#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___৩৬
কিছু বলার আগেই তরী কান্না শুরু করলো। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘সেদিন পরীক্ষা শেষ করে লুকিয়ে একটু ফুলের দোকানে যেতে চেয়েছিলাম। আপনাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে! সেজন্য ড্রাইভারকে আসতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু ফুলের দোকানে পৌঁছানোর আগেই আমি আশিকের ফাঁদে পা দিই। আমার ক্লাসমেট জেরিন নামের এক মেয়ে ভন্ডামি করে আমাকে আমাদের কলেজে নিয়ে যায়। আমি প্রথমে যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। সেজন্য সে বলে আমার কাগজপত্রে নাকি সমস্যা হয়েছে এবং ম্যাম অনতিবিলম্বে দেখা করতে বলেছে। একা যেতে ভয় পাই বলে জোর করে ওকে সাথে নিয়ে যাই। এতে হিতে আরো বিপরীত হয়। আমাকে ফাঁকা একটা রুমে নিয়ে আটকে ফেলে। পরে বুঝতে পারি আশিক আর জেরিন এক দলে! কি পরিমাণ ভয় পেয়েছিলাম!’
তরীর শরীর শিউরে উঠে। নির্ঝর কিছু বলার আগেই সে অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,
‘আপনি জানেন, সেদিন আশিক আমায় কত মেরেছিল? আমার গালে থাপ্পড় মেরেছিল, ধাক্কা দিয়ে বেঞ্চের উপর ফেলে দিয়েছিল, চুল টেনে দরজার সাথে মাথা ঠুকে দিয়েছিল। কত ব্যথা পেয়েছিলাম আমি! কতবার আপনাকে ডাকলাম। আপনি শুনতে পেলেন না। আপনি আসলেন না।’
তরীর কন্ঠ ধরে আসতে সে থেমে যায়। নির্ঝরের চোখ দুটো সময়ের সাথে সাথে রক্তবর্ণ ধারণ করে। নিজের অজান্তে হাতের তালু মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। তরীর ব্যথাতুর কন্ঠের প্রতিটি শব্দে শরীর পুড়ে যাচ্ছে তার। ত্বকের উপর অদৃশ্য কোনো শক্তি যেন জ্বলন্ত কয়লা চেপে ধরে আছে। সে সহ্য করতে পারছে না! কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না! কিন্তু তাকে শুনতে হবে তো। তরীর হাসি, আনন্দের দিনগুলোর মতোই তরীর কষ্টের দিনগুলো মনের কুঠুরিতে রাখতে চায়। ভবিষ্যতে যেন ফুলের টোকা দিতে তার বুক কেঁপে উঠে।
তরীকে জড়িয়ে রাখা নির্ঝরের হাতের বাঁধন আরো শক্ত হয়ে আসে। তরী নিঃশব্দে তার বুকের সাথে মিশে থাকে। কিছুক্ষণ দম নিয়ে সে ফের ক্ষীণ স্বরে বলা শুরু করলো,
‘মাথায় আঘাত পাওয়ার পর আমি নেতিয়ে পড়ে ছিলাম। ধস্তাধস্তি করে পালিয়ে আসার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একেবারে জ্ঞান হারাইনি। অল্প সেন্স ছিল। জেরিন কিছু একটা নাকের সামনে স্প্রে করতে ব্যথা উপলব্ধি করতে পারছিলাম না। শরীর অবশ হয়ে আসছিল ধীরে ধীরে। এক পর্যায়ে ঢলে পড়ি।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি চারিদিকে অন্ধকার। এর মধ্যে কত সময় কেটে গেছে কোনো ধারণা ছিল না। মধ্য বয়স্ক এক বিশ্রী লোক রঙিন একটা পানীয় নিয়ে আসে। জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে বাঁধা দিই। এর মধ্যে রুমে রঙ চঙ মাখা আরো একটা মহিলা আসে। খাবার দেয় আমাকে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা ছিল। খেতে শুরু করি। তৃষ্ণা পেতে পানির বদলে তারা অন্য কিছু দেয়। পরে বুঝতে পেরেছিলাম ওগুলো মদ ছিল।’
তরী হাঁসফাঁস করতে নির্ঝর হাত ঢিলে করলো। সঙ্গে সঙ্গে তরী শরীর গুটিয়ে উঠে বসলো। নির্ঝর তার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিছু বলার চেষ্টা করেও পারছে না সে। কয়েক সেকেন্ড পর নিজেও উঠে বসে পড়লো। ছাড়া ছাড়া ভাবে কোনো রকমে উচ্চারণ করলো,
‘আর শুনতে চাই না আমি। এবার ঘুমিয়ে পড়ো!’
তরী চোখ মুছে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। পুনরায় বলল,
‘ছোট্ট একটা রুমে আমাকে আটকে রেখেছিল। রুমের বাইরে বের হওয়া নিষেধ ছিল। সবসময় বহির্গমন দরজা বন্ধ করে রাখতো। কেউ ভেতরে ঢুকলে বের হয়ে আবার বাইরে থেকে বন্ধ করে দিতো। তবে সবাই আমাকে একটু আলাদা ভাবে দেখতো। কয়েক দিন যেতে একটা মেয়ে আমার রুমে প্রায়ই আসতো। আমার দেখাশোনা করার জন্য। কখনো খাবার নিয়ে, কখনো বা জামাকাপড় নিয়ে গোসলের জন্য বলতো। মেয়েটা আমার বয়সী ছিল। ওর থেকে যতটুকু জানতে পেরেছিলাম যে আশিক আমাকে ওদের কাছে রেখে কোথাও পালিয়ে রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আসবে।আশিকের কথায় আমাকে এতদিন আটকে রেখেছিল। না হলে আরো আগে বিদেশে পাচার করে দিতো। আশিক আমাকে ব্যবহার করার জন্য কিছুদিন নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল হয়তো!
ওখানকার সর্দার এক মহিলা। তার সাথে আরো অনেক বড় বড় মানুষ যুক্ত আছে। কিন্তু কোনো নিষিদ্ধ পল্লী নয় ওটা। পুরুষ বলতে দুজন ছিল। একজন মহিলা সর্দারের ডান হাত, আরেকজন বাবুর্চি! ওদের কাজ আলাদা। যতদূর শুনেছি ওরা বিদেশের সাথে অনৈতিক কর্মকান্ড করে। ড্রাগ, স্মাগলিং বা চোরাচালান এসব। আর এসব কাজে সন্দেহের হাত থেকে রক্ষার জন্য মেয়েদের ব্যবহার করে। এরা নাকি অপারেশন করে মেয়েদের শরীরে অত্যন্ত দামী ড্রাগ গুলো প্যাকেট করে বিদেশে পাঠায়। যেগুলো ওদেশে পৌঁছানোর পর পুনরায় অপারেশন করে বের করা হয়।
রুম থেকে প্রায়ই অনেক মেয়ের কন্ঠ শুনতাম। দিনে কারো কারো ক্ষীণ স্বরের কান্নার আওয়াজ শুনতাম। কিন্তু রাত হলেই সবার হাসি, তামাশা, হৈ হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসতো। কারণ তখন সবাই মাতাল থাকতো। আমাকে প্রথম ড্রাগ দেয় শেষ রাতের দিকে বোধ হয়। কয়েকজন মেয়ে আর সেই বিশ্রী লোকটা ধরে বেঁধে মদ খাওয়ায়, নাকের সামনে কিসব যেন ধরে। প্রথমদিকে বুকের ভেতর জ্বলে পুড়ে যেতো। কিন্তু আস্তে আস্তে সয়ে আসে। ভালো লাগতে শুরু করে। তখন ড্রাগের জন্য নিজে থেকে ছটফট করতাম। আমার বয়সী মেয়েটা আসতেই দুজন একসাথে মাতাল হতাম।
কিন্তু নেশা কাটলে পুরোটা সময় কান্নাকাটি করতাম। কতভাবে পালানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি। যে মেয়েটা আমার দেখাশোনা করতো, ওই মেয়েটার ভেতর আমার জন্য হয়তো কোনো দূর্বলতা ছিল। সেদিন রাতে আমরা দুজন আংশিক মাতাল হতেই আমাকে রুমের বাইরে নিয়ে এলো। তখন প্রতি রুমে সবাই ড্রাগ নিয়ে অন্য ভুবনে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমার তখনো সেন্স আছে। মাথার মধ্যে শুধু একটা বাক্যই ঘুরতো। আমাকে পালাতে হবে! সেই ভেবে অগ্রসর হই। সবার থেকে লুকিয়ে মেয়েটা আমাকে রান্নাঘরের পেছনের দরজার ঘুপচি দিয়ে বের করে দেয়। এরপর গাছ বেয়ে, প্রাচীর টপকে লাফ দেওয়ার সময় কিছু একটা তে প্রচন্ড আঘাত পাই। তখন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য ছিলাম। পায়ের ব্যথা উপেক্ষা করে পালাতে থাকি।
কোন রাস্তা দিয়ে এসেছি, কোথা দিয়ে দৌঁড়েছি কিচ্ছু মনে নেই আমার। কিন্তু কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারছিলাম না। সবাইকে ভয় লাগে। মেয়ে মানুষকে ভয় পাই, পুরুষকে ভয় পাই। সবাইকে ভয় পাই। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কত সময় কেটে গেছে জানি না। আপনার বন্ধুকে যখন পেয়েছি তখন আমার পা আর চলছিল না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিল। চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন। সেজন্য শেষ মুহূর্ত এসে তাকে ভরসা করে সাহায্য চাইছিলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই!
জ্ঞান ফিরতে দেখি ফুপি, শ্বাশুড়ি মা আমার পাশে বসে। কতক্ষণ আমি ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে চেয়ে ছিলাম। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি সবাইকে ফিরে পেয়েছি। বার বার মনে হচ্ছিল আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি। অথবা মাতাল আছি। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি বুঝতে পারলাম যে সবাইকে ফিরে পেয়েছি তখন কি যে পরিমাণ কষ্ট হচ্ছিল আমার! সুখের কষ্ট, আনন্দের কষ্ট!’
তরী থামলো। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। নির্ঝর ঝাপসা চোখে তরীর গাল মুছে দিল। চোখ মুছে দিল। তরীর মাথাটা কাঁধের উপর চেপে ধরে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘পানি খাবে?’
তরী মাথা নেড়ে না জানাল। এতদিন হঠাৎ হঠাৎ ভেতরে যন্ত্রণা হতো। মনের উপর কথার পাহাড় জমে ছিল। আজ নির্ঝরকে বলতে পেরে বুকের ভার নামলো। স্বস্তি পেল সে। এই যে নির্ঝর তার দুঃখে কথা শুনে পাশে রয়েছে, নিজের কাঁধে জায়গা দিয়েছে, তার দুঃখ মুছে দিচ্ছে এতে সে প্রগাঢ় তৃপ্তি অনুভব করছে! ঠোঁটের কোণে তীব্র হাসি ঝুলিয়ে সে আরো নিবিড়ভাবে নির্ঝরের কাঁধে মাথা গুঁজলো।
তরীকে পরম মমতায় আগলে রাখলেও নির্ঝরের মনের বিপর্যস্ত দশা! আশিক নামক নরপিশাচের উপর রাগে, ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠছে। মাথার ভেতর যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। পেটের ভেতর থেকে পিত্তরসের অথই সাগরে ডুবে মন তেঁতো হয়ে উঠছে বার বার। তার মনে হচ্ছে সে বুঝি পাগল হয়ে যাবে। যে মেয়েটাকে ফুলের মতো আগলে রাখার অভিপ্রায় ছিল, সে তার অজান্তে এতটা কষ্ট অনুভব করেছে তা সে কিছুতেই মানতে পারছে না।
কেটে গেল কিছু সময়! কেউ আর কিছু বলল না। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল একে অপরের মনের আঙিনা। কিছুক্ষন পর তরীর ভারী নিঃশ্বাস নির্ঝরের গলার কাছে আছড়ে পড়তে কিছু সময়ের জন্য সে সব দহন ভুলে গেল। বুকের জ্বলুনি কমে এলো। স্নিগ্ধ এক আবেশ ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত শরীর জুড়ে। বুকের বা পাশটায় নির্মল অনুভূতির সমুদ্রে তলিয়ে যেতে থাকলো। সে ধীরে সুস্থে তরীকে শুইয়ে দিল। মাথার নিচে বালিশ দিয়ে অপলক চেয়ে রইলো।
তরীর গালে হাত ছুঁইয়ে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলো নির্ঝর। ভবিষ্যতে তরীর প্রতি আরো মনোযোগী হয়ে উঠবে। তরীর সাথে সবসময় হাসিখুশি ভরা বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক বজায় রাখবে। তরীকে কখনো দুঃখের ছোঁয়া পেতে দিবে না। প্রয়োজনে নিজের সমস্ত কাজ, সমস্ত কিছু মুলতুবি করে দিবে। তবুও তরীর গায়ে ছিঁটেফোঁটা কষ্টের আঁচড় পড়তে দিবে না।
তরীর কপালে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে নির্ঝর শুয়ে পড়লো। বহু বছর আগে কিশোর বয়সে তরীকে দেখে সে বুঝতে পেরেছিল মেয়েটা বড্ড সহজ-সরল, হাসিখুশি আর কিছুটা বোকা! ওর রয়েছে সুন্দর একটা অবুঝ মন। সাথে এটা বুঝে গিয়েছিল যে প্রথম সাক্ষাতেই মানুষের মনে ছাপ ফেলার সুন্দর একটা গুণ রয়েছে তার। কিন্তু তরী শুধু তার মনে ছাপ ফেলে ক্ষান্ত হয়নি। তার সম্পূর্ণ মনের দখল নিয়েছে। সাথে তার অস্তিত্বেরও দখলদারিত্ব নিয়েছে।
নির্ঝর মুচকি হেসে তরীর আরো কাছ ঘেঁষে এলো। ফিসফিস করে বলল,
‘ভালোবাসি!’
_____________
তৃতীয় বারের মতো নিনাদের গুটি কেটে দিতে তার মুখ কালো হয়ে গেল। তিন তিনটে গুটি ঘরে। কোন দুঃখে আজ সে লুডু খেলতে বসেছিল? এইবার হারলে পরপর চার বার হেরে যাবে সে। শিট! আজ অবধি পরীক্ষায় চার সাবজেক্টে সে ফেইল করেনি। বড়জোর তিন সাবজেক্ট পর্যন্ত ফেইল করেছে। ঐ গণিত, বিজ্ঞান আর ধর্মে! ধর্ম সাবজেক্টে কেউ সচরাচর ফেইল করে না। কিন্তু সে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠার সময় ধর্মে ফেইল করলো। বড়ই অাচানক ঘটনা!
কপাল গুণে সে জেএসসি তে সবগুলো সাবজেক্টে টেনটুনে পাস করে গেছে। কিন্তু আজকের লুডু খেলায় টানার কোনো অপশন নেই যে টেনেটুনে জিতে যাবে। তার মুখ কালো হয়ে গেল। তবুও আশা নিয়ে বলল,
‘ভাবী আপনি চিটিং করছেন নাকি? আমার ছক্কা পড়ে না, কিন্তু আপনি ছক্কা ঠেলে সরাতে পারেন না। কারণ কি?’
তরী মুচকি হাসলো। ছোটবেলা থেকে লুডু খেলার এক প্রকার ওস্তাদ সে। কেউ তার সাথে লুডু খেলে জিতেছে তার সংখ্যা নগন্য বলা চলে। সে নিজের গুটি সরিয়ে বলল,
‘আমার সাথে জেতা খুব মুশকিল নিনাদ! তবে জেতার চেষ্টা করো! এবার হারলে কি করতে হবে মনে আছে?’
‘হুঁ মনে আছে। তিনটে প্যারাগ্রাফ এক বসায় মুখস্থ করতে হবে।’
‘বাহ! মনে আছে দেখছি।’
নিনাদের মনের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। আরো কয়েক দান খেলে যখন ছক্কার মুখ দেখলো না তখন আশা ছেড়ে দিল। ধরেই নিল তার তিনটে প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করতে হবে। কিন্তু সে প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করতে চাচ্ছে না।
তরীর একটা মাত্র গুটি আছে। তার চাল আসতে সে পাঁচ ঘর সরিয়ে গুটি পাকা করলো। তা দেখে নিনাদের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। সে চোখের পলকে সব গুটি এলোমেলো করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তরী রাগী চোখে তাকাতে সে বলল,
‘আমি মনোযোগ দিয়ে খেললে আপনার হার নিশ্চিত ভাবী। সেজন্য গুটি এলোমেলো করে দিলাম। আমি চাই না আপনি আমার কাছে হেরে যান!’
‘তুমি ইংরেজি প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করবে কি না বলো।’
এটা শুনেই অতিদ্রুত দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল নিনাদ। সে চলে যেতে তরী হেসে ফেলল। হাত পা ছড়িয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো বিছানায়। সালোয়ার উঁচু করে সে পায়ের ক্ষত স্থান টা পরখ করলো। সেলাই খোলা হয়েছে তিন-চার দিন হলো। ক্ষত শুকিয়ে গেছে প্রায়। পায়ের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে। তারপর বালিশের তলা থেকে ফোন বের করে সময় দেখলো। সাথে পরখ করলো নির্ঝর ফোন দিয়েছে কি না। দেয়নি!
তরী ফোনটা ছুঁড়ে সরিয়ে রাখলো। সপ্তাহ খানেক হয়েছে নির্ঝর তাকে আলাদা ফোন কিনে দিয়েছে। হঠাৎ করে বাহিরে বৃষ্টির ঝুমঝুমানি শব্দ কানে যেতে অবাক হলো। কখন মেঘ জমেছে, আবার কখন বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে তা খেয়াল করেনি। আবেগে আপ্লূত হয়ে সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেলকনিতে ঢুকলো সে। চারিদিকে ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দ গানের মতো বেজে চলেছে। ঝড়ো বাতাস নেই, নিরব বৃষ্টি। আবহাওয়া শীতল। তরী হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। নির্ঝর সকাল দশটার দিকে আজ বের হয়েছে। তার মাস্টার্সের কিছু কাগজে সাইন দরকার সেজন্য। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সন্ধ্যা হতে চলল। অথচ ফেরার নাম নেই। সেই দুপুরবেলা ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছিল। আর তার কিছুক্ষণ পর মেসেজ করে মেডিসিন ঠিক মতো খেতে বলেছিল। তারপর আর কথা হয়নি। কিন্তু এখনো ফিরছে না কেন?
‘তরী? কোথায় তুমি? এই তরী?’
আচমকা নির্ঝরের কন্ঠ কানে যেতে তরী চমকে উঠলো। সেই সঙ্গে ভালো লাগার সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র একটা স্রোত সমস্ত শরীর জুড়ে বয়ে গেল। সে যতদ্রুত সম্ভব বেলকনি থেকে রুমে ঢুকলো। দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,
‘আপনি এসেছেন?’
নির্ঝর ওয়াশরুমের পাশটায় ছিল। তরীর কন্ঠ পেয়ে পেছন ঘুরে তাকাল। তার শরীর অনেকটাই ভেজা। মাথার চুল বেশি জবজবে। কপালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে। চোখের পাপড়ি ভিজে ঘন হয়ে আছে। স্নিগ্ধ ঠোঁট যুগলে বিন্দু বিন্দু পানির টুকরো। পরণের ছাই রঙা চেক শার্টের বুকের কাছে অনেকখানি ভেজা। তরী চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘এত ভিজলেন কিভাবে? ‘
নির্ঝর কোনো প্রতিত্তর করলো না। শান্ত, অথচ ধীর পায়ে এগিয়ে এলো তরীর দিকে। কাছাকাছি এসে তরীকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুটা কুঁজো হয়ে তরীর কাঁধে মাথা রাখলো সে। শীতল এক স্পর্শে তরী কেঁপে উঠলো। ঠোঁট জোড়া কাঁপতে লাগলো। এলোমেলো সুরে বলল,
‘ভিজে যাব তো আমি।’
নির্ঝর এবারও কোনো কথা বলল না। আরো গভীর ভাবে তরীকে জড়িয়ে ধরলো। তরীর হাতদুটো আপনা-আপনি নির্ঝরের পিঠে চলে গেল। সে অতি সহজে নির্ঝরের মন পড়তে পারছে যেন। নরম গলায় বলল,
‘মন খারাপ? কিছু হয়েছে?’
নির্ঝর শীতল কন্ঠে বলল,
‘না!’
‘শুকনো কাপড় পড়ুন। ঠান্ডা লেগে যাবে।’
‘হুঁ!’
কিছুক্ষণ পর তরীর কাঁধ থেকে মাথা তুলে নির্ঝর মুখের দিকে তাকালো। মৃদু হেসে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। তরী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কামিজের কাঁধের কাছে অনেকটা ভিজে গেছে। মুচকি হেসে সে গলার স্বর উঁচু করে বলল,
‘তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসুন। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।’
বলে সে রুম থেকে বের হলো। ডাইনিং এ গিয়ে দেখলো টেবিলে খাবার বেড়ে রাখা। সব ঠিকঠাক দেখে তরী সরে গিয়ে সোফায় বসে পড়লো। ড্রয়িং রুম আপাতত ফাঁকা। সে সময় কাটানোর জন্য টিভি ছাড়লো।
মিনিট দশেক চ্যানেল পাল্টাতে থাকলো সে। আর বার বার রুমের দিকে উঁকিঝুঁকি মারলো। নির্ঝর এখনো বের হয়নি! এতক্ষণ লাগে ফ্রেশ হতে? অদ্ভুত মানুষ! চোখ মুখ কুঁচকে সে টিভির দিকে নজর দিল। টিভিতে খবর দেখাচ্ছে। তার চোখ আটকে গেল নিচের লেখাগুলোর দিকে। হাইলাইটসে দেখাচ্ছে একটা মেয়েকে গ্যাং রেপ করে মেরে ফেলা হয়েছে। পড়ে ভয়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল তার। কয়েক সেকেন্ড পরে টিভির দৃশ্য চেঞ্জ হয়ে একটা মেয়ের ছবি ভেসে উঠলো। মেয়েটার ছবি দেখে সে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো।
(চলবে…..)
ইদের আগে শেষ হবে না। শেষের দিকের পর্বগুলো সময় নিয়ে লিখতে হবে। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। 🤎