শেষটা_সুন্দর #অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম) #পর্ব___১১

0
619

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১১

নির্ঝর শুকনো ঢোক গিলে তরীর বন্ধ চোখের দিকে তাকালো। মুখটা নিচু করে তরীর মুখের কাছাকাছি আনতে আচমকা তরী ধপ করে চোখ খুলল। নির্ঝরের অনুভূতি গুলো যেন থমকে গেল। সাথে থমকে গেল সে। অাবছা অন্ধকারে তার অক্ষিযুগল বড় বড় হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে নিজেকে উঁচু করে রাখা হাতদুটো ভেঙে পরতে তরীর বুকের উপর লুটিয়ে পড়লো। তৎক্ষনাৎ তরী দু হাতে ঠেলে তাকে সরিয়ে দিল। একলাফে বিছানায় উঠে বসে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

‘কি করছেন কি?’

নির্ঝর খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। কথাও সাজিয়ে নিল। উঠে গিয়ে রুমের লাইট অন করে তরীর দিকে এগিয়ে এলো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘তরী তুমি ঠিক আছো?’

‘ঠিক থাকবো না কেন? কি করেছেন আমাকে?’

‘ধুর! বোকা মেয়ে। আমি কি করবো? তুমি নিজেই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আচ্ছা, এই রোগটা কি তোমার বহু পুরনো? ‘

তরীর চোখে মুখে চিন্তার ক্লেশ। সে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো। মিনমিন করে বলল,

‘কোন রোগের কথা বলছেন আপনি?’

‘কি রোগ সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। ঘুমের মধ্যে তোমার প্রচন্ড চিৎকারের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়।ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি তুমি ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করছো। সেজন্য আমি কোলে করে রুমে নিয়ে আসলাম। কিন্তু রুমে এনে আরেক বিপদ দেখা দিল। তোমার পালস চলছিল না। শ্বাস নিচ্ছিলে না তুমি। ‘

তরীর দু চোখে আতংক এসে ভর করলো। সে নিভু নিভু স্বরে বলল,

‘শ্বাস প্রশ্বাস চলছিল না আমার?’

‘না! সেজন্য আমি ভয়ে কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের চিন্তা করলাম। বিষয়টা যদিও আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। তবুও জান বাঁচানো ফরয ভেবে করতে নিয়েছিলাম। কিন্তু…. ইট’স অ্যা মিরাকল তরী! যেইমাত্র তোমার কাছাকাছি গেলাম সেইমাত্র তুমি সুস্থ হয়ে গেলে। থাঙ্কস গড!’

তরী ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের দিকে চেয়ে আছে। তার অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে ঝুলে আছে। নির্ঝর একটা হাই তুলে বলল,

‘মাঝরাতে এত নাটক কেন করছো? এভাবে তাকিয়ে থাকার কি মানে?’

‘আপনি মিথ্যে বলছেন,তাই না?’

‘হাউ ফানি! মিথ্যে বলে আমার কি লাভ? তুমি কি ভেবেছ, তোমায় চুমু খেতে নিয়েছিলাম আমি? তাও আবার লুকিয়ে?’

‘এটাই সত্য! তাই তো?’

‘হাউ ফানি! তোমায় চুমু খাওয়ার জন্য তো আমার কোনো লুকোচুরির দরকার নেই। এই সহজ বিষয়টা বুঝো না কেন তুমি?’

বলে নির্ঝর এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না। তরীর মাথা চেপে ধরে ঠোঁটে স্বশব্দে চুমু খেল। তিন সেকেন্ডের ব্যবধানে তরীর ভেতর বড়সড় পরিবর্তন ঘটলো। বাঁধা দেওয়ার অবকাশ পেল না। তার আগেই নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়েছে। সে বিস্ময় মিশ্রিত চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো। কিন্তু নির্ঝর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবে উঠে দাঁড়ালো।

তার দিকে ভুলেও তাকাল না। ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে ধীরে সুস্থে বের হয়ে গেল। সেই গমনপথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তরীর চোখ দুটো ক্রমেই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।

দরজা বাইরে থেকে ভিড়িয়ে দিয়ে একদৌঁড়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়লো নির্ঝর। বুকের দুই ইঞ্চি নিচে পুরোদস্তুর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আনমনে ডান হাত ঠোঁটে চলে গেল। এক্ষুণি সে কি করল? এত সাহস কোথায় পেল সে? সে দু গালে হাত রেখে টেনে টেনে শ্বাস নিল।

___________

নির্ঝর অফিস থেকে ফিরলো সন্ধ্যাবেলা। ড্রয়িং রুমে কাউকে দেখতে না পেয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিল। তার মাকে দেখতে পেল। ডেকচিতে পানি বসিয়েছে। সে মায়ের আঁচলে ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে ডাক দিল,

‘মা!’

তার মা নাহিদা বেগম ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,

‘এতক্ষণে আসার সময় হলো?’

‘এতদিন ছুটিতে ছিলাম না! সেজন্য আজ একটু বেশি কাজ জমে ছিল।’

এর মধ্যে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। এ সময়টাতে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। শুধু নির্ঝর তার অফিসে জয়েন করেছে। আর সিলেট থেকে তার ভাইসহ বাবা-মা ফিরে এসেছে। নির্ঝর এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে বলল,

‘নিনাদ কি করে মা?’

‘ড্রয়িং রুমেই তো দেখলাম একটু আগে। তরীর সাথে গল্প করছিল। হয়তো রুমে এখন। ভালো কথা! শোন! তরীর বাবা ফোন করেছিল। ওর পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বললো। বোর্ড এক্সামের বেশিদিন নেই। তোর বড় মা-ও বলল এ বিষয়ে। মেয়েটা তো গতবার ফেল করেছে। এবার তো পাস করতে হবে।নাকি?’

মায়ের কথা শুনে নির্ঝরের মুখে লজ্জামিশ্রিত হাসি ফুটে উঠলো। তরী যে গতবছর ইন্টারের বোর্ড পরীক্ষায় তিন সাবজেক্টে ফেইল করেছে তা সে অনেক আগে থেকে জানে। তবুও মায়ের মুখে শুনে হাসি পেল। সে বিদ্রুপ করে বলল,

‘মা, তোমার বৌমা এত বোকা কেন? সারাজীবন আমি টপ রেজাল্ট করে এসেছি। আর আমার বউ কি না কমার্স থেকে ইন্টারে তিন সাবজেক্টে ফেইল করেছে। মেনে নেয়া যায়?’

নাহিদা বেগম মুখ ঘুরিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,

‘খবরদার বৌমাকে অপমান করবি না। একবার ফেইল করেছে তো কি হয়েছে? এবার ইমপ্রুভ দিবে। অনেক ভালো রেজাল্ট করবে নিশ্চয়ই! তুই শুধু গ্রাম থেকে বই আনার ব্যবস্থা কর।’

নির্ঝরের মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠলো। কত সহজে তার বাবা-মা তরীকে মেনে নিয়েছে। তার বাবা-মায়ের এমন সুন্দর মন মানসিকতার জন্যই সে অনেকটা একা একা এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সে এক পলক দরজা দিয়ে ড্রয়িং রুমে তাকাল। তরীকে চোখে পড়ছে না। শার্টের উপরের বাটন খুলে দিয়ে সে বলল,

‘মা গো! তরীকে পড়াবে কে? আমার তো সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। কমার্সের স্টুডেন্ট কিভাবে পড়াবো?’

‘তুই পড়াবি কেন গাধা? আমি পড়াবো! আমি কমার্সের স্টুডেন্ট ছিলাম তোর মনে নেই? আমি পড়াবো ওকে! প্রয়োজনে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিবো। নিনাদ যেভাবে পড়ছে, ও সেভাবেই পড়বে।যা ফ্রেশ হয়ে নে।’

‘হুঁ!’

নির্ঝর মাকে জড়িয়ে ধরে রান্নাঘর থেকে বের হলো। তার মা ঢাকার একটা প্রাইভেট হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছে দীর্ঘ দিন। সে অফিসে জয়েন করার পর থেকে মাকে আর চাকরি করতে দেয়নি।

নিজের রুমে ঢোকার আগে নির্ঝর তার ছোট ভাই নিনাদের রুমে উঁকি দিল। নিনাদ এ বছর নবম শ্রেনীতে উঠেছে। এর মস্তিষ্ক অবিকল তরীর মতো। টেনেটুনে জেএসসি পাস করেছে।

‘তুই আবার গল্পের বই হাতে নিয়েছিস?’

নির্ঝরের আচমকা আক্রমণে নিনাদ এক লাফে উঠে বসলো। হাতে ধরে রাখা ইংরেজি সাহিত্যের বইটা পেছনে লুকিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,

‘হে হে! বই কোথায় দেখলে ভাইয়া? আমি তো নোটবুক পড়ছিলাম।’

‘নোটবুক? আজকাল হ্যানরি রাইডার হ্যাগার্ড নামের বিদেশি লেখকও দেখছি নোটবুক লিখে? তাও আবার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য। হাউ ফানি! বইটা বের কর।’

‘থাক না ভাইয়া।’

‘এক চড় খাবি। বই দে!’

‘তুমি একটা অশান্তি ভাইয়া!’

‘বই দে আগে! তোর আর তোর ভাবীর মস্তিষ্ক ধুয়ে গোবরমুক্ত করে তারপর মাথায় পুনরায় সেট-আপ করতে হবে। ‘

নিনাদ মুখ শক্ত করে বালিশের নিচ থেকে বইটা টেনে বের করলো। তার বড় ভাইয়াকে কখনো সাহিত্যের বই পড়তে দেখেনি। মাঝে মধ্যে এস্ট্রোনমির বই হাতে দেখে এই যাঃ! নিজে না পড়ুক তাতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। তার আফসোস একটা জায়গা সেটা হলো তার ভাই তাকেও গল্পের বই পড়তে দিতে চায় না। সাহিত্যের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয় না।

বইটা নির্ঝরের হাতে তুলে দিয়ে নিচুস্বরে বলল,

‘বিয়ে করেছ এবার তো একটু সাহিত্যের বই পড়ে রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করো?’

নির্ঝরের কানে সম্পূর্ণ অংশ পৌঁছাল না। সে বইটা ছিনিয়ে হাতে নিল। বইয়ের নামটার দিকে ফিরেও তাকাল না। এক হাতে শার্টের বাটন খুলতে খুলতে রুমে ঢুকলো।

রোজকার মতো আজও তরী আয়নার সামনে বসে আছে। নির্ঝর দরজার আড়াল থেকে কিছুক্ষণ তরীর দিকে চেয়ে রইলো। তার আর তরীর সম্পর্কটা আগের মতোই আছে। সে তরীকে সময় দিচ্ছে নিজেকে গুছিয়ে তোলার। জোরপূর্বক কিছু চাপিয়ে দেওয়ার ইনটেনশন তার মধ্যে কোনো সময়ে ছিল না। একই বিছানায় শুয়েও মাঝের কোলবালিশটা যেন যোজন যোজন দূরে রেখেছে দুজনকে!

সেই চাইলেই কোলবালিশটা সরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু সরাচ্ছে না। তরীর অপেক্ষায় আছে। যেদিন তরীর চোখের দৃষ্টি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হবে, তরীর মনে তার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে সেদিন তরী নিজে থেকে কোলবালিশ সরিয়ে তার কাছে আসবে। সেদিনের অপেক্ষা!

একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। হাতের বইটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে বলল,

‘সবসময় আয়নার সামনে বসে থেকে কি হবে? পড়াশোনার নাম গন্ধ নেই? তোমার উপর থেকে যে স্টুডেন্ট তকমাটা এখনো যায়নি তা কি বেমালুম ভুলে গেছো?’

তরী কিছুটা চমকে উঠলো। সত্যি তো! সে তো এখনো পড়াশোনা করছে। কিন্তু এটা ভেবেছিল যে তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই আর পড়তে হবে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের উন্মুক্ত বুকের কিছু অংশ নজরে পরতে চোখ সরিয়ে নিল। অ্য দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আমাকে এখনো পড়তে হবে? মানে বিয়ের পরো?’

‘কেন? তুমি বিয়ের পর পতি সেবায় নিজেকে বিলীন করে দিয়েছ যে বিয়ের পর পড়তে পারবে না? হাউ ফানি!’

‘দেখুন, কথায় কথায় হাউ ফানি, হাউ ফানি করবেন না! সবজায়গা মানায় না।’

‘ওটা আমার মুদ্রাদোষ। এখন কাজের কথায় আসো। গ্রাম থেকে বই খাতাপত্র আনার ব্যবস্থা করছি। দু একদিনের মধ্যে পড়াশোনা শুরু করবে। এবার ফেইল করলে কিন্তু ডিভোর্স দিয়ে দিব।’

নির্ঝর কপাল কুঁচকে তরীর দিকে তাকালো। তরীর মুখের উজ্জ্বলতা তার চোখ এড়াল না। তরীর সেই মুখোভঙ্গি লক্ষ্য করে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। হালকা করে তরীর সদ্য বিনুনি করা চুল টেনে ধরে কাছে নিয়ে এলো। চোখে চোখ রেখে টেনে টেনে বলল,

‘তারপর তৃতীয় বারের মতো আবার আমিই বিয়ে করবো।’

(চলবে)

আসসালামু আলাইকুম। পরবর্তী পর্ব কাল দুপুরে পোস্ট করবো। এখন থেকে নিয়মিত গল্প পাবেন। ইনশাআল্লাহ আর অনিয়ম হবে না। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here