শ্রেয়সী
লেখাঃKhayrun Nessa Ripa
পর্বঃ২৮
দুপুরে ভাত ঘুম দিয়ে উঠলো বিন্দু। পাশ ফিরেই দেখে শিশির নেই। আজ আবার শুক্রবার। স্কুলেও তো যাওয়ার কথা না। তাহলে গেল কোথায়? আজ সতেরো-আঠারো দিন হয়ে গেছে অপারেশনের। এখন অনেকটাই সুস্থ অনুভব করছে বিন্দু। সেলাইর জায়গাটাও অনেকটা শুকিয়ে গেছে। তবুও শিশির বেশি নড়াচড়া করতে দেয় না। বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুম থেকে ওযু করে এসে আসরের নামাজ পড়তে বসে মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়লো। জীবনে যে পাপ করেছে সে তার ক্ষমা শুধুমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয়। দোটানায় ভুগছে বিন্দু একদিকে নিজের ভালোবাসা অন্যদিকে তার স্বামী। যেই মানুষটার প্রতি দিন দিন শ্রদ্ধা-ভক্তি বেড়েই চলেছে বিন্দুর। হসপিটালে যে কয়দিন ছিলো শিশির সারাক্ষণ জান-প্রাণ দিয়ে সেবা করে গেছে। স্বামী নামক এই মানুষটাকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। এতটাও ভালো মানুষ হয় পৃথিবীতে! সব জেনেশুনেও কী করে এতটা নিঃস্বার্থভাবে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে সাপোর্ট করতে পারে? বিন্দু এখন চাইলেও শিশিরের ওপর রাগ করতে পারে না। কেন পারে না তা বড্ড অজানা বিন্দুর। যখনই শিশির কোনো পাগলামী শুরু করে তখন বিন্দু কিছু বলতে গেলেই মনে হয় অজানা কোনো শক্তি তার মুখ চেপে ধরে রেখেছে হাজার চেষ্টা করলেও তখন একটা কথা মুখ থেকে বের হয় না। কেন যেন আজকাল শিশিরের এই দুষ্টু-মিষ্টি আদরগুলো খুব ভালো লাগে। মন চায় শিশিরের সাথে সহজভাবে মিশতে। তখনই শিহাবের ভালোবাসা পিছু টেনে ধরে বিন্দুকে। তখন চাইলেও বিন্দু কিছু করতে পারে না। মাঝে মাঝে অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা কাজ করে বিন্দুর। এখন প্রায়ই বিন্দু লুকিয়ে লুকিয়ে শিশিরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। তখন ভেতরে এক প্রগাঢ় ভালো লাগায় হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কারণ শিশির এমনই একজন যাকে ভালো না লাগার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না বিন্দু। হসপিটালে বিন্দুর যাবতীয় কাজগুলো শিশিরই করতো। সেই থেকে শিশিরের প্রতি সম্মানটাও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কী না পেয়েছে বিন্দু শিশিরের থেকে! নিজের স্ত্রীর সম্মানটাও কত সহজেই দিয়ে দিলো। আর শিশিরের এই বিষয়গুলো খুব করে টানে বিন্দুকে। বিন্দু মাদুর থেকে উঠতেই ফোনে কল আসলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখে বিধুর কল। বিন্দুর পুরনো ফোনটা বিন্দু বিধুকে দিয়ে দিছে কারণ শিশির নতুন একটা ফোন বিন্দুকে কিনে দিছে।
–কিরে কেমন আছিস?”
–ভালো। তুই?”
–এই তো ভালোই। মা-বাবা কেমন আছে?”
–দু’জনেই ভালো আছেন। ভাইয়া কেমন আছে?”
–ভালো। ”
–ভাইয়াকে একটু দে কথা বলি।”
–ওনাকে দেখছি না। মনে হয় বাহিরে বের হয়েছে।”
–ওহ্। আপু একটা কথা বলার ছিলো।”
–বল?”
–আপু আমি তোর অনেক ছোট আমার অবশ্য তোকে এসব বলা সাজে না। তবুও বলছি উপদেশ হিসেবে কথাগুলো নিস না।”
–হুঁ।”
–আপু তুই শিশির ভাইয়াকে আর ঠাকাইস না। ভাইয়ার কী দোষ, বল? তোকে বিয়ে করেছে এটাই কী ভাইয়ার দোষ?”
–উনি তোকে কিছু বলছে?”
–নাহ্। আমি তো সবই দেখি। ভাইয়া কিছু বললে তুই কিভাবে ভাইয়াকে ইগনোর করিস। সবই আমার চোখে পরে।”
–বিধু একটা সত্যি কথা বলবি?”
–কী?”
–তুই কি ওনাকে ভালোবাসিস?”
বিন্দু একরকম উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বললো,
–আপু! ছিঃ কী বলছিস এসব? ভাইয়া একদিন কী বলেছে আমাকে জানিস? ”
–কী?”
–বলেছে বিধু তুমি আমার ছোট বোন রিদির মতো। ওকে ঠিক যে চোখে দেখি তোমাকেও ঠিক সেইভাবে দেখি কখনো আমার এই ভালোবাসাটার অন্যমানে খুঁজো না।”
–হঠাৎ এই কথা কেন বলেছিলো? নিশ্চয়ই তুই ওনাকে ভালোবাসিস ওইরকম কিছু বলেছিস!”
–নাহ্! একদিন ভাইয়ার সাথে স্কুল থেকে আসার পথে একজন বাজে মন্তব্য করেছিলো আমাকে আর ভাইয়াকে নিয়ে তখন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম আর তখনই ভাইয়া কথাগুলো বলে। সেদিনই বুঝেছি আমি একজন ভাই পেয়েছি আর সেই থেকেই আমার শিশির ভাইয়াকে খুব ভালো লাগে আর আমিও মরিয়া হয়ে উঠি ওনাকে আমার দুলাভাই বানিয়ে পার্মানেন্ট ভাই করার জন্য। আর সেই জন্যই সেদিন জোর করে ভাইয়াকে আমাদের বাসায় ইংরেজি গ্রামার শেখানোর নাম করে আমাদের বাসায় আসতে বলেছি।”
–ওহ্।”
–শোন আপু ভাইয়ার মতো এমন একজন মানুষকে প্লিজ আর কষ্ট দিস না। যে যাওয়ার সে চলে গেছে। আর ভুলে যাস না তোদের আগের সম্পর্কটা কিন্তু অবৈধ ছিল। একটা অবৈধ সম্পর্কের জন্য বৈধ সম্পর্ককে ভাঙলো আল্লাহ কিন্তু সহ্য করবেন না।”
বিন্দুর দম আটকে আসছে। সে নিজেও নিজের এই পাপ সম্পর্কে অবগত। কেন যেন আজকাল সেই ঘনিষ্ট মুহূর্তগুলোও মনে করতে চায় না বিন্দু। যখনই সেই মুহূর্তগুলো মনে পরে তখনই ইচ্ছে করে নিজেকে শেষ করে দিতে। নিজেকে খুব পাপী মনে হয়। আর এই জন্যই আরও বেশি নিজেকে শিশিরের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। নিজের এই পাপ মোচন কিভাবে করবে জানা নেই বিন্দুর। নিজের মধ্যে সবসময় একটা পাপবোধ কাজ করে। কিন্তু এটাই বুঝতে পারছে না বিন্দু সে একটা পাপের অনুশোচনা করতে গিয়ে আরও অনেকগুলো পাপে জড়িয়ে পরছে। কারো মন ভাঙাও যে একটা পাপ!
বিধুর ডাকে গভীর কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসলো বিন্দু।
–হুঁ।”
–বিধু বিশ্বাস কর যদি পারতাম নিজের এই পাপী শরীরটাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে নিতাম। কিন্তু আমি অসহায়! পারছি না। নিজের এই পাপ নিয়েও শিশিরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারছি না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।”
–সমর্পণ ভাবছিস কেন? একটু ভালোবাসতে পারিস না। শুধু কী শরীর দিয়ে ভালোবাসা হয়? তোর কী মনে হয় শিশির ভাইয়া তোর শরীর পাওয়ার জন্য তোকে বিয়ে করেছিলো? কেন সহজ বিষয়টাকে জলিট করে দিচ্ছিস? কেন বুঝতে পারছিস না শিশির ভাইয়া তোকে ভালোবাসে?”
–কই উনি তো কখনো আমাকে বলেনি উনি আমাকে ভালোবাসে!”
–গাধী হয়ে গেছিস তুই। সারাক্ষণ তোর অতীত নিয়ে চিন্তা করতে করতে তোর মাথা গেছে। শিশির ভাইয়াকে কেন বলতে হবে? উনি তোকে ভালোবাসে! তুই কী কিছুই বুঝিস না?”
–না বললে কিভাবে বুঝবো। সেই বোঝার মতো মনটাই যে নেই।”
–একজনকে ভালোবেসেই বোধহয় তোর জীবনের শেষ! ”
বিন্দু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো,
–সত্যিই তো বিধু কী আছে আমার! যা ওনাকে দেওয়ার মতো? আছে একটা পুরনো মন আর অন্য কারো ইউজ করা একটা শরীর!”
কথাগুলো বলতে গিয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ঝড়ে পড়লো বিন্দুর চোখের কোণ বেয়ে যেটা বিধু বুঝতে পরলো না।
–সারাক্ষণ তোর এসব ফালতু কথা শুনতে ভালো লাগে না। ভালোবাসা মানেই যে শরীর কেন বারবার এটা ভাবছিস। মন কখনো পুরনো হয় না। এটা বৃদ্ধকাল অব্দিও সম্পূর্ণ সতেজ থাকে৷ একটু ভাইয়াকে বোঝার চেষ্টা কর, ওনার মনটা বোঝার চেষ্টা কর। দেখবি তুই কখনো অসুখী হবি না।ভাইয়া তোর পয়াের কাছে সব সুখ এনে রাখবে। আমার কথাগুলো তোর কাছে অসহ্য লাগলেও এটাই সত্যি! ”
এভাবে অনেকক্ষণ দুই বোন মিলে অনেক কথা বার্তা বললো তারপর বিন্দু ফোন কেটে এগুলো রুমের বাহিরে। এ ঘর- ওঘর শাশুড়ি আর ননদকে খোঁজার পর শিশিরকে ডাকতে লাগলো।
–শিশির ভাইয়া, শিশির ভাইয়া কোথায় আপনি?”
তখনই শিশির খালি গায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। বুক ভর্তি কালো লোমে আবৃত্ত। লোমগুলো ঘামে ভিজে গিয়ে পুরো বুক জুরে লেপ্টে আছে। কপালেও ঘামের বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টির জলের আকার ধারণ করে আছে। বিন্দু কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে থাকলো পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললো,
–আপনার এই অবস্থা কেন?”
–আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। এতক্ষণ কী বলে ডাকছিলে আমাকে? ”
বিন্দু এক পলক শিশিরের দিকে তাকালো। শিশির শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিন্দুর দিকে। বিন্দু ওড়নায় হাত প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো,
–কাউকে দেখছি না তাই ডাকছিলাম। মা আর রিদি কোথায়?”
–নানু বাড়ি গেছে।”
–আমাকে বলে যায়নি কেন?”
–তুমি ঘুমিয়েছিলে তাই ডাকতে বারণ করেছি। আর আজকে কেউই আসবে না। কালকে চলে আসবে।”
–ওহ্। তা আপনি কী করছেন রান্নাঘরে?”
শিশির সে কথার জবাব না দিয়ে ধীর পায়ে এগুতে লাগলো বিন্দুর দিকে। বিন্দু শক্ত পাথরের ন্যায় আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। শিশিরকে এভাবে এগুতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল।
–আ…আপনি এভাবে এগুচ্ছেন কেন? আমি কিন্তু দৌড় দেব।”
কথা শেষ করেই বিন্দু যেই দৌড় দিতে নিলো ওমনি শিশির ধরে ফেললো। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে শিশিরের পুরো মুখের ঘাম বিন্দুর মুখে লাগিয়ে দিলো। বিন্দু শক্ত হয়ে শিশিরের বাহুডোরে চোখ-মুখ খিঁচিয়ে একদম চুপ করে রয়েছে। শিশির ফিসফিসিয়ে বললো,
–ভুলেও আর কখনো ভাইয়া ডাকবে না। আমি তোমার হাজবেন্ড হই পাগলী। আর হাজবেন্ডকে ভাইয়া ডাকলে পাপ হয়।”
বিন্দু আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো। তখনও বিন্দু শিশিরের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। শিশিরকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,
–তাই বলে ঘাম লাগিয়ে দিতে হবে? ইশ, ঘামের কী বিশ্রী গন্ধ!”
শিশির বিন্দুর নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে বললো,
–শুধু ঘামের গন্ধই না সাথে আমার শরীরের গন্ধও লেগে আছে। এখনকার বউয়েরা স্বামীর জন্য কত পাগল আর আমার বউটা সারাক্ষণ আমাকে দূরে রাখতে পারলেই বাঁচে। যখন একেবারে দূরে চলে যাব তখন আর খু্ঁজেও পাবে না৷”
কথাটা বলতে বলতেই শিশির আবারও রান্নাঘরে চলে গেল। বিন্দু সেখানেই কাঠের পুতুলের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হচ্ছে এক্ষুণি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। শিশির এটা কেন বলে গেল! বুকের মধ্যে অজানা এক ভয় এসে দানা বাঁধলো। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে খুব। পা যেন একটুও নাড়াতে পারছে না। শিশির খিচুড়ি নাড়তেছে আর গুনগুন করে গান গাইতেছে,
“বলতে চেয়ে মনে হয়, বলতে তবু দেয় না হৃদয়
কতটা তোমায় ভালোবাসি।”
এক কলি গান শেষ করতে না করতেই শিশির টের পেলো কেউ একজন এসে পেছন থেকে ঝাপটে ধরেছে। শিশির হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা নিশ্চয়ই তার ভ্রম। এমনটা আধেও হওয়ার কী কোনো সম্ভাবনা আছে?
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি সবার থেকে।
চলবে,,,,,,,