শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৪০
গোধূলী আলোয় আকাশটাকে দেখতে বেশ লাগছে বিন্দুর। কেমন যেন পুরো আকাশ নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। যেন বিন্দুর সাথে আকাশটা স্বেচ্ছায় খুনসুটি করতে চাইছে। বিন্দুরও বেশ ভালো লাগছে বিষয়টা। নির্বিকার তাকিয়ে রইলো আকাশ পানে। এত ভালো লাগে এই নীল বর্ণের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাহিরে হাত বাড়ালো বিন্দু। একটুখানি আকাশ ছোঁয়ার বৃথা চেষ্টা। কিন্তু ভালো লাগাটা অনেক প্রশান্তির। চারদিকে ক্রমশ আধার ঘনিয়ে এলো। আকাশের বুকে ফুটে উঠলো একটা গোলাকার পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদটা একদম পূর্ণ। আর পূর্ণিমার চাঁদই তো নাকি পূর্ণ হয়৷ কত নিখুঁত বিধাতার সৃষ্টি। চাঁদের চারপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রুপালী তারায় পুরো আকাশ যেন নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রাতের আকাশে একটা চাঁদ আর অসংখ্য তারার খুনসুটি দেখতে। যেন ঈশারায় চাঁদ আর তারা তাদের মনের অনুভূতিগুলো একে -অপরকে জানান দিচ্ছে। সহসাই ফোনের রিংটোন বাজলো। বিন্দু একটু বিরক্তই হলো। এই সুন্দর মুহূর্তটা মিস করতে কেন যেন মন টানছে না। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো শিশিরের ফোন। গভীর ভালোলাগায় চোখে-মুখে হাসি ফুটে উঠলো বিন্দুর। ফোন রিসভ করতেই ওপাশ থেকে শিশিরের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট কানে ভেসে আসলো।
–কী করছো? ”
–দেখছি! ”
–কী!”
–প্রেম?”
–তা কার প্রেম দেখছো শুনতে পারি?”
–অবশ্যই। চাঁদ আর আকাশের!”
–ইশ আমি পারলে এক্ষুণি চলে আসতাম আর দু’জনে মিলে প্রেম করতাম। কিন্তু কী আর করা!”
–জানেন?”
–কী?”
–আমার না একটা কঠিন অসুখ করেছে।”
–কী সেই কঠিন অসুখ?”
–সারাক্ষণই কণার বাবাকে মিস করি। তার কাছে কাছে একদম গা ঘেঁষে থাকতে ইচ্ছে করে।”
–তাই বুঝি?”
–হুঁ!”
–আর কিছু ইচ্ছে করে না?”
–হুম, করে তো। সারাক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তার চোখে কত শত মায়া। সেই মায়ার প্রেমেই তো হাবুডুবু খাচ্ছি। যখনই কণার বাবা দূরে যায়। বুকের ভেতর কেমন অস্থির অস্থির করে। মনে হয় কী যেন হারিয়ে ফেলেছি। খুব ভালোবাসি কণার বাবাকে। কিন্তু উনি যেন কিছুই বোঝেন না।”
–হুম খুব বোকা কণার বাবা। তার মাকে একটুও বুঝতে চায় না। তবে কণার মা কী এটা জানে? কণার বাবা কিন্তু কণার মাকে ভিষণ ভালোবাসে। ঠিক কতটা ভালোবাসে সেটা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। ভালোবাসা তো আর কোনো বস্তু না যে তাকে পরিমাপ করা যাবে! এটা হলো একটা সুন্দর অনুভূতি যাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। তবে এইটুকু বলতে পারি কণার মায়ের জন্য কণার বাবা নিজের জীবনও বাজি রাখতে পারবে!”
বিন্দু মুগ্ধ হয়ে শিশিরের কথা শুনছে। সেই সাথে প্রশস্ত একটা হাসির রেখা ঠোঁটের কোণে এঁকে রেখেছে। শিশির বিন্দুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললো,
–তা কণার মায়ের মনটা কি খুব খারাপ?”
–উঁহু।এখন ঠিক আছে।”
–যাক শুনে ভালো লাগলো। তা আমার মা কোথায়?”
–ওর ফুপির কাছে।”
–বউ!”
বউ ডাকটা শুনেই অদ্ভুত ভালো লাগলো বিন্দুর। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
–এই বউ কথা বলছো না কেন?”
–আমি তো কণার বাবার বউ আপনার বউ হতে যাব কোন দুঃখে?”
শিশির বেশ শব্দ করে হাসলো বিন্দুও হাসছে।
–বউ একটু তোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে চাই। ফোনটা চুলের ভাঁজে রাখো তো!”
–উফ কী অদ্ভুত কথাবার্তা। ফোন দিয়ে কিভাবে কেউ ঘ্রাণ নেয়?”
–আরেহ ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।”
–ওকে রাখলাম।”
বিন্দু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনটা চুলের ওপর রাখলো। সহসাই টের পেল কেউ একজন ওর চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়েছে। বিন্দু হকচকিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলো শিশির দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে দুষ্টুমির হাসি। বিন্দু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। নাক ফুলিয়ে বললো,
–আপনি এখন?”
শিশির বিন্দুর কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে আনলো। আলতো করে নাকে চুমু দিয়ে বললো,
–তোমার তো নাকি সারাক্ষণ কণার বাবার গা ঘেঁষে থাকতে ইচ্ছে করে। তাই চলে এলাম।”
বিন্দু শিশিরের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
–তা বেশ তো ভালোই হয়েছে। দু’জনে মিলে একটু প্রেম করা যাবে।”
কথাটা বলেই বিন্দু চোখ মারলো শিশিরকে। তখনই রিদি কণাকে নিয়ে রুমে ঢুকলো। বিন্দু তাড়াতাড়ি দূরে সরে গেল।
–দেখি আমার পিচ্চি মাকে আমার কোলে দে তো।”
–এই নাও। আর থাকতে চাইছে না আমার কাছে মনে হয় খুব ক্ষুধা লাগছে।”
শিশির মেয়েকে কোলে নিতে নিতে বললো,
–বোস আমার পাশে।”
রিদি ভাইয়ের পাশে বসলো। কণা শিশিরের কোলে দু’হাত মুঠো করে সমানে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে৷ আর বিন্দু গেল চা করতে।
–সামনেই তো ফাইনাল এক্সাম পড়াশোনা করিস তো ঠিক মতো?”
–এই একটু একটু।”
রিদির কথাটা বড্ড ফ্যাকাসে শোনালো। শিশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
–হয়তো আমার ওপর তোর খুব অভিমান হতে পারে কিন্তু কী জানিস তো তোকে আমি বড্ড ভালোবাসি। আর তোর সাথে যেটা হয়েছে হয়তো বলতে পারিস আমার ইচ্ছায় হয়েছে। কিন্তু কী বলতো, আমার এই ইচ্ছা হওয়ার কারণ একটাই কারণ আমার বোনটার জীবনটা তছনছ হয়ে যাক আমি এটা কখনোই চাই না। সব জেনে-বুঝে সোহেলের হাতে তোকে দেওয়াটা কখনোই আমি ঠিক মনে করিনি। দেখিস আল্লাহ তোর জন্য অবশ্যই ভালো কিছু রাখবে৷ আমরা অনেক সময় বলি চেষ্টা করলেই সফল হওয়া যায়। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানিস, মনে হয় ভাগ্য বলেও কিছু একটা আছে। নয়তো দেখ কত যাচাই-বাছাই করলাম৷ আর সকলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবাই সোহেলের নামে এত এত ভালো কথা বলেছে তার কারণেই বিয়েটা হয়েছে। কিন্তু দেখ সেই সোহেলের আসল রুপটা বেরিয়েই আসলো। আর ভাবতে পারিস এই যে কণা আমাদের মাঝে আছে, খেলছে, হাসছে সেদিন যদি আর একটু দেরি হতো হয়তো আমরা বিন্দুকেই পেতাম না। সোহেলকে শাস্তি দেওয়াটা রিতিমতো ফরজ হয়ে গেছে। ও তো মূলত বিন্দুকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। ভাগ্য ভালো এমন কিছুই হয়নি। সবই আল্লাহর দোয়ায়।”
রিদি একটা চাপা কষ্ট ভেতরে লুকিয়ে বললো,
–ভাইয়া সত্যিই আমার তোদের ওপর কোনো রাগ, ক্ষোভ বা অভিমান নেই৷ সবই আমার ভাগ্য। এমন হওয়ার ছিলো তাই হয়েছে। তবে খারাপ লাগে এটা ভেবে ভাগ্যটা এত খারাপ না হলেই পারতো।”
কথাটা বলতে বলতেই রিদি কেঁদে ফেললো। শিশির বোনের মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে ধরা ধরা গলায় বললো,
–খুব কাঁদতে ইচ্ছে করলে এই কাঁধটা তো সবসময় আছে৷ এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদবি দেখবি খুব হাল্কা লাগবে। তবে হ্যাঁ বেশি কাঁদা যাবে না। বেশি কাঁদলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অল্প কাঁদলে মাঝে মাঝে মন হালকা হয়।”
রিদির বেশ ভালো লাগছে ভেবে এমন একটা ভাই বোধহয় অনেক পূণ্য করলেই পাওয়া যায়। রিদির চোখের এক ফোঁটা পানি কণার মাথায় গিয়ে পড়লো। কণা হাত খাওয়া রেখে উপরের দিকে মাথা তুলো তাকালো। রিদির চুলগুলো সামনে ঝুলছে। হুট করেই কণা ওর ছোট্ট ছোট্ট হাতে রিদির এক গোছা চুল টেনে ধরলো। রিদি কান্নার নাঝেই হেসে ফেললো৷ শিশিরও হাসছে। রিদি কণাকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিতে দিতে বললো,
–আম্মা কাঁদছে তাই বুঝি এভাবে শাসন করা হচ্ছে? পাকা বুড়ি একটা!”
চলবে,,,,,,,