#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১৩
সোফায় বই, খাতা গুছিয়ে রেখে তরী লম্বা একটা হাই তুলল। প্রচুর ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ড্রয়িং রুমের সদর দরজার উপরে রাখা দেয়ালঘড়ির দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠলো সে। রাত বারোটার বেশি বাজে! এত রাত হয়ে গেছে? এক লাফে উঠে রুমের দিকে পা বাড়াল সে।
ডিনারের পর থেকে সে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে পড়াশোনা করেছে। মাঝে আধ ঘন্টার মতো টেলিভিশন দেখেছিল দুজন। তারপর শ্বাশুড়ি মা পড়া দিয়ে গিয়েছিল। সেগুলোই সে এতক্ষণ ভর বিড়বিড় করে মুখস্থ করছিল। তার বিয়ের সময় সীমা দুই মাসের কাছাকাছি। অথচ মনে হয় না এতদিন হয়ে গেছে। মনে হয়, এইতো সেদিন রাত্রের কথা!
এই দেড় মাসে সে একবারও গ্রামে যায়নি। দুবার তার বাবা-মা, ভাই বেড়াতে এসেছিল। দু’বার ফুপা-ফুপি এসেছিল। তাছাড়া রোজ সবার সাথে ফোনে কথা হয়। সত্যি বলতে সে গ্রামকে ততটা মিস করে না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা, দুপুরের দিকে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে পড়া দেওয়া, সন্ধ্যার সময় উঁকিঝুঁকি মেরে নির্ঝরের অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষা করা, নিনাদের সাথে অবসরে লুডু খেলা, আবার রাতের বেলা পড়া শেষ করে ঘুমানো তার নিত্য রুটিন।
রাতের পড়াটুকু সে নিজের রুমে বসে শেষ করে। নির্ঝরের হুকুম এটা! সে যতক্ষন বাসায় থাকবে তার সামনে বসে পড়তে হবে। ব্যাপারটা তার জন্য ভীষণ লজ্জাকর। প্রতিবার নির্ঝরের চোখে চোখ পড়তে লজ্জায় চুপসে যায় সে!
কিছুটা ভয়ে ভয়ে তরী ভেড়ানো দরজা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ডিনার শেষে নির্ঝর রুমে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল। অথচ সে কিছুটা ইচ্ছে কৃতভাবে দেরি করেছে। নির্ঝরের সামনে না পড়ে ড্রয়িং রুমে পড়তে বসেছিল।
দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তরী। নির্ঝরকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে। লাইট অন রেখেই বিছানার দিকে এগিয়ে এলো সে।
নির্ঝর ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে। তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কেমন নিস্তব্ধতার সুর তুলে যাচ্ছে। তরী নিচু হয়ে নির্ঝরের আঘাতের জায়গাটা পরখ করলো। ক্ষত সেরে গেছে। সেলাই দেওয়ার সময় এখান থেকে কিছু চুল কেটে ফেলা হয়েছিল। সেগুলো আবার বড় হয়ে যাচ্ছে। সে সরে দাঁড়াল। বিছানা ঘুরে নিজের জায়গা এসে শুয়ে পড়লো। প্রায় তার সমান কোলবালিশটা নির্ঝর আগে থেকে মাঝখানে দিয়ে রেখেছে।
নিজের জায়গা উবু হয়ে শুয়ে সে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো। কি অদ্ভুত মেয়েদের জীবন। সে যে এতগুলো দিন হলো সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা বাসায়, অপরিচিত মানুষদের সাথে রয়েছে তবুও বাবা-মা কত নিশ্চিন্তে রয়েছে। সর্বোপরি সে অপরিচিত একটা ছেলের সাথে এক রুমে, এক বিছানায়!
কোলবালিশের উপর দিয়ে নির্ঝরের দিকে এগিয়ে গেল তরী। ঘুমের মধ্যে কি সুন্দর লাগে ছেলেটাকে! এত সুদর্শন একটা ছেলে তার বর ভেবে মাঝে মধ্যে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে তার। সে কিছুদিন হলো লক্ষ্য করেছে, একমাত্র এই মানুষটার কথা মনে হলে তার বুক ধুকপুক করে, ঠোঁটের কোণে লজ্জামিশ্রিত হাসি ফুটে উঠে। শরীরে অন্য রকম শিহরণ বয়ে যায়। কিন্তু সে বুঝতে পারে না এই মানুষটা তাকে পছন্দ করে কিনা! বা আদৌ ভালোবাসে কি না। সবসময় কেমন ধমকের মধ্যে রাখে। অথচ ফুপি বলেছে, একেক জনের ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ একেক রকম। তাই বলে ধমকে ধমকে কেউ কারো ভালোবাসা প্রকাশ করে?
ডান হাতটা বাড়িয়ে তরী নির্ঝরের গাল স্পর্শ করলো। এই মানুষটার একটুখানি স্পর্শে তার ভেতরে ঝড় বয়ে যায়। রাতের বেলা পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে যতবার নির্ঝরের আঙুলে আঙুল রাখে, ভুলবশত হাতে ছোঁয়া লাগে বা খাতা দেওয়া নেওয়ার সময় হালকা ছুঁয়ে দেয় তখন তার ভেতরে উলোট পালোট হয়ে যায়। হৃদপিণ্ড যেন বুক চিঁড়ে বের হয়ে আসতে চায়। কতটা কষ্টে নিজেকে আড়ালে রাখে তা একমাত্র সেই জানে!
নির্ঝরের মুখের সর্বত্র হালকা করে ছুঁয়ে দিয়ে চিবুকের কাছে এসে তরীর হাতটা থেমে গেল। সামান্য ঝুঁকে নির্ঝরের আরো একটু কাছাকাছি গেল। প্রায় ফিসফিস করে বলল,
‘আপনি এত অমানুষ কেন নির্ঝর শাহরিয়ার? কবে মানুষ হবেন আপনি?’
আচমকা তরীর হাতের উপর নির্ঝর বাম হাত রাখলো। তরীর পিলে চমকে উঠলো। নির্ঝরের দিকে চেয়ে দেখলো চোখ বন্ধ। ঘুমজড়ানো কন্ঠে নির্ঝর বলল,
‘হাউ ফানি! এতগুলো বছর তো মানুষ ছিলাম আমি। আর মানুষ হতে চাই না। এবার বাবা হতে চাই!’
নির্ঝরের শেষের বাক্যটি কানে যেতে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল তরী। মুখ দিয়ে একটা শব্দই বের করলো। সেটা হলো,
‘ছি!’
নির্ঝরের হাতের তলা থেকে ডান হাতটা একটানে সরিয়ে নিল। ঝটপট নিজের জায়গা শুয়ে কম্বল টেনে সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে ফেলল। কি অসভ্য মানুষ!
কিছু মুহূর্ত কেটে গেল। কিন্তু ওপাশ একদম নিশ্চুপ। তরীর কপাল কুঁচকে গেল। নির্ঝর কি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাবা হবে? সে একটানে মুখের উপর থেকে কম্বল সরালো। মাথা উঁচু করে নির্ঝরের দিকে চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। নির্ঝর আগের মতো নির্বিকার ভাবে ঘুমাচ্ছে। তবে কি এতক্ষণ ঘুমের মধ্যে কথা বলল? হয়তো!
ধপাস করে আবার নিজের জায়গা শুয়ে পড়লো তরী। বিড়বিড় করে নির্ঝরকে বকাঝকা করতে করতে চোখ বন্ধ করলো।
____________
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তরীকে ডাকলো নির্ঝর। এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তরী। মাথার ভেজা চুল গুলো মুছে সে বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। তরী বাচ্চাদের মতো পা ভাঁজ করে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। তরীর ঘুমানোর প্রতিটি ভঙ্গি নির্ঝরের মুখস্থ, কতক্ষণ পর পর তরী কাত ঘুরে, ঘুমের মধ্যে কতবার নড়াচড়া করে সব মুখস্থ তার। বিগত দিনগুলোতে রাত জেগে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এসবই দেখে গেছে। তরী যেন তার এক হাত দূরে স্বযত্নে সাজিয়ে রাখা কোনো ফুলের বাগান। যে বাগান শুধু দেখার অধিকার আছে, ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। অধিকার নেই ভালোবেসে বুক পাঁজরে পিষে ফেলার!
‘তরী? এই তরী?’
ক্ষীণ স্বরে ডাকলো নির্ঝর। তার ডাকে কপাল কুঁচকে গেল তরীর। কিন্তু কোনো নড়চড় করলো না। তরীর গায়ের কম্বলটা হালকা করে টান দিয়ে নির্ঝর আবার ডাকলো। তরী বিরক্তি নিয়ে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,
‘ঘুমাতে দিন তো! রাতে ঘুম হয়নি।’
‘তরী উঠে পড়তে বসো।’
‘পারবো না!’
‘তরী, উঠে পরো। চড় খাবে কিন্তু!’
তরী পিটপিট করে চোখ খুলল। আবার বন্ধ করে ভালো মতো নিজেকে কম্বলে পেঁচিয়ে ফেলল। টেনে টেনে বলল,
‘আপনি এমন করেন কেন? একটু তো ঘুমাচ্ছিই! আপনার মাথার উপর উঠে তো আর নাচছি না!’
‘মাথার উপর উঠে নাচতে চাইলে নাচতে পারো। কিন্তু ঘুমাতে পারবে না।’
‘চুপচাপ সরে যান তো। প্লিজ!’
নির্ঝর একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তরীর বোর্ড পরীক্ষা দোরগোড়ায়। বেশিদিন নেই আর! গতবারের মতো এবার ফেইল করলে তো অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে। তাছাড়া এবার তার মা অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়াচ্ছে। সেও ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরার পর আবার তরীকে সময় দিচ্ছে, জোরজবরদস্তি করে পড়াচ্ছে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে তো।
মাথার ভেজা চুলে আরেকবার ঝাড়া দিয়ে তরীর মুখের দিকে ঝুঁকে পড়লো নির্ঝর। শীতল হাত দিয়ে তরীর চিবুক স্পর্শ করতে একলাফে উঠে বসলো তরী! চমকে বলল,
‘কি হয়েছে?’
‘কিছু হওয়ার আশা রাখো?’
তরী কপাল কুঁচকে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের স্নিগ্ধ চেহারার দিকে চোখ পড়তে কুঁচকানো কপাল প্রসারিত হয়ে এলো ধীরে ধীরে। চোখে এসে ভর করলো একরাশ মুগ্ধতা। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
‘ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসো। সকালবেলার পড়া স্মরণে থাকে।’
নির্ঝরের কন্ঠে সংবিৎ ফিরে পায় তরী। ঘোর কাটতে ব্যস্ত হয়ে পরে ওড়না খুঁজতে। দিন বিশেক হলো সে শাড়ি পরা বাদ রেখেছে। শ্বাশুড়ির কথায় থ্রি পিস পরে। নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়েছে। বালিশের তলা থেকে ওড়না টেনে বের করে গায়ে জড়ালো তরী। হতাশ সুরে বলল,
‘রাতে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম আমি।’
তরীর ঘুমজড়ানো প্রতিটি কথা নির্ঝরের বুকে গিয়ে বিঁধছে। কেমন মাতাল করা কন্ঠ। কাছে ডাকার অস্পষ্ট আহবান। কেমন সম্মোহিত সে কন্ঠ। নির্ঝর দ্রুত তরীর সামন থেকে সরে গেল। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আলমারির থেকে বেছে বেছে ড্রেস বের করে শক্ত গলায় বলল,
‘পড়াশোনার ব্যাপারে নো গাফিলতি। টপ রেজাল্ট করতে হবে তোমায়। মাথায় ঢুকিয়ে নাও! নিজের মাস্টার্সের পড়াশোনা বাদ দিয়ে তোমার পেছনে এমনি এমনি সময় নষ্ট করছি না কিন্তু! ফেইল করলে হাড়গোড় ভেঙে ফেলবো।’
‘সময় নষ্ট করতে বলেছে কে আপনাকে? খোঁচা মেরে কথা না বলে থাকতে পারেন না আপনি? বেহায়া মানুষ!’
তরী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওয়াশরুমে ঢুকলো। সেদিকে তাকিয়ে নির্ঝর ছোট্ট করে শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করলো। কিছুদিন যাবত সে খেয়াল করছে তরীর চোখ দুটো অন্য কিছু বলতে চায় তাকে। হাবভাব কেমন অস্থিরতায় পরিপূর্ণ। সে কিছুতেই তরীর মন অন্য দিকে যেতে দিতে পারে না। কিছুদিন পর পরীক্ষা। এখন নতুন কোনো অনুভূতির সাথে পরিচয় ঘটানোর উপযুক্ত সময় নয়। তরীর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে তাকে। না হলে যখন তখন অঘটন ঘটে যাবে।
তরী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো নির্ঝর ফর্মাল ড্রেস আপে অফিসের জন্য রেডি। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এখন চুলে ব্রাশ করছে। ভেজা পাপড়ি মেলে আড়চোখে সে নির্ঝরের প্রতিটি কাজ সূক্ষ্ণ ভাবে পরখ করলো। রাগ পড়ে গিয়ে ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
তার চাহনিরত অবস্থায় হঠাৎ করে নির্ঝর পেছন ঘুরে তাকালো। তরীর চোখ দুটো স্ফিত হলো। সে চোখ সরানোর অবকাশ পেল না। নির্ঝর হালকা পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। শার্টের হাতের বাটনটা লাগিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রসন্ন হেসে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘কিছু বলবে তরী?’
তরীর গলা শুকিয়ে এলো। এক মন বললো, সামনের এই সুদর্শণ পুরুষটিকে তাের অনেককিছু বলার আছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরেক মন প্রতিবাদ করে উঠলো, কিচ্ছু বলার নেই। মুখ খুলবি তো ধরা পড়ে যাবি। চিরদিনের জন্য!
দ্বিতীয় মনের গতিবিধি অনুসরণ করে তরী মুখ খুলল না।শুধু মাথা ডানে বায়ে নাড়িয়ে বুঝালো তার কিছু বলার নেই। তার চোখ আটকে গেল নির্ঝরের ভরাট ঠোঁটে। ঠোঁটের কোণে সবসময় স্মিত হাসি ঝুলে থাকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নির্ঝরের হাসি বিস্তৃত হলো। চট করে নিজের ডান হাতটা তরীর মাথা স্পর্শ করলো।
বার কয়েক মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘মন দিয়ে পড়ালেখা করবে সারাদিন। সময় মতো খাবার খেয়ে নিয়ো। আমি সন্ধ্যায় ফিরবো। আসি!’
তরীর উত্তরের অপেক্ষা না করে নির্ঝর ঘুরে দাঁড়াল। সেন্টার টেবিল থেকে ফাইলটা হাতে তুলে আরেক পলক আয়নায় নিজেকে দেখে শব্দ হীন পদধ্বনি তুলে দরজার দিকে এগিয়ে চলল।
তরীর বুকের ভেতর কোথায় যেন জ্বলেপুড়ে গেল। চোখের মণিতে পানির অস্তিত্ব টের পেল। ইচ্ছে করলো এক দৌঁড়ে গিয়ে নির্ঝরকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরতে। সে কি দৌঁড়াবে? মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে বলবে, আপনি যতক্ষণ বাসায় থাকেন না আমি বড্ড অভাববোধ করি আপনার? আপনি আশপাশে থাকলে, কাছাকাছি আসলে নাম না জানা হাজারো অনুভূতিতে ভেসে যাই আমি? এমন কেন হয় আমার?
(চলবে)
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।🧡