#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ২৫
শিরিনা বেগম সেই থেকে ছেলেকে সমানে বকেই যাচ্ছে। এভাবে কেন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেল শিশির। শিশির ভয়ে মুখটা কাচুমাচু করে ওয়েটিং রুমে বসে আছে। সমানে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে চলেছে বেবীটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তাহলে কী করে এই পাপী মুখ সে বিন্দুকে দেখাবে। বিন্দুর মা’কেও খবরটা দিতে সাহসে কুলাচ্ছে না শিশিরের। সব মিলিয়ে প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে। শিশির ওয়েটিং রুমে হাতদু’টো মুঠো করে তার ওপর থুতনি ঠেকিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ জোড়া বারবারই জলে ভরে উঠছে। একটা অজনা ভয়-আশংকা! সব মিলিয়ে খুব খারাপ সময় পার করছে। হসপিটালে নিয়ে আসার একটু পরেই জ্ঞান ফিরে বিন্দুর। কিন্তু কারো সাথেই কোনো কথা বলে না৷ এরপর নিয়ে যাওয়া হয় আলট্রাসনোগ্রাফিতে। সেখান থেকে পাঁচ মিনিট হওয়ার আগেই বিন্দুকে বের করে আনা হয়। শিশির এসেই বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
–এত তাড়াতাড়ি আলট্রাসনোগ্রাফি শেষ?”
কিন্তু বিন্দু কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। চুপচাপ নার্সের সঙ্গে কেবিনের দিকে চলে গেল। শিরিনা বেগমও পিছুপিছু গেলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর রিপোর্ট বের হলো। শিশির ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললো,
–আপনি তো বলেছিলেন আপনার বউ প্রেগন্যান্ট। কিন্তু উনি তো প্রেগন্যান্ট না।”
কথাটা শুনেই একটা বড়সড় ধাক্কা খেলো শিশির। অবাক হয়ে বললো,
–কিন্তু রমজানের মধ্যেই তো ওর ইউরিন টেস্ট করানো হয় আর সেখানে পজেটিভ আসলো।”
ডাক্তার বললো,
–হয়তো ভুল ইনফরমেশন দিয়েছে।”
–আজকাল মেডিক্যাল সায়েন্সও কী ভুল তথ্য দেয়?”
–নাহ্। তবে যে যন্ত্রের মাধ্যমে টেস্ট করানো হয় সেটায় যদি প্রবলেম থাকে তাহলে তো ভুল তথ্য দেবেই। তবে হ্যাঁ, আপনার ওয়াইফের একটা প্রবলেম আছে।”
শিশির উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো,
–কী প্রবলেম?”
–ওনার পেটে একটা টিউমার হয়েছে। সম্ভবত এটার বেশ বয়স হয়েছে। আর আমার মনে হয় এটার জন্যই তখন প্রেগন্যান্সির রেজাল্ট পজিটিভ দেখায়।”
–কিন্তু ডক্টর এটা তো আলট্রাসনোগ্রাফিতে হলেও বিশ্বাস যোগ্য ছিল। কিন্তু ইউরিন টেস্টে এটা কী করে সম্ভব হয়?”
ডাক্তার বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
–হুম সেটাও ঠিক বলেছেন। যাই হোক তবে আমাদের এখানকার মেশিনগুলোতে কোনো প্রবলেম নেই৷ আর আমি নিঃসন্দেহে বলছি, “আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট না।”
শিশির যেন ডাক্তারের কথাগুকোতে ভরসা হারিয়ে ফেলেছে। পরক্ষণেই কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললো,
–তাহলে ডক্টর ওর এত বমি কেন হতো? মাথা যন্ত্রণাও করতো খুব।”
ডাক্তার আর কিছু না বলেই আরও দুইটা টেস্ট লিখে দিলেন। একটা ব্লাড টেস্ট আর একটা ইউরিন টেস্ট। আবারও একটা ঘণ্টা অপেক্ষা! রিপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই শিশিরের। বিন্দু কিছুতেই এসব কথা বিশ্বাস করবে না। মেয়েটা কত লড়াই করেছে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে৷ এখন যদি শুনে ওর কোনো বাচ্চাই হবে না তাহলে এটা কিছুতেই মানতে পারবে না। উল্টো সব দোষ এসে পরবে শিশিরের ঘাড়ে। শিশির ভয়ে ভয়ে আল্লাহকে ডাকলো৷ যেন রিপোর্টে পজেটিভ আসে। বারবার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। শিিশর হাতের উল্টো পিঠে বেখেয়ালি ভাবে জমে থাকা ঘাম মুয়ছে নিচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পর ডাক্তারের কেবিনে আবারও রিপোর্ট নিয়ে ঢুকলো। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন,
–ওনার টাইফয়েড হয়েছে। জ্বরটা কমে গেলেও। ভেতরে ভেতরে ঠিক রয়ে গেছে। যেটা ওনাকে দুর্বল করে দিচ্ছিলো। আর প্রচন্ড গ্যাস্ট্রিক বাড়ছে যার কারণে মাথা যন্ত্রণা আর বমি হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই। কিছু ইনজেকশন লিখে দিচ্ছি। প্রতিদিন সকাল-বিকাল নিয়ম করে ইনজেকশন পুষ করলেই বমিটা কমে যাবে।”
শিশির আশাহত কণ্ঠে বললো,
–সত্যিই ডক্টর ওর বেবী হবে না?”
ডাক্তার খুব সাবলীল ভাবে উত্তর দিলেন,
–নাহ্।”
ডাক্তারের এই একটা কথা আরও বেশি ভয়ের মধ্যে ফেলে দিলো শিশিরকে। একটুখানি আশার আলো যেন ধপ করেই নিভে গেল।
শিশির চিন্তিত স্বরে বললো,
–ডক্টর ওর টিউমারের কী হবে?”
–আপাতত টাইফয়েড আর বমিটা কমুক। আমি পাঁচ দিনের ইনজেকশন দিচ্ছি। আশা করি কমে যাবে৷ আর পাঁচদিন পর ওনাকে নিয়ে আসবেন। ওনার অপারেশন করাতে হবে। নতুবা যদি টিউমার পেকে গিয়ে ব্লাস্ট করে তাহলে তা আপনার ওয়াইফের জন্য খুবই হুমকিস্বরুপ হবে৷ ইভেন মারাও যেতে পারে।”
শিশির ডাক্তারের কথায় বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেল৷ তারপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে চলে আসলো।
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে ওদের। শিরিনা বেগম বিন্দুকে ধরে এনে শুইয়ে দিলেন। বিন্দু চোখ বন্ধ করে বিছানায় পরে আছে। মাথা যন্ত্রণাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। রিদি এসেও পাশে বসলো। শিরিনা বেগম মেয়েকে কোন কথা বলতে বারণ করলেন। শিশির বাসায় আসার সাথে সাথেই ঘটক ফোন করলো।
–কী ব্যাপার শিশির সাহেব। ঈদ তো শেষ। বিয়ের দিন-তারিখ কবে ঠিক করবেন? কথা তো ছিল ঈদের পরেই বিয়ে হবে।”
–আসলে চাচা একটা অঘটন ঘটে গেছে। আমার ওয়াইফ সিঁড়ি থেকে পরে গিয়ে এখন মারাত্মক অবস্থা। এছাড়াও আবার টেস্ট করাতে গিয়ে টিউমার ধরা পরছে। ইমার্জেন্সি অপারেশন করাতে হবে। যদি বিয়েটা একটু পিছানো যায় তাহলে আমার জন্য ভালো হতো। আপনি প্লিজ ওনাদের একটু বুঝিয়ে বলুন। এখন এই পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে কী করবো। আর তাছাড়া আমি মানুষ একা সবদিক আমাকেই সামলাতে হয়।”
–হুম বুঝছি। আমি ছেলে পক্ষের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি। ”
–আচ্ছা। ওনাদেরকে একটু বঝিয়ে বলবেন। ”
–হুঁ।”
শিশির স্পষ্ট বুঝতে পারছে ঘটক সাহেবের গলায় বিরক্তির ভাব। কিন্তু তাতে শিশিরের কিচ্ছু যায় আসে না। যেখানে তার প্রিয় মানুষটা অসুস্থ হয়ে পরে আছে সেখানে অন্য কিছুতেই মেতে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। আর বিয়ের মতো এমন একটা আনন্দের মুহূর্তে যদি বিন্দু না থাকতে পারে তাহলে এমন বিয়ে না হোক তাতে কিছুই হবে না। আগে তার প্রিয় মানুষটার সুস্থ হওয়া প্রয়োজন তারপর বাকি সব। ভাবনার মাঝেই দরজায় টোকা পরলো। শিশির ভারাক্রান্ত হয়ে দরজা খুলতেই সাজেদা বেগম আর বিধুকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে কুশল বিনিময় করলো। সাজেদা বেগম রুমে এসে মেয়ের পাশে বসলেন। আলতো করে মাথার ব্যান্ডেজে হাত ছোঁয়ালেন। কারো হাতের ছোঁয়া পেয়েই বিন্দু চোখ মেলে তাকালো। মাকে আর বোনকে দেখে উঠতে নিলেই সাজেদা বেগম বারণ করলেন।
–কীভাবে এসব হলো? ”
শিশির ভয়ে ভয়ে পুরো ঘটনা বললো।
সাজেদা বেগম এখনো ধোঁয়াশার মাঝে আছেন। কারণ উনি তো জানেন ওনার মেয়ে প্রেগন্যান্ট। তাহলে বাচ্চাটা আধেও ঠিক আছে কিনা, না জানা অব্দি শান্তি লাগছে না সাজেদা বেগমের। সব শুনে চুপ করেই থাকলেন। কারণ শিরিনা বেগম আর রিদির সামনেও তো কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। শিরিনা বেগমের সাথে কথা শেষ হতেই উনি আর রিদি চলে গেলেন নাস্তার আয়োজন করতে। এই ফাঁকে সাজেদা বেগম ব্যালকনিতে ডেকে নিয়ে গেলেন শিশিরকে।
–শিশির বাচ্চাটা ঠিক আছে তো?”
শিশির মন খারাপ করে বললো,
–মা একটা বেড নিউজ আছে!”
–বাচ্চাটা নেই তাই তো?”
–মা বিন্দু প্রেগন্যান্টই ছিল না। ওর পেটে একটা টিউমার হয়েছে।”
সাজেদা বেগম অবিশ্বাস্য সুরে বললেন,
–কী বলো?”
–হ্যাঁ মা, আমিও এটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। ওর আলট্রা করানো হয় সেখানে টিউমার ধরা পরে। এরপর ব্লাড টেস্ট আর ইউরিন টেস্ট করানো হয় সেখানে টাইফয়েড ধরা পরে আর প্রচন্ড গ্যাস্ট্রিক বাড়ছে। ”
–হুম। রমজানেও যখন টেস্টগুলো করানো হয় তখনও বলছে টাইফয়েড হয়েছে।’
”
–হুম। ডাক্তার বলছে জ্বরটা ভেতরে ভেতরে রয়ে গেছে যার কারণেই ও এতটা দুর্বল হয়ে পরেছে। আর প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। তখন ডাক্তার বলছে,” হয়তো যেই মেশিনে টেস্ট করানো হইছে সেটায় প্রবলেম ছিল তাই ভুল রেজাল্ট দেখাইছে। ” কিন্তু আমার মন মানছিল না। তারপরে যখন ওই দুইটা টেস্ট করাই তখনও দেখি নেগেটিভ আসছে। এখন আমি আর কী বলবো। ডাক্তারের মুখে মুখে তো তর্ক করতে পারি না। আমি সেই রিপোর্ট গুলি আপনাকে দেখাই?”
–না লাগবে না। যাক যা হয় ভালোর জন্যই হয়। না হলে একটা অবৈধ বাচ্চাকে সারাজীবন তোমার বয়ে বেড়াতে হতো। আল্লাহ যা করছেন ভালোর জন্যই করছেন।”
–কিন্তু মা আমার এটাতে কোনো আপত্তি ছিল না। আমি নিজেকে সুখী মানুষই ভেবেছি। বাচ্চাটা যারই হোক ওকে আমি নিজের বলেই জানতাম। ”
–এতটা উদার হয়ো না শিশির। বাস্তবতা এত সহজ না।”
কথাটা শেষ করেই যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন সাজেদা বেগম। মনে হয় মাথা থেকে বড় কোনো বোঝা নেমে গেছে। যেটার ভার বহন করতে করতে উনি ক্লান্ত হয়ে পরেছেন।
গঠনমূলক মন্তব্য চাই সবার।
চলবে,,,,,,,