শেষটা_সুন্দর #অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম) #পর্ব___৩১

0
467

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___৩১

কয়েক পা এগিয়ে উঁকি দিতে নির্ঝরের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। দু হাতে মাথা চেপে ধরে সামনে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

‘তরী? তরী!’

নির্ঝর মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা নাড়াতে পারছে না। তার চোখের সামনে একটু দূরে তরী বিছানায় শুয়ে আছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে! অথচ সে এগিয়ে যেতে পারছে না। পা দুটো কিছুতেই টেনে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। ঘূর্নায়মান মাথার চুল আরো শক্ত হাতে টেনে ধরে সে দু বার ডাকলো,

‘তরী? এই তরী?’

প্রবল উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে তার। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে। পা দুটো টেনে হুড়মুড় করে এগিয়ে যেতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। পড়ে যাওয়ার আগে একটা হাত তাকে আচমকা ধরে ফেলল। নির্ঝর সোজা হয়ে সাহায্যকারীর মুখপানে চেয়ে কিঞ্চিৎ অবাক হলো। কপাল কুঁচকে বলল,

‘প্রভা তুই?’

প্রভা নির্ঝরের হাত ছেড়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে তার পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করলো। আনুমানিক দিন কুড়ি আগে যে নির্ঝরের সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল, সেই নির্ঝর আর আজকের নির্ঝরের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আজকের নির্ঝর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চেহারা ভেঙে গেছে। কপালে ব্যান্ডেজ করা। ফতুয়ার গলার ফাঁক দিয়ে কাঁধের কাছে আরেকটা ব্যান্ডেজ চোখে পড়ছে। গলার কাছে কাটার দাগ। ক্ষত শুকিয়ে গেলেও দাগ রয়ে গেছে। পায়ে ইনজুরি। সে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘তোর এ অবস্থা কেন? এক্সিডেন্ট করেছিলি? কিভাবে? কখন? মারাত্মক ইনজুরি মনে হচ্ছে!’

প্রভার একগাদা প্রশ্নের প্রতিত্তরে নির্ঝর হাত উঁচিয়ে কেবিনের দিকে নির্দেশ করলো শুধু। পরক্ষণে প্রভাকে পাশ কাটিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কেবিনে ঢুকলো। বিছানার কাছাকাছি গিয়ে পা আর চলতে চাইলো না। ঘোর লাগা চোখে তরীর দিকে চেয়ে রইলো সে। কতগুলো দিন, কতগুলো রাত পর এই মুখটা দেখতে পেল। এত শুকিয়ে গেছে কেন মুখটা? কেমন ফ্যাকাসে পান্ডুর মতো হয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে বালিশে ছড়িয়ে আছে। চোখের নিচে কালি। শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে যেন! নির্ঝরের ঘোর লাগা চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তরীর দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে ডান হাতটা দিয়ে তরীর কপাল স্পর্শ করলো। গভীর আবেগ মিশিয়ে সে ডাক দিল,

‘ডিঙিরাণী! এতদিন কোথায় ছিলে তুমি?’

পরক্ষণে প্রায় হুমড়ি খেয়ে বিছানার উপর পড়লো সে। তরীর স্যালাইনমুক্ত হাতটা বুকে জড়িয়ে অনবরত ডাকা শুরু করলো,

‘তরী? এই তরী? কথা বলো! কি হয়েছে তোমার? এই দেখো, আমি এসে গেছি। তরী? এই ডিঙিরাণী কোথায় ছিলে এতদিন? বলোতো! চোখ খুলো! চোখ খুলে দেখো আমায়। তরী?’

প্রভা বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে এলো। বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটির নিস্তেজ শরীরের দিকে এক পলক চেয়ে আবার নির্ঝরের দিকে তাকালো। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,

‘কে তরী নির্ঝর? তুই এই মেয়েটিকে চিনিস?’

নির্ঝরের এক হাত শক্ত হাতে তরীর ডান হাতটা বুকে জড়িয়ে আছে। যেন একটু ঢিল দিলেই তরী আবার পালিয়ে যাবে। আরেক হাত তরীর সমস্ত মুখমণ্ডল ছুঁয়ে দিচ্ছে। দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। বুকের কাছের হাতটা উঁচু করে সে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল। একটুপর বলল,

‘প্রভা ও তরী!’

‘তরী?’

‘হুঁ! আমার বউ! আমার ওয়াইফ! আমার এভরিথিং।’

প্রভা নড়েচড়ে উঠলো। বিস্ময়ে হাতে ধরে রাখা মেডিকেল রিপোর্টটা নিচে পড়ে গেল। সে দ্রুত সেটা কুড়িয়ে হাতে তুলে বলল,

‘এই মেয়েটি তোর বউ নির্ঝর? ওর এ অবস্থা কেন?’

‘জানি না! ও উনিশ দিন আগে নিখোঁজ হয়েছিল।’

নির্ঝর সংক্ষিপ্ত আকারে প্রভাকে সব খুলে বলল। পরক্ষণে চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘প্রভা ও কথা বলছে না কেন? রেসপন্স করছে না কেন? কি হয়েছে ওর?’

‘ওকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে রাখা হয়েছে। শরীর প্রচন্ড উইক। আড়াই দিন হলো হসপিটালে ভর্তি।’

‘কে ভর্তি করিয়েছে?’

নির্ঝরের সম্পূর্ণ দৃষ্টি তরীতে নিবদ্ধ। প্রভা সাইড থেকে একটা টুল এনে সেটাতে বসে পড়লো। ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

‘তরীকে আমিই ভর্তি করিয়েছি এখানে। গত পরশু দিন ভর্তি করা হয়েছে। অনেক কাহিনি। পরশু দিন রাতের বেলা ড্রাইভে বের হয়েছিলাম। ড্রাইভ করতে করতে কখন যে পুরান ঢাকার ওদিকে চলে গেছি টের পাইনি। তখন প্রায় মধ্যরাত। ফেরার পথে গুলিস্তানের কাছে পৌঁছানোর আগে তরীর সাথে দেখা। দেখি দ্বিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে দৌঁড়াচ্ছে। আমি ভাবলাম হয়তো বিপদে পড়েছে। গাড়ি থামিয়ে জিগ্যেস করলাম, কি হয়েছে? কিছু বলতে পারছিল না। প্রচুর ভয়ে, আতংকে ছিল। হঠাৎ আমার পা জড়িয়ে ধরে সাহায্যের ইঙ্গিত করে। আমি সামনা-সামনি দাঁড় করিয়ে দেখি গা দিয়ে মদের গন্ধ। আংশিক মাতাল ছিল।’

নির্ঝরের বুক কেঁপে উঠলো। অস্পষ্ট সুরে বলল,

‘ওকে কোথায় আটকে রেখেছিল? কি হয়েছিল ওর সাথে কিছু বলেছে?’

‘না! কিছু বলতে পারছিল না। আমি জোর করিনি। হঠাৎ ওর পায়ের দিকে চোখ পড়ে। দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পাজামা উঁচু করতে গা শিউরে উঠে আমার। হাঁটুর একটু নিচে থেকে মাংস খসে পড়েছে। উঁচু কোনো জায়গা থেকে লাফিয়ে পড়েছিল বোধ হয়। লাফিয়ে রড বা ধারালো কিছুর উপর পড়েছিল। আমি দ্রুত ওর গায়ের ওড়নাটা দিয়ে পা বেঁধে দিই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কোনো উপায় না পেয়ে হসপিটালে ভর্তি করি।’

প্রভার কথা শেষ হতে না হতে নির্ঝর পেছন ঘুরে বসে। খুঁড়িয়ে তরীর পায়ের কাছে যায়। পাতলা চাদর সরিয়ে দেখে বাম পা ব্যান্ডেজ করা। তার চোখ পুনরায় জলে ভরে উঠে। সে রুদ্ধ কন্ঠে বলে,

‘পায়ে সেলাই দেওয়া হয়েছে?’

‘হুম। তিনটে সেলাই দেওয়া হয়েছে। হাঁড় থেকে মাংস প্রায় আলাদা হয়ে গেছিল। অনেক গভীর ক্ষত!’

নির্ঝর আর শুনতে পারলো না। এক হাতে কান চেপে ধরলো। আরেক হাতে তরীর ব্যান্ডেজ করা পায়ে হালকা করে ছুঁয়ে দিল। পায়ের পাতা ছুঁয়ে দিল। এই পা দুটোকে সে বুকে জায়গা দিয়েছিল। বুকে আগলে রাখতো। অথচ, সেই পায়ের কি অবস্থা হয়েছে। আচমকা সে তরীর পায়ের উপর মুখ রেখে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,

‘স্যরি তরী! ভেরি স্যরি। আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি। তোমায় আগলে রাখতে পারিনি আমি। এমন ভুল আর হবে না। আর কখনো তোমায় একা ছাড়বো না! কথা দিচ্ছি, আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমার থেকে কেউ তোমায় আলাদা করতে পারবে না।’

রিপোর্টটা টুলের উপর রেখে প্রভা উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গিয়ে তরীর স্যালাইন পরখ করলো। বুকে টেথোস্কোপ লাগিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবিধি পরখ করলো। সব নরমাল! সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,

‘প্রচুর উইক মেয়েটা। আমার কাছে আনার পর একবার মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য চোখ খুলেছিল। ভীষণ ছটফট করছিল। ফলস্বরূপ বড় ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রেখেছে। আর দিন-রাত স্যালাইন চলছে।’

নির্ঝর তরীর পায়ের উপর থেকে মাথা তুলে চোখ মুখ মুছে ফেলল। তরীর মুখ পানে চেয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

‘প্রভা তুই এই হসপিটালের ডাক্তার অথচ আমার সাথে আজ দেখা হলো? কেন বলতো? তুই জানিস না আমি সেই কবে থেকে এখানে এডমিট?’

‘আমরা ইন্টার্ণী ডাক্তার। ইন্টার্ণ করার সময় বড় বড় হসপিটাল গুলোতে কিছু দিনের জন্য কাজ করতে হয়। সাতদিনের জন্য আমি এই হসপিটালে আছি। তিনদিন হয়েছে মাত্র। সেজন্য তরীকে এই হসপিটালে এডমিট করিয়েছি। যাতে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারি।’

নির্ঝর কিছু বলল না। চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে প্রভার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ করে প্রভার সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। কৃতজ্ঞতার সুরে বলল,

‘প্রভা। থ্যাঙ্কস অা লট! আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো তোর কাছে।’

প্রভা বিস্ময়ে হাতটা মুখের উপর দিল। বিস্ফারিত নয়নে বলে উঠলো,

‘নির্ঝর? তোর এত পরিবর্তন হয়েছে? কলেজে কি মুড নিয়ে থাকতি সবসময়। কারো সাথে কথা বলতি না। সে কি এটিটিউড! কলেজের এটিটিউড বয় খ্যাত সেই ছেলে আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে? এসব তোর ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না।’

নির্ঝর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। পুনরায় তরীর মুখের কাছে গিয়ে বসে গভীর মমতায় চেয়ে রইলো তার মুখপানে। একটা শ্বাস ফেলে বলল,

‘এই মেয়েটা আমার সব প্রভা। আমার পৃথিবী। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমার শ্বাস প্রশ্বাস ও! তুই জানিস, ওকে ছাড়া এ কয়েকটা দিন আমার নিঃশ্বাস ফেলতে, শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। দম বন্ধ হয়ে মারা যাইনি এটা একটা মীরাকল! এই দেখ, আমি এখন ঠিকমতো নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি। সুস্থ মতো শ্বাস নিতে পারছি। সব এই মেয়েটার জন্য। আর আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনকে পরম করুণাময় তোর হাত দিয়ে ফিরিয়ে দিল তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো না? তোর কাছে আমি চিরঋণী। এই মেয়েটার জন্য আমি সব করতে পারি। সামান্য হাঁটু গেড়ে বসা ব্যাপার নাহ! ধন্যবাদ রে!’

প্রভা মুচকি হাসলো। ভালোবাসা মানুষকে কতটা পরিবর্তন করিয়ে দেয়। নির্ঝর কতখানি মায়া নিয়ে, আবেগ নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে তরীর দিকে তাকাচ্ছে! তার বুক জুড়িয়ে গেল। সেই সাথে মনটা কিঞ্চিৎ ভার হয়ে এলো। বিছানায় গভীর ঘুমে শুয়ে থাকা মেয়েটির দিকে চেয়ে সে মনে মনে বলল,

‘সত্যি মেয়ে! তুমি অনেক লাকি। তোমায় ভেঙে চূড়ে ভালোবাসার মতো কেউ পৃথিবীতে এখনো আছে। এজন্যই তুমি এত বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছ!’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে টুলের উপর থেকে মেডিকেল রিপোর্ট হাতে নিল। দরজার দিকে হেঁটে যেতে যেতে বলল,

‘নির্ঝর সুব্রত কুমার স্যারের কেবিনে আয়। তরীর মেডিকেল রিপোর্ট দেখতে হবে। রিপোর্ট হাতে পেয়েছি মাত্র।’

‘হুঁ! আসছি একটুপর।’

প্রভা কেবিনের বাইরে যেতে নির্ঝর প্যান্টের পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। ঝটপট তরীর কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। তারপর বড় মায়ের ফোনে ছোট্ট একটা এসএমএস দিয়ে পুনরায় চোখ দুটো তরীতে নিবদ্ধ করলো।আস্তে আস্তে তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নিচু হয়ে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। অশ্রুমিশ্রিত চোখে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে নাকে নাক ঘঁষলো। কতগুলো দিন পর মেয়েটার স্পর্শ পাচ্ছে। সেই চির পরিচিত ঘ্রাণ নাকে আসছে। সে কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচুস্বরে বলল,

‘আমার ডিঙিরাণী!’

(চলবে)

সারাদিন প্রচন্ড মাথা ব্যথা ছিল। আজ দিতে চাইলাম না। সবাই অপেক্ষা করবেন বলে ছোট করে দিয়ে দিলাম। রি-চেইক করা হয়নি। 🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here