#হৃদয়ে_রেখো
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)
পর্বসংখ্যা -০৬
কিছু কিছু আকস্মিক ধাক্কা মাঝে মাঝে আমরা নিতে পারি না। অপর পাশের মানুষকে সাজিয়ে বলি মিথ্যাগুলো। আবার প্রবল ভয়ও থাকে যদি সে সত্যটা যেনে যায়। আদ্রিদের সাথে ডিনার শেষে মিলিয়া বাড়িতে আসে। আদ্রিদ তাকে অনেকটা পথ পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু বাসায় এসে ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে বসা মানুষটাকে দেখে তার হাত পা হিম হয়ে যেতে থাকে। অবিশ্বাস্য বিষ্ফোরিত চোখে তাকায়। অবাকের রেশ কাটতেই প্রশ্ন ছোড়ে-
-” ডাক্তার আরিশা আপনি এখানে।
মিলিয়া মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তার মা স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে আরিশার সাথে। মিলিয়া কে দেখে আরিশা চুপ করে উঠে পরে। যেতে যেতে বলে-
-” ফুপ্পি ওর খেয়াল রেখো। মিলিয়া আসি। আল্লাহ হাফেজ।
মিলিয়া কিছুই বুজতে পারছেনা। এই মেয়ে তার মাকে ফুপ্পি কেন ডাকছে। তার তো আরিশা নামের কোন মামাতো বোন ছিলনা। মিলিয়ার এসব আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই উঠে দাঁড়ায় তার মা।
-” মিলিয়া তুমি এত বড় সত্যটা এতো দিন কেন লুকিয়ে ছিলে?
মিলিয়া মায়ের গভীর চাহনী আর শান্ত কন্ঠের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায়। জোড়পূর্বক হেসে যাকেই উল্টো প্রশ্ন করে –
-” মা আসলে ঐ ডাক্তার আরিশা আমাদের বাসায় কি করছিলো? তুমি তাকে চিনো?
-” হ্যা চিনি। ও আমার খালাতো ভাইয়ের মেয়ে।
-” ওহ আচ্ছা আমিও তাই বলি। আমার তো কোন মামার এত বড় মেয়ে নাই সব পুচকো পুচকি।
মিলিয়ার মা বুঝলেন মেয়ে কথা ঘুরাতে চাইছে। এবার উদ্বিগ্ন হয়েই বলে-
-” দেখো মিলিয়া তুমি বুঝতে পারছো ক্যান্সার কতটা ভয়াবহ। তুমিই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। তোমাকে ছাড়া আমি কি করে থাকবো? কেন নিজের প্রতি যত্ন নিলে না? কেন এত অবহেলা করলে নিজেকে?
মিলিয়ার মা কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে উঠলো। মায়ের কান্না মিলিয়ার সহ্য হচ্ছেনা। মায়েরা বুঝি এমনই হয়? বাচ্চাদের অসুখে এমন অবস্থা করেন মনে হয় অসুখটা মায়েদের বেশি পীড়া দিচ্ছে। মিলিয়া নিজেকে শক্ত করে হেসে মাকে দু হাতে পরম মমতায় আগলে নেয়-
-“মা তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? তোমার কি এভাবে কাদা মানায়? লোকে দেখলে কি বলবে? বলবে এত বড় মহিলা বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। কান্না থামাও মা। আমি তোমায় অনেকগুলো চকলেট কিনে দিব।
মিলিয়ার মায়ের কান্নার বেগ আরো বাড়ে। তার মেয়েটা কবে এত বড় হয়ে গেলো? নিজে এমন মর’নব্যাধী বাঁধিয়ে দিব্বি তাকে বাচ্চাদের মত স্বান্তনা দিচ্ছে। যে মেয়ের সামান্য হাত কেটে গেলে সারা বাড়ি মাথায় তুলতো বাপ আর মেয়ে মিলে। সেই মেয়ে আর ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগকেও পাত্তা দিচ্ছে না! স্বামীর কথা মনে উঠতেই মিলিয়ার মা আরো জোরে কেঁদে ওঠে। মেয়েকে শক্ত করে আকড়ে ধরেন। পারবেনা তার এই মেয়েকে হারাতে। মিলিয়া মায়ের কান্নার মাঝেই বলে-
-” জানো মা দুবছর আগে যখন অসুখটা ধরা পরে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিলো। শুধু তোমার কথাই তখন মাথায় আসছিলো। কিন্তু কি করবো বলো তখন ক্যামো থ্যারাপি নিয়েছি সার্জারি করিয়েছি। কিন্তু এখন আবার নতুন করে সংক্রান্ত হয়েছি ক্যান্সারে। তুমি কবে থেকে জানলে?
-” তুই আগেরবার যখন এসেছিলি তখনি আরিশা বলেছে। কিন্তু আমার মন মানতে চাইছিলো না কিছুতেই কি করি বল। আচ্ছা চল এখনি ডাক্তারের কাছে যাবো।
মিলিয়ার মা নাক টেনে কথাগুলো বলে। মিলিয়া মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে-
-‘ এখন আর বিশেষ লাভ হবেনা মা। আরিশাও জানে এটা তবুও সে ক্যামো থ্যারাপি দিতে চাইছে। আমি জানি আমার সময় খুব অল্প এসব থ্যারাপি সার্জারি দিয়ে আমার আর কোন কাজ হবেনা। তাই বলি কি আমায় তোমার সাথে কাটাতে দাও মা কটা দিন।
মিলিয়ার মায়ের মনে আবারো ব্যাথার কিটটা চারা দিয়ে ওঠে। মেয়েকে হারানো তীব্র ভয়ে জাপটে ধরেন মেয়েকে।
-” মা তুমি খেয়েছো?
-” আব হ্যা আরিশার জোড়াজুড়িতে খেয়েছি। চল তোকে খাইয়ে দেই।
-” নাহ মা আমি বাহিরে থেকে ডিনার করেই এসেছি। চলো তাহলে ঘুমিয়ে পড়ি।
-” আজ থেকে তুই আমার সাথেই ঘুমাবি। অন্য রুমে ঘুমাতে দিব না।
মিলিয়া মায়ের বাচ্চাদের মতো কান্ডকারখানায় হেসে দেয়। মাকে নিয়ে চুপচাপ রুমে যায়। তারপর মায়ের পাশে গুটিসুটি দিয়ে চুপটি করে মাকে জড়িয়ে ধরে। মিলিয়ার মা বলে-
-” বলো তুমি কি খাবে? কোথায় ঘূরতে যাবে? কাকে দেখতে মন চাইছে? কি করতে মন চাইছে? আমি তোমার জন্য সবকিছু করবো।
-” মা আপাতত ডেট এ যেতে মন চাইছে পারলে একটা ছেলে নিয়ে আসো।
মিলিয়া দুষ্টুমি করে কথাটা বলে। মিলিয়ার মা অনেক অবাক হয়। এমন সময়ও তার মেয়ে মজা করছে? আশ্চর্য। মিলিয়া মায়ের সাথে অনেক ফ্রি তাই এসব বলতে কোন জড়তা কাজ করেনি।
-” কার ছেলেকে না কার ছেলেকে আনবো পরে তারা তোর মায়ের নামে ছেলে ধরার মা’মলা ঠুকে দিক।
মিলিয়ার মা বাচ্চাদের মতো করে কথাটা বলে। মিলিয়া মায়ের কথায় হু হা করে হেসে দেয়। পরক্ষনেই মনে খারাপ করে বলে-
-” জানো মা আজ আদ্রিদের সাথে দেখা হয়েছিল!
-” তারপর কি হলো?
-” ওর সাথেই ডিনার করেছি। আমায় একগাদা খাইয়ে ছেড়েছে। ছেলেটার জেদ কমলোনা। জানো মা আমি ওকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছিলাম। কিন্তু ও কোন রেসপন্স করেনি। ছোটবেলায় আমরা কত ভালো বন্ধু ছিলাম তাইনা। ও আমাকে ছোট বেলায় খুব পছন্দ করতো। কিন্তু সবকিছু কেন এমন অগোছালো হয়ে গেলো। আসলে আমিই ওকে অনেক পছন্দ করতাম ছোট বেলায়। ও যতটা না আমাকে পছন্দ করতো, তার থেকে বেশি আমিই ওকে পছন্দ করতাম। আদ্রিদ কে আজ পর্যন্ত কখনোই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়তে দেখিনি। আই লাইক হিম।
মিলিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে। মিলিয়ার দীর্ঘশ্বাস তার মায়ের বুকে ছুড়ির মতোই লাগে। মেয়েটা কাউকে ভালোবাসে। সে কি কিছুই করতে পারবেনা মেয়েটার জন্য?
।
সকলে মিলিয়ার মা খুব সতর্ক ভাবে মেয়ের পাশে থেকে উঠে যায়। আস্তে করে বোরকাটা পড়ে নিকাবটা লাগিয়ে বেড়িয়ে যায়। এখান থেকে আদ্রিদের বাসা বেশি দূরে নয়। সে হেঁটে যায়। আদ্রিদের দরজায় গিয়ে কলিংবেল বাজায় তিনবার বাজতেই আদ্রিদ ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খোলে। মিলিয়ার মা কে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি সে। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে মহিলা টা কে? তারপর প্রশ্ন করলো –
-” আপনি কে? ঠিক চিনতে পারলাম না।
মিলিয়ার মা চমকানো না। সে জানে আদ্রিদের এলজাইমার রোগের জন্য মাঝে মাঝেই এমন সব কথাবার্তা বলে সে। হুটহাট কাউকেই চিনতে পারেনা সে। মিলিয়ার মা নিকাবটা খুলে। আদ্রিদের মহিলাটাকে খুব চেনা চেনা লাগলেও মনে পড়ছে না এটা কে? মিলিয়ার মা নিজেই বলে-
-” আমি মিলিয়ার মা আদ্রিদ। চিনতে পেরেছো?
আদ্রিদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মিলিয়ার সাথে হওয়া সবকিছুই সে মনে রাখে কৌশলে। একটু ভাবতেই চিনতে পারলো। অপ্রস্তুত হেসে বলল-
-” আসসালামুয়ালাইকুম আন্টি। এত সকালে আপনি আসতে গেলেন কেন? কোন সমস্যা হয়েছে নাকি? আমায় কল দিতেন। আমিই চলে যেতাম। আপনার আর কষ্ট করে আসা লাগতো না।
মিলিয়ার মা তাকিয়ে আছে।সে সালামের জবাব দেয়-
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম বাবা। তা কি বাহিরেই দাঁড়িয়ে কথা বলবে?
আদ্রিদ সরে দাঁড়ায়। মাথা চুলকে মিলিয়ার মা কে ভিতরে আসতে বলেন। মিলিয়ার মা গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেন। আদ্রিদ চটপট দু কাপ কফি নিয়ে আসে।
-” আরে বাবা আমি কি বলেছি কফি আনতে?
-” না আসলে আন্টি কফি তো আপনার পছন্দের তাই আরকি?
মিলিয়ার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই ছেলেটার পছন্দের কফির কথা মনে আছে অথচ একটু আগে চিনতেই পারছিলো না। সব প্রিয় জিনিস, প্রিয় অভ্যাস, প্রিয় মানুষগুলোই তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ক্রমাগত। কফিতে চুমুক দেয়। আসলেই এত সকালে কি বলতে এসেছে আদ্রিদকে সে? কিছুটা জড়তা নিয়ে আদ্রিদকে বলে-
-” আদ্রিদ আমার মেয়েটা ক্যান্সারে আক্রান্ত।
এই একটা কথা আদ্রিদের কানে যেতেই বজ্রপাত ঘটল তার পৃথিবীতে। কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। তার সাজানো সারা পৃথিবী এক মিনিটের মধ্যেই লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। মাথাটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চারদিকে সব মিথ্যা মনে হচ্ছে।
-” আমার মেয়েটার দু’বছর আগে এই ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। তখন চিকিৎসা নিয়েছিলো কিন্তু এখন আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। আর কোন চিকিৎসায়ও কাজ হবেনা তার।
এটুকু বলেই কেঁদে উঠে মিলিয়ার মা। আদ্রিদ ফাঁকা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি আজ অনুভূতি শূন্য –
-” আমার জানামতে তোমরা একে অপরকে অনেক পছন্দ করো। তুমি কি আমার মেয়েকে গ্রহন করবে?
এটুকু বলেই কাঁদতে কাঁদতে মিলিয়ার মা চলে আসে। আর কিছু বলার শক্তি নেই। আদ্রিদ বুঝতে পারছেনা, মিলিয়া ও তাকে পছন্দ করে এই ব্যাপারটায় তার কি খুশি হওয়া উচিত নাকি মিলিয়ার অসুখের জন্য কষ্ট পাওয়া উচিত? মাথাটা ব্যাথা করছে খুব। পেয়েও হারানোর ভয়টা জেঁকে বসেছে। কি করা উচিত না করা উচিত কিছুই মাথায় আসছেনা। কিন্তু মিলিয়া নামের মেয়েটাকে তার চাইই চাই।
#চলবে