#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____১৭
তরী মুখটা একটু এগিয়ে নিল নির্ঝরের দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘আপনাকে! নির্ঝর শাহরিয়ারকে।’
বলার সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল সে। চটপট সোজা হয়ে নিজের জায়গা বসে মাথা নত করে নিজেকে গুটিয়ে নিল। ধড়ফড় করা বুক নিয়ে প্রতিক্ষায় রইলো নির্ঝরের উত্তরের।
কিছুটা সময় কেটে গেল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। তরীর চোখে মুখে এসে দুঃখ ভর করলো। ব্যথিত মন নিয়ে সে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝর আগের মতো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নেতিয়ে পড়া লতার মতো! তার মানে এতক্ষণ বলা কথার কোনো শব্দই সে শুনতে পায়নি। মুহুর্তে তীব্র মন খারাপ এসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো তাকে। বুকের ভেতর নীল নীল ব্যথা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়লো। ব্যথাতুর মনটাকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে গেল। তারপর থমথমে মুখ নিয়ে সে আবার বইয়ের দিকে তাকালো।
তরীর যদি অপর পাশের মানুষটার মন পড়ার ক্ষমতা থাকতো বা ভেতরে কি চলছে তা বুঝার ক্ষমতা থাকতো তাহলে তার মুখে হাসি ফুটে উঠতো। দিব্যি টের পেত যে নির্বিকার ভাবে শুয়ে থাকা মানুষটার বুকে ইতোমধ্যে সে ঝড় তুলে দিয়েছে। তার এই একটি কথা যেন অথই সাগরে এক টুকরো ভেলা হয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে। অকূল পাথারে তার অসুস্থ মনটা সেই ভেলায় চড়ে পরম সুখে ভেসে চলেছে। ঘুমের ঘোরে ভালোবাসার জোয়ারে সে দ্বিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভেসে চলেছে। দূর থেকে বহুদূরে। বহুদূরে!
__________
এরপরের সময় গুলো খুব দ্রুত কাটলো। তরী পড়াশোনা নিয়ে চরম ব্যস্ততায় দিন কাটাল। দিনের বেলা শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে কয়েক ঘন্টা সমস্যা সলভ করে। বাকি সময়টা নিজের মতো করে পড়ে। ছুটির দিনগুলোতে শ্বশুর মশাই টুকটাক প্রশ্ন ধরে। কখনো বা ইংরেজির গ্রামার অংশ সলভ করতে দেয়। মন ফ্রেশ করার জন্য নিনাদের সাথে দুপুরবেলা ছাদ থেকে ঘুরে আসে একটু। কখনো বা অল্প সময়ের জন্য দুজন একত্রে টেলিভিশনে কার্টুন দেখে।
তবে এসবের মধ্যে তার পড়াশোনার সব তদারকি করে নির্ঝর। কোনদিন কতটুকু পড়লো, কতটুকু বাকি রইলো, সিলেবাস কমপ্লিট হয়েছে কি না ইত্যাদি নানা বিষয়। তাছাড়া কখন তার কি প্রয়োজন তা মুখ ফুটে বলতে হয় না। চাওয়ার আগেই সময় মতো চা, কফি, বিস্কুট বা পানির গ্লাস বাড়িয়ে দেয় নির্ঝর। মাঝে মাঝে সে এমন অবাক হয় যে হাঁ করে নির্ঝরের দিকে চেয়ে থাকে৷ অতঃপর নির্ঝরের ধমকে তার হুশ ফিরে। তবে সে এতদিনে এটা সিউর যে তার নিজের থেকে নির্ঝর তাকে বেশি চিনে। সত্যি বেশি চিনে। কিন্তু কিভাবে? মাত্র কয়েক মাস একত্রে থেকে একটা মানুষকে এতটা চিনে ফেলা যায়? তার নাড়ি নক্ষত্র এতটা চেনা যায়? মুখ খোলার আগে অঙ্গভঙ্গি দেখে সব বুঝে ফেলা যায়? তার মানে নির্ঝর এটা তো নিশ্চয়ই বুঝেছে যে সে মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এটা বোঝার পরো এতটা নির্বিকার কি করে থাকতে পারে? কি করে!
তবে তরী নির্ঝর নামক মানুষটাকে একটুও চিনেনি। পুরোপুরি রহস্যে আবৃত মানুষটা যেন। কিছুতেই তাকে ধরি ধরি করে ধরা যায় না। ঠিক তার মন অবধি পৌঁছানো যায় না। তবে নির্ঝর তার প্রতি খেয়াল রাখতে ভোলে না। প্রায়ই রাত জেগে পড়তে পড়তে সে বইয়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে নিজেকে ঠিকঠাক কম্বলের নিচে আবিষ্কার করে। মাথার নিচে বালিশের অস্তিত্ব টের পায়। এতটা খেয়াল রাখা মানুষটার মন অবধি কিছুতেই প্রবেশ করতে পারছে না।
তবে সবকিছু মিলিয়ে তার পরীক্ষার প্রিপারেশন আগের থেকে ভালো। সে আশাবাদী এবার অন্তত কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস ঘটবে না।
বোর্ড পরীক্ষার তিনদিন আগে ব্যাগপত্র গুছিয়ে প্রস্তুতি নেয় তরী। নির্ঝর অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে।পরীক্ষার সময়গুলোতে তার সাথে সিলেট থাকবে। পরদিন সিলেট যাওয়ার জন্য ঠিক করা হয়েছে। রওনা দেওয়ার দিন ভোরের সূর্য উঠার আগে তরীর ঘুম ভেঙে যায়। রাতে ভালোমতো ঘুম হয়নি তার। মাথার মধ্যে সাজানো হাজারো জল্পনা কল্পনা। মাস তিনেক পর সে গ্রামে ফিরবে। প্রবল উত্তেজিত সে। এতগুলো বছরের বহু স্মৃতি জমে আছে যে গ্রামে। গ্রাম! তার নিজ এলাকা।বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। পাশে তাকিয়ে দেখে নির্ঝর পিঠ সোজা করে শুয়ে আছে। পেটের কাছের টিশার্ট উপরে উঠে গেছে। কয়েক সেকেন্ড পেটের অনাবৃত অংশের দিকে চেয়ে রইলো। একটুপর লজ্জামিশ্রিত দৃষ্টি সরিয়ে সে ওয়াশরুমের দিকে এগোল।
মিনিট পাঁচেক পর ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো অনেক সময় বাকি আছে। আজ তাহলে নিজের হাতে সবার জন্য নাস্তা করা যাক! খুশিমনে সে দরজার দিকে ঘুরলো। কয়েক পা গিয়ে আবার বিছানার কাছাকাছি আসলো। নির্ঝরের মুখের দিকে ঝুঁকে এলোমেলো চুল গুলো হাত নেড়ে আরো এলোমেলো করে দিল। নির্ঝর কপাল কুঁচকে হালকা নড়ে উঠতে সে একদৌঁড়ে দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
_____________
‘তরী, গাড়ির চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। রাতের বেলা বাবার কাছে থেকে এনে কোথায় রাখলাম?’
নির্ঝর ড্রেসিং টেবিলের প্রতিটা ড্রয়ার খুঁজতে খুঁজতে প্রশ্ন করলো। বেলা হয়ে যাচ্ছে। সিলেট রওনা দিতে হবে! আরো কিছুক্ষণ খুঁজল সে। পেল না! তরীর উত্তর না পেয়ে সে হতাশ হয়ে পেছনে তাকাল। তরী বিছানার উপর বসে পায়ের নখ কাটছে। কপাল কুঁচকে গেল তার। কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে বলল,
‘তোমার এখন নখ কাটতে হবে? সারাবছর সময় পাওনি?’
‘ভারী অদ্ভুত প্রশ্ন। সারাবছর সময় পাব না কেন? এক সপ্তাহ আগে নখ কেটেছিলাম। আবার বড় হয়ে গেছে। আমি কি করবো! আমার ফুপিকে তো আপনি চিনেন না? নখ বড় দেখলে আমায় মেরে ফেলবে।’
‘ফুপিকে চিনবো না মানে? তরী তোমার ফুপি আমার বড় মা হয়। বার বার মনে করিয়ে দিতে হয় কেন?’
তরী নখ কাটা বাদ রেখে ঝট করে চোখ তুলে তাকাল। জিভ কেটে বলল,
‘হ্যাঁ, তাইতো! ‘
নির্ঝর এগিয়ে এলো। তরীর মুখ বরাবর বিছানায় বসে পড়লো। কোনো কথা না বলে আচমকা তরীর পা ধরে টেনে একটু কাছে নিল। তরী তৎক্ষনাৎ বিছানার চাদর চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিল। নির্ঝরের হঠাৎ স্পর্শে শরীর শিউরে উঠছে তার। বড় বড় চোখে নির্ঝরের দিকে চেয়ে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘ছাড়ুন! পা ধরছেন কেন?’
‘প্রণাম করার জন্য ভেবেছ? হাউ ফানি! এনিওয়েস, দুদিন পর পর আর কষ্ট করে তোমার নখ কাটতে হবে না। এখন একেবারে আঙুল কেটে ফেলবো আমি।’
‘কি?’
ভয়ার্ত চোখে তরী নিজের পা টা গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। পারলো না। নির্ঝর বাম পা টা টেনে আরো কাছে নিল। একহাতে চেপে ধরে রেখে আরেক হাত বাড়িয়ে বলল,
‘নেইল কাটার আমার হাতে দাও। আমি কেটে দিচ্ছি।’
‘কি কাটবেন আপনি? আঙুল কাটতে দিবো না আমি।’
‘আচ্ছা যাও! আমার মায়ার শরীর। মেনে নিলাম তোমার আকুতিভরা কথা। আঙুল কাটবো না। আজকের মতো নখ কেটে দিই!’
তরী বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘আমার নখ কাটবেন আপনি? তাও আবার পায়ের?’
‘হাউ ফানি! এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি এমনি এমনি নখ কেটে দিচ্ছি না।’
‘মানে?’
‘মানে আমি তোমার নখ কেটে দিবো। বিনিময়ে তুমি আমার গাড়ির চাবি খুঁজে বের করবে। এই নির্ঝর শাহরিয়ার ভীষণ স্বার্থপর মানুষ। টেক এন্ড গিভ! এই ফরমুলার বাইরে কিছু বুঝে না। মাথায় ঢুকেছে?’
তরী থমথমে মুখে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো। তার অবাক হয়ে যাওয়া মুখোচ্ছবি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নির্ঝর নেইল কাটার ছিনিয়ে নিল। পা টা কোলের উপর নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে নখ কাটা শুরু করলো। তরী শুধু বিস্ময় নিয়ে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো। এই ছেলেটা প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে তাকে কনফিউজড করে। একবার মনে হয়, তাকে ভীষণ ভালোবাসে। আবার পরক্ষণে মনে হয় ছেলেটা প্রচন্ড ধূর্ত একজন মানুষ। তাকে একটুও ভালোবাসে না! তাকে নিয়ে বড় কোনো গেইম খেলছে।
এটা অবশ্য ঠিক যে নির্ঝর আজ পর্যন্ত তাকে সরাসরি মুখে কখনো ‘ভালোবাসি’ বলেনি। কিন্তু তার যত্নাদি দেখে মাঝে মধ্যে মনে হয় একটু ভালোবাসে। আবার হুটহাট এমন ধমকাধামকি করে যে মনে হয়, ভালোবাসা তো দূরের ব্যাপার তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না নির্ঝর। কি একটা অবস্থা। সে কেমন দোটানায় ভুগছে। কিভাবে নির্ঝরের মনের কথা জানতে পারবে?
তরী আমতা আমতা করে শেষমেশ প্রশ্ন করলো,
‘আপনি কাউকে ভালোবাসেন?’
কয়েক সেকেন্ডের জন্য নির্ঝরের হাত থেমে গেল। চোখ উল্টে একবার তরীর দিকে চেয়ে বলল,
‘হাতের নখ কাটা শেষ?’
‘ডান হাতের বাকি। বাম হাত দিয়ে কাটতে অনেক সময় লাগে সেজন্য কাটিনি।’
নির্ঝর চুপচাপ তরীর ডান হাতটা টেনে নিল। তরী গভীর দৃষ্টিতে নির্ঝরের মুখের দিকে চেয়ে আছে। নির্ঝরের মুখোভঙ্গি পরখ করার চেষ্টা করছে। নির্ঝরের কপাল কুঁচকানো। মুখে বিরক্তির ছাপ। তার মানে ছেলেটার তার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। এটা আবিষ্কার করতে পেরে তরীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবুও নির্ঝরের মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরাতে পারলো না। নির্ঝর কড়ে আঙুলের নখ কেটে শাহাদাত আঙুলের নখ অর্ধেক কাটলো। তাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ শাহাদাত আঙুল মুখে পুড়ে নিল। নখের বাকি অংশ দাঁত দিয়ে কাটার চেষ্টা করলো।
আঙুলে নির্ঝরের ঠোঁটের স্পর্শ পেতে তরীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেল। ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেল। বুকের ভেতর ছুটন্ত বেগে কিছু একটা ছুটে চলল। মাথার ভেতর কেমন ঝিমঝিমানি অনুভব করলো সে। অগোছালো কন্ঠে কোনোরকমে বলল,
‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি? হাত ছাড়ুন।’
(চলবে)
এই প্রথম কোনো গল্পে এতটা ইররেগুলার আমি! দুঃখীত। কয়েক ঘন্টা ব্যবধান নিয়ে রাতে আরো দুটো পর্ব পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ।🤎