শেষটা_সুন্দর #অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম) #পর্ব_____০৫

0
767

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____০৫

তরীর কথা শেষ হতে না হতে নির্ঝর হ্যাঁচকা টানে তাকে বুকের উপর ফেলে বলল,

‘মিস তরী!স্যরি মিসেস নির্ঝর শাহরিয়ার।তুমি অলরেডি তিন বার কবুল বলে ফেলেছ!তার মানে আজ থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী।’

তরী অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড নির্ঝরের চোখের দিকে চেয়ে রইলো।নির্ঝরের তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া যেন অনেক কিছু বলতে চাইছে!সে চোখ সরিয়ে নিল।নিজেকে নির্ঝরের বুকের উপর অনুভব করে দ্রুত সরে আসতে চাইলো।নির্ঝর ঠোঁটের কোণে পুরনো সেই স্মিত হাসি ধরে রেখে তার পিঠের কাছের হাতটা আরো শক্ত করলো।

তরী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘মি. নির্ঝর শাহরিয়ার!এক সেকেন্ডের মধ্যে আমায় ছাড়ুন।না হলে কিন্তু এবার সত্যি সত্যি খুন করে ফেলবো।’

‘করো না!প্লিজ খুন করো!আমি হাসতে হাসতে মরতে রাজি।অনেক আগেই আমি ভেতর থেকে খুন হয়ে গেছি।এবার বাইরের খোলসটার প্রাণ নিয়ে নাও তরীরাণী।’

‘আপনার মাথায় গন্ডগোল হয়েছে।কিসব বলছেন?নিজের সেন্সে ফিরুন নির্ঝর ভাই!’

নির্ঝরের হাত ঢিলে হয়ে এলো।তরী শশব্যস্ত হয়ে সরে এলো।অন্য দিকে ঘুরে ঘন ঘন শ্বাস টেনে নিল।বুক ধড়ফড় করছে তার!একটুর জন্য প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়নি!

কেবিনে পিনপতন নিরবতা বিরাজমান।একে অপরের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দহীন আনাগোনা ব্যতিত রুম নিস্তব্ধ।ভারী বাতাসের সাথে হালকা ফিনাইলের গন্ধ এসে নাকে লাগছে।কেবিনের দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে।হালকা সে বাতাসে জানালার সবুজ পর্দা গুলো মৃদু কাঁপছে।জানালার ওপাশে সন্ধ্যা নেমে গেছে।বাইরের সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারের দিকে চেয়ে নির্ঝর ভারী গলায় বলল,

‘আমায় বিয়ে করবে তরী?আল্লাহর কালামকে সাক্ষী করে সত্যি সত্যি আমার স্ত্রী হবে?’

নির্ঝরের ভারী কন্ঠ আরো পর্বতসম হয়ে তরীর কানে পৌঁছাল।নির্ঝরের এই কন্ঠের সাথে তার পূর্বপরিচয় নেই।এই কন্ঠ যে দ্বিধাহীন ভাবে সত্যতা বহন করে।মানুষটার আকুতিতে যে মজার ছিঁটেফোঁটা রেশ নেই।এই অম্লান সত্যতা যাচাই করতে পেরে তরীর বুক কেঁপে উঠলো।

সে নির্ঝরের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলো নির্ঝর তার উত্তরের অপেক্ষা করছে।মনকে শক্ত করে খুব দ্রুত সে মস্তিষ্কে উত্তর সাজিয়ে নিল।হাতের আঙুল মুঠ করে সে নির্ঝরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।নির্ঝরের মলিন দৃষ্টি এখনো জানালার ওপাশে।তরী মৃদু হেসে মুখ খুলতে নিতেই রুমের নিস্তব্ধতার পর্দা চিঁড়ে টুংটাং আওয়াজ বেজে উঠলো।

ফোনের কর্কশ রিংটোনের আওয়াজ।একটানা বেজে চলেছে।সে আওয়াজে নির্ঝর, তরী দুজনে একে অপরের দিকে তাকালো।ভ্রু কুঁচকে নির্ঝর পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে নিজের ফোন খুঁজলো।পাঞ্জাবির পকেটে না পেয়ে প্যান্টের পকেট হাতড়াতে পেয়ে গেল।ফোনটা বের করে দেখলো তার ফোন বাজছে না।তাছাড়া এই রিংটোন তার ফোনের নয়।টোনটা কোনো বাটন ফোনের থেকে আসছে।

সন্দিহান দৃষ্টিতে সে তরীর দিকে তাকালো।তরীর মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেছে।গোল গোল ভয়ার্ত চোখজোড়া তারই পানে চেয়ে আছে।হাতদুটো কোমড়ের কাছে কিছু চেপে ধরে আছে।

নির্ঝর হতাশ সুরে বলল,

‘ফোনটা বের করো!’

তরীর মধ্য কোনো অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা গেল না।সে আগের মতোই দু হাত দিয়ে কোমড় চেপে আছে।ইতোমধ্যে কল কেটে গেছে।বিশ্রী টোনটা মিলিয়ে যেতে তরীর মুখে যেন পুনরায় রক্ত ফিরে এলো।কিন্তু বেশিক্ষণ সে রক্ত স্থায়ী হলো না।তাকে বিপদের দ্বারপ্রান্তে নিক্ষেপ করতে আরেক দফা ফোন বেজে উঠলো।নির্ঝর এবার ধমকে বলে উঠলো,

‘ফোন বের করতে বলেছি তরী! নাকি আমি নিজ হাতে বের করবো?’

তরী শাড়ির আঁচলের তলা থেকে কোমড়ে গুঁজে রাখা অল্প দামের বাটন ফোনটা বের করলো।ফোনটা হাতে নিয়ে নাম চোখে পড়তে ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল।আশিক ফোন করেছে!

দ্বিতীয় বারের মতো ফোন কেটে গেল।নির্ঝর তরীর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর শান্ত গলায় বলল,

‘আমার জানামতে, তোমার কোনো পার্সোনাল ফোন থাকার কথা না তরী।তাহলে এই ফোনটা কোথায় পেলে?’

তরী কয়েক সেকেন্ড মৌন রইলো।দেড় দুই মিনিট পর নিশ্চুপতা ভেঙে একটানা বলল,

‘আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি নির্ঝর ভাই।ওর নাম আশিক!ফোনটা ওই আমাকে দিয়েছে।কথা বলার জন্য।এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম।আজ ভুলে কিভাবে যেন সাইলেন্ট মুড অন হয়ে গেছে।আর আপনি ধরে ফেললেন।আমি দুঃখীত নির্ঝর ভাই।আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।আশিককে আমি ভীষণ ভালোবাসি।’

নির্ঝর কোনো প্রতিত্তর করলো না।হাতের ফোনটা বিছানায় ফেলে রাখলো।পা টান করে আস্তে করে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।পায়ের কাছের চাদরটা বুক পর্যন্ত টেনে চোখ বন্ধ করলো।

নির্ঝরের আকস্মিক নিরবতা সহ্য হলো না তরীর।সে সামান্য এগিয়ে গিয়ে অনুরোধের স্বরে বলল,

‘আপনার খাবারটা খেয়ে নিন নির্ঝর ভাই।’

‘ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!আমার এখন ঘুম দরকার!চলে যাও।’

‘কিন্তু একটু খে…….’

নির্ঝরের গলার স্বর ভয়ানক উঁচু হয়ে গেল।রক্তচক্ষু নিয়ে চিল্লিয়ে বলল,

‘বললাম না চোখের সামনে সরে যেতে?জাস্ট টু সেকেন্ডস!দুই সেকেন্ডের মধ্যে চোখের সামনে থেকে দূর হও!’

নির্ঝরের ধমকে তরীর চোখে জল চলে আসলো।সে কি এমন ভুল বললো যে এভাবে রিয়েক্ট করতে হবে?অপমানে তার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।সে নির্ঝরের রাগান্বিত মুখের দিকে এক পলক চেয়ে সুড়সুড় করে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।

তরীর গমনপথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নির্ঝরের রক্তলাল চোখ জোড়া টলমল হয়ে উঠলো।চোখের মরা শুষ্ক নদী জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।হৃদয়ের পুরনো ক্ষতে যেন কেউ নতুন করে আঘাত করলো।তরতাজা হয়ে উঠলো।বুকের ভেতর হু হু করে উঠছে বার বার।সে তো জানতো তরী এমন উত্তর দিবে।তবুও এত কষ্ট হচ্ছে কেন আজ?তরীর এত বড় সত্যিটা সে কেন মেনে নিতে পারছে না?কেন অমোঘ কষ্ট হচ্ছে?

নির্ঝর পাঞ্জাবির হাতায় নাক মুছলো।চোখ জ্বালা করছে।দুই চোখের পাতা এক করতে চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।

____________

‘ফুপি তুমি পাগল হয়ে গেছো?কি বলছো এসব?আমি নির্ঝর ভাইকে বিয়ে করবো?তুমি বলছো এসব?’

তরীর বিস্ময় মাখা মুখ উপেক্ষা করে মমতাজ বেগম সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

‘হ্যাঁ আমি বলছি।কেন?নির্ঝরকে তোর পছন্দ নয়?স্মার্ট ও সুর্দশন একটা ছেলে।তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন।মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।সাথে ভালো জব করছে।আর কি চাই তোর?’

তরী হাঁসফাঁস করতে করতে ফুপির সামনে থেকে সরে গেল।তারা নির্ঝরকে হসপিটাল থেকে রিলিজ হরে বাড়িতে নিয়ে এসেছে ঘন্টাখানেক হলো।এর মধ্যে বিয়ের কথাবার্তাও চলছে।রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার মমতাজ বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো তরী।হতাশ সুরে বলল,

‘নির্ঝর ভাইকে কোনো মেয়েই অপছন্দ করবে না ফুপি।কথা সেটা নয়,কথা হচ্ছে আমি উনাকে পছন্দ করি না।পছন্দ করি না বলতে এখনি আমি বিয়ে করতে চাই না।’

‘তুই না চাইলে কি হবে তরী?তোর বাপ দুদিন পর পর বাড়িতে পাত্রপক্ষ নিয়ে আসছে।আর তুই ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে পাত্রপক্ষের সামনে যাচ্ছিস।দু পক্ষের মিল পড়ছে না বলে তোর বিয়েটা হচ্ছে না।মিল যে কোনো দিন পড়বে না তার ইয়ত্তা আছে?তার চেয়ে আমার কথা শোন মা আমার!নির্ঝরকে বিয়ে করে নে।আমি নিশ্চিত, নির্ঝরের মতো করে ভালো তোকে পৃথিবীর কেউ রাখতে পারবে না।’

‘আমি রাজি হলেই হলো ফুপি?নির্ঝর ভাইয়ের বাবা-মা রাজি হবে না।উনারা আমার মতো গ্রামে বড় হওয়া, জীবনে শহর না দেখা মেয়েকে ওমন ছেলের বউ করবে না নিশ্চয়ই!’

মমতাজ বেগম মৃদু হাসলেন।তরী যে তাকে কথার প্যাঁচে ফেলতে চাচ্ছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।তরীর মনের কথা তার অজানা নয়।কিন্তু তরীর ভবিষ্যত সুখের জন্য এটুকু কঠোর তাকে হতেই হবে।তিনি স্পষ্ট ভাবে বললেন,

‘তুই খুব ভালো করে আমায় চিনিস তরী।আমি ঝোঁকের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নেই না।তোর আর নির্ঝরের কথা আমি অনেক আগে থেকে ভেবে রেখেছিলাম।আজকের ঘটনা থেকে মনে হলো তোদের এক করে দেয়া আমার অন্যতম উচিত কাজ।আমি ইতোমধ্যে নির্ঝরের বাবা-মা, তোর বাবা-মা সবার সাথে কথা বলে ফেলেছি।সবাই বেশ খুশি এবং রাজি।কয়েকজন তো রওনা দিয়ে দিয়েছে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার জন্য।শোন!এখন শুধু তোর মতামত প্রয়োজন তরী।কারণ নির্ঝর বলে দিয়েছে,তুই মত না দিলে বিয়ে করবে না।’

তরী ঠোঁট কামড়ে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করলো।কিছুতেই মনোবল হারানো চলবে না।সে আশিককে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না!এখন আশিকের কথা সবাইকে বলবে কি করে?বাবা নিশ্চিত তাকে মারধোর করবে।কিছুতেই নির্ঝরের মতো ছেলে হাতছাড়া করবে না।

তরী আচমকা মমতাজ বেগমের হাত চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

‘ফুপি আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি।ওকেই বিয়ে করবো।প্লিজ!’

মমতাজ বেগম হাত ছাড়িয়ে নিলেন।কঠোর কন্ঠে বললেন,

‘ছেলেটার নাম আশিক।তোর কলেজের সিনিয়র।অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।পলিটিক্যাল লিডার!সারাদিন রাত কলেজে, রাস্তাঘাটে গুন্ডা,বদমাশি করে বেড়ায়।তার চেয়ে বড় কথা ছেলেটার চরিত্র জঘন্য।ওমন একটা ছেলের সাথে তোর জীবন জুড়ে দেওয়ার চেয়ে মেরে সাগরে ভাসিয়ে দিবো।’

‘ফুপি ও খুব ভালো ছেলে।ওকে যে…..’

‘চুপ!একদম চুপ।তরী,তুই বিয়ে না করার অন্য হাজারটা কারণ দেখিয়ে অন্য একটা কারণ দেখালে আমি থেমে যেতাম।কিন্তু আশিকের মতো চরিত্রহীন একটা ছেলেকে কারণ হিসেবে দেখালে আমি জোর করে তোর বিয়ে দিবো।’

তরী শব্দ করে কেঁদে উঠলো।ফ্লোরে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ফুপি, আশিক অনেক ভালো ছেলে।ও আমায় কথা দিয়েছে আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।আমাকে ছাড়া মরে যাবে।’

‘মরবে না তরী।তুই যে চোখে কালো পট্টি বেঁধে ঘুরছিস,তোর সেই কালো পট্টি খোলার জন্য হলেও আজ রাতেই নির্ঝরের সাথে তোর বিয়ে দিবো আমি।’

মমতাজ বেগম গটগট করে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।রাত আটটা বাজে!নতুন বউ নিয়ে বরযাত্রীদের ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজার কথা।এরই মধ্যে তাকে সব ব্যবস্থা করতে হবে।

______________

“আমি তরী!আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে দূরুহ ব্যাপার।সেজন্য আমি পালিয়ে গেলাম।আশা রাখলাম,আমায় কেউ খোঁজার চেষ্টা করবেন না।”

রাত দশটার দিকে নির্ঝরের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে এই মেসেজটা আসে।সে তখন সবেমাত্র বিয়ের নতুন পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছিল।মেসেজটা দেখার পরপরই তার পৃথিবীটা বর্ণহীন হয়ে গেল।জীবনের সবটুকু রং সাথে নিয়ে কেউ যেন পালাল।বুক চিঁড়ে বের হওয়া অগুণতি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সে অসুস্থ শরীর নিয়ে সমস্ত বাড়ি তন্নতন্ন করে তরীকে খুঁজলো।না পেয়ে শুধুমাত্র বড় মাকে সত্যিটা জানিয়ে, এদিকটা সামলাতে বলে সে রাস্তায় বের হলো।

(চলবে)

দু-চার পর্ব পড়ে সম্পূর্ণ গল্প বিচার না করার অনুরোধ রইলো।আর কিছুটা পথ যাক!তারপর ভালো মন্দ বিচার করবেন।সবশেষে, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।🤎

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here