শেষটা_সুন্দর #অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম) #পর্ব___(১৮+১৯) (বোনাস পার্ট)

0
544

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___(১৮+১৯) (বোনাস পার্ট)

অগোছালো কন্ঠে তরী কোনোরকমে বলল,

‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি? হাত ছাড়ুন!’

নির্ঝর চোখ তুলে একবার তরীর দিকে তাকালো। তারপর আঙুলটা মুখ থেকে সরাল। নির্বিকার কন্ঠে বলল,

‘এভাবে রিয়েক্ট করছো কেন? কি করেছি আমি? আঙুল তো খেয়ে ফেলতাম না। জাস্ট দাঁত দিয়ে নখ কাটার ট্রাই করছিলাম।’

‘ছি! আপনি?’

‘চোখ মুখ কুঁচকাচ্ছো কেন ডিঙি? ছোটবেলায় আমার একটা বদঅভ্যেস ছিল। দাঁত দিয়ে নখ কাটা আর কি! মা অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে অভ্যাসটা গায়েব করেছে। আজ সেটা রিকল করার চেষ্টা করলাম। দেখলাম প্রক্রিয়াটি ভুলে গেছি কিনা।’

তরীর এখনো বুক ধড়ফড় করছে। হতাশ সুরে বলল,

‘তারপর?’

‘তারপর বুঝতে পারলাম দাঁত দিয়ে নখ কাটা ভুলে গেছি।’

তরী আর কথা বাড়াল না। যতদ্রুত সম্ভব নির্ঝরের সামনে থেকে গায়েব হতে চাচ্ছে সে। শাড়ির আঁচল টেনেটুনে উঠার চেষ্টা করতে নির্ঝর হাত ধরে আবার বসিয়ে দিল। সে কঠিন কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নির্ঝর ঝটপট বলল,

‘আমি জানি অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর তিনটে আঙুল কাটা বাকি আছে। মানে তিনটে আঙুলের নখ কাটা বাকি। দ্রুততার সহিত কেটে দিচ্ছি। এরপর তুমি চাবি খুঁজবে।’

‘কাটতে হবে না।’

‘হাউ ফানি! কেন?’

‘আপনার চাবি খুঁজতে পারবো না আমি। আমি এখন এখান থেকে উঠতে চাচ্ছি।’

নির্ঝর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না। তরীর ডান হাতটা আবার টেনে নিয়ে নখ কাটায় মনোযোগ দিল। তরী চলে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে নির্ঝর বলল,

‘যে হারে নড়চড় করছো, হাত কেটে গেলে আমি কিন্তু খাইয়ে দিতে পারবো না। তখন বাম হাত দিয়ে খেতে হবে। তাই, বি হুঁশিয়ার!’

তরী উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর কড়ে আঙুলের নখ কাটা শেষ হতে সে একলাফে উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির কুচিতে বেঁধে পড়ে যেতে নিয়েও শেষ পর্যন্ত সামলে নিল নিজেকে। অনেকদিন পর গ্রামে যাবে বলে খুশিতে সে শাড়ি পরেছে। তাছাড়া বিয়ের পর এই প্রথম গ্রামে যাচ্ছে। সে এখন অন্য কারো বউ। বউ কথাটা মনে পড়তে চট করে নির্ঝরের দিকে তাকালো। মুখটা রক্তিম হতে সে দরজা দিয়ে ছুটে পালাল। পেছন থেকে নির্ঝর চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘আরে তরী তুমি তো কথা রাখছো না। টেক এন্ড গিভ ফরমুলা মানতে চাইছো না। আমার চাবি কে খুঁজে দিবে?’

তরী কানে তুলল না। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে শ্বাশুড়ির রুমের দিকে এগোল। রান্নাঘর থেকে তৎক্ষনাৎ ভারিক্কি গলার মেয়েলি সুরে কেউ বলল,

‘তরী এদিকে আয়। আমি এখানে।’

তরীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে আর রুমে ঢুকলো না। দরজার সামনে থেকে সরে এলো। অতঃপর ধুপধাপ পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তার শ্বাশুড়ি মা তাকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। তুই, তুই করে কথা বলে। তার তো মনে হয়, নির্ঝরের থেকে তাকে বেশি ভালোবাসে। এদের এত এত ভালোবাসা পেয়ে তরী বুঝতে পেরেছে সত্যিকার ভালোবাসা গুলো কেমন হয়। তার আর আশিকের ভালোবাসাটা কেমন ছিল সেটার পার্থক্য বুঝতে শিখেছে।

‘মা!’

তরী এগিয়ে গিয়ে নাহিদা বেগমের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। নাহিদা বেগম হাস্যোজ্জ্বল মুখ তুলে তরীর দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার মুখ থেকে হাসি গায়েব হয়ে গেল। তিনি চিন্তিত মুখে বললেন,

‘তুই শাড়ি পরেছিস কেন রে? এই গরমে শাড়ি পরে জার্নি করতে পারবি? হাঁসফাঁস লাগবে না?’

তরী আরো একটু গা ঘেঁষে দাঁড়ালো নাহিদা বেগমের। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,

‘বিয়ের পর প্রথম গ্রামে যাচ্ছি মা। সেজন্য শাড়ি পরলাম।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা! সমস্যা নেই। গাড়িতে এসি আছে। এখন শোন। তোরা তো এখন হালকা নাস্তা করেছিস। সেজন্য আমি বক্সে করে খাবার রেডি করে রাখলাম। নিয়ে যাবি মনে করে। অনেক দূরের পথ। ক্ষুধা লাগলে গাড়ি থামিয়ে খেয়ে নিবি।’

‘হুঁঁ! মা নিনাদ কোথায়?’

‘রোজ যা করে! তোর বাবার সাথে সকালের পেপার পড়ছে। ছোটবেলা এভাবে নির্ঝরকে জোর করে নিয়ে পেপার পড়তো। জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলতো, শুধু বুকিশ নলেজ আহরণ করলে চলবে না। পুরো বিশ্ব, পুরো পৃথিবী সম্পর্কে জানতে হবে। ছেলেটা বেঁচে গেছে। এখন নিনাদের ঘাড়ে সব পড়েছে। তোরা বেরিয়ে পড়বি কখন? বেলা হয়ে যাচ্ছে তো।’

তরী কাঁটা দিয়ে পেঁচানো চুল গুলোতে একবার হাত বুলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা মা! তোমার বড় ছেলে ছোটবেলায় দুষ্টমি করতো না? নাকি নিনাদের মতো শান্ত ছিল?’

‘তরী রে! নির্ঝর ছোটবেলায় খুব পাজি ছিল। একটা সেকেন্ড চোখের আড়াল করতে পারতাম না। কিছু না কিছু আকাম করে ফেলতো। ওর যখন দেড়-দুই বছর বয়স তখন বেশি জ্বালিয়েছে। চোখের পলকে এটা ওটা করে বসতো। ফ্রিজের ভেতর ঢুকে বসে থাকতো, কারেন্টের ফুটোয় আঙুল দিত, ফ্লোরে আঙুল রেখে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে বসতো, জানালার গ্রিল দিয়ে কিছু না কিছু ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিতো। যেগুলো কারো না কারো মাথায় পড়তো। কত নালিশ শুনতে হতো এজন্য। একবার তো গ্রিল থেকে পড়ে গিয়ে কপালের কাছে কেটে গিয়েছিল। একটা সেলাই দিতে হয়েছিল। এখনো দাগ আছে। চুল দিয়ে ঢাকা থাকে সবসময়। একবার কি হয়েছে জানিস তরী? তখন সবেমাত্র কথা শিখেছে। আমি রান্নাঘরে রান্না করছি৷ ও তিন-চারদিন আগের একটা মরা ইঁদুর ধরে নিয়ে এসে বলছে, মা এ-এটা কি? এ-টা খাবো আমি! আমি গন্ধে নাক মুখ কুঁচকে সেটা ফেলে দিই। সেকি কান্না। আরেকবার করেছে কি! ওয়াশরুমের……..’

‘মা!’

তরীর পিলে চমকে উঠল। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো নির্ঝর। সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নাহিদা বেগম আবার মুখ খোলার আগে নির্ঝর বলল,

‘ছোটবেলার ওসব কথা কেউ বলে মা? তুমি তো দেখছি আমার মান সম্মানে জং ধরিয়ে দিবে। এখন এসব কথা রেখে তোমার বৌমাকে বলো চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসতে। রোদ উঠে যাচ্ছে। ড্রাইভিং করতে আমার কষ্ট হবে।’

নাহিদা বেগম স্মিত হাসলেন। খাবারের বক্সটা হাতে নিয়ে বললেন,

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। চল।’

__________

গাড়িতে উঠার আগে তরী শফিকুর রহমানকে সালাম করে বলল,

‘আমার জন্য দোয়া করবেন বাবা।’

শফিকুর রহমান আশ্বাস দিয়ে বললেন,

‘এত টেনশন করবে না তো মা। একদম টেনশন ফ্রি হয়ে পরীক্ষা দিবে। ফলাফল যা আসে আমি দেখবো। যাও! শুভকামনা রইল।’

তরী একটু হাসার চেষ্টা করলো। সত্যি বলতে তার ভীষণ ভয় করছে। মনে হচ্ছে সে এখন সরাসরি গিয়ে পরীক্ষার হলে বসবে। ধীরপায়ে সে নাহিদা বেগমের দিকে এগিয়ে গেল। কিছু বলার চেষ্টা করতে কোনো এক অদ্ভুত কারণে তার দম বন্ধ হয়ে আসলো। চোখ মুখ উপচে কান্না পেল। বুকের ভেতর কোথায় যেন হু হু করে উঠলো। মন কু ডাক গাইছে। একবারের জন্য মনে হলো এদের সাথে সহজে আর মিলিত হতে পারবে না সে। হারিয়ে ফেলবে এদের।

নাহিদা বেগম ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখে তরীর মাথায় হাত রাখলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তরী তাঁকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। প্রথমে তিনি অবাক হলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলেন। নিজেরও চোখের কোণে পানির অস্তিত্বের টের পেলেন। এই অল্প বয়সী নরম মেয়েটা খুব দ্রুত সবার মন জয় করে নিয়েছে। মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে নিয়েছে। তিনি তরীর মুখ তুলে পানি মুছে দিলেন। আশ্যস্তের সুরে বললেন,

‘বোকা মেয়ে।এসব নিয়ে কেউ চিন্তা করে? কিছুদিন যাক। আমি আর তোর বাবা গিয়ে দেখে আসবো।’

নিনাদ মায়ের পাশে এসে মুচকি হেসে বলল,

‘ভাবী, তুমি এতবড় মানুষ পরীক্ষা দেখে ভয় পাও? কেমন বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করছো!’

তরীর একটু হাসার চেষ্টা করলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ির দিকে এগোল। নির্ঝর এতক্ষণ গাড়িতে হেলান দিয়ে বিদায় দৃশ্য দেখছিল। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তরী যে কান্নাকাটি করবে তা চিন্তাতে ছিল না। সে গাড়ির দরজা খুলে তরীকে ভেতরে বসতে ইশারা করলো।

তরী বসে পড়তে সে বাবা-মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো। দুজনের সিটবেল্ট লাগিয়ে পার্কিং লট থেকে গাড়ি ঘুরাল। কিছু সময় পর গাড়ি মেইন রোডে আসতে তরী আবার স্ব শব্দে কান্না শুরু করলো। নির্ঝর প্রচন্ডভাবে হকচকিয়ে গেল। গাড়ি থামাতে গিয়েও থামাল না। কিন্তু নিজের বিস্ময় ভাব লুকাতে পারলো না। অবাক কন্ঠে বলল,

‘আবার কান্নাকাটি করছো কেন?’

তরী কিছু বলল না। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে কান্না করছে সে। নির্ঝর গাড়ির বেগ কমিয়ে দিল। তরীকে সহজ করার জন্য বলল,

‘অনেকদিন পর তোমায় কান্না করতে দেখলাম ডিঙিরানি! আমি তো ভেবেছিলাম তোমার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। কান্না করার মতো এতো সুন্দর দৃশ্য আর দেখতে পারবো না কোনোদিন। কিন্তু তুমি আমার ভাবনা পাল্টে দিলে। ধন্যবাদ!’

নির্ঝর সাবধানে সামনে থাকা টিস্যু বক্সটা তরীর দিকে এগিয়ে দিল। তরী বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে চোখের জল মোছার চেষ্টা করলো।

ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে নির্ঝর আড়চোখে তরীর দিকে তাকালো। তার বাম হাত আর তরীর ডান হাতের মধ্যবর্তী দূরত্ব খুবই কম। সে কি একটু মেয়েটার হাত ধরবে? কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে তরীর হাতটা ধরার সিদ্ধান্ত নিল।

তৎক্ষনাৎ তরী নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘গাড়ি ঘুরান। আমি পরীক্ষা দিবো না।’

নির্ঝর এতটা চমকালো যে একটুর জন্য এক্সিডেন্টের হাত থেকে রক্ষা পেল। সে বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘কি বললে তুমি?’

‘আমি পরীক্ষা দিবো না। আমার ভয় করছে। পরীক্ষা শেষ হলে আমি সিলেট যাব। এখন যাবো না!’

নির্ঝর কিছুটা সময় নিল নিজেকে ধাতস্থ করতে। তাকে এখন কঠিন কিছু বলতে হবে। সে আগে থেকে জানতো তরী খুবই নরম মনের মানুষ। একটুখানি ভালো ব্যবহার, একটুখানি ভালোবাসা পেলে আর কথা শুনবে না। একে পরীক্ষা দেওয়ানো খুব কঠিন হয়ে যাবে। সেজন্যই সে এতটা দিন হুটহাট কঠিন ব্যবহার করতো। আজও নিজেকে শক্ত করে নিল।

‘কি হলো গাড়ি ঘুরাচ্ছেন না কেন? গাড়ি থামান আপনি!’

‘এক থাপ্পড় দিয়ে চোয়ালসহ সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো তোমার। পরীক্ষা দিবে না মানে?’

তরী কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘এবারও ফেইল করবো আমি। আমার মন বলছে। কিচ্ছু মাথায় নেই আমার। সব সূত্র ভুলে গেছি। আর্টিকেলের ব্যবহার ভুলে গেছি। একটা প্যারাগ্রাফের প্রথম লাইন মনে নেই। ফিন্যান্সের….. ‘

‘চুপ! ফেইল করলে করবে। তোমার কাজ হলো পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া। তুমি সেটাই করবে।’

‘পরীক্ষা দিবো না আমি!’

‘তরী জিদ করবে না একদম। আমায় চিনো ভালো করে। এক ধাক্কা দিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিবো।’

‘বললাম তো পরীক্ষা দিবো না।’

নির্ঝর বাম হাত দিয়ে টিস্যু বক্সটা মুচড়ে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে রক্তলাল চোখে বলল,

‘চুপচাপ বসে থাকতে বলেছি। নো কান্নাকাটি। আমি পরীক্ষা দিবো। আমার সাথে সিলেট যাবে তুমি।’

নির্ঝরের কন্ঠে কিছু একটা ছিল যার দরুন তরীর কান্না থেমে গেল। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে থম মেরে বসে রইলো। সে বেশ বুঝতে পারছে, পৃথিবী দুই টুকরো হয়ে উড়ে গেলেও নির্ঝর তাকে সিলেট নিয়ে যাবে। নিয়ে যাবে পরীক্ষার হল অবধি। এতক্ষণ গাড়ি স্লথ গতিতে চলছিল। আস্তে আস্তে নির্ঝর গাড়ির বেগ বাড়িয়ে দিল।

_____________

কয়েক ঘন্টা সময় কেটে গেছে। গাড়ি ঢাকা শহর অতিক্রম করেছে অনেক আগে। এখন চিকন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার দুপাশে ছোটবড় সব মিলিয়ে প্রচুর গাছ। কেমন সবুজ আর সবুজ চরিদিকে। সকালের সেই কোমল রোদ আর নেই। কড়া হয়ে গেছে। দুপুরের সেই কড়া রোদ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে। অল্প বিস্তর গাড়ির হর্ণের শব্দ ছাপিয়ে কিচিরমিচির পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।

আকাশ পরিষ্কার। মেঘমুক্ত! সমস্ত আকাশ সাদা আর নীল চাদরে ঢেকে আছে। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে সেই আকাশের দিকে চেয়ে আছে তরী। আর নির্ঝর আড়চোখে বার বার তরীর দিকে তাকাচ্ছে। এতটা সময় কেটে যাওয়ার পরো তরী ঘুমায়নি। চুপচাপ বসে আছে। নির্ঝর নরম গলায় অনেকবার অনুরোধ করেছে ঘুমানোর জন্য। কিন্তু তরী ঘুমানো তো দূরে থাক, কথা পর্যন্ত বলেনি।

নির্ঝর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা এত অবুঝ কেন? সবাই তার পড়াশোনার জন্য এত এত উৎসাহ দিল আর শেষ মুহূর্তে এসে বলছে পরীক্ষা দিবে না। অদ্ভুত! সে পুনরায় কোমল কন্ঠে বলল,

‘এখনো অনেকটা পথ বাকি তরী। এভাবে চেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। ঘুমিয়ে পড়ো একটু।’

তরী কোনো প্রতিত্তর করলো না। নির্ঝর আলতো করে বাম হাতটা দিয়ে তরীর হাত চেপে ধরলো। তার দৃষ্টি সম্মুখে। এক হাতে গাড়ির লেন ঠিক রেখে বলল,

‘একটা কবিতা শুনবে?’

এই প্রথম তরী নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। আলগোছে মাথাটা শুধু সিটে এলিয়ে দিল। তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখ দুটো বশে গেছে। কেমন এলোমেলো লাগছে। গাড়ির এসি বন্ধ। জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস আসছে। সেই বাতাসে তরীর মাথার অবাধ্য চুলগুলো উড়ছে। তরীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নির্ঝর আরেকটু শক্ত হাতে তার হাত ধরলো। নরম সুরে বলা শুরু করলো,

‘এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন!
বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা-

দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে
স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি,
কোন বেদনার বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ রাত?

সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি, সহজে ভুলিনা কিছু-
না-বলা কথায় তন্ত্রে তনুতে পুড়ি,
যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে
উড়াই নিজেকে আকাশের পাশাপাশি।

সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি
সহজে থাকি না কাছে,
পাছে বাঁধা পড়ে যাই।
বিস্মিত তুমি যতোবার টানো বন্ধন-সুতো ধ’রে,
আমি শুধু যাই দূরে।

আমি দূরে যাই-
স্বপ্নের চোখে তুমি মেখে নাও ব্যথা-চন্দন চুয়া,
সারাটি রাত্রি ভাসো উদাসীন বেদনার বেনোজলে…

এতো সহজেই ভালোবেসে ফ্যালো কেন?’

-রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

তরী চোখ বন্ধ করে ফেলল। এতক্ষণে তার ঘুম পাচ্ছে। প্রচুর ঘুম।

তরীর নিস্তব্ধে মোড়ানো নিঃশ্বাসের শব্দ নির্ঝরের বুকে গিয়ে বিঁধলো। অবশেষে তরী ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তরীর ডান হাতটা উঁচু করে তাতে আলতো করে চুমু খেল।

(চলবে…)

ভালোমতো রিচেক করা হয়নি। শুভরাত্রি সবাইকে।🌚🤎

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here