#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____২৫ (বোনাস পার্ট)
ভেজা দৃষ্টি মেলে তরী নির্ঝরের আরো নিকটে এলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ডান হাতটা উঁচিয়ে নির্ঝরের গাল স্পর্শ করলো। মানুষটাকে এখনো সে ভীষণ ভয় পায় আবার ভালোবাসে! তবে ভয় আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য করলে ভালোবাসার পাল্লা ভারী হবে। সেখান থেকে সাহস নিয়ে সে ভয়ানক একটা কাজ করতে চাইলো। পায়ের উপর ভর দিয়ে সে কিঞ্চিৎ উঁচু হয়ে নির্ঝরের নাক পর্যন্ত এলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নির্ঝরের বাম গাল চেপে ধরে ডান গালে নরম ঠোঁটযুগল ছোঁয়াল। নির্ঝরের অবাক হয়ে যাওয়া মুখের দিকে চেয়ে হুশ ফিরে তার। লজ্জা পেয়ে সরে আসতে নিতে বাঁধা পেল। নির্ঝর এক হাতে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিল।
তরীর নত মাথা। চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছে। মুখের উপর রংধনুর মতো লজ্জার রেখা ভেসে উঠছে। আবছা আলোয় তার সে মুখপানে চেয়ে নির্ঝর ঘোর লাগা কন্ঠে ফিসফিস করে বলল,
‘চোখ খুলো তো তরীরানি!’
তরী তার থেকেও নিচু স্বরে বলল,
‘না!’
‘কেন? আমার উদ্দেশ্য সৎ! আমি জাস্ট তোমার চোখের রঙ পরখ করবো। এতদিন ভালো করে দেখা হয়নি।’
‘অন্ধকারে চোখের রঙ দেখা যায় বুঝি?’
‘বাহ্যিা চোখ দিয়ে দেখবো তোমায় কে বললো গো? মনের চোখ দিয়ে দেখবো। চোখ খুলো তো।’
তরী লজ্জায় চোখ খুলতে পারলো না। তার সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। সে ভেবে রেখেছে এই চোখ আর এ জীবনে খুলবে না। নির্ঝরের চোখে চোখ রাখবে না। তার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর তাকে লজ্জা নামক বাণ দিয়ে মেরে ফেলবে। নির্ঝর মুচকি হেসে মুখটা নিচু করলো। তরীর কপালে অধর চুম্বন দিতে সে কেঁপে উঠলো। ঝটপট চোখ খুলতে নির্ঝরের দৃষ্টিতে ঘায়েল হয়ে গেল। হারিয়ে গেল দুজন দুজনার চোখের মাঝেতে।
কিছু মুগ্ধকর মুহূর্ত কেটে গেল। নির্ঝরের বাহুডোরে আবদ্ধ থাকা তরীর শরীর হালকা নড়ে উঠলো। নির্ঝর চোখ ছোট ছোট করে ফু দিল তরীর মুখে। সঙ্গে সঙ্গে তরী চোখ বন্ধ করে ফেলল। কয়েক মিনিট সে মুখের দিকে চেয়ে পুনরায় মুখটা নিচু করলো। তরীর পাতলা ঠোঁটযুগলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। বুকের নদীতে বয়ে চলা অকস্মাৎ ঢেউ থামাতে সে তিন-চার সেকেন্ড সময় নিয়ে তরীর নিচের ঠোঁটে চুমু খেল।
নির্ঝরের বুকের ঝড় থেমে গেল। সে হাত ঢিলে করতে তরী কয়েক পা পিছিয়ে গেল। বাম হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে আবার দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। অযথা মাথার খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চুলে হাত দিতে নির্ঝর পুনরায় এগিয়ে এলো। তরীর হাত ধরে বাঁধা দিয়ে বলল,
‘উঁহু! ওভাবে নয়।’
তরীর হাত থেমে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ওভাবে নয় কিভাবে? আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি চুল বাঁধতে পারি না?’
‘মহারানী। কখন বললাম যে আপনি চুল বাঁধতে পারেন না? আপনি সব পারেন। শুধু একটা জিনিস ছাড়া।’
তরী কৌতূহল নিয়ে নির্ঝরের মুখের দিকে তাকালো। কোন জিনিসটা সে পারে না? জানতেই হবে! সেটা আগে শিখতে হবে। সে ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের উত্তরের অপেক্ষা করছে। কিন্তু নির্ঝর নিশ্চুপ রয়েছে। তার অস্থিরতা ভীষণ উপভোগ করছে। তরী ধুম করে নির্ঝরের বুকে কিল বসিয়ে দিল। নির্ঝর সঙ্গে সঙ্গে বুকে হাত চেপে হেসে ফেলল। তরী কপাল কুঁচকে বলল,
‘কোন জিনিস পারি না আমি?’
‘বলবো না। গেস করো!’
‘আপনি বলবেন নাকি বলবেন না?’
‘একটু চিন্তা করো তুমি!’
‘বুঝতে পেরেছি। আপনি বুঝাতে চাইছেন যে আমি পড়াশোনা পারি না। ফেল্টুস আমি। তাই তো?’
নির্ঝর শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
‘সিরিয়াসলি! আমি পড়াশোনা বুঝিয়েছি? এটা মনে হলো তোমার?’
‘তাহলে বলুন না স্পেসিফিক কোন জিনিসটা আমি পারি না?’
তরীর অধৈর্যতা দেখে নিরবে হাসি থামাল নির্ঝর। তরীর খোলা চুলগুলো আঙুলের ডগা দিয়ে নেড়েচেড়ে বলল,
‘শুধু আমায় ভালোবাসতে পারো না। বাকিসব পারো তুমি।’
‘কে বলেছে আপনাকে ভালোবাসতে পারি না? বাসি তো!’
‘কি বাসো?’
তরী লজ্জায় পুনরায় মাথা নত করলো। দু হাতে ওড়নার ঝুলন্ত অংশ চেপে ধরে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খোঁটা শুরু করলো। নির্ঝর আর অপেক্ষা করলো না। এক ঝটকায় তরীকে কোলে তুলে নিল। তরী চমকে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। বিস্ফারিত কন্ঠে বলল,
‘কোলে তুলছেন কেন?’
‘অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়তে হবে না?’
‘অহ, হ্যাঁ! ঠিক আছে। নিচে নামান, হে-হেঁটে যাই আমি!’
‘ডিঙিরানী চুপ! আমাকে আমার কাজ করতে দাও।’
বেলকনি থেকে রুমে ঢুকে নির্ঝর পা দিয়ে কাচ ঠেলে দিল। চেয়ার টেনে তরীকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিল। ব্রাশ হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে নিল। তরী বাঁধা দিল না।
তরীর মাঝারি সাইজের চুল এখন। বিয়ের আগে অনেক যত্ন করে সে চুল বড় করেছিল। কোমড় ছাড়িয়ে গিয়েছিল চুলে। কিন্তু বিয়ের পর নির্ঝর চুলের নিচ থেকে কিছু অংশ কেটে দিয়েছে। কারণ একটা না, অনেকগুলো। সে শাওয়ার শেষ করে চুল ভালোমতো শুকায় না, মাথায় নিয়মিত ব্রাশ করে না, চুল বাঁধে না ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কারণ এই চুলের ভাড়ে সে নাকি দিনদিন চিকন হয়ে যাচ্ছে। এরকম আরো অনেক অজুহাত দেখিয়ে নির্ঝর তার লম্বা বিঁনুনি ধরে কেটে দিয়েছিল।
তরীর ঘন কৃষ্ণ চুলের মাঝে নির্ঝর হারিয়ে ফেলল নিজেকে। চুলে মুখ ডুবিয়ে সে গন্ধ নিল। সময়ের কথা মনে পড়তে সে দ্রুত চুল বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তরীকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এত রাত জাগলে অারো বেশি অসুস্থ হয়ে পরবে। সে চুলগুলো তিন ভাগ করে বিঁনুনি পাকানোর চেষ্টা করলো।
কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও প্যাঁচ গুলো ঠিকমতো দিতে পারলো না। বিগত মাসগুলোতে সে লুকিয়ে তরীর চুল বাঁধা দেখেছে। তখন বিঁনুনি পাকানো পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ সাধ্য কাজ মনে হয়েছে। কিন্তু জিনিসটা মোটেই সহজ নয়। নির্ঝরের অবস্থা বুঝতে পেরে তরী নিজে থেকে বলল,
‘আমি বেঁধে ফেলি। আপনাকে করতে হবে না।’
‘আমি নিয়ত যখন করেছি, বিঁনুনি গেঁথেই ছাড়বো। ‘
তরী একটু হাসলো। বহুক্ষণ বহু কসরত করে নির্ঝর চুলগুলো দড়ির মতো পেঁচাতে সম্ভব হলো। রাজ্য জয়ের হাসি দিয়ে সে আয়নার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘তরী! দেখেছ কত সুন্দর করে করতে পেরেছি আমি।’
তরী বিনিময়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। বিঁনুনি টা হাত দিয়ে স্পর্শ করলো সে। যখন তখন খুলে যাবে হয়তো। তবুও বুকে কি যে ভালো লাগা! কত যে মুগ্ধতা! সে পুলকিত মনে উঠে দাঁড়াতে নির্ঝর আবার তাকে কোলে তুলে নিল।
বিছানার দিকে এগিয়ে তরীকে একপাশে শুইয়ে দিল নির্ঝর। মাথার নিচে বালিশ ঠিকঠাক দিয়ে পাশ থেকে ব্লাঙ্কেট তুলে গায়ে জড়িয়ে দিল। তরীর দিকে ঝুঁকে বলল,
‘ক্ষুধা লেগেছে? এত রাত অবধি জেগেছিলে। কিছু খাবে?’
তরী এদিক ওদিক মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল। তার চোখের মণি চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রুমে দিনের মতো আলো। এই আলোতে নির্ঝরের চোখে চোখ পড়লে সর্বনাশ। তার এখনো কেন জানি মনে হচ্ছে ওপাশের বেলকনির ঘটনাগুলো নিছক স্বপ্ন। যা সে জেগে জেগে দেখছে। অথবা সম্পূর্ণ অংশ কল্পনা! কপালে নির্ঝরের হাতের স্পর্শ পেতে সে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলো। কি অদ্ভুত অনুভূতি। নির্ঝর কনফার্ম হওয়ার জন্য বলে উঠলো,
‘সত্যি ক্ষুধা লাগেনি তো?’
‘নাহ।’
‘লাইট বন্ধ করবো? নাকি জ্বালানো থাকবে?’
‘বন্ধ থাক!’
তরী অল্প ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। নির্ঝর উঠে দাঁড়ালো। পেছন ঘুরে দেয়ালের সুইচের দিকে এগিয়ে যেতে তরী আড়চোখে নির্ঝরের সর্বাঙ্গে নজর বুলাল। মানুষটার গায়ে ছাই রঙা ঢিলেঢালা ট্রাউজার আর গাঢ় সবুজ রঙের টিশার্ট। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। উন্মুক্ত ফর্সা বাহু কেমন উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে থাকা অবস্থায় রুম অন্ধকার হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেলকনির সবুজ আলো জ্বলে উঠলো। যার বেশিরভাগ আলো রুমে এসে পড়েছে। নির্ঝর ঘুরে দাঁড়াতে সে দ্রুত মাথা সোজা করে চোখ বন্ধ করলো।
তরীর পাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে নির্ঝর শুয়ে পড়লো। টান টান হয়ে শুয়ে দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলো। তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ। এ হাসি কখনো ফিকে হবে না। তার প্রতিনিয়ত হাসির কারণ যেই মেয়েটি সে তো এখন তার পাশে, তার কাছে। তার খুব কাছে! তরীকে নিজের পাশে পেয়েছে, বউ করতে পেরেছে এতেই তার জীবন ধন্য। তরীর একটু আধটু স্পর্শে সে পাগলপ্রায়। সে মুখ ঘুরিয়ে তরীর দিকে তাকাল।
তরী উসখুস করছে। একটুপর পর কাত ঘুরছে। গায়ের ব্লাঙ্কেট একবার ফেলে দিচ্ছে তো একবার গায়ে জড়াচ্ছে। নির্ঝর কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ্য করে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘পেট ব্যথা করছে তরী? এমন নড়াচড়া করছে কেন?’
তরী ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘পেট ব্যথা করে না।’
‘তাহলে?’
‘ঘুম আসছে না।’
‘সে কি! শুধু শুধু ঘুম আসবে না কেন? ঘুম তো আসবে আসবে, সাথে তার বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে আসবে। নিশ্চয়ই তুমি মাথার নিচে বালিশ দাওনি।’
‘মাথার নিচে বালিশ আছে। আপনি নিজ হাতে দিয়ে দিয়েছেন।’
‘তাই তো! তাহলে ঘুম আসছে না কেন?’
তরী উত্তর দিল না। সে কাত ঘুরে চিৎ হলো। নির্ঝর হঠাৎ নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘আমার হাতটা ধার দিতে পারি। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি,এখানে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম চলে আসবে।’
‘আর যদি না আসে?’
‘নৌকারানী! এই নির্ঝর শাহরিয়ারের কোনো কথা কখনো অবিশ্বাস করতে হয় না। যারা অবিশ্বাস করে তারা ঠকে যায়। পুরো হাতে আমি ঘুমনাশক স্প্রে করেছি। মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম চলে আসবে। না আসলে হাত কেটে ফেলবো।’
তরী ফিক করে হেসে ফেলল। একটুপর আড়ষ্টতা নিয়ে এগিয়ে এলো। বালিশ রেখে নির্ঝরের হাতের উপর মাথা রাখলো। নির্ঝর হাতটা সামান্য গুটিয়ে তরীকে আরো একটু কাছে নিয়ে আসলো। বাম হাতে তরীর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,
‘চোখ বন্ধ করো তো এবার।’
তরীর শ্বাস গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তার সে ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে নির্ঝর অযাচিত হাসছে। তরী তার বুকের কাছে কেমন বিশ্বাস হতে চায় না। মুচকি হেসে সে তরীর ডান হাত উঁচু করে তার উল্টোপিঠে চুমু খেল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
‘ঠিক অতোটা ভালোবাসার দরকার নেই আমার! তুমি শুধু তোমায় আমার মতো করে ভালোবাসতে দিয়ো। আমার মতো করে আগলে রাখতে দিয়ো প্রিয়। ব্যস এইটুকুই!’
______________
ভোরবেলা গাড়ির বিশ্রী হর্ণের শব্দে নির্ঝরের ঘুম ভাঙলো। কাছে কোথাও অনবরত গাড়ির হর্ণ বেজে যাচ্ছে। দোতলা থেকেও সেগুলো যেন কানের মধ্যে ঢুকে যায়। সে রোজকার মতো বন্ধ চোখে উঠতে নিতে বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব করলো। বিস্ময় নিয়ে দ্রুত চোখ খুলতে মুখের উপর একরাশ চুলের অস্তিত্ব টের পেল। বাম হাতে চুলগুলো সাবধানে সরিয়ে নিল। মাথা উঁচু করতে নাকে চিরপরিচিত গন্ধ এসে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
(চলবে….)
পর্বের শেষে বোনাস পার্ট উল্লেখ করার কারণ হলো সবার চোখে যেন পড়ে, নতুন পর্বের সাথে কয়েক ঘন্টা আগের পর্ব যেন গুলিয়ে না ফেলে সেজন্য। ভালো মতো রিচেইক করা হয়নি!🖤