শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৩৮
বাচ্চাটার নাম রাখা নিয়ে রিদি, বিধু, বিন্দু, সাজেদা বেগম আর শিরিনা বেগম সবাই আলোচনায় বসেছে। রাত দশটা বাজছে শিশিরও স্কুল থেকে চলে এসেছে। যদিও আকিকা করে হুজুরের দেওয়া নামও থাকবে তবুও সবাই একটা ডাক নাম রাখতে চায়৷
কিন্তু এত এত নাম বলা শেষ তবুও কোনো নামই পছন্দ হচ্ছে না কারও। হুট করেই রিদি বলে উঠলো,
–ভাবির তো আসল নাম মুনতাহা৷ বাবুর নাম সিন্থিয়া হলে কেমন হয়?”
–উমমম! সিন্থিয়া ডাক নাম কেমন যেন লাগে৷ আরও ছোট হলে ভালো হয়৷ আচ্ছা নীহার হলে কেমন হয়? শিশির ভাইয়ার নামের প্রতিশব্দ হলো নীহার!”
রিদি জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো,
–ওয়াও সুন্দর নাম! এটা রাখাই যায়।”
বাবুটা বিন্দুর কোলেই হাত-পা নেড়ে খেলছিলো। শিশির এক ঝটকায় মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। মেয়ের গালে চুমু খেতে খেতে বললো,
–কোনো নাম রাখা হবে না৷ আমি ওর নাম রেখে ফেলেছি!”
সবাই উৎসাহ নিয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে। রিদি চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
–ভাইয়া তাড়াতাড়ি বল শুনি।”
শিশির মেয়ের কপালে চুমু এঁকে বললো,
–কণা! শিশিরের বিন্দু কণা!”
খানিকটা সময় উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে গেল। বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়ে রিদি উত্তেজিত হয়ে বললো,
–কণা! রিয়েলি অসাধারণ একটা নাম। শিশিরের বিন্দু কণা! যেন এক সুতোয় বাঁধা তিনটা প্রাণ!”
শিশিরের চোখে-মুখে উত্তাল সুখের ঢেউ বইছে। যেন পৃথিবীতে সেই একমাত্র সুখী একজন বাবা। মেয়েকে একদম বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে রেখেছে যেন কোনো বিপদ-আপদ তাকে না ছুঁতে পারে। বিন্দু নাম শুনেই থ হয়ে বসে রইলো। না চাইতেও সেদিনের বলা শিহাবের কথাটা কানে বাজতে লাগলো বারংবার। শিহাব সেদিন বিন্দুর পুরো নামটা শুনেই বলেছিলো,
“ওয়াও নাইস নেইম! শিশিরের বিন্দু কণা!”
আর খুব স্বাভাবিকভাবেই সেদিন শিশির বিষম খেয়েছিলো। তবে কী বিধাতার এটাই ইচ্ছে ছিলো? তিনি নিজে শিশিরের বিন্দু কণাকে এক সুতোয় বাঁধবেন! দমটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এই অতীত কী কখনো ছাড়বে না তাকে? যত বারই শিহাবকে মনে পরে তত বারই নিজের সবকিছু এলোমেলো লাগে। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসে, দম যেন বন্ধ হয়ে আসে, ভেতরে কেমন যেন অসহ্য ব্যথা হয়,বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ করে। এত ভালোলাগার মুহূর্তে মনটাই বিষাদ হয়ে গেল বিন্দুর। ভেতরের চাপা দীর্ঘশ্বাস বুক চিঁড়ে নিঃশ্বাসের শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসলো। সব কিছু যেন খুব অসহ্য লাগছিলো। বিন্দু শিরিনা বেগমের রুম ছেড়ে নিজের রুমে চলে আসলো। আলোচনা মূলত শিরিনা বেগমের রুমেই হচ্ছিলো। শিশির কিছু একটা বুঝতে পেরেই বিধুর কোলে বাবুকে দিয়ে শার্ট-প্যান্ট পাল্টানোর অজুহাতে নিজের রুমে আসলো। বিন্দু ব্যালকনিতে দোলনায় বসে আছে। শিশির এসে পাশে বসলো। জ্যোৎস্নার মৃদু আলোয় বিন্দুর মুখের ফ্যাকাশে ভাব স্পষ্ট ধরা পড়লো শিশিরের চোখে। শিশির স্নিগ্ধ গলায় ডাকলো,
–বিন্দু? ”
–হুম?”
–মন খারাপ?”
–নাহ্!”
বিন্দুর নাহ্ বলাটা যেন শিশিরের বুকে অশনিসংকেত হয়ে বিঁধলো। গলার স্বর মিহি করে বললো,
–প্লিজ বিন্দু এভাবে মন খারাপ করো না। তোমাকে এমন ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে একদম মানায় না! ”
বিন্দু ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। গলার স্বর অস্বাভাবিক করে বললো,
–কণা নামটা না রাখলেই কী নয়?”
শিশির অবাক হয়ে বললো,
–কেন?”
–আমি আমার অতীত ভুলতে চাই। অতীতকে মনে রেখে কষ্ট পেতে চাই না। তবুও দেখুন ঘুরেফিরে সেই অতীতগুলোই আমার সামনে আসছে আর ভেতরটাকে ভেঙে-চূরে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। খুব কষ্ট হয় আমার। সহ্য করতে পারি না। জীবনটা এত কঠিন কেন বলুন তো? অতীত কেন পিছু ছাড়ে না? কেন এত এত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। কেন একটুও ভালো থাকতে দেয় না। দেখুন একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে কত স্বচ্ছ তার বুকে ফুটে উঠেছে এক ফালি রুপালী চাঁদ। আকাশের সাথে চাঁদের কত খুনসুটি। একটুও দুঃখ নেই আকাশের আর চাঁদের। কিন্তু মানব জীবনটাই কেন এমন হয়? কেন আকাশের মতো স্বচ্ছ হয় না। কেন এত জটিলতাপূর্ণ হয় এই মানব জীবন? বাবুটাকে আনতে গিয়েও কত কিছু সহ্য করতে হয়েছে। মা চেয়েছিলো ওকে নষ্ট করে ফেলতে কিন্তু আমি পারিনি। কী করে পারতাম বলুন ও তো আমার শরীরেরই একটা অংশ। মা হয়ে কী করে এতটা নিষ্ঠুর হতাম আমি। ভেবেছিলাম ওর মুখের দিকে তাকালেই বুঝি সব কষ্ট ভুলে থাকতে পারবো। কিন্তু কী ভাগ্য আমার ওকে দেখেই আমার অতীতগুলোর কথা আরও বেশি মনে পড়ছে। না চাইতেও শিহাব আমার মনে এসে বাসা বাঁধছে। কিন্তু আমি তো সব কিছু ভুলতে চাই। একটা স্বাভাবিক জীবন লিড করতে চাই। কেন পারি না আমি?”
কথাগুলো বলতে বলতে বিন্দু কেঁদে ফেললো। শিশির বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। বিন্দু আরও শব্দ করে কেঁদে ফেললো।
–প্লিজ বিন্দু এই যে বর্তমানটা আছে সেটাকে মনে কর। এই যে তোমার মেয়ে আছে তোমার পাশে আমরা সবাই আছি। এই সুখের মুহূর্তগুলোর কথা ভাবো তাহলে আর অতীতের কথা মনে পরবে না। অতীতের কথা ভেবে হতাশাগ্রস্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই পাবে না তুমি তার চেয়ে বরং বর্তমানের এই সময়টাকে নিয়ে ভাবো। তাহলে দেখবে কত ভালো লাগে।”
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে শিশিরের বুকের মাঝে চুপ করে রইলো বিন্দু। তারপর মৃদু গলায় বললো
–আমি একটা জিনিস চাই। দেবেন আমায়? ”
–বল কী চাও তুমি?”
বিন্দু শিশিরের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
–যখন সময় হবে তখন ঠিক চেয়ে নেব।”
–আচ্ছা।”
অনেকগুলো দিন বেশ ভালোভাবেই কেটে যায় সবার নতুন অতিথিকে নিয়ে। আকিকা শেষে বাবুর নাম রাখা হয় মেহেরিমা। এটা রাখা হয় আসল নাম আর ডাক নাম কণা। এর মধ্যে রিদিরও ডিভোর্স হয়ে যায়। একদম স্বেচ্ছায় রিদি সোহেলকে ডিভোর্স দেয়। এ নিয়ে রিদির কোনো অনুশোচনা নেই। কারণ সোহেল এমনই একজন যার জন্য কোনো অনুশোচনা কাজ করে না বরং ঘেন্না হয়।
শিরিনা বেগম আর রিদি দু’জনেই রিদির মামা বাড়ি। দশদিন আগে রিদির নানু পরলোক গমণ করেন। সেই থেকেই মনটা ভালো নেই শিরিনা বেগমের। বোনেরাও সব এসেছে ওনাদের মায়ের মৃত্যুতে তাই শিরিনা বেগমও আর বাড়ি ফেরেননি। আর রিদির মনটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এই অল্প বয়সেই বিয়ে তারপর ডিভোর্স সব মিলিয়ে মনটা খুব একটা ভালো নেই ওর। সবার সামনে হাসিহাসি ভাব ধরে থাকলেও মনের ভেতর কী চলছে সেটা কারওই বুঝতে অসুবিধা হলো না। তাই শিশির ইচ্ছে করেই শিরিনা বেগমের সাথে রিদিকে মামা বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। সবার মাঝে যদি মনটা একটু হলেও ভালো থাকে। এদিকে বিন্দুর বাবুকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই শিশিরও সকাল সকাল উঠে বিন্দুর কিছু কাজ এগিয়ে রাখে। এখন অনেকটাই ভালো রান্না করতে পারে বিন্দু আগের মতো ভুলত্রুটি হয় না।
বিন্দু কণাকে ঘুমের মধ্যে সাজাচ্ছিলো আর মিটিমিটি হাসছিলো। সারাক্ষণ মেয়েকে নিয়ে খুনসুঁটিতে মেতে থাকে বিন্দু। তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। বিন্দু উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই শিশির ঘরে ঢুকলো। হাতে শিশিরের একটা শপিং ব্যাগ। শিশির সোজা এসে রুমে ঢুকলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে শার্ট-প্যান্ট পাল্টে লুঙ্গি আর টি-শার্ট পরে নিলো। এরপর শপিংটা এনে বিন্দুর হাতে দিয়ে বললো,
–তোমার এই গরীব হাজবেন্ডের পক্ষ থেকে তোমাকে এই ছোট্ট উপহার।”
বিন্দু হেসে শপিং ব্যাগটা হাতে নিলো। ব্যাগ থেকে বের করলো একটা সুন্দর শাড়ি। কাঁচা হলুদ জামিনে কালো পাড়। আর জামিনের ভেতর কালো সুতোর ভেতর পাথরের কাজ।
বিন্দু নেড়েচেড়ে শাড়িটা দেখছিলো। শিশির পাশেই বসে ছিলো। বিন্দুকে কিছু না বলতে দেখে নিজেই বললো,
–ভালো লাগেনি তাই না?”
–অনেক ভালো লেগেছে। কিন্তু কিসের উপহার এটা?”
শিশির পাশে ঘুমন্ত কণার কপালে চুমু এঁকে বললো,
–এই পরীটাকে উপহার দেওয়ার জন্য এইটুকুনি সামান্য উপহার। চেয়েছিলাম অন্য কিছু দেব। কিন্তু হাত একদম খালি।”
বিন্দু মুগ্ধ হয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ গলায় বললো,
–উপহার তো আপনাকে দেওয়া উচিত আমার কারণ আপনিই তো আমাকে উপহারটা দিলেন”
কথাটা শুনেই শিশির ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বিন্দুর দিকে তাকালো। বিন্দুর কথার মানে খোঁজার বৃথা চেষ্টা চালালো কিন্তু বিন্দুর চোখের চাহনি একদম শীতল। কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। শিশির কোনরকম ঢোক চেপে বললো,
–আমি উপহার দিয়েছি মা…মানে?”
বিন্দু রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো,
–অত মানে খুঁজতে হবে না। শাড়িটা আমার ভিষণ ভালো লেগেছে। আমার স্বামীর রোজগারের টাকায় আমার জন্য যা নিয়ে আসবে তাই আমার জন্য অনেক দামী হোক সেটার মূল্য এক টাকা। কিন্তু এই জিনিসগুলোতে তো মিশে থাকে অনেক ভালোবাসা, শরীরের ঘাম, সম্মান, আরও কত কিছু।”
শিশির কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট ব্যাগ এনে বিন্দুর হাতে দিলো। বিন্দু ব্যাগটার উপরে দেখলো “বিসমিল্লাহ গোল্ড হাউজ “লেখা আছে।
–কী এতে?”
–খুলেই দেখো না।”
বিন্দু খুলতেই দেখলো একজোড়া বাচ্চাদের রুপোর চুড়ি। লাইটের আলোয় কেমন চকচক করছে।
–কণার জন্য? ”
শিশির মাথা ঝাঁকালো।
–আপনিই ওকে পরিয়ে দিন।”
শিশির কণার দুই হাতে চুড়িগুলো পরিয়ে দিলো। কণার মোটামুটি একটু স্বাস্থ্য হয়েছে। ফর্সা হাতে চুড়িগুলো বেশ মানিয়েছে। শিশির মাশআল্লাহ বলেই মেয়ের হাতে চুমু খেলো। আর বিন্দু শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাবা-মেয়ের মধুর দৃশ্য চোখে ধারণ করলো!
গল্পটা যত ছোট করতে চাইছি ততই বড় হয়ে যাচ্ছে😞। কবে যে শেষ হবে….
চলবে,,,,,,,