শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৪২
সকালে ঘুম ভাঙতেই বিন্দু দেখলো শিশির তখনও ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। বিন্দু শিশিরের কপালে আলতো করে চুমু খেল। শিশিরের ঘুমন্ত মুখটা অনেক প্রিয় বিন্দুর। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে বিন্দু খানিকটা সময় মুগ্ধ হয়ে শিশিরকে দেখে তারপর ফজরের নামাজ পড়তে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না বিন্দু আস্তে করে ঘুম থেকে উঠলো। কণাকে শিশিরের কাছে এনে শিশিরের একটা হাত কণার বুকের ওপার রাখলো। বাবা-মেয়ের এই সুন্দর দৃশ্য বিন্দুর ফোনে সেভ করে রাখার তীব্র লোভ জাগলো। দু’জনেরই ঘুমন্ত মুখটা দেখতে কী যে ভালো লাগছে বিন্দুর সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। বাবা-মেয়ের যেন একই প্রতিচ্ছবি। বিন্দু ফোনের ফ্লাশ না জ্বেলেই বেশ কয়েকটা ছবি ফোনের স্ক্রিনে ধারণ কারলো। বেশ সুন্দর হয়েছে ছবিগুলো। তারপর আবারও দু’জনের কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। তখনই পায়ে লাগলো ফোনের ব্যাক কভার। বিন্দু কিছুটা অবাক হয়ে ফোনের খন্ড গুলো তুলে নিলো। ভাগ্য ভালো ফোনটা ভাঙেনি তবে টাচটা ফেটে গেছে তবুও স্পষ্ট সব দেখা যাচ্ছে। বিন্দু ফোনটা অন করে ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখলো। পরক্ষণেই কী ভেবে যেন ফোনটা বন্ধ করে দিলো। আশ্চর্যজনকভাবে আজকে ল্যাপটপটাও শিশির বন্ধ করেনি। বিন্দু অবাক হয়ে শিশিরের মুখের দিকে তাকালো। গতকাল রাতে কী এমন হয়েছে যে সব এমন এলোমেলো? কিন্তু শিশিরের মুখের দিকে তাকালে মনেই হয় না কোনো কিছু হয়েছে। কী সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে। ল্যাপটপটা বন্ধ করে বিন্দু নামাজ পড়লো। মোনাজাতে শিশিরের জন্য প্রার্থনা করলো। যেন সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। কোনো বিপদ যেন শিশিরকে না ছোঁয়। নামাজ শেষ করেই সকালের এঁটো বাসন পত্র ধুয়ে সবার জন্য নাস্তা বানাতে লাগলো। পরোটা,ভাজি, ডিম ভাজা আর চা। এর মধ্যে রিদিও এসে হাতে হাতে বিন্দুকে সাহায্য করতে লাগলো। দুই ননদ-ভাবি মিলে সব নাস্তা তৈরী করে ফেললো। ইদানিং শিরিনা বেগমের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তাই শিশিরের মানা যেন উনি রান্নাঘরে ভুলেও পা রাখেন। এর মধ্যে একদিন শিরিনা বেগমকে রান্নাঘরে দেখেই শিশির হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে। সেই ভয়ে এখন ভুলেও উনি রান্নাঘরে আসেন না। ফজরের নামাজ পড়ে পাটিতে বসেই জিকির-আজকার করেন। বিন্দু টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রুমে আসলো শিশিরকে ডাকতে ততক্ষণে শিশির উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে লাগলো।
–ওহ আপনি উঠেও গেছেন?”
–হুম। কী আর করা স্কুল তো সকাল সাকল।”
বিন্দুর খুব খারাপ লাগছে। মানুষটা সারাটাদিন গাদার খাটুনি খাটে। বিন্দুকে বিষণ্ণ মনে দেখে শিশির কাছে টেনে নিলো। গালে চুমু খেয়ে বললো,
–এত আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তোমরাই আমার সুখ। তোমরা ভালো আছো মনে করো আমিও ভালো আছি।”
বিন্দু মৃদু হাসলো। শিশিরের শার্টের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বললো,
–ফোনটা এভাবে ফেলে রেখেছিলে কেন?”
–বাদ দাও তো এসব। চলো নাস্তা খাই।”
এর মধ্যেই কণা কেঁদে উঠলো।
–দেখেছেন আপনার মেয়ের কান্ডকারখানা? আমাকে একটু শান্তিমতো খেতেও দেবে না। আপনি যান আমি ওকে ফ্রেশ করিয়ে আসছি।”
শিশির চলে যেতেই বিন্দু পায়ের ওপর বালিশ রেখে কণাকে শুইয়ে দিলো ওর প্যামপাস চেঞ্জ করে দিয়ে নতুন একটা পরিয়ে দিলো। মুখটা পানি দিয়ে ধুয়ে স্নো গালিয়ে দিলো। কপালে একটা কালো টিপ দিয়ে তাতে একটু পাউডার লাগিয়ে দিলো। আর কণা চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো নড়াচড়া না করে হাত খেয়ে যাচ্ছে। শিশির রুমে ঢুকেই মেয়ের গালে চুমু দিলো সেই সাথে বিন্দুর গালেও। পরোটা ছিঁড়ে বিন্দুর মুখের সামনে এগিয়ে ধরলো।
–এখানে কেন আনতে গেলেন? আমি এখনই যেতাম৷ কণাকে সাজানোও হয়ে এসেছে।”
–তুমি না খেলে আমার মেয়েটাও ঠিক মতো খেতে পারবে না। তাই তোমার আগে খাওয়া দরকার৷ এখন আর কথা নয়। হা করো।”
বিন্দু হা করলো আর শিশির খাইয়ে দিলো। বেশ কয়েকবার বিন্দুকে খাইয়ে দিতেই কণা কেঁদে ফেললো৷ শিশির বিন্দুর হাতে পরোটার প্লেট দিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েকে আদর করতে করতে বললো,
–খুব খিদে পেয়েছে মেয়েটার। তাড়াতাড়ি খাও তো তুমি। ”
সহসাই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। বিন্দু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো শিশিরের দিকে। শিশিরের হাসি মাখা মুখটা হঠাৎ করেই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ততক্ষণে বিন্দুরও খাওয়া শেষ। বিন্দু প্লেটে হাত ধুতে ধুতে বললো,
–এত সকাল সকাল আবার কে আসলো?”
শিশির কণাকে বিন্দুর কোলে দিয়ে বললো,
–আমি দেখছি।”
শিশির রুম থেকে বেরুতে নিলেই বিন্দুর ফোনটা বেজে উঠলো। শিশির একরকম তাড়াহুড়ো করে এসেই বিন্দুর ফোনটা হাতে নিলো। ফোনের স্ক্রণে সুমির নামটা দেখেই কিছুটা আশ্বস্ত হলো শিশির। বিন্দুর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
–সুমি ফোন করেছে কথা বলো।”
বিন্দু ফোনটা হাতে নিতেই দ্রুত পায়ে শিশির রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শিহাবকে সামনের বারান্দায় সোফায় বসে থাকতে দেখেই ঘামতে শুরু করলো শিশির। দৌড়ে এসে বাহির থেকে রুমের দরজাটা লক করে দিলো। রিদিকেও বারণ করে দিলো যেন রুমের দরজা না খোলা হয়। রিদিকে পাল্টা কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দিলো না শিশির। সোফার পাশে দুইটা ক্রাচ। যেগুলোই এখন শিহাবের নিত্য সঙ্গী। এই দু’টো ক্রাচ ছাড়া এক কদম হাঁটারও শক্তি নেই ওর। শিশির এবার গিয়ে সামনে দাঁড়ালো শিহাবের। শিহাব উঠে দাঁড়িয়ে শিশিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। শিশিরও নিশ্চুপ কাঁদছে৷ আজ নিজের এই প্রাণ প্রিয় বন্ধুটাকেই জীবনের বড় শত্রু মনে হচ্ছে। সব কিছু তছনছ করে দেওয়ার জন্যই যেন শিহাব আবার ফিরে এসেছে। শিশির, শিহাবকে ধরে বসিয়ে দিলো। ভাগ্য আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে শিশিরকে সে নিজেও জানে না এর ভবিষ্যত কী! তবে বড়সড় একটা ঝড় যে তাকে মোকাবেলা করতে হবে এটা নিশ্চিত। এই ঝড়ে বিন্দু কী থাকবে ওর পাশে? বিন্দু না থাকলে যে এই আবহমান ঝড়ের কবলে পড়ে সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে শিশিরের। তার সাথে এই সাজানো-গোছানো সংসারটাও। বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলেও সেদিকে পাত্তা দিলো না শিশির। নিজের মধ্যে আড়াল করে নিলো।
–কেমন আছিস?”
–আর ভালো থাকা। এখন চল তাড়াতাড়ি। ”
–কোথায়? বিন্দুদের বাসায়।”
–এখনই?”
–হুঁ। আমি ওকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি।”
এর মধ্যেই শিরিনা বেগম সামনের বারান্দায় আসলেন। শিহাবকে দেখেই উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
–বাবা কেমন আছো তুমি?”
–আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনাদের দোয়ায়।”
শিশির ঘামছে, গলা শুকিয়ে আসছে৷ হাত-পা ঝিনঝিন করছে, মাথা ঘুরছে। রিদিও নাস্তার ট্রে নিয়ে সেখানে আসলো।
–ভাইয়া কেমন আছেন?”
শিহাব হালকা হেসে জবাব দিলো,
–এই তো ভালো। তুমি কেমন আছো? পড়ালেখা কেমন চলছে?”
–ভালো ভাইয়া। এখন একটু নাস্তা করে নিন।”
অল্প খানিকক্ষণ শিহাব শিশিরদের বাড়িতে বসলো। শিহাব তাড়া দেখিয়ে শিশিরকে বাড়ি থেকে বের করে আনলো। শিশির বাড়ি থেকে বের হয়েই রিদিকে ফোন করলো বিন্দুর রুমের দরজা খুলে দিতে। বিন্দু তখনও ফোনে কথা বলছিলো তাই বিষয়টা বুঝতে পারেনি তবে রিদি শিশিরের এমন কাজে অবাক না হয়ে পারলো না।
শিহাব শিশিরকে সব খুলে বললো। সব শুনে শিশিরের কিছুটা রাগও হলো শিহাবের প্রতি। শিহাব যদি চাইতো অনায়াসেই বিন্দুকে বিয়ে করে রেখে যেতে পারতো তাহলে আজ অন্তত এই দিনটা দেখতে হতো না। আর না বিন্দুকেও এত গ্লানি সহ্য করতে হতো। আগে হলেও শিশির নিজের কষ্ট গুলো বুকের মধ্যে চেপে রাখতে পারতো। প্রিয়জনকে কাছে না পেলেও তার সুখটা দেখেই ও খুশি থাকতো। কিন্তু এখন তো সেটা সম্ভব না। চাইলেও নিজের আত্মাকে অন্য কাউকে দেওয়া সম্ভব না। বিন্দু যে এখন শিশিরের আত্মার সাথে মিশে গেছে। যাকে ছাড়া একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারে না শিশির। তাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার মহৎ কাজটা আদৌ কী তার পক্ষে করা সম্ভব!
–শিহাব আজকে ওই বাড়িতে না গেলে হয় না?”
–না রে শিশির। কতদিন পর ওকে দেখবো ভাবতে পারছিস তুই। ওকে এক নজর দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে আছি। ”
শিশিরের খুব খারাপ লাগছে কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে শিশিরের পায়ের অবস্থা দেখেও খুব মায়া লাগছে। বাঁ-পায়ের হাঁটুর একটু নিচে থেকেই পা’টা কেটে ফেলা দেওয়া হয়েছে। চিরজীবনের জন্য খুঁত ধরে ফেলেছে ওকে৷ চাইলেও আর আগের মতো স্বাভাবিক জীবন পার করা সম্ভব না শিহাবের। খুব মায়াও লাগছে শিহাবের জন্য। আর যখন জানবে বিন্দু অন্য কারও, এই সত্যটা জানলে ঠিক কতই না কষ্ট পাবে ভেবেই শিশিরের আরও দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
–আসলে শিহাব আমার তো এখন স্কুল টাইম। এখন যাওয়া পসিবলও না। প্রিন্সিপাল স্যার খুব রাগী। যথা সময়ে ক্লাসে উপস্থিত না হলে অনেক কথা শুনান।”
–শিশির ভাই আমার, প্লিজ তুই স্যারের কাছ থেকে ছুটি নে আজ। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ওকে কখন দেখবো সেই আশায় আমার এখানে ফিরে আসা আমি আর একটা দিনও সহ্য করতে পারবো না।”
শিশির হুট করেই বলে ফেললো,
–বিন্দু ওদের বাড়িতে নেই!”
শিহাব অবাক হয়ে বললো,
–তাহলে ও কোথায়?”
–শ্বশুরবাড়ি!”
স্যরি এতটা লেট করার জন্য 😣
চলবে,,,,,,,