শেষটা_সুন্দর #অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম) #পর্ব___০২

0
757

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___০২

তরীর বিস্ময়মিশ্রিত চোখের দিকে এক পলক চেয়ে আচমকা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল নির্ঝর।ভয়ে তরীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল।বুক কেঁপে উঠলো।শুকনো ঢোক গিলে জানালার গ্রিলের সাথে সেঁটে দাঁড়াল।তবে কি নির্ঝর বরযাত্রীর সাথে যায়নি?কেন যায় নি?

নির্ঝর বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে লাগলো।তরী কথার খই হারিয়ে ফেলেছে যেন।মুখ দিয়ে কোনো বুলি ফুটছে না।ভয়ে অনবরত শরীর কাঁপছে।এই ছেলে কি ফাঁকা বাড়িতে তার কোনো ক্ষতি করে ফেলবে?ফুপি!ফুপি কোথায়?

গলা ছেড়ে হাঁক ছাড়তে নিয়েও অস্ফুট একটা শব্দ ছাড়া মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না।নির্ঝর কয়েক পা এগিয়ে এসে থেমে গেল।তরী দু হাতে জানালার গ্রিল চেপে ধরে কম্পিত কন্ঠে বলল,

‘দ-দরজা বন্ধ করছেন কেন ভাই?নির্ঝর ভাই!’

নির্ঝর বেশ আয়েস করে রুমের মাঝামাঝি থাকা বিছানায় বসে পড়লো।বালিশে হেলান দিয়ে পা ভাঁজ করে তরীর দিকে তাকালো।সেদিকে তাকিয়েই পাঞ্জাবির উপরের দুটো বাটন খুলল।ব্যঙ্গ করে বলল,

‘এতক্ষণ না মি. নির্ঝর শাহরিয়ার বলে খুব চিল্লাফাল্লা করছিলে।যেই আমার কারমা একটু শুরু করলাম ওমনি ভয়ে চুপসে গেলে?ভাই বলে ডাকা শুরু করলে?হাউ ফানি!’

‘আপনি বরযাত্রীর সাথে যাননি?’

‘দেখতেই পাচ্ছো যাইনি!’

‘কেন যাননি?’

নির্ঝর সে প্রশ্নের উত্তর দিল না।তরী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,

‘নিশ্চয়ই গাড়ি মিস করেছেন!এখনো ঢেড় সময় আছে।চলে যান!’

‘যাওয়ার হলে অনেক আগেই যেতাম।’

‘আমারও যা-ওয়া হলো না।কে যেন বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়েছিল।’

‘ওই মহৎ কাজটা আমি করেছি।’

নির্ঝরের অতিরিক্ত শীতল কন্ঠ তরীর শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল।বিস্ফারিত নেত্রে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।অবাক কন্ঠে বলল,

‘কি!আপনি বাইরে থেকে দরজা লক করে রেখেছিলেন? কেন?’

‘দরকার আছে!’

‘যাওয়ার সময় কেউ খোঁজ করেনি আমার?কেউ না করলে অন্তত ফুপির তো করার কথা।’

‘অনেকে খোঁজ করেছিল।সবাইকে অনেক গুছিয়ে সত্যের মতো করে মিথ্যে বলেছি।আর ফুপি!আই মিন বড় মা তো সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময়ও জিগ্যেস করেছে তুমি গিয়েছ কি না!বলেছি তুমি জীবন ভাইয়ার গাড়িতেই চলে গেছো!’

তরীর মুখের সর্বত্র রাগ ফুটে উঠলো।এই বদমাইশ ছেলে চায় কি?একে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারলে একটু শান্তি পেত।কনের বাড়িতে গিয়ে সবাই কত হৈ হুল্লোড় আর মজা করছে।আর সে?একটা বদ ছেলের সাথে এক রুমে!

এক রুমে মনে পড়তে তরী দ্রুত জানালা থেকে সরে আসলো।নির্ঝরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে আবার নামিয়ে নিল সে।দরজার দিকে পা বাড়াতে নির্ঝর ঝড়ের গতিতে সামনে এসে তার পথ আগলে দাঁড়ালো।তরী কপাল কুঁচকে তাকাতে সে বলল,

‘পালাচ্ছো কোথায় তরীরাণী?বললাম না দরকার আছে!’

তরী ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে ধীর পায়ে পিছিয়ে গেল।ফের জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খুঁটা শুরু করলো।

নির্ঝর পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে বসলো।কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না।নিরবতা ভেঙে তরী মুখ তুলে তাকাল।নির্ঝরের মুখপানে তাকিয়ে বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল,

‘কি দরকার বলছেন না কেন?কোনো হেল্প লাগবে?এ বাড়িতে কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না?টিস্যু লাগবে?টয়লেট টিস্যু?’

তরীর হড়বড় করে বলা একগাদা প্রশ্নে নির্ঝর চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।তরীর দিকে ক্ষীপ্র পায়ে এগিয়ে এসে বলল,

‘আমার ক্যামেরা কোথায়?’

তরী ফুস করে নিভে গেল।ক্যামেরা!তার ঘূর্ণায়মান চোখ দুটো আশপাশে উত্তরণের পথ খুঁজলো।না পেয়ে ভয়ার্ত চোখে এক পলক নির্ঝরের দিকে তাকালো।নির্ঝরের রাগান্বিত রূপ দেখে ভীত হলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,

‘ক্যামেরা?কোন ক্যামেরা?’

নির্ঝর আরো দু পা এগিয়ে এলো।তরীর এক হাত সামনে এসে থেমে বলল,

‘কোন ক্যামেরা জানো না?’

‘না!’

‘আমার গলায় ঝুলানো যে ক্যামেরাটি দেখেছিলে সেটা কোথায়?’

তরী শাড়ির আঁচল টেনেটুনে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলল।জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল,

‘ভারী অদ্ভুত তো আপনি!আমি কিভাবে বলবো আপনার ক্যামেরা কোথায়!’

‘অদ্ভুত?আমি?কতটা অদ্ভুত তা টের পাবে যদি আমার ক্যামেরা ঠিকঠাক মতো ফেরত না দাও!আমার ক্যামেরা কোথায়?’

‘বললাম তো আমি জানি না!’

তরী জানালার পাশ থেকে সরে আসতে চাইলো।ডান দিকে পা বাড়াতেই নির্ঝর আরো এগিয়ে এলো।নির্ঝরকে এত কাছে অনুভব করে তরীর কলিজা কেঁপে উঠলো।ভয়ে!অজানা আতংকে!কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

‘এত কাছে আসছেন কেন?’

নির্ঝর আরো একটু এগিয়ে এলো।গায়ের সাথে গা লাগতে তরী দেয়ালের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করলো।মনে মনে অসংখ্য বার ফুপিকে ডাকলো।ফুপি এলেই সে এখান থেকে বের হতে পারবে।আতংকে মাথা ঘুরছে তার।পা ধরে আসছে।শরীরের ভর রাখতে চাইছে না।যখন তখন পড়ে যাবে হয়তো!সে বা দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে নির্ঝর দেয়ালের দু পাশে হাত দিয়ে তাকে আটকে ফেলল।

চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘লাস্ট বারের মতো জিজ্ঞেস করছি।আমার ক্যামেরা কোথায়?’

তরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।ছলছল চোখে মাথা চেপে ফ্লোরে বসে পড়লো।বিড়বিড় করে নিচুস্বরে বলল,

‘ওটা আমি ভেঙে ফেলেছি!ছাদের উপর রেখে ইট দিয়ে থেঁতলে টুকরো টুকরো করে ফেলেছি।’

নির্ঝরের কান অবধি সে কথা পৌঁছাল না।সে হাঁটুতে ভর দিয়ে তরীর সামনে বসে পড়লো।তরীর নিচু করে রাখা মাথাটা থুতনি ধরে উঁচু করলো।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘স্পষ্ট করে বলো কোথায় রেখেছ?’

তরী এক ঝটকায় নির্ঝরের হাতটা সরিয়ে দিল।আচমকা আক্রমণে নির্ঝর কিছুটা পিছিয়ে গেল।তরী বাজখাঁই কন্ঠে বলল,

‘আমি তো আস্তো একটা ডাস্টবিন।তাহলে ছুঁয়ে দিচ্ছেন কোন সাহসে?বজ্জাত ছেলে!’

নির্ঝর হুট করে তরীর আরো কাছে চলে এলো।দু হাতে তরীর গাল স্পর্শ করে বলল,

‘এবার শুধু ছুঁয়ে দিবো না।আরো অনেক কিছু করবো!’

তরীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।চেহারা জুড়ে ভয়ের হাতছানি।অনবরত শরীর কাঁপছে।কম্পমান ঠোঁট জোড়া কিছুটা আলগা করে অস্পষ্ট ভাবে বলল,

‘দূরে যান!প্লিজ!’

নির্ঝরের ভেতর কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটলো না।আগের মতো নির্বিকার ভঙ্গিতে মুখটা তরীর মুখের কাছাকাছি আনতে তরী ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।দু হাতে সমস্ত ফ্লোরে রক্ষাকবচ খুঁজে ফিরলো।আচমকা ডান হাতে লোহা জাতীয় কিছু টের পেতে সেটা আকড়ে ধরলো।ধপ করে চোখ খুলে দেখলো নির্ঝরের চোখ জোড়া বন্ধ!সমস্ত মুখ শিথিল।একটা পেশিও কুঁচকে নেই।

দুজনের ঠোঁটের মাঝের দূরত্ব নির্ঝর ক্রমেই কমিয়ে ফেলতে তরী ডান হাত উঁচিয়ে নির্ঝরের মাথায় সমস্ত শক্তি দিয়ে পরপর দুটো আঘাত করলো।

তরীর গাল থেকে নির্ঝরের হাত দুটো খসে পড়লো।নির্ঝর অস্ফুট আর্তনাদ করে আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা দু হাতে চেপে ধরলো।অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকাল যেন এমন কিছু ঘটবে তা তার কল্পনাতেও ছিল না।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নির্ঝরের মাথার ডান পাশ গড়িয়ে ছিপ পর্যন্ত রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা লক্ষ্য করলো তরী।ভয়ার্ত চোখে নিজের হাতে ধরে রাখা অস্ত্রের দিকে তাকাল।সঙ্গে সঙ্গে তার পিলে চমকে উঠলো।এটা তো লোহার সুপারি কাঁটা যাঁতাকল।গতকাল রাতে এই রুমে তার পাশে ফুপির বয়স্ক খালা শ্বাশুড়ির শোয়ার কথা ছিল।এই যাঁতাকল,পানের ডালা সব তো উনার!শেষ মেষ এই লোহার জিনিস দিয়ে সে নির্ঝরকে আঘাত করে বসলো?

তরী নিজের মধ্যে নেই!হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে।সে শকুনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নির্ঝরের দিকে তাকালো।এই ছেলেটা তাকে ডাস্টবিনের সাথে তুলনা করেছে।এর শাস্তি প্রাপ্য ছিল।

তার জ্বলন্ত চোখদুটো নির্ঝরের ছোট হয়ে আসা চোখে নিবদ্ধ হতে ছলছল করে উঠলো।চোখের উত্তপ্ততা ক্ষয়ে এলো।নির্ঝরের চোখে চেয়েই সে যেন তার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারলো।অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো নির্ঝরের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা।এটা কি তার মনের ভুল?সে ভুল দেখছে?

নির্ঝর শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।রক্তাক্ত বাম হাতটা বাড়িয়ে তরীর গাল স্পর্শ করতে নিল।জ্ঞানশূন্য হয়ে তরী ফের হাতের যাঁতাকল উঁচু করতে নির্ঝর সেটা ধরে ফেলল।একটানে কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলো।কোথাও সেটা পড়ে ঝনঝন করে কাচ ভাঙার শব্দ কানে এলো তরীর।

সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তরীর।সে চেয়ে আছে নির্ঝরের দিকে।নির্ঝরের শরীরটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে।নির্ঝর বিড়বিড় করে বলল,

‘ইউ!ক্রেজি স্টুপিড!’

পরক্ষণে ঢলে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো।কোনোরকমে ভেঙে ভেঙে বলল,

‘তরীরাণী আ-আমায় ইমিডিয়েটলি হ-হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।মরে যাচ্ছি আ-আমি!’

নির্ঝরের চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে যেতে তরী নিজের মাঝে ফিরলো।চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো।সে দ্রুত নির্ঝরের মাথাটা কোলের উপর নিয়ে মাথায় নিজের আঁচল চেপে ধরলো।রক্তের ধারা বন্ধ হচ্ছে না কেন?এতটা আঘাত করে বসলো!

দরজায় কেউ অনবরত ধাক্কা দিচ্ছে।জোরেসোরে কয়েক বার ধাক্কার পরপরই তরী ফুপির কন্ঠ শুনতে পেল।তার ফুপি মমতাজ বেগম চিন্তিত কন্ঠে বার বার বলছেন,

‘নির্ঝর ঠিক আছিস বাবা?কি হয়েছে?মাথা ব্যথা কমেনি? দরজা খোল তো!কাচ ভাঙার শব্দ পেলাম মনে হয়।’

তরী নির্ঝরের মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে দরজার দিকে দিল একছুট।ছিটকিনি খুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ফুপি,নির্ঝর ভাই!নির্ঝর ভাই মরে যাচ্ছে।হসপিটালে নিতে হবে।’

মমতাজ বেগমের কপালে চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠলো।ভেতরে উঁকি না দিয়ে অবাক হয়ে বলল,

‘তোরা দুজন একরুমে দরজা বন্ধ করে কি করছিলি রে?তরী, তুই বরযাত্রীর সাথে যাসনি?’

(চলবে)

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।🧡

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here