#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১২
হালকা করে তরীর সদ্য বিনুনি করা চুল টেনে ধরে তাকে কাছে নিয়ে এলো নির্ঝর। চোখে চোখ রেখে টেনে টেনে বলল,
‘তারপর তৃতীয় বারের মতো আবার আমিই বিয়ে করবো!’
‘তৃতীয় বারের মতো কবুল বলার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে বসে আছি!’
তরীর ব্যঙ্গাত্মক কথার ভঙ্গি কানে যেতে নির্ঝর এক হাতে তার কোমড় চেপে ধরে আরো একটু কাছে নিয়ে এলো। চোখ সরু করে বলল,
‘হাউ ফানি! কবুল বলবে না মানে? তুমিসহ তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে কবুল বলানোর ক্ষমতা এই নির্ঝর শাহরিয়ার রাখে। তরীরানি, তুমি এখনো আমাকে চিনলে না। সো স্যাড!’
‘ছাড়ুন! আপনার গা দিয়ে গন্ধ।’
‘গন্ধ?’
নির্ঝর নিজের শার্ট একবার শুঁকে তরীর গলার কাছে মুখ নিয়ে লম্বা করে শ্বাস টেনে নিল। তরী জমে পাথর হয়ে গেল। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য নির্ঝরের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইল। নির্ঝর উল্টো হাতটা এক হাতে বুকে চেপে ধরে বলল,
‘তোমার গায়ের গন্ধ থেকে বেশি নয়। তুমি যে টানা সাতদিন শাওয়ার নাও না!’
‘ছি! কি মিথ্যুক আপনি। একবার শুধু দুইদিন গোসল করেছিলাম না। আর আপনি সাতদিন বানিয়ে দিলেন?’
‘জোর না করলে তো আরামসে সাতদিন হয়ে যেতো।’
‘এই ছাড়ুন তো আপনি!’
তরীর অস্থিরতায় ডুবে থাকা মুখের দিকে পলকহীন চোখে নির্ঝর চেয়ে রইলো। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ধরে রেখে বাম হাতটা উঁচু করে তরীর মুখে হালকা করে ছুঁয়ে দিল। তার স্পর্শ পেতে তরী সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে বুকের কাছের শার্ট আঁকড়ে ধরলো। নির্ঝর মুচকি হেসে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করে তাকে ছেড়ে দিল। ঠোঁট সরু করে শব্দ সৃষ্টি করতে করতে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড খুঁজো ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
নির্ঝর ওয়াশরুমে ঢুকতে তরী ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। নিজের বোকামিতে গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল। কি বজ্জাত ছেলে। তার মাথার সব নতুন অনুভূতি ছাপিয়ে একটা শব্দই ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো ছেলেটা আস্তো একটা বদের হাড্ডি।
তার ভাবনার সুতোয় টান পড়লো নির্ঝরের কন্ঠে।ঝরঝরে গলায় ওয়াশরুম থেকে বলা শুরু করেছে,
‘তরী, কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসো তো। সুগার কম, মিষ্টি বেশি!’
‘সাথে এক চামচ গাঁজা মিশিয়ে দিস তরী।’
বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে শোনাল তরী। শাড়ির আঁচল ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে রুম থেকে বের হলো।
ভেজা চুলে বার কয়েক নাড়া দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো নির্ঝর। আড়চোখে রুমে নজর বুলিয়ে দেখলো তরী নেই। হাতের টাওয়ালটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে সেন্টার টেবিল থেকে চাপের কাপ হাতে তুলে নিল। বেলকনির দিকে তাকিয়ে তাতে একটা চুমুক দিল।
আবছা অন্ধকারে বেলকনির কাচ মাড়িয়ে তরীর জাম রঙের শাড়ি নজরে এলো তার। হালকা বাতাসে শাড়ির আঁচল দোল খাচ্ছে। চায়ের কাপে আরেক চুমুক দিয়ে সে বেলকনির দিকে পা বাড়াল।
তরীর পেছনে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো নির্ঝর। তরী আজও টের পেল না। হয়তো গভীর কোনো ভাবনায় ডুবে আছে। এই মেয়ে যে কোনো কিছু ভাবতে বসলে দিন দুনিয়া ভুলে যায় তা অজানা নয়। সে পাশ কাটিয়ে তরীর কানের কাছে ফু দিল। তরী দ্রুত ঘাড় ঘুড়িয়ে নির্ঝরকে দেখে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। তার নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগছে। নির্ঝরের কাছে তার দূর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না। তাকে কিছুতেই কাবু হওয়া যাবে না। দৃষ্টি সম্মুখে নিবদ্ধ করে সে একটু সরে গিয়ে দাঁড়ালো।
ওপাশে এতক্ষণে গাঢ় ছায়া নেমে গেছে। সূর্য তার সারাদিনের কর্মব্যস্ত জীবন গুটিয়ে নিয়ে আকাশের বুকে তলিয়ে গেছে। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে রাতের ঢাকা। সেই অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে পরপর কয়েক চুমুক দিয়ে নির্ঝর চায়ের কাপ খালি করলো। তরীর দিকে শূন্য পেয়ালা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘কাপটা ধরো।’
তরী অন্য মনস্ক হয়ে চায়ের কাপ ধরতে সেটা ঠাস করে হাত থেকে পড়ে গেল। বিকট একটা শব্দ হয়ে সেটা মুহূর্তে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তরী চমকে নির্ঝরের মুখের দিকে তাকালো। ভয়ার্ত চোখ জোড়া পালানোর পথ খুঁজছে যেন। নির্ঝর থমথমে মুখে এগিয়ে আসতে তরী প্রচন্ড ভয় পেয়ে বলল,
‘দুঃখীত। মাফ করবেন। আমি খেয়ালে ছিলাম না।’
নির্ঝরের উত্তরের অপেক্ষা না করে তরী দ্রুত নিচু হয়ে বসে পড়লো। কাপের ভাঙ্গা টুকরোয় হাত রাখার আগেই নির্ঝরের তার হাত ধরে ফেলল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘শুধু শুধু মাফ করতে যাব কেন? আমি বার বার এত মহান হতে পারবো না। ভুল করেছ এর শাস্তি পাবে।’
‘কি? সামান্য একটা কাপ ভাঙার জন্য আমায় শাস্তি দিবেন?’
‘হাউ ফানি! কেন দিবো না? আজ কাপ ভাঙবে, কাল প্লেট ভাঙবে, পরশু ড্রেসিং টেবিল ভাঙবে, তরশু আমার মন ভেঙে অন্য আশিকের সাথে চলে যাবে! তা তো হতে দেয়া যায় না।’
‘আপনি এমন ভাবে বলছেন যেন ইচ্ছেকৃত ভাবে কাপ ভেঙেছি!’
‘ইচ্ছা অনিচ্ছা দিয়ে আমার আসে বা যায় না। তুমি কাপ ভেঙেছো। শাস্তি স্বরূপ আমার রাতের খাবারটা রুমে নিয়ে আসবে এবং আমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিবে।’
তরী চোখ উল্টে নির্ঝরের দিকে তাকালো। তার ক্রুদ্ধ নয়ন জানিয়ে দিচ্ছে যে শাস্তিটা তার পছন্দ হয়নি। নির্ঝর তার হাত ছেড়ে দিতে সে হনহনিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে গেল। সে চলে যেতে নির্ঝর মুচকি হেসে কাপের ভাঙা টুকরো গুলো একত্রে করলো। সাবধানে উঠিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলল।
___________
‘নিন, হা করুন! এতোবড় ধামড়া ছেলেকে নাকি তুলে খাওয়াতে হবে! বলি হাতের আঙুল কি খসে পড়েছে? ভাতের দানা ধরতে পারছেন না?’
নির্ঝর আধ শোয়া থেকে সটান বসে পড়লো। তরীর বিরক্তিতে ভরপুর মুখের দিকে চেয়ে কাঠ গলায় বলল,
‘এই তুমি এভাবে বলছো কেন? তোমার সাহস দেখছি তো আলোর সমবেগে বেড়ে চলেছে।’
‘নিন এবার বড় করে হা করুন।’
নির্ঝর তরীর গাল টিপে ধরে বলল,
‘এভাবে হেসে হেসে কথা বলবে আমার সাথে ডিঙিরানি! মনে থাকবে?’
তরী মাথা পেছন দিকে নিতে নির্ঝর হাত সরিয়ে নিল। এক পলক প্লেটের দিকে চেয়ে যুতসই বসে পড়লো। দুহাতের তালু একত্রে করে ঘঁষতে ঘঁষতে বলল,
‘তুমি খেয়েছ?’
‘খেতে দিলেন কই? এমন তালগাছকে তুলে খাওয়ানোর হুকুম পড়েছে আমার উপর! ভাত কি গলা দিয়ে নামবে?’
‘আশ্চর্য, এমন ভাবে বলছো কেন তুমি? এতটা রিয়েক্ট করছো যেন তোমার হাতে না খেলে আমি মরে যাব! জীবনে হাত ধুয়েছ ভালো করে? তোমার অপরিষ্কার হাতে খেয়ে নিশ্চিত আমার ডায়রিয়া হবে। নেহায়েত আমি পাতলা পায়খানা বানিয়ে কয়েকদিন অফিসের ছুটি কাটাতে চাচ্ছি বলে তোমার হাতে খাওয়া।’
‘ছি! খাবার সামনে নিয়ে কি ধরনের কথাবার্তা?’
‘তুমিই তো শুরু করলে!’
‘কি? আমি কখন শুরু করলাম?’
‘শুরু করোনি? এবার তাহলে শুরু করো। ভাতের লোকমা মুখে দাও!’
নির্ঝর হাঁ করতে তরী ছোট করে ভাতের লোকমা মুখে পুড়ে দিল। নির্ঝর বালিশের তলা থেকে ফোন বের করে স্ক্রল করা শুরু করলো। সে বেশ আয়েস নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। এদিকে তরীর খাওয়াতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। কাউকে খাইয়ে দিয়ে অভ্যাস নেই। নির্ঝরের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার সময় প্রতিবার মুখের চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিল নির্ঝর হয়তো ধমক দিবে সেজন্য। কিন্তু নাহ! প্রতিবার মুখে খাবার নেওয়ার পর নিজেই টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে ফেলছে।
কয়েক লোকমা খাওয়ার পর নির্ঝর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলল,
‘ডিঙি, এখান থেকেই খেয়ে নিতে পারো। তোমার মতো পাষাণ নই আমি! তাছাড়া এত ভাত একা খেতে পারবো না আমি।’
‘চুপচাপ খেতে থাকুন। নইলে তুলে আছাড় দিবো!’
শেষের বাক্যটি ক্ষীণ স্বরে বলল তরী। নির্ঝরের কানে কানে পুরোপুরি পৌঁছাল না। সে মুখের খাবারটুকু গিলে বলল,
‘আছাড় টাইপ কিছু বলছিলে মনে হয়?’
‘তেমন কিছু না। নিজেকে! নিজেকে আছাড় দেওয়ার কথা বলছিলাম।’
‘তুমি না পারলে আমায় হুকুম করতে পারো। আছাড় দিয়ে দিবো।’
তরী আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ নির্ঝরের মুখে খাবার তুলে দিল। আরো কয়েক লোকমা খেয়ে নির্ঝর হাত দিয়ে ইশারা করে না করলো। সে আর জোর করলো না। প্লেটটা নামিয়ে রেখে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। নরম সুরে বলল,
‘বলছিলাম কি? অনেকদিন তো হলো। একবার সিলেট থেকে ঘুরে আসলে হয় না? বাবা-মাকে অনেক দিন হলো দেখি না। আমার ছোট ভাইটাকেও দেখি না!’
নির্ঝর পানি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তরীর মুখোভঙ্গি লক্ষ্য করলো। বড় মায়ের সাথে কথা বলে রেখেছে সে। তরীকে এখনি গ্রামে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পুরনো ভূত মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া আশিকও নতুন করে বিপদ ডেকে আনতে পারে। পানির গ্লাস নামিয়ে রেখে বলল,
‘আগামীকাল বড় মাসহ তোমার বাবা-মা, ভাই সবাই ঢাকা আসছে। তোমাকে দেখার জন্য। এদের ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে চাও? যাকে দেখতে চাইবে তাকেই তোমার চোখের সামনে হাজির করবো। শুধু তোমার দুই মাস সাতাশ দিনের ভালোবাসার আশিক ছাড়া।’
‘কথায় কথায় আমার আশিক আমার আশিক করবেন না। দিনের মধ্যে যতবার আশিকের নাম নেন, মনে হয় আশিকের সাথে দুই মাস সাতাশ দিন আমি নয়, আপনি প্রেম করেছেন।’
‘আমার রুচি এত থার্ডক্লাস না!’
তরী কথার পিঠে কথা খুঁজে পেল না। আপতত তার মন ভালো হয়ে গেছে এটা ভেবে যে সবাই আগামীকাল ঢাকা আসছে। সে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ওষুধপত্রের ব্যাগটা নির্ঝরের পাশে রাখলো। গ্লাসে নতুন করে পানি ঢেলে দিয়ে প্লেট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পা গিয়ে আবার থেমে গেল। নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হেসে বলল,
‘আপনার বাবা-মা এত ভালো মানুষ কেন?’
‘দেখতে হবে না বাবা-মা টা কার? এখন চটজলদি ডিনার শেষ করে রুমে আসো তো। আমার মাথা ব্যথা করছে। চুল টেনে দিবে। আগামীকাল একবার ডক্টরের কাছে গিয়ে মাথার সেলাই খুঁলতে হবে।’
তরী দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,
‘আপনাকে নিশ্চিত ছোটবেলায় কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল।’
(চলবে)