#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-৭
বেশ অনেকক্ষন ধরে ওয়াশরুমের দরজা খোলার চেষ্টা করছে সুমনা। অনেক টানাটানি, ধাক্কাধাক্কি, লক ঘুরানো, সবভাবেই চেষ্টা করা শেষ কিন্তু দরজা আর খোলে না। শুরুতে ব্যাপারটা আমোলে না নিলেও এখন ভয় করতে শুরু করেছে সুমনার। ঘড়ি দেখলো, প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে সে লক হয়ে আছে। এতোক্ষণে সে বাসার কাছাকাছি পোঁছে যায়। সে আরো কয়েক বার ঠান্ডা মাথায় লকটা খোলার চেষ্টা করলো। নাহ, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এবার দরজায় আওয়াজ করে করে ডাকতে শুরু করলো-
“কেউ আছেন? আছেন কেউ? আমি আঁটকা পড়েছি, প্লিজ একটু হেল্প করুন আমাকে।”
বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে সুমনার কান্ডকারখানা শুনে শুনে হাসছিলো আদি। একবার ভাবলো খুলে দেয়। দরজার কাছে যেয়েও আবার ফিরে এলো। মাথা নাড়লো, আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, এই মেয়ে অনেক শক্ত, সহজে ভাংবে না।
বেশ অনেকক্ষন ধরে দরজায় আওয়াজ করে ডাকাডাকি করেও কারো সাড়া পেলো না সুমনা। এখন তার খারাপ লাগতে শুরু করেছে। ঘড়ি দেখলো, আরো আধাঘণ্টা পার হয়ে গেছে। সুমনা ঘামতে শুরু করলো। সুমনা ভেবেছিলো, কেউ না কেউ ওয়াশরুমে আসবে তখন দরজা আপনাতেই খুলে যাবে। এখন তো সন্ধ্যা লেগে আসছে। এই সময় আর কে ওয়াশরুম আসবে? সুমনার কান্না পেয়ে গেলো, তার কি আজ রাত এখানেই কাটাতে হবে নাকি? ভাবনাটা মাথায় আসতেই সুমনা আরো অস্থির হলো। সে কান্না গিলে নিয়ে আবার ডাকতে শুরু করলো।
এবার আদি সাড়া দিলো-
“কে? কে আছেন বাথরুমে? ”
“ভাই একটু দেখুন তো আমি লক হয়ে গেছি ভিতরে। দরজায় কি সমস্যা দেখবেন একটু?”
সুমনা করুন গলায় মিনতি করে।
“অবশ্যই করবো আপু, তার আগে আপনি বলুন তো আপনি কে?”
“আমি আজরা জাবিন, ফাস্ট ইয়ার, সিএসই ডিপার্টমেন্ট।”
“এটা তো ভালো নাম বললেন, ডাকনাম কি আপনার? স্কুল কোনটা?”
রাগ হয়ে গেলো সুমনা। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে চেচিয়ে উঠলো-
“আমার ডাকনাম দিয়ে আপনার কি দরকার? আমি বিপদে পড়ে আছি আর আপনি আমার সাথে মজা করছেন?”
“আস্তে সুমনা বেইবি আস্তে! এতো অস্থির হচ্ছো কেন? এবার স্বীকার করে ফেলো তো যে, তুমি সেই সুমনা?”
“আদি! হারামী তুই আবার আমার পিছনে লেগেছিস? এবার আমি তোকে ছাড়বো না, কিছুতেই ছাড়বো না। তুই আমাকে এখানে আঁটকেছিস?”
“আর কে? কার এতো ঠেকা পড়েছে তোর পিছনে টাইম ওয়েস্ট করবে?”
“শয়তান, দরজা খোল তাড়াতাড়ি। এবার তোর কি হাল করি দেখিস?”
“কেন রে? এবারো পালিয়ে যাবি নাকি?”
বলেই ফিক ফিক করে হাসলো আদি।
“আদি, দরজা খোল বলছি! সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আমি বাড়ি যাবো?”
“তাহলে তুই স্বীকার কর যে, তুই সেই সুমনা যে সৃষ্টি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলি? তারপর আমার সাথে না পেরে স্কুল চেন্জ করেছিলি?”
“হ্যা রে বদমায়েশ হ্যা, আমি সেই সুমনা। হয়েছে? গেট খোল এবার!”
আদি বত্রিশ পাটি বের করে হাসতে হাসতে গেট খুলে দিলো। সুমনার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসা মাত্রই তার মনে হলো, সে বিশাল বড় বোকামি করে ফেলেছে। রাগের মাথায় সে সবকথা গড়গড় করে বলে দিয়েছে। পরক্ষণেই ভাবলো যা হয়েছে ভালো হয়েছে। সব জানাজানি হয়ে গেছে, এখন আর কোনো ঝামেলা রইলো না। সুমনা আদির দিকে একবার অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গটগট করে হাঁটতে শুরু করলো। আদি হাসতে হাসতে ওর পিছু নিলো-
“এই সুমনা, কথা আছে তোর সাথে। চলে যাচ্ছিস কেন?”
“কি চাস তুই? কেন আমার পিছু নিয়েছিস?”
হাঁটা থামিয়ে আদির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো সুমনা। আদি থমকে গেলো, অবাক গলায় বললো-
“আমি কি চাইবো? তোর সাথে শুধু একটু কথা বলতে চাইছি!”
“কি কথা তোর আমার সাথে? আমরা কি তোর বন্ধু হই? নাকি ছিলাম কখনো?”
“ছিলি না? আচ্ছা! শত্রু তো ছিলি?”
“তো?”
ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সুমনা আদির দিকে।
“তো আবার কি?”
আদি পাল্টা জানতে চায়।
“শুধু আমার পরিচয় জানার জন্য তুই আমায় বাথরুমে আঁটকে রেখেছিলি?”
কথাটা বলতে বলতে আদিকে হিমশীতল চাহুনি দিয়ে গিলে নিতে চাইলো সুমনা।
“হ্যা। তোকে ভালো ভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই বলিসনি।”
“তোর জানতে হবে কেন? এই যে জানলি, কি লাভ হলো?”
“লাভ লোকসানের কি আছে? তুই স্কুল ছেড়ে দিলি, তোর সাথে আর দেখা হলো না। আমার তোকে কিছু বলার ছিলো।”
“সরি বলতে চাইছিলি তো? কিন্তু আমি তো শুনতে চাই না। না তোর সরি না থ্যাংকু, বুঝেছিস?”
“আমি কিন্তু সত্যিই সরি বলতে চাইছি, মন থেকে! আমি তখন বুঝতে পারিনি যে তুই….”
হাতের ইশারায় আদিকে থামিয়ে দিলো সুমনা-
“তোর এসব নাটুকে কথাবার্তা তুই নিজের কাছেই রাখ, এসব আমি শুনতে চাই না। আর শোন, আজকে তুই যে কাজটা করলি এটা খুব খারাপ হয়েছে। তুই আসলে একদম আগের মতোই বদমাশ আর ইতর রয়ে গেছিস। একদম চেঞ্জ হসনি।”
বলেই ঘুরে হাঁটা দিলো সুমনা। আদি ব্যাথিত মুখ করে সুমনার চলে যাওয়া দেখছে। সুমনা কিছুদূর যেয়ে আবার ফিরে এলো-
“আর একটা কথা, ভার্সিটিতে তুই আমার সিনিয়র, সিনিয়র হয়েই থাক। সম্মান নিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে, ঠিক আছে?”
আদিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই গটগট করে হেঁটে ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে গেলো সুমনা।
আদির কানে সুমনার বলা কথাগুলো এখনো বাজছে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা ভীষণ রকম রেগে আছে। মনটা খারাপ হলো আদির। ও তো সরি বলতে চাচ্ছিলো। ছয় বছর আগের করা দুষ্টুমির জন্য সরি বলাটা জরুরি কিন্তু মেয়েটা তো ওর কোনো কথাই শুনতে চাইছে না? আদি ভাবলো কিছুক্ষন, সুমনা রাগ করাটা হয়তো জাস্টিফাইড। ওর জন্যই মেয়েটাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু আদি তো আজো বোঝে না, সুমনা কেন স্কুল ছেড়ে দিলো, কেন ও ইয়ার গ্যাপ দিলো, কেন সুমনা ওর এতো সুন্দর চুলগুলো কেটে ফেললো? আচ্ছা! তখন কেটেছিলো ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে কি আর চুল বড় করা যাবে না? আদির খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সুমনার সাথে এই ভার্সিটি মাঠে বসে অনেক অনেকক্ষন ধরে গল্প করতে। কেন জানে না সুমনার জন্য অন্যরকম টান অনুভব করছে। কেন করছে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে আদি।
*******
বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে আজ। সুমনা অস্থির হয়ে ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই ব্যাগটা ছুড়ে ফেললো বিছানায়। থমথমে মুখচোখ নিয়ে সে কোনোরকমে কাপড় চোপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। পিছনে আশা অবাক হয়ে তাকিয়ে সুমনা কে দেখছিলো, এতো খারাপ মেজাজে কখনো দেখেছেন কিনা ভাবছেন! বছর ছয়েক আগে একবার দেখেছিলেন এমন মেজাজ। প্রতিদিন বাসায় ফিরেই আগে গাবলুর কথা জিজ্ঞেস করে। আজ কোনো কিছুই বললো না? সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলো? আশা একবার কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো। এখন বললে মনেহয় না কোনো উত্তর পাওয়া যাবে। তার মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেছে? আগের মতো উচ্ছসিত থাকে না। মেয়ে ভাবে সে কিছু বোঝে না। কিন্তু তিনি তো মা, সন্তানকে বুঝবেন না তা কি হয়? আশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে টেবিলে খাবার দিতে গেলো।
সুৃমনা শাওয়ার ছেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো শাওয়ারের নিচে। খুব রাগ হচ্ছে, খুব! কেন প্রতিবার এমন করবে আদি? কেন? কেন প্রতিবার জিতবি তুই? এতো সখ তোর আমাকে হারানোর? এবার তোকে এমন শিক্ষা দেবো যাতে সারাজীবন মনে রাখিস তুই? চাইলেও যাতে ভুলতে না পারিস। এই যে আজ আমাকে এভাবে জ্বালালী এর জন্য তোকে পস্তাতে হবে। তুই কি ভেবেছিস! সবসময় দোষ করে পার পেয়ে যাবি? নো ম্যান, নো! এখনো তাহলে এই সুমনাকে চিনিস নি তুই। সব মনে রেখেছি আমি, কড়ায় গন্ডায় সব শোধ তুলবো। তোকে আমার কাছে নত হতেই হবে আদি! নত হতেই হবে! তোর জন্য আমার এতো সাধের চুলগুলো কাটতে হয়েছিলো, স্কুল চেন্জ করতে হয়েছিলো। তোকে যাতে ভুলে না যাই সেজন্যই তো রাগে জেদে এই চুল আর বড় করলাম না। সবসময় ছেঁটে ছোট করে রাখি চুলগুলো। আর তাছাড়া ভাগ্য এতোবড় সুযোগ যখন দিয়েছে, সে সুযোগ তো হেলায় নষ্ট করা ঠিক হবে না, তাই না? তোর সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ছি, এটাতো ভাগ্যই বলতে হবে। যদিও একই ব্যাচে পড়ার কথা ছিলো, কিন্তু তুই তা হতে দিসনি। এখন তোর জুনিয়র হয়ে তোকে কিরকম নাকানি চুবানি খাওয়াবো দেখবি। সুমনার চোখ থেকে পানি পরছে। যদিও ঝর্নার পানি আর চোখের পানি আলাদা করা যাচ্ছে না তবুও ওর লাল চোখ দেখে বোঝা যায় কাঁদছে মেয়েটা। মুখে অদ্ভুত ধরনের হাসি। মেয়েটাকে দেখতে ভয়ঙ্কর লাগছে। রাগ, জেদ, ক্রোধ ওকে একেবারে অন্যকেউ বানিয়ে দিয়েছে।
ওদিকে আদি অন্যরকম কিছু ভাবছিলো। আদির স্বভাবের চাইতে অন্যরকম সে ভাবনা। সুমনার এই মুহুর্তের ভাবনা জানলে আদি হয়তো শিউরে উঠতো! দুজনের দু’রকম ভাবনা কি কখনো একরকম হবে? দেখা যাক কি হয় সামনের দিনগুলোতে!
চলবে—–
©Farhana_Yesmin