নয়নতারা পর্ব ১৯

0
737

#নয়নতারা
পর্ব ১৯
Suvhan Årag (ছদ্মনাম)
Suvhan Arag’s Storys

মেজর আব্রাহাম মেয়ের বা পাশে এসে মেয়ের হাত ধরে গল্প করতে করতে আসছেন।তারার ডান হাতের সাথে ক্রাচ লাগানো।ক্রাচের ওপর ভর করে অনেকটা খোড়াতে খোঁড়াতে সে হাটছে।বাবা মেয়ে দুজনেই হাসি ঠাট্টা তে ব্যস্ত।

তারার টোল পড়া হাসিটা যেন নাফিজকে আরো বেশি আকর্ষণ করছে।এক অজানা অনুভূতি,অজানা টান,অজানা শুভ্রতা নাফিজের ভেতর তোলপাড় করে দিচ্ছে।নাফিজ শুধু এটাই ভাবছে কি অদ্ভুত নিয়তি,এতো ফুটফুটে একটা মেয়ে দুটো পা আছে ঠিকই কিন্তু ঠিকভাবে চলার ক্ষমতা নেই।

—-বাপি,দেখেছো কতো সিলেবাস বাকি আছে আমার?
—-তাতে কি হয়েছে।আমি তো জানি আমার তারা মা সব খুব দ্রুত শেষ করতে পারবে।
—-কিন্তু পরীক্ষার তো বেশি দিন নেই।
—-আল্লাহ ভরসা মা।আল্লাহ তোকে আজ অবধি কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হতে দেন নি।দেখবি ইনশাহআল্লাহ এবার ও তুই প্রথম হবি ক্লাসে।দেখে নিস।
—-জাযাকাল্লাহ খাইরুন।

আব্রাহাম সাহেব এগিয়ে আসতে আসতে একদম নাফিজের সামনেই চলে আসলেন।আব্রাহাম সাহেবকে দেখেই মারিয়া নাফিজ স্যালুট করলো।

—-স্যার ইনি ক্যাপ্টেন নাফিজ।গতকাল ইউনিটে জয়েন্ট করেছেন।

আব্রাহাম সাহেব মুখে হাসির রেখা টেনে নাফিজের দিকে তাকালেন।ওনার একটা হাত নাফিজের কাধের ওপর রেখে দুটো থাবা দিলেন।

—-শুভ কামনা ক্যাপ্টেন নাফিজ।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অন্যতম গর্ব আপনি।
—-স্যার।
—-অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন আপনারা।চলুন ভেতরে যাওয়া যাক।
—-জি স্যার।
—-তারা মা চলো।

ক্যাপ্টেন নাফিজ নামটা শুনে তারা একবার ভালো করে নাফিজের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল।তারার এই দৃষ্টি নাফিজের চোখ এড়ায়নি।

—-বাপি,ইনিই কি সেই ক্যাপ্টেন নাফিজ?যার কথা তোমার মুখে শুনি।
—-হ্যাঁ মা।ইনিই সেই ক্যাপ্টেন নাফিজ।নাফিজ এটা আমার মেয়ে তারা।

আব্রাহাম সাহেবের কথা শুনে নাফিজ মুচকি হেসে তারার দিকে তাকালো।তারা একবার আব্রাহাম সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার নাফিজের দিকে।তারপর মাথা নিচু করেই তারা সালাম দিল।

—-আসসালামু আলাইকুম।
—-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
—-চলুন।আমরা ভেতরে যাই।

মেজর আব্রাহাম তারা কে নিয়ে ভেতরের দিকে গেলেন।মারিয়া ও পেছনে গেল।নাফিজ এখনো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

“প্রেয়সীর ঘন কালো চুল,টোল পড়া গাল,স্থির দৃষ্টি,সুমধুর কন্ঠ বড়ই বেদনাদায়ক।সুখকর বেদনা।”

দুচোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ক্যাপটা মাথায় দিয়ে নাফিজ নিজেও ভেতরের দিকে পা বাড়ালো।

;;;;;

“আইঝা ওইঝা,ঘাস পেত্নী, সাকচুন্নি ঝুপ যা,
ঝাটার বাড়ি,কলকেপড়া ছ্যাকা,
তুই যাবি তোর বাপ যাবে
আইঝা ওইঝা,,,,,,”

তারা ভেতরে ঢুকে দাড়িয়ে আছে।দাঁড়িয়ে গাসুর কান্ড দেখছে।এটা তার কাছে নতুন না।তিনটা শুকনো মরিচ নিয়ে গাসু এসব বিড়বিড় করতে করতে তারার মাথা থেকে পা অবধি বুলিয়ে নিচ্ছে।

সোফায় বসে আব্রাহাম সাহেব গাসুর কান্ড দেখে মাথা নাড়লেন।যার অর্থ-এই পাগলকে কিছু বলে লাভ নেই।সোফার এপাশে বসে ক্যাপ্টেন মারিয়া আর নাফিজ গাসুর কান্ড দেখে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তারা চিড়িয়াখানায় এসেছে।

—-তুমি আবার শুরু করেছো গাসু?

মাহমুদা বেগম চায়ের ট্রে নিয়ে বসার ঘরে আসলেন।মাহমুদা বেগমের ডাক শুনে গাসু নিজের গীত থামিয়ে মাহমুদা বেগমের দিকে তাকালো।

—-কি করুম ম্যাডাম?হামি তো আফার নজর কাটাচ্ছি।আমার চাঁদের লগন দেখতে আফাটা।কাক পক্ষী কু নজর দেবে।আই গাসু ন হইতে দিতাম।
—-তা ঠিক আছে।তাই বলে এসব বলে।শুধু মরিচ ছুইয়ে পরে আগুনে দিলেই তো হয়।তা না।
—-উহ ম্যাডাম।আপনি বুঝেতেছেন। না।এই যে আফারে আজকে আরো বড় বড় ডাইমন রা নজর দিছে হের লিগে এতো কিছু।
—-ডাইমন?
—-আরে আফা আপনি ও বুঝলেন না।এই কষ্ট কই রাখুম।হো গড দেখো আফাও মোর ইংলিশ বুঝে না।আফা এর মানে রাক্ষস।
—-ওহ আল্লাহ।ওটা Demon(রাক্ষস)।
—-হ।এক্কেরে নাইট।এইটাই।
—-আবার নাইট!
—-ঐ যে সঠিক।বুঝেন না আফা।
—-হ্যাঁ বুঝলাম।
—-তয় ম্যাডাম।আসল কথা হলো আইজকে এই ডাইমন রা আফার ছবিতে নজর দিছে।আর আই গাসুয়া সিমসাং মোর আফার দিকে কারোর নজর ন লাগতে দিতাম।

গাসু নাফিজের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিল।এদিকে নাফিজ সেই লজ্জা পাচ্ছে।গাসুর কথার উদ্দেশ্য সে ঠিক বুঝতে পেরেছে।

“ছু মন্তর ছু,কালা কুত্তার ঘু,থু থু”

—-আফা হইয়া গেছে।আপনে উপরে যান।

গাসু দাঁত কেলিয়ে মরিচ তিনটা নিয়ে গিয়ে চুলার আগুনে ফেললো।অদ্ভুত ব্যাপার মরিচ পুড়ছে অথচ একটু ও গন্ধ বের হচ্ছে না।

—-ও ম্যাডাম।দেহেন কইছিলাম আফারে আবার কেডা নজর দিকে।
—-হ্যাঁ।তুমি এবার ওসব আকাজ বাদ দিয়ে তারা কে নিয়ে উপরে যাও।

রান্নাঘর থেকে গাসুর গলা শুনে চেঁচিয়ে উওর দিলেন মাহমুদা বেগম।

;;;;;

প্রিয় পাঠক/পাঠিকা,ইনশাহআল্লাহ অমর একুশে বইমেলা ২০২১ এ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে আমার প্রথম উপন্যাস “আবেদিতা “।আশা করি “নয়নতারা” উপন্যাসের মতো সেটাও আপনাদের ভালো লাগবে।

;;;;;

—-মা জানো,আজ একটা সিনড্রেইলা দেখেছি।তবে ছোটো না বড় একটা সিনড্রেইলা।আমার মিষ্টিও নিশ্চয়ই এরকম একটা সিনড্রেইলা হবে বলো।

কফির মগ হাতে নিয়ে জানালার কাছে দাড়িয়ে আছে নাফিজ।পেছনে লতিফা খাটের ওপর বসা।চোখ বুজলেই আজ নাফিজের শুধু একটা চেহারায় যেন ভাসছে।

—-কি বলছিস তুই?
—-হ্যাঁ মা সত্যি।একদম সত্যি।
—-নাফিজ তোকে একটা কথা বলবো?
—-বলো।
—-উনত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে তোর।ভালো চাকরি করিস।ভালো পজিশন সব আছে।এবার একটা বিয়ে,,,,,,
—-সম্ভব না মা।তুমি কেন এই কথাটা বার বার বলো?আমি পারছি না মা।অনেক তো চেষ্টা করেছি ভুলে থাকার।কিন্তু কোনো লাভ কি হলো।আজ ও ঘুমানোর সময় চোখ বন্ধ করলে ভেসে আসে মিষ্টির মুখটা।কিভাবে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়েছিল আমাকে।কানে ভেসে আসে সেই শেষ কথা,”টা টা নাফিজ ভাইয়া”।
—-জীবন থেমে থাকে না নাফিজ।আমিও চাই মিষ্টিকে খুঁজে পেতে।কিন্তু কি করবি বল।ও বেচে আছে কি না সেটাও আমরা জানিনা।আর যদি বেচে থাকে তো নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে আমাদের মিষ্টি বুড়ি।তুই ওকে সামনে দেখলেও চিনতে পারবি না।আর যদি কখনো তুই ওকে পাস তখন যদি দেখিস এতোদিনে ওর বিয়ে হয়ে গেছে।তুই বল কি করবি তখন?
—-মা তুমি এ কথা বলো না।
—-আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়।
—-আচ্ছা।

লতিফা উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

নাফিজ জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।অনেকদিন পর রাতের আকাশে ছোটো ছোটো তারা দেখা দিয়েছে।

—-মিষ্টি,মা কি বললো?সত্যি কি আমি তোকে চিনতে পারব না?মিষ্টি কোথায় তুই?তুই আমার মিষ্টি পাখি হয়ে আছিস।নাকি আমার মনের খাচা থেকে উড়াল দিয়ে অন্য কারোর খাঁচায় আবদ্ধ হয়েছিস।এতোটা কষ্ট দিস না মিষ্টি।আমি যে দমবন্ধ হয়ে মরে যাব।

নাফিজ চোখ বন্ধ করে বাইরের ঠান্ডা বাতাসকে ভেতরে টেনে নিচ্ছে শ্বাস নিয়ে।চোখ বন্ধ করলেই আজ মিষ্টির জায়গায় আরেকটা মুখ ভেসে আসছে।সাথে সাথে চোখ খুললো নাফিজ।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।বুকের ভেতর ধুকপুকানিটা বেড়েই যাচ্ছে।

—-না না।এরকম কেন হচ্ছে?তারা।সত্যি আকাশের খসে পড়া তারা।কিন্তু কেন আমার নয়নতারা বাগানে আজ নতুন ফুলের মুখ দেখছি বার বার।এটা তো হওয়ার নয়।আমার বাগান যে শুধুই আমার বেবি সিনড্রেইলার।

;;;;

“ভোরের পাখি,
তুমি কি শুনতে পাও?
আমি যে তোমাকে ডেকে ডেকে মরিয়া হয়ে যাচ্ছি,
আচ্ছা তুমি কি আমাকে ধার দেবে?
কিছুক্ষণের জন্য,
তোমার ঐ ডানা দুটো।
আমি উড়বো,ডানা মেলে উড়ে যাব ঐ দূরে,
ঘুরে বেরাব পুরো পৃথিবী,
জানো আমার না খুব ইচ্ছে করে
খরগোশের মতো লাফিয়ে বেড়াবে,
চিতাবাঘের মতো দৌড়াব,
শীতের বিকেলে সাইকেল নিয়ে ঘুরবো,
সাইকেলের সামনে থাকবে এক বিশাল ঝুড়ি,
ঝুড়ি ভরা ফুল,
আমি ঘুরব,খুব ঘুরব,
কিন্তু আমি যে পারি না।
দু কদম হাঁটতে পারিনা ঠিকমতো,
জানো আমি খুব চাই
কারোর হাত ধরে হাঁটতে,
যে আমাকে নিয়ে যাবে ঐ পাহাড়ের চূড়ায়,
আর তার সাইকেলের পেছনে বসে আমি ঘুরে বেড়াব,
আমার ইচ্ছা গুলো বড় বেমানান জানো তো,
এমন কেউ নেই,
আমি আমার সুপ্ত ইচ্ছে গুলোর নির্বাক কবি”(স্বরচিত)

—-তারা,তারা মামোনি,,,,

মাহমুদা বেগমের গলা শুনে খাতার ভাজে কলম টা রেখে দিয়ে খাতাটা বন্ধ করে দিল তারা।পেছনে তাকিয়ে দেখে মাহমুদা বেগম খাবারের প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।

—-মা বলো।
—-এই দেখ তোর জন্য লুচি বানিয়েছি।
—-এখন কেন করতে গেলে?সারাদিন হসপিটাল থেকে এসে ক্লান্ত হয়ে যাও এমনি তুমি।
—-ও কিছু না।নে হা কর।খেতে হবে।
—-আমিও ডাইনিং এ যেতাম।
—-তোর বাবা একটু ইউনিটে গেছে।তাই তোর খাবার ঘরে আনলাম।ওষুধ খেতে হবে তো।
—-গাসু খেয়েছে?
—-হ্যাঁ।নে হা কর।

মাহমুদা বেগম তারাকে গালে তুলে লুচি আর আলুর দম খাইয়ে দিচ্ছেন।

চলবে———–

ক্যাপ্টেন তানহাকে যারা মিষ্টি ভেবেছিলেন ,তাদের জন্য তিন বালতি, ছয় মগ সমবেদনা 🥳

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here