলোনা। চলছে অন্তর্মনের কথা,, তারমানে সেই ভুলটা অনিচ্ছাতে নয়,ইচ্ছে করেই করেছিলেন? যা ইচ্ছে করে করা হয় তাকে তো ভুল বলে সম্বোধন করা যায় না। তাকে বলতে হয় অন্যায়। আমার বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেটাকে আপনি একটি অন্যায়ঘেরা সন্ধ্যা বানিয়ে দিলেন,লাল ব্যাঙ?
রিপ্তির মাথা ঘুরাচ্ছে,পেটের ভেতরের সকল যান্ত্রিকগুলো যেন একে অপরের সাথে যুদ্ধে লড়ছে। অশ্রুভেজা চোখদুটো হঠাৎ করেই পলক ফেললো। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে যেতে নিবে,তখনি রুবিনা দৌড়ে এলো। শঙ্কিত কন্ঠে বললো,,
“” রিপ্তি! ঠিক আছিস তো?””
“” আমি বাসায় যাবো!””
“” কিন্তু..””
“” প্লিজ!””
খানিকটা অনাগ্রহ নিয়েই রিপ্তিকে নিয়ে হাঁটা ধরেছে রুবিনা। রিপ্তিও ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। দুজনের পায়ের দ্রুত চাপ পড়ছে সাদা মসৃণ টাইলসের উপর। অনুভব তখনো ধাক্কা আর অবাকটাকে সামলিয়ে উঠতে পারেনি। রিপ্তির চলে যাওয়ার পানেই গভীরদৃষ্টি। যা রিপ্তিকে ফেলে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। তখনি নার্সের গলা,,
“” আপনার ওয়াইফ আপনাকে ডাকছেন।””
অনুভবের হুশ এলো। সাথে সাথেই ব্যাকুল হয়ে পিছু ডাকছে,,
“” রিপ্তি,দাড়াও। রিপ্তি!””
অনুভব দৌড়োবে নাকি দাড়িয়েই থাকবে বুঝে উঠতে পারছেনা। এতোগুলো মাস পর এক পলকের দেখাতে তার সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। খরস্রোত বয়ছে আপাদমস্তকে। কি করা উচিত,কোনো কুল কিনারায় পাচ্ছে না। নির্বোধের মতো দাড়িয়ে চিৎকার করে শুধু ডেকেই চলেছে। অবশেষে যখন বোধশক্তি ফিরে এলো বাচ্চাসহই দ্রুত হেঁটে চলেছে। সিড়ি পার হয়ে নিচে এসে শূন্যহারা হয়ে গেলো। কোথাও রিপ্তির চিহ্ন নেই। তবে কি সে ভুল দেখলো? কিন্তু এতোটা ভুল কি করে হতে পারে? সে স্পষ্ট রিপ্তির ক্লান্তমাখা চোখদুটো দেখেছে। কন্ঠধ্বনি পেয়েছে। খুব কাছ থেকে। অনুভব অতিশয় উৎকন্ঠা হয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো। চোখের দৃষ্টি চারপাশে ঠেকছে। অস্থির নয়নদুটি শুধু রিপ্তিকেই খুজছে। কিন্তু কোথায় সে? কোথায় হারিয়ে গেলো??
~~~
দীর্ঘদিন ধরেই সকালের চুলোটা রিপ্তি ধরাচ্ছিলো। আজ হঠাৎ চুলোয় আগুন না দেখে চিন্তায় পড়ে যায় মিন্মি। চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নিজেই চুলোয় আগুন ধরিয়েছে। হাড়িতে তিন কাপ পানি ঢেলে দিয়ে সাথে লবণ মিশিয়ে দিলো। পানি সিদ্ধ হতে হতে আটার কৌটোটা নিচে নামিয়ে রাখে,রুটি বানানোর পিড়ি বেলুনগুলো ভালো করে ধুতে থাকে। সবশেষে সিদ্ধপানিতে আটা ঢেলে নাড়তে লাগলো।
ঘন্টাখানিকের মধ্যে সকালের নাস্তা গুছিয়ে ফেলে মিন্মি। সময় এখন আট’টা। রাসেল একটু পরই বের হবে। কোচিং খুলেছে সে। এক মাস পার হতে চললো। কোচিংয়ের মাঝেই মাস্টার্স শেষ করে একটা ভালো চাকরির খোঁজ লাগাবে। সংসারের কর্তা তো এখন সে’ই!রিপ্তিরও এতক্ষণে বের হয়ে যাওয়ার কথা। রোজ তো আট’টা নাগাদই বের হয়। এখনো ঘুমুচ্ছে নাকি? ভাস্যমান প্রশ্নটির সাথেই মনের ভেতর থেকে অজান্তেই আরেকটা প্রশ্ন চলে আসে,রিপ্তির শরীরটা ভালো তো?
মিন্মি আর সময় নষ্ট করেনি সোজা রিপ্তির রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। কাল বাসায় আসার পর থেকে মেয়েটা রুম থেকে তেমন বের হয়নি। রাতে জোর করে দু’দলা ভাত খায়িয়ে দিয়েছিলো মিন্মি। এ কয়দিন তো বেশ ছিলো,হঠাৎ কি হলো? না চাইতেও মিন্মির মনের ভেতর কুচিন্তারা উকি দিচ্ছে। জড়ো হচ্ছে নানা অজানা আসঙ্কিত দুশ্চিন্তা। একেই হয়তো বলে মায়ের মন!
দরজায় ছোট্ট বারি মারতেই পাল্লা খোলে গেলো। ভেতরে কেউ নেই। পুরো রুমটা গুছানো। খুব যত্নসহিত গুছিয়ে রাখা হয়েছে সবকিছু। রিপ্তি সবসময় আশেপাশের জিনিসকে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে কিন্তু আজকেরটা খুব বেশিই যত্ন করা। যেমনটা কেউ দীর্ঘদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে গেলে গুছিয়ে রেখে যায়। মিন্মির মনের কুচিন্তারা এবার জোরালোভাবে বয়ছে। দ্রুতকদমে ভেতরে ঢুকে আশেপাশে খোঁজ করছে রিপ্তির। কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেলোনা তখন বাইরে ছুটলো। দরজা ছেড়ে বাইরে পা ফেলবে তখনি নজর আটকালো বিছানার উপর। একদম মাঝ বরাবর একটি বালিশ রাখা। যার নিচ দিয়ে এক টুকরো কাগজ বেরিয়ে আছে। মিন্মি ব্যগ্রভঙ্গিমায় কাগজটি তুলে নিলো।
**প্রিয়
মিন্মি মা
খুব অবাক হয়েছো তাইনা ভাবী? হবেই তো। অবাক হওয়ার কান্ড ঘটালে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। তুমি কি খেয়াল করেছো তোমাকে আমি মা বলে সম্বোধন করেছি? যদি না করে থাকো তাহলে এবার করো,এই আমি আবার ডাকলাম,মিন্মি মা!
আমি মা হারা সন্তান ছিলাম। কিন্তু এখন নেই। ‘মা’ নামক এই ছোট্ট শব্দটাতে যে কত অজস্র অনুভূতি লুকিয়ে থাকে তা শুধু সেই জানে যার মা নেই। আমিও জানি। বাবা নিশ্চয় তোমাকে বলেছে,আমি ছোটবেলা আম্মু এনে দেওয়ার বায়না ধরতাম? তখন তো বুঝিনি আমার এই আবদার বাবাকে কত কষ্ট দিতো। যখন বুঝতে পারলাম তখন তুমি চলে এলে। আমার বাবা তোমায় এনেছে। ভাইয়ার বউ হয়ে আসলেও আমি জানি,বাবা তোমাকে আমার জন্য এনেছিলো। আমার মা রূপে! বাবার সব সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক হয়। কোনো সমস্যা সমাধান বাচ-বিচার না করে চট জলদি সিদ্ধান্তে চলে যায়না। উনার এক কথা,সব থেকে ভালো সমাধান পেতে হলে খুটিয়ে,সময় নিয়ে,বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে হয়। তাহলে এবার কেন তা করেনি? আমাকে এতো বড় সমস্যার মধ্যে রেখেই কেন চলে গেলেন? এতো অল্প সময়ে কি করে সমাধান খুজে নিলেন? যে সমাধানের মানে আমি বুঝতেই পারছিনা! আমার কি বাবাকে স্বার্থপর বলা উচিত?
বাবা সবসময় বলতেন,আমি খুব বুদ্ধীমতী মেয়ে কিন্তু বুদ্ধীর ব্যবহার করিনা বলে মস্তিষ্কে মরিচা পড়ে গিয়েছে তাই বোকা বোকা কাজ করি। এবারও কি বোকা কাজটাই করেছি? নাকি বুদ্ধীর ব্যবহার করেছি? যেটাই হোক না কেন,সমস্যার সমাধান তো আমি বের করবোই। তারজন্যই আমায় বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। মিন্মি মা! আমাকে তুমি সাহায্য করবেনা? আমার পাশে থাকবেনা? তোমার কাছে আমার তেমন কোনো চাওয়া নেই,শুধু এইটুকুই আবদার ভাইয়াকে সামলে নিও। আমি যা করছি আমার বাবার সম্মান বাঁচাতে। তারজন্য তো ভাইয়ারও আমার পাশে থাকা উচিত তাইনা বলো? নিশ্চয় থাকবে। আমি জানি আমার ভাইয়া আমাকে খুব ভালোবাসে,বাবার মতো!
পাপ করেছি,অনেক বড় পাপ। পাপ মোচন করে আমি আবার আমার মিন্মি মা,বাবার সমতুল্য ভাইয়ের কাছে ফিরে আসবো। দু’হাত ভরে তোমাদের স্নেহ,মমতা,ভাললবাসা কুড়িয়ে নিবো। ততদিন তোমরা আমার অপেক্ষায় থেকো। কথা দিচ্ছি,আমি ভালো থাকবো,সুস্থ থাকবো। যদি মনে হয়,ভালো থাকতে পারছিনা তখন তোমাদের ডেকে নিবো!
ভালো থেকো
তোমার হঠাৎ পাওয়া রিপ্তি মেয়ে
পুনশ্চঃ
১.মায়ের বোরকা আর তোমার কাছে থাকা আমার মোবাইলটা নিয়ে যাচ্ছি।
২.না বলে চলে আসার জন্য ক্ষমাপার্থী!
৩.আমার এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণপ্রার্থীর থেকে আমাকে আড়াল করার অনুরোধ। তার মুখদর্শনে হয়তো আমি দ্বিতীয় পাপটিও করে ফেলতে পারি। তুমি মা হয়ে নিশ্চয় চাইবেনা তোমার মেয়ে আরো একটি পাপ করুক?
৪.তোমার সাথে আবার যেদিন দেখা হবে,শুধু মা বলে ডাকবো। হয়তো লুকিয়ে রাখা দুটি গোপন কথাও জানাবো! যার একটি বাবা জেনেছেন,এতক্ষণে তুমিও আন্দাজ করতে পেরেছো। অপরটি শুধু তুমি জানবে,বাবা জানতে পারেননি!
~~~
“” বাব্বাহ! রিপ্তি,তুই বোরকাও পড়িস? তোকে তো চেনায় যাচ্ছেনা। পুরো আন্টি লাগছে।””
রুবিনার কথায় সামান্য হাঁসলো রিপ্তি। তবে মুখে কিছু বললোনা। ক্লাস চলছে। ক্লাস চলাকালিন কথা বলাকে সে বেয়াদবী মনে করে। রিপ্তি হাতমোজাটা খুলে লিখা শুরু করেছে। রুবিনা তখনো রিপ্তির দিকেই তাকিয়ে। তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে চমকানোর পর্বটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রথম ঘন্টা পড়তেই রিপ্তি রুবিনার দিকে ঘুরলো। অসহায় গলায় বললো,,
“” আমার হলের একটি সিট লাগবে। সেটা আজই!””
রুবিনা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,,
“” হলের সিট কি মুড়ির মোয়া যে তুই চাইলি আর পেয়ে যাবি? আজকাল তো মোয়াও পাওয়া যায়না রে। ইশ! অনেকদিন হলো মোয়া খাইনা।””
রিপ্তি বিরক্ত হয়ে বললো,,
“” আমি সিরিয়াস। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।””
রুবিনা সন্দেহচোখে তাকাচ্ছে। মনে মনে হিসেব-নিকেশ করে বললো,,
“” পালিয়ে এসেছিস? তোর আশিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবিনা?””
রিপ্তি চোখরাঙিয়ে বললো,,
“”কোনো আশিক নেই।””
“” আশিক ছাড়াই পালিয়েছিস? এটা কেমন পালানো হলো?””
“” হলের সিট কি করে পাবো জানা থাকলে বল নাহলে আমার পাশ থেকে সরে যা!””
এবার রুবিনাও গম্ভীর হয়ে বললো,,
“” এভাবে বললেই কি পাওয়া যায় নাকি? আমি কত চেষ্টা করলাম। লাভের লাভ কিছুই হয়নি উল্টো কতগুলো টাকা জলে গিয়েছে। তবে..””
“” তবে কি?””
“” ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করে দেখতে পারিস। যদি ভাগ্যে লেগে যায় পেয়েও যেতে পারিস।””
“” তোর ভাগ্যে লাগেনি আমার ভাগ্যে লাগবে কিভাবে?””
“” যেভাবে তুই আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসে লেগেছিস!””
রুবিনা শব্দ করে হেঁসে দিলো। যেন সে চুড়ান্ত পর্যায়ের হাঁসির জোকস বলেছে।
~~~
“” তুই যেভাবে সিড়ি পার হচ্ছিস অফিসরুমে যেতে যেতে একমাস লাগবে,রিপ্তি। তোর জন্য আমি একমাস এই সিড়িতে কাটাতে পারবোনা।””
সাথে সাথেই উল্টোদিকে পা বাড়ালো রিপ্তি। চলতি পথে বললো,,
“” তাহলে চল ফেরত যাই।””
রুবিনা দৌড়ে এসে পথ আটকালো রিপ্তির।
“” আরে মজা করছিলাম এতো রাগ করছিস কেন? তোর জন্য একমাস কেন একহাজার বছরও আমি সিড়িতে কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু আমাদের ডিপার্টমেন্টের হ্যাড,মহসিন স্যার তো কাটাবেন না। উনি এখন আছেন নাকি চলে গিয়েছেন কে জানে! চলে গেলে আবেদনটা কার কাছে দিবি?””
রিপ্তির মনটা কুঁকড়িয়ে গেলো। সে জানে মানুষটা এখনো আছে। বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যে তার উপস্থিতির সুবাস। রজনীগন্ধার সুবাস! আর উনি আছেন বলেই রিপ্তি যাবেনা। এই লোকটার কাছে কোনো আবেদন করবে না সে। কখনো না! দরকার হলে রেললাইনে থাকবে,গাছতলায় থাকবে,ফুটপাতে থাকবে তবুও এই লোকটার সামনে আর কখনো মাথা নিচু করবেনা।
হাতের মাঝে থাকা কাগজটা টুকরো টুকরো করে ফেললো রিপ্তি। যেন কত বছরের প্রতিহিংসা ছিড়ে ফেলছে সে। রুবিনা অসহায়ভঙ্গিতে বললো,,
“” অ্যাপ্লিকেশনটা লিখতে কত্ত খাটনি করতে হয়েছিলো রিপ্তি,তুই এভাবে ছিড়ে ফেললি? আমারতো মনে হলো তুই আমাকে ছিড়ে ফেলেছিস। তোর একটুও মায়া লাগলো না?””
রিপ্তি বিনাবাক্যে হাঁটা শুরু করেছে। মাথার ভেতরটা ঝিন ধরে আছে তার। এভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। এখন কোথায় যাবে? রিপ্তি মনে মনে বিড়বিড় করলো,বাবা! আমি আবারও বোকার মতো কাজ করেছি!
“” আপনাদের মধ্যে রিপ্তি কে?””
রিপ্তি চট করে চোখ খুললো। চল্লিশ/পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি লোক দাড়িয়ে আছে। লোকটাকে চেনাচেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছে তা মনে করতে পারছেনা সে। রিপ্তির মনের সন্দেহ দুর করতেই হয়তো রুবিনা কথা বললো,,
“” জমিল মামা যে? কি খবর? কেমন আছো?””
লোকটি জবাব দেওয়ার আগেই রিপ্তি ফিসফিসিয়ে বললো,,
“” উনি তোর মামা লাগেন?””
রুবিনা মুখভর্তি হাঁসি নিয়ে বললো,,
“” আরে উনি হলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের দপ্তরিমামা। আমি জমিলমামা বলে ডাকি।””
“” ওহ!””
রুবিনা রিপ্তির দিকে ইশারা করে বললো,,
“” ওর নাম মিন্মি। কি হয়েছে মামা?””
লোকটি কোনো কথায় জড়ালোনা। সরাসরি এক টুকরো কাগজ এগিয়ে ধরেছে রিপ্তির দিকে। বেশ সংশয় নিয়েই কাগজটা নিলো রিপ্তি। চোখ বুলাতেই দেখতে পেলো কাগজটিতে,ক্রমানুসারে হলের নাম,রুম নং,সিটনংসহ আরো বিভিন্ন ধরনের তথ্য দেওয়া। এতোকিছু পড়ার প্রয়োজন মনে করলোনা রিপ্তি। কাগজে চোখ রেখেই রুবিনার উদ্দেশ্যে বললো,,
“” কলমটা দে তো।””
রুবিনাও বাধ্য মেয়ের মতো ব্যাগ থেকে কলম বের করলো। রিপ্তি কাগজটা উল্টিয়ে খচখচ করে লিখছে,,
Ans: I love you
=আমি তোমাকে ভালোবাসি।
লেখা শেষ করেই কাগজটা দপ্তরির হাতে ধরিয়ে বললো,,
“”এইটা আপনার স্যারকে দিবেন।””
লোকটির বোধহয় ভিষণ তাড়া ছিলো। কাগজ নিয়েই ফিরতিপথে হাঁটা ধরেছে। এতোক্ষণ মুখ বন্ধ করে চুপচাপ সবকিছুই দেখছিলো রুবিনা। এবার মুখ খুললো,,
“” এটা কি হলো? আমি তো আগাগোড়া কিছুই বুঝলাম না।””
রিপ্তি সামান্য হাঁসলো। মুখের নেকাপটা বেধে নিয়ে বললো,,
“” বলার ইচ্ছে নেই তবুও বলছি। শোন!””
রুবিনা বেশ আগ্রহ নিয়ে রিপ্তির পাশে হাঁটছে। রিপ্তি চোখটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ করে বললো,,
“” আমি যখন জেএসসি দিলাম তখন আমাদের স্কুলে একজন স্যার নিয়োগ দেওয়া হয়। উনি আমাদের ইংলিশ পড়াতেন। খুব ভালো পড়াতেন। রসিকতাও করতেন। সকলে তার রসিকতার ফাঁদে পড়ে উনার কাছে প্রাইভেট পড়তে শুরু করলো। একমাত্র আমি বাদে। একমাস পরেই আমাদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা হলো। সকলে পাস আর আমি ফেল! তাই আমিও বই-খাতা নিয়ে ছুটে গেলাম প্রাইভেট পড়তে। প্রথমদিনই উনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ভয়ে ভয়ে উনার সামনে যেতেই বললেন,ট্রান্সলেট করো!
আমি বললামঃকি?
উনি বললেনঃআমি মনে মনে যে সেন্টেন্সটা বললাম ঐটার বাংলা ট্রান্সলেট করো নাহলে তোমাকে আমি পড়াবোনা।
কারো মনে মনে বলা বাক্য কি আমি শুনতে পারবো? শুনতে পারলে তো চেষ্টা করে দেখতে পারতাম পারি কিনা। আমি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,পারিনা। উনি হাঁসলেন সাথে প্রাইভেটে উপস্থিত থাকা সকলেই হেঁসে দিলো। লজ্জায় আমার চোখ থেকে পানি ঝরলো!””
রিপ্তি থেমে গিয়েছে আর কিছু বলছেনা দেখে রুবিনা বললো,,
“” তারপর?””
“” তারপর উনার টেবিলে থাকা ফুলদানি থেকে রজনীগন্ধা ফুলটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,তোমার স্পেশাল ট্রেইনিং হবে। যাতে করে মনের কথা বুঝতে পারো। নানি কে বলে দিও,কাল থেকে আমি রোজ সন্ধ্যায় তোমাকে পড়াতে আসবো!””
“” তারপর?””
রিপ্তি আবার নিরব। ধীরপায়ে হাঁটছে। রুবিনা বুঝে গেলো গল্পটা আর গড়াবেনা। তাই শুরু থেকে শেষটা নিয়ে ভাবনায় ডুব দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বললো,,
“” তারমানে তোর প্রাইভেট টিউটরের মনের বাক্যটার ট্রান্সলেশন করলি? আই মিন উনি তোকে মনে মনে পছন্দ করতো?””
রিপ্তি কোনো উত্তর দিলোনা। রুবিনা পুনরায় বললো,,
“” কিন্তু তুই কি করে বুঝলি এই কাগজটা তোর প্রাইভেট টিউটর দিয়েছিলো?””
“” হাতের লেখা দেখে।””
“” কিন্তু কে সে?””
রিপ্তি ফিসফিস করে বললো,,
“”মহসীন স্যার!””
চলবে