শেষটা_সুন্দর #অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম) #পর্ব___৩৩

0
489

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___৩৩

ঠোঁটে পরিপূর্ণ হাসি ঝুলিয়ে নির্ঝর তরীর কেবিনে প্রবেশ করলো। পা থেমে থেমে আসছে তার। জোরপূর্বক হাঁটলেও বেশিদূর এগোতে পারলো না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাতের মেডিকেল রিপোর্ট টা শক্ত হাতে চেপে ধরে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। তারপর ভয়ে ভয়ে বিছানার দিকে তাকালো।

বালিশে হেলান দিয়ে আধ শোয়া হয়ে আছে তরী। দৃষ্টি নত করে রাখা। হাতের স্যালাইন খুলে দেওয়া হয়েছে। তার ভেজা গাল দুটো এখান থেকেও স্পষ্ট। লাইটের আলো পড়ে পানির রেখা চিকচিক করছে। মমতাজ বেগমের বুকে মাথা রেখে সে থমকে আছে। আরেকটা হাত নাহিদা বেগমকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে আছে। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সবাইকে ফিরে পেয়ে এখনো ঘোরের মধ্যে আছে।

তরীকে চোখ খুলতে দেখে, জ্ঞান ফিরতে দেখে নির্ঝরের দেহে প্রাণ ফিরে এলো। মন্ত্র মুগ্ধের মতো চেয়ে রইলো সে।

দরজার কাছে নির্ঝরকে দাঁড়িয়ে দেখে মমতাজ বেগম চোখের পানি মুছে ফেললেন। তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ক্ষুধা লাগেনি?’

তরী মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারলো না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। নাহিদা বেগম তরীর মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,

‘তুই থাক। আমরা খাবার নিয়ে আসি। লাইট খাবার খেতে হবে। বাসায় গিয়ে স্যুপ টুপ বানিয়ে নিয়ে আসছি। কেমন?’

তরী এবারও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। দুজন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো। নাহিদা বেগম দরজার দিকে তাকিয়ে নির্ঝরকে দেখে বললেন,

‘তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন নির্ঝর? ভেতরে আয়!’

‘নির্ঝর’ নামটা কর্ণকূহরে প্রবেশ করতে তরীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। হাত পা পুনরায় অসাড় হয়ে এলো। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে সে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল। মমতাজ বেগম হেঁটে নির্ঝরের দিকে এগিয়ে গেলেন। নির্ঝরের হাতের রিপোর্ট টা নিয়ে নিলেন। তারপর কর্ণারের দিকের টেবিল নির্দেশ করে বললেন,

‘ওখানে শুকনো খাবার আছে। তরী আপাতত কিছু খেতে চাইলে ওখান থেকে দিস। আর তুইও কিছু খেয়ে নিস।’

নির্ঝর মাথা নাড়তে দুজন বেরিয়ে গেল। তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্ঝর। দরজার সামনের ঝুলন্ত পর্দার নড়চড় কমে স্থির হয়ে আসতে সে মাথা ঘুরিয়ে নিল। আবার তরীর দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। কি বলে শুরু করবে, কোথা থেকে শুরু করবে সবকিছুর খেই হারিয়ে ফেলেছে যেন!

নির্ঝরের শরীর দরজার ওখানেই স্থির হয়ে গেছে। নড়ার শক্তি পাচ্ছে না। তরীর কাছাকাছি যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। তরীকে সে প্রটেক্ট করতে পারেনি। তাকে আগলে রাখতে পারেনি। আগলে রাখলে তরীর সাথে এতবড় ঘটনা ঘটতো না। মেয়েটা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অমানবিক কষ্টের সাক্ষী হতো না। নিজের বিবেকের কাছে তীব্র অপরাধ বোধে দগ্ধ হচ্ছে সে। তরী কি তাকে ক্ষমা করবে? তার এই অপারগতা ভুলে কাছে টেনে নিবে?

সে অপরাধী কন্ঠে ক্ষীন সুর তুলে ডাক দিল,

‘তরী!’

তরী দু হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরলো। বুকের ভেতর ঝড়ো হাওয়া বইছে। ঠিক কতগুলো দিন, কতগুলো ঘন্টা, কতগুলো সেকেন্ড পর এই চিরচেনা কন্ঠ শুনলো তার হিসেব নেই তার কাছে। শুধু মনে হচ্ছে যুগের পর যুগ প্রতিক্ষার পরে, বহু তপস্যার পরে সে এই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সুর শুনতে পেল। সে তো এ জীবনে এই মানুষটার দেখা পাওয়ার, কন্ঠ শোনার আশা ছেড়ে দিয়েছিল।

তরীর অগোছালো দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে। শুধু নির্ঝরকে দেখছে না। নির্ঝরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর মতো দুঃসাহস তার নেই। ওই চোখে চোখ রাখবে কি করে সে? এতগুলো দিন পর ফিরে এসেছে সে। নির্ঝর কি তাকে পুনরায় মেনে নিবে? আগের মতো ভালোবাসবে? তরীর মুখ উপচে কান্না বের হলো।

জড়তা কাটিয়ে নির্ঝর ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি গিয়ে বিছানায় বসে পড়তে চোখ বন্ধ করে ফেলল তরী। নির্ঝর ব্যথাতুর কন্ঠে পুনরায় ডাক দিল,

‘এই তরী?’

কি মোলায়েম আর বিষণ্ণ সুন্দর সে কন্ঠ! তরীর শ্বাস দ্রুততর হয়ে এলো। এত কাছে মানুষটির অস্তিত্ব টের পেয়েও চোখ খুলল না।

বিছারার চাদর চেপে ধরে রাখা তরীর হাতটা ছুঁয়ে দিল নির্ঝর। দু হাতের মুঠোয় পুড়ে নিল। একটুপর তরী হাতটা দিয়ে নিজের গাল স্পর্শ করলো। তরীর দিকে চেয়ে অভিমানী সুরে বলল,

‘ডিঙিরানী! কথা বলবে না আমার সাথে?’

নির্ঝরের গলা ধরে এলো। তরীর বন্ধ চোখের কিনারা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁটদুটো ক্রমাগত কাঁপছে। বারংবার কিছু বলার চেষ্টা করতেও বলতে পারছে না। বুকের গহীনের ক্ষতটা সারিয়ে তুলতে নির্ঝরের স্পর্শ প্রয়োজন। সে আর থাকতে পারলো না। সহ্য করতে পারলো না এই দূরত্ব! এগিয়ে এসে বন্ধ চোখেই নির্ঝরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

তরীকে দু হাতে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো নির্ঝর। বুকের ভেতর নতুন প্রাণশক্তির সঞ্চার হলো। নতুন করে শ্বাস- প্রশ্বাসের সাথে পরিচিত হলো। এ কয়েক দিনে অন্তর পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দেহটা নতুন প্রান ফিরে পেল। পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। তরীকে কাছে পেয়ে চোখ ভিজে উঠলো তার।

তরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এতগুলো দিনের সমস্ত কষ্ট, অত্যাচার, নির্যাতন সব যেন কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে। তরীর এই হাহাকার ভরা কান্নায় রুমের বাতাস ভারী হয়ে গেছে। নিস্তব্ধতার বুক চিঁড়ি একের পর এক দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে। নির্ঝর বাঁধা দিল না। কাঁদুক! আজকের পর থেকে তরী হাসুক, কাঁদুক, অভিমান করুক, রাগারাগি করুক, এমনকি পাগলামি করুক; যাই করুক না কেন সব তার বুকের উপর করবে। সব তার বুকে মাথা রেখে করবে। তার হৃৎস্পন্দন কান পেতে শুনবে। বাম হাতটা দিয়ে তরীর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো সে। একটুপর নরম গলায় বলল,

‘আমি স্যরি তরী। ক্ষমা করো আমায়।’

তরী কিছু বলার চেষ্টা করে এবারও পারলো না। বহুদিন পর তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। প্রশান্তির হাসি। নির্ঝরের বুকে মাথা রেখে সে অন্তত এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে এই জনমে নির্ঝর তাকে কখনো ছাড়বে না। যত যাই হয়ে যাক না কেন, তার চরিত্রে যত কালিমা লেপন হোক না কেন নির্ঝর তাকে ভালোবেসে যাবে। শুধু ভালোবাসবে না, বরং তার ভালোবাসা দিন কে দিন আরো বেড়ে চলবে!

তরী নড়েচড়ে উঠতে নির্ঝর তার মুখটা বুক থেকে তুলল। তরী এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। নির্ঝর দুহাতে তার গালের পানি মুছে দিল। কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তরীর মুখের শিরা উপশিরা গুনে চলল। আচমকা উঁচু হয়ে তরীর কপালে স্বশব্দে চুমু খেল। তরী ভয়ানক লজ্জা পেলেও সরে গেল না। নির্ঝরের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো তার মুখে আছড়ে পড়ছে। সে নিরবে সেই অগোছালো নিঃশ্বাসের ঢেউ গুনতে লাগলো।

নির্ঝর এক হাতে তার ডান গাল ছুঁইয়ে বলল,

‘আমায় দেখবে না তুমি?’

তরী আরো শক্ত করে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল। ঠোঁট টিপে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে সে। চোখে মুখে এসে ভর করেছে রক্তিম আভা। নির্ঝর সকৌতুক সুরে বলল,

‘হাউ ফানি! তুমি নতুন বউয়ের মতো এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন? আমরা কি সদ্য বিয়ে করেছি নাকি? দেখো তোমার বর কত মোটা হয়ে গেছে। ভর সইতে পারবে তো?’

লজ্জায় তরী ডান হাত উঁচিয়ে নির্ঝরের বুকে কিল বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে নির্ঝর বুক চেপে মৃদু স্বরে অার্তনাদ করে উঠলো। তরী চিন্তিত মুখে আচমকা চোখ খুলল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে নির্ঝরের বুকে হাত রেখে বলল,

‘কি হয়েছে? ব্যথা পেয়েছেন কোথাও?’

‘হুঁ! পেয়েছি।’

বলে নির্ঝর হেসে ফেলল। তরীর চোখে চোখ রাখলো। তরী একদৃষ্টিতে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রয়েছে। কি গভীর সে চাহনি! এর গভীরতা শুধু মাত্র নির্ঝর পরিমাপ করতে পারে। নির্ঝরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তরীর চোখদুটো টলমল হয়ে এলো। জীর্ণ হাত উঁচিয়ে সে নির্ঝরের কপাল স্পর্শ করলো। গলার ক্ষত ছুঁয়ে দিল। কাঁধের ব্যান্ডেজের উপর আলতো করে ছুঁয়ে কম্পিত কন্ঠে বলল,

‘ক-কি হয়েছে আপনার? ব্যথা প-পেয়েছেন কিভাবে?’

তরীর হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলল,

‘এসব কিছু নাহ! ছোটখাটো একটা দূর্ঘটনা হয়েছিল।’

‘এত জায়গা আঘাত পেয়েছেন আর বলছেন এসব কিছুই না?’

‘নৌকারানী! আমার বুকের আঘাতের কাছে, বুকের ভেতরের অন্তর্দহনের কাছে এগুলো কিছুই না। তুমি জানো, তোমায় ছেড়ে আমি কতটা কষ্টে ছিলাম? কি বিষাক্ত অনুভূতি হচ্ছিল? কি পরিমাণ জ্বলুনি অনুভব করেছি যে আমি শুধু আমি জানি।’

তরী মাথা নিচু করলো। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘যদি আমি ওখান থেকে পালাতে না পারতাম? কোথায় পেতেন আমাকে? কি করতেন তখন?’

‘তোমার কাছে ঠিক পৌঁছে যেতাম। আর পৌঁছাতে না পারলে ঘরে ফিরতাম না বোধ হয়! আজ হসপিটাল থেকে পালানোর জন্য বের হয়েছিলাম। পথিমধ্যে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল।’

‘কি চেহারা হয়েছে আপনার! এত শুকিয়ে গেছেন কেন?’

‘তোমাকে কাছে পেয়েছি আবার ফিট হয়ে যাব। নিয়ম করে তুমি তিনবেলার জায়গা সাত বেলা খাইয়ে দিবে। কেমন?’

তরী এক নজর নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের দুষ্টুমি মাখা দৃষ্টি থেকে নজর সরিয়ে বলল,

এক্সিডেন্ট করেছিলেন?’

‘হুঁ! ওই রাতেই সিলেট থেকে ঢাকা রওনা দিয়েছিলাম। মাইন্ড ঠিক ছিল না। ফলে এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেদিন থেকে হসপিটালাইজড! না হলে হয়তো অনেক আগে তোমায় খুঁজে বের করতাম। সেদিন রাতে……’

নির্ঝর থেমে গেল। সেদিন রাতের কথা মনে পড়তে তরীর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আশিকের কুটিল হাসিমাখা মুখটা স্মৃতি পটে ভেসে উঠলো। সে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ফের মাথাটা নিচু করে নির্ঝরের বুকে রাখলো।

কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। জানালার ওপাশে অন্ধকার ঘন হয়ে এলো। সময় বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে রাতের দৈর্ঘ্য কমে আসতে লাগলো। তরীর খুব করে বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে। পুনরায় চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘আমার বাবা-মা কোথায়?’

‘রওনা দিয়েছেন ওনারা! কয়েক ঘন্টার মধ্যে এসে যাবে। চিন্তা করো না! তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।’

‘ক্ষুধা লেগেছে আমার।’

‘কি খাবে?’

‘বলবো না!’

নির্ঝর মুচকি হাসলো। তরীকে রেখে উঠে দাঁড়ালো। তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে তরী বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘আপনার পা?’

‘ও কিছু নাহ!’

‘কিছু না মানে? কি অবস্থা হয়েছে পায়ের। সব দোষ আমার!’

বলেই তরী আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কর্ণারের টেবিলের উপর থেকে ফলের জুসের বোতলটা হাতে তুলে নিল নির্ঝর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবার তরীর কাছে চলে এলো। বিছানায় বসে তরীর নাক টেনে ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে বলল,

‘চুপ! আবার কান্না করছো তুমি? এত এত কান্না করলে আমার চারপাশে ছোটখাটো সমুদ্র হয়ে যাবে। আমি সাঁতার পারি না। কি হবে তখন ভেবে দেখেছ?’

তরী নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘আপনার পা!’

‘আমার পা পায়ের জায়গাতেই আছে। কিচ্ছু হয়নি! চুপ একদম!’

তরী থেমে যেতে নির্ঝর জুস গ্লাসে ঢেলে দিল। তরীর মুখের কাছে ধরে নিরবে বলল,

‘এটা খাও! মা এসে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। পাতলা খাবার খেতে হবে তোমাকে। এতদিন না খেয়ে খেয়ে খাদ্যনালি চিকন হয়ে গেছে। ডাক্তার কিছুদিন লাইট খাবার খেতে বলেছে।’

তরী কিছু বলল না। দু হাত কোলের উপর রেখেই সে নির্ঝরের বাড়িয়ে রাখা গ্লাসে চুমুক দিল।

(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here