#হৃদয়ে_রেখো
পর্বসংখ্যা – ০২
ক্যালেন্ডারের বুক থেকে হারিয়ে গেছে কত কত মাস। মাস পেরিয়ে কয়েক বছর ও পেরিয়ে গেছে। পরীক্ষার পর কেউই কারো সাথে দেখা করতে পারেনি। তারা কেউই এক কলেজে পড়তে পারেনি। আলাদা আলাদা কলেজ এরপর ভার্সিটি শেষ করে সবাই কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটুও ফুসরত পাইনি প্রিয় বন্ধু গুলো এক হওয়ার। মিলিয়া নিজের ইচ্ছে পূরণ করেছে। সে একজন অভিনেত্রী আজ। কাজের সুবাদে অনেক জায়গায়ই যাওয়া লাগে। তার বয়ফ্রেন্ডের নাম আনাফ। আদ্রিদ কলেজের পড়া শেষ করে বেকারি শপ শুরু করেছিল। আজ তার ব্যবসা অনেক বড় হয়ে গেছে। অনলাইনে অফলাইনে সব জায়গায় সে অর্ডার নেয়। আজ সুটিং শেষ করে মিলিয়া যায় আনাফের সাথে দেখা করে। তারপর সেখান থেকে চলে যায় হাসপাতালে। মিলিয়ার পার্সোনাল ডাক্তার আনিশা তাকে বলে-
-” দেখো মিলি তোমার বেশি বেশি ক্যামো থ্যারাপি নেয়া লাগবে। দিন দিন তার শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটছে।
-” আপু আমি নিব থ্যারাপি সমস্যা নেই। তবে আপনি আমার আম্মুকে কিছুই বলবেন না প্লিজ প্লিজ। আমার আম্মু ছাড়া এখন আমার কেউ নেই আর। সে জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে।
আনিশা মিলিয়ার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।
-” দেখো মিলিয়া আমি তোমার আম্মুকে কিছুই বলবোনা। কিন্তু নিজের যত্ন তোমায় নিতে হবে। ঠিকমতো চিকিৎসা না নিলে তোমার যদি কিছু হয়ে যায়। তখন তোমার আম্মুকে কে দেখবে?
-” না না কিছু হবেনা আমি ঠিকমতোই করব সব। আজ আসি।
-” আচ্ছা।
মিলিয়া চেম্বার থেকে বেরিয়ে যায়। কেন এই রোগ হলো তার? কি পাপ করেছিলো? উদাস হয়ে হাঁটতে থাকে।
।
পরেরদিন মিলিয়ার ঘুম ভাঙে কলিংবেলের আওয়াজে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে গিয়ে দরজা খোলে। দরজার সামনে একটা পার্সেল দেখতে পেয়ে ভারী অবাক হয় সে। পার্সেলটা এনে দরজা লাগিয়ে দেয় সে। চটজলদি তার আম্মুকে কল করে-
-” হ্যালো আম্মু!
-” হ্যাপি বার্থডে মাই সানসাইন।
-” ধন্যবাদ আম্মু। তুমি কি আমার জন্য কোন পার্সেল পাঠিয়েছো?
-” না তো মা। তবে তোমার ছোটবেলার বন্ধুরা পাঠাতে পারে।
-” আচ্ছা আম্মু রাখি তাহলে। আল্লাহ হাফেজ। আসসালামুয়ালাইকুম।
-” নিজের যত্ন নিও। ওয়ালাইকুমুস সালাম। আল্লাহ হাফেজ।
ফোন টা রেখে তারাতাড়ি করে পার্সেল টা খুলে। খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা একটা কেক আর একটা গিফট বক্স। গিফট বক্স টা খুলে দেখে একটা ব্লাক ড্রেস আর কতগুলো চকলেট। একটা চিঠি। তারাতাড়ি চিঠি খুলে পড়া শুরু করে-
আল্লাহ তোমার হৃদয়ের সমস্ত স্বপ্ন আকাংক্ষা পূরণে আশীর্বাদ করুক। তোমার মঙ্গল কামনা করছি। এই জন্মদিন যেন একটু হয় হাসি, ও মেঘেদের ন্যায় কোমল ও মলীন। শুভ জন্মদিন, প্রিয়!
বছরের পর বছর ধরে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। তবে তুমি এখনও সে একই ব্যক্তি, আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা। আমাদের ভালবাসা সমুদ্র এবং অন্তহীন আকাশের মতো। শুভ জন্মদিন, প্রিয়।
তুমি আমার জীবনে আসার পর থেকে জীবনের সমস্ত ধুলো পরিষ্কার হয়ে গেছে। তুমি আমার অন্ধকার জীবনে এনেছো আলো। জীবনকে করেছো পশ্চিমা ডুবো সূর্যের ন্যায় রংগিন।শুভ জন্মদিন, হরিণী। তুমি আমার জীবনের সেরা একটি মুহূর্তে আসা আকাশের নীল তারকা! আজকের দিন যেমন তেমন না। বরং একটি বিশেষ দিন। শুভ জন্মদিন আমার প্রণয়ী। তোমার সাথে প্রতিদিন দুর্দান্তসব মুহূর্ত উদযাপন করেছি। আমার জীবন ডায়েরী কেবল তোমার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলিতে ভরা। যেহেতু তুমি খুব বিশেষ। তোমার জীবনের এই বিশেষ দিনটি খুব বিশেষ জিনিস দিয়ে ভরপুর হোক। আমি তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি দিন উদযাপন করি। এবং এই দিনটি এক বিশেষ হওয়ায়, এই বিশেষ নোটটি দিয়ে তোমাকে খুব বিশেষ উপায়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।নোটটি বেশ সিক্রেট। নোটঃ “আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ!” হয়তো তুমি আমার হবেনা তবুও তোমার সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো ছিল দূর্দান্ত। প্রণয়ী, বয়স কেবল একটি সংখ্যা। আমার জন্য তুমি আজ এক বছরের ছোট। এবং তোমার জন্মদিনের বাকি জন্মদিনের জন্যও সর্বদা আমার থেকে ছোটোই থাকবে। আমার চোখ এবং হৃদয়ে জুড়ে তুমি কখনও বৃদ্ধ হবেন না। তোমার প্রতি আমার ভালবাসা কখনো বৃদ্ধ হয়ে যাবে না। তুমি যতই বৃদ্ধ হও, এটি তোমার কাছে আমার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। তুমি সেরাদের সেরা। আমি আমার জীবনে কিছু বিশেষ ব্যক্তির সাথে দেখা করেছি। তবে তুমি তাদের সবার চেয়ে ছাড়িয়ে গেছো। আজকের এই শুভ দিন ছাড়া, তোমাকে একথা জানানোর জন্য ভালো আর কোনও দিন হতে পারে না। আজকের এই অসাধারণ দিনই উপর্যুক্ত সময় তোমাকে একটি কথা বলার,তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় একটি অধ্যায়। তোমাকে অনেক ভালোবাসি। জানো কখনোই বলতে পারিনি ভালোবাসি কারন ভয় হতো। তুমি কি কেকের মোমবাতিগুলি ফু নিয়ে নিভাতে পারবে, নাকি আমাকে ফায়ার সার্ভিসে কল করা উচিত? মজার বিষয় এই যে, কীভাবে আমার জীবনে সবচেয়ে সেরা এবং সব থেকে খারাপ একজনই আসতে পারে। সেটা তুমি। প্রিয় মেয়ে, আমি তোমার জন্মদিন ভুলে যেতে ভীষণ ভয় পাচ্ছি! আমি তোমাকে জানাচ্ছি অনেক অনেক অনেক অনেক জন্মদিনের শুভেচ্ছা ! তোমার প্রতি আমার ভালবাসা সূর্যের উজ্জ্বলতার মতো চিরকাল জ্বলতে থাকবে। ঐ মেয়ে, আমাকে একটি জন্মদিন উপহারের জন্য জিজ্ঞাসা করো। তবে গাড়ি জিজ্ঞাসা করবেনা। যদি বলো ১০০ টাকার মধ্যে শ্রেষ্ঠ উপহারটি খুজে আনতে, তাহলে এটি আমি ১ মিনিটেই সম্ভব করে দেখাবো। শুভ জন্মদিন, My beautiful Lady। আমার মিষ্টি এবং সুন্দর প্রিয়ণী।আমার সেরা বন্ধু হওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমার মনে সন্দেহ নেই,যে তুমি স্বর্গ-প্রেরিত। আর সে কারণেই তোমার প্রতি আমার ভালবাসা ।সবসময় অপরিবর্তিত।শুভ জন্মদিন, মনোষ্কামনা। এই যা অনেক বকবক করে ফেলেছি। আমার পাঠানো এই ছোট উপহার গ্রহন করো প্রিয়তমা। হয়তো আর দেখা হবেনা আমাদের আমি চাইনা আমাদের দেখা হোক। তোমার ভালোবাসার মানুষটির সাথেই সুখে থাকো তুমি। এই কালো ড্রেসে তোমায় অসম্ভব সুন্দর লাগবে। আবারো শুভ জন্মদিন প্রিয়তমা।।
মিলিয়ার চোখ ভিজে আসছে। এটা আনাফ নয় সে জানে। তার জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা বার্তা এসেছে। কিন্তু এটা বেশিই সুন্দর। কে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে ভালোবাসে। তার মতো একটা মেয়েও কারো জীবনে এতো সুন্দর করে দিয়েছে ভাবতেই অবাক লাগে। মিলিয়া আনাফ কে কল করে-
-” হ্যালো আনাফ!
-” হুম বেবি বলো।
-” আমার বাসায় চলে এসো।
-” কেন?
-” এমনিতেই।
-” ওকেই।
মিলিয়া কল কেটে দেয়। বাহ এমন মানুষের সাথে রিলেশন করি যে কিনা আমার জন্মদিন মনেই রাখেনি। আজব! মিলিয়া ব্লাক ড্রেসটা পরে রেডি হয়ে যায়। হাতে কেকটা নিয়ে সুন্দর করে একটা পিক তুলে। তারপর ফেসবুকে আপলোড দেয়। হয়তো নেটওয়ার্কের অপর প্রান্ত থেকে কেউ এই ছবি দেখে প্রশান্তির হাসি হাসে। কিছুক্ষণ পরেই আনাফ এসে পড়ে। মিলিয়া তাকে টেবিলে বসতে বলে নিজেও বসে পড়ে।
-” ওহহ বেবি সিট সরি মনেই ছিলনা। হ্যাপি বার্থডে।
-” হুম হয়েছে।
-” কেকটা কাটো।
মিলিয়া কথা না বাড়িয়ে কেক কাটে তবে আনাফকে খাইয়ে দেয়না। একটা প্লেটে করে দেয় তার সামনে। আনাফ কিছুই বলেনা। জানে মিলিয়া রাগ করেছে। আনাফ কেক খেতে শুরু করে।
-” আনাফ তোমায় একটা কথা বলার ছিল।
মিলিয়ার শান্ত কন্ঠ
-” বলো।
-” আমার ক্যান্সার হয়েছে।
মিলিয়ার কন্ঠে কথাটা শুনে আনাফ বোকা বনে যায়।
-” মিলিয়া মজা করারো একটা লিমিট থাকে। আজকের দিনে অন্তত মজা করো না প্লিজ।
-” তোমার কি মনে হয় আমি মজা করছি?
-” মানে কি বলতে চাইছো ?
মিলিয়া উঠে গিয়ে কতগুলো রিপোর্ট নিয়ে আসে। আনাফের হাতে দেয়। পেপারগুলো হাতে নিয়ে আনাফ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। একবার মিলিয়ার মুখের দিকে আরেকবার হাতে থাকা কাগজগুলোর দিকে তাকায়। আনাফ পেপারগুলো রেখে আস্তে করে চেয়ার থেকে উঠে যায়। চুপচাপ হেটে চলে যায় মিলিয়ার বাসা থেকে। মিলিয়া আনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কেঁদেই ফেলে। কি করবে আনাফ এখন? আসলেই মা ছাড়া কেউই নেই তার। সে তার ডাক্তারকে ম্যাছেজ করে বলে দেয় এবারের ক্যামো থ্যারাপি নিতে দেরি হবে। আর তার আম্মুকে জানি এ বিষয়ে না জানায়। আরিশা হতাশ হয়ে মেসেজ টা পড়ে। উত্তরে হ্যাপি বার্থডে লিখে দেয়।
#চলবে
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)