#ভালোবাসায়_ভেজায়_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১০)
“” এ্যাবোরশন? তোমার ভাবনা এতোদুর কি করে গেলো,লিনা? আবার কান্না করছো কেন? লিনা প্লিজ কেঁদোনা,আমি বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো। আমি তো আছি। আমার উপর একটু ভরসা রাখো। আমি বেঁচে থাকতে আমার বংশের প্রথম আলো আমি কিছুতেই নিভতে দিবোনা। তুমি একটু ধৈর্য্য ধরো,আমি কিছুদিনের মধ্যে….””
“” আউচ!””
ব্যথাতুর শিষে অনুভব পেছন ঘুরলো। রিপ্তি উপুত হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। চোখ ছলছল,মুখ বেদনার্ত,হাতের কনুই রক্তাক্ত!
অনুভব কানে থাকা ফোনটা মুখের সামনে এনে ফিসফিস করে বললো,,
“” আমি পরে কল করছি, লিনা!””
ওপাশের মেয়েটি তার কথা শুনেছে নাকি কে জানে? পুরোকথা শেষ হওয়ার রেশ না কাটিয়েই পকেটে ফোন ঢুকালো। ঘন পা ফেলে রিপ্তির দিকে এগিয়ে এসেছে। মুখে উদ্বিগ্ন আর ব্যথাহত নিয়ে রিপ্তির হাত স্পর্শে করতে গেলে রিপ্তি হাত সরিয়ে নেয়। ধীরস্থিরে উঠে দাড়িয়ে বার কয়েক ফু দিলো নিজের ক্ষতস্থানে। অনুভব কিছু বলবে তার আগেই রিপ্তি বলে উঠলো,,
“” দুঃখিত,এতোরাতে আপনার রুমে আসার জন্য!””
রিপ্তির নরমসুর অনুভবের ভেতরটায় ধোয়া উঠিয়ে দিচ্ছে। যে মেয়েটার কথায় সবসময় বিরক্ত আর রাগ ঝরে সেই মেয়েটার কন্ঠ আজ এতো নিভু কেন? চোখে,মুখে বিষাদের ছায়া অনুভব মানতে পারছেনা। রিপ্তির লালরাগ যে তার অভ্যাস!
রিপ্তির ইচ্ছে হলো অনুভবকে একটু আড়চোখে দেখার। কিন্তু চাওয়াটা অপাওয়াতেই রয়ে গেলো। মাথা নিচু করে অনুভবের রুম ছাড়ছে।
~~~
সকালের নাস্তা বানানোতে বেশ ব্যস্ত মিন্মি। রুটি বেলায় পটু মেয়েটি আজ রুটি বানাচ্ছে মানচিত্রের মতো। এটা কি ভাবা যায়? মিন্মিও ভাবতে পারছেনা। আাধঘন্টা ধরে সে একটা রুটিই বানাচ্ছে। কখনো বাংলাদেশের মানচিত্র,কখনো ভারতের মানচিত্র কখনো বা আফ্রিকার মানচিত্র! বাবাকে মানচিত্র খাওয়াবে ভাবতেই মিন্মির পেটে গুড়ুমগুড়ুম শব্দ হচ্ছে। তাই মানচিত্র ভাঙা গড়ায় তার হাত ব্যথায় টনটন।
মেয়ের এমন অকর্মক কান্ডে বিরক্ত আলেয়া বেগম। অতিরিক্ত বিরক্তে তার মুখে থুথু জমে। তবে সে থুথু ফেলতে নারাজ। তাই মুখভর্তি থুথু নিয়ে বললেন,,,
“” সব মানচিত্র বানানো শেষ? অস্ট্রেলিয়ারটা তো এখনো বাকি!””
মায়ের মশকরাতে মিন্মি আহত হলো। কেউ জানুক বা না জানুক মা তো জানে সে কত ভালো রুটি বানাতে পারে?? তবুও কেন এমন তাচ্ছিল্য বাক্য? এই হলো বুড়ো মায়েদের স্বভাব। সন্তানদের একটু ভালোকাজে যেমন আহ্লাদে গদগদ হয়ে পড়েন তেমনি একটু বেকাজে তিরস্কার করতে করতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেন!
মিন্মি নাম না জানা দেশের মানচিত্রটা হাতের তালুতে পিষে নিয়ে বললো,,,
“” মা,তুমি এখান থেকে যাবে?””
“” কেন যাবো? তোর মানচিত্রের মেলায় আমার ঘুরতে বেশ ভালো লাগছে৷ আচ্ছা তুই মানচিত্র বেচাকেনা করতে থাক,আমি বরং তোর শ্বশুড়কে পাউরুটি আর কলা দিয়ে আসি। খালি পেটে মানচিত্র খেলে যদি হজম না হয়??””
মিন্মি মায়ের তাচ্ছিল্য সহ্য করতে পারলোনা। আটার বোলে একজগ পানি ঢেলে উৎসাহে বললো,,,
“” আমি ঠিক করেছি বাবাকে গোল গোল আটার চাপটি খাওয়াবো! মা তাওয়াটা বসাও তো।””
মেয়ের উৎসাহীতে আলেয়া বেগম নিরাশ। বিয়ের পর এই প্রথম ছেলের শ্বশুড় বাড়ি এসেছেন,গোল গোল আটার চাপটি খেতে??
~~~
রিপ্তির ঘুম ভেঙেছে কখন সে জানেনা। সে তো এটাও জানেনা,আদৌ ঘুমিয়েছিলো নাকি?? হয় তো ঘুমিয়েছিলো নাহলে চোখের নিচে ফুলাভাবটা কি করে এলো?? রিপ্তি আয়নার সামনে দাড়িয়েই গভীর ভাবনায় ডুব দিলো। মনে করার চেষ্টা করছে কোনো স্বপ্ন দেখেছি নাকি। তার ধারণা,মানুষ গভীরঘুমে গেলে স্বপ্নে হারায়!
রিপ্তি মাথার ভার কমাতে সকাল সকাল গোসল সেরেছে। একরকম তাজা অনুভূতি নিয়ে খাওয়ার রুমে পা ফেলে থমকে দাড়ালো। বাবার মুখোমুখি বসে আছে অনুভব। পরিপাটি চুল, ছোটছোট দাড়ি, চোখে বিনয়ী,ঠোঁটে সৌজন্যমূলক হাসির রেখার সাথে লাল টি-শার্ট। রিপ্তির এই প্রথম মনে হলো অনুভবকে সুন্দর লাগছে,স্নিগ্ধ শুভ্রতায় লালজ্জা! সবসময়ের লাল রঙটাকে বিরক্ত লাগলেও আজ বেশ কোমল লাগছে। মনে হচ্ছে অনুভব কোনো উপন্যাসের লালকুমার! যার বুকের ভেতর চলে লালজলপ্রবাহ। স্রোতের শিষধ্বনিতে বাজে রোমাঞ্চকর কাব্যকথা!
“” রিপি,দাড়িয়ে পড়লি যে? খেতে আয়।””
মিন্মির আহ্বানিসুরে অনুভবও রিপ্তির দিকে তাকালো। সবসময়ের মতো রিপ্তি এবারও অনুভবের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে চলা মনের ভেতর সুখের কাব্যিক অনুভূতি হঠাৎই বিয়োগান্তক নাটকের মতো বেদনার সুর বেজে উঠলো। রিপ্তি সহজ গলায় বললো,,
“” আমার ক্ষিধে নেই,ভাবী।””
রিপ্তির বাবা কবির হক ঘাড় ঘুরিয়ে চিন্তিতকন্ঠে বললেন,,
“” খাবি না মানে? তোর তো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে রিপ্তি মা। খাবারে অনিহা করা একদম ঠিক নয়!””
রিপ্তি বাবারদিকে করুণদৃষ্টি ছুড়ে নিজের রুমে ফেরত এলো। বাবার কথার অবাধ্য হতে তার একদম ভালো লাগেনা৷ কিন্তু আজ যে তার মনভারাক্রান্ত! খাবার খেলে বিস্বাদ লাগবে।
“” তোর ইচ্ছেকে কোন পিরিন্জায় বন্দী করবো বল তো। তোর ইচ্ছেরা তো গিরগিটিকেও হার মানাবে। এই আছিস,এই নাই,এই ভালো,এই খারাপ!””
মিন্মির হাতে খাবার।
“” আমার সত্যিই খেতে ইচ্ছে করছেনা,ভাবী। তুমি আবার খাবার নিয়ে এলে কেন?””
“” অনিহার কারণটা তো বল!””
হঠাৎ বাবার আগমনে রিপ্তির মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু সে তো নিজেই জানেনা তার মন খারাপের কারণ। বাবার প্রশ্নের কি উত্তর দিবে?””
রিপ্তির বাবা মেয়ের কাছে এগিয়ে এলেন। আদর ঢেলে বললেন,,,
“” কি হলো বল!””
রিপ্তি বাবার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাল্টা প্রশ্ন করলো,,,
“” তোমার প্রিয়ছাত্র এখানে কি করছে,বাবা?””
মেয়ের মুখে হঠাৎ এমন প্রশ্নে তিনি চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,,,
“” সেটা তুই অনুভবকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারিস!””
“” উনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? তুমি বললেই তো পারো।””
খড়কুটোর এক বাসা বাধলাম
বাবুই পাখির মতো
এই হৃদয়ে ভালোবাসা
দিলাম আছে যত
একটা ময়না পাখি সেই বাসায়
পুষি কত ভালোবাসায়
তারে চোখে চোখে রাখি
উইড়া যেন না যায়
আমার পোষা ময়না পাখি!(ছবিরগান)
অনুভবের গানের সুরে রিপ্তি উগ্র হয়ে উঠছে।
“” বাবা,দেখ ঐ লাল ব্যাঙটা আবার আমাকে নিয়ে গান গায়ছে।””
“” লাল ব্যাঙ!””
“” আরে তোমার প্রিয় ছাত্র!””
“” তুই কি অনুভবের কথা বলছিস? কিন্তু আমি তো কোনো গান শুনিনি।””
রিপ্তি ভাবীর উদ্দশ্যে বললো,,,
“” তুমি তো শুনেছো,তাইনা ভাবী?””
রিপ্তির প্রশ্নে মিন্মি মাথা নাড়িয়ে শুনেনি বুঝালো। রিপ্তি সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে পড়তেই অনুভবকে দেখতে পেলো। তার রুমের দরজার কাছের দেয়ালেই পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে। এক পা মেঝেতে আরেক পা দেয়ালে ভর দেওয়া,চোখ বন্ধ,ঠোঁটে সেই চিরচেনা হাঁসি!
রিপ্তি অনুভবকে কিছু বলতে গিয়েও বললোনা। দরজার সামনে দাড়িয়ে বাবা আর ভাবীর উদ্দেশ্যে বললো,,,
“” তোমরা সবাই মিথ্যে বলেছো। তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না,কেউ না!””
রিপ্তি দ্রুত পা ফেলে সদর দরজার দিকে এগুচ্ছে। মিন্মি রিপ্তির পিছ ধরলে অনুভব রহস্যকন্ঠে বললো,,
“” আমার রাগিনীকে আমায় মানাতে দিন,ভাবী!””
মিন্মির কন্ঠে বিস্ময়,,,
“”আপনার রাগিনী?””
চলবে
[আমি একটু অসুস্থ। ভেবেছিলাম আজ দিবোনা। কিন্তু তোমাদের অপেক্ষায় রাখতে আমার খুব খারাপ লাগে তাই ছোট্ট করে দিয়ে দিলাম!]