শ্রেয়সী
লেখাঃKhayrun Nessa Ripa
পর্বঃ৩২
পশ্চিমাকাশ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। একটুবাদেই পৃথিবীর কোল জুড়ে বিচরণ করবে অন্ধকার। তারপর নিজের রাজত্ব চালাবে কয়েক ঘণ্টা অব্দি। তারপর আবার পূর্ণতা পাবে একটি নতুন সকাল। কিন্তু সালেহা বেগম দৈনিক এক কথা শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে গেছেন। নতুন কিছুই তার জীবনে পদার্পণ করেনি। জানালার পাশে বিষণ্ণ মনে বসে আছেন তিনি। মনটা আজ খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। আজ কয়েকটা মাস হয়ে গেল অথচ ছেলের সাথে কোনো কথাই বলতে পারছেন না। আজ যেভাবেই হোক এ নিয়ে আসলাম সাহেবের(হাজবেন্ড) সাথে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। সহ্যেরও তো একটা সীমা থাকে।
এতদিন হয়ে গেল অথচ একটাবার ফোন করার সময় পায় না। এ কেমন ব্যস্ততা? একটাবার শুধু ফোন ধরার অপেক্ষা! সেই কখন থেকে শিহাবের বাবাকে ফোন করে চলেছে অথচ রিসিভ করার নামই নিচ্ছেন না তিনি। বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। ফোনের ব্যাক কভার খুলে ছিটকে গিয়ে পরলো খাটের তলায়। রাগে গা জ্বলছে। এত লুকোচুরির কী আছে বুঝে পান না তিনি। সেই মুহূর্তেই সাহেলা বেগমের ঘরে ঢুকলো সিয়াম।
–মা তোমার ফোনের কী হয়েছে? ফোন বন্ধ কেন? বাবা আমার ফোনে কল করলো!”
সাহেলা বেগম কিছু না বলেই সিয়ামের কান থেকে ফোনটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে নিজের কানে ধরলেন। ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
–সমস্যা কী তোমার? কী পেয়েছো তুমি আমাকে? আমার ছেলে কোথায়? কী করেছো তুমি ওকে? কী এমন ব্যস্ততা তোমার হুঁ? যে সময় করে ওকে একটু আমার সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারো না? খোদার কসম যদি আমার ছেলের কিছু হয়ে যায় তোমায় আমি ছাড়বো না।”
ফোনের ওপাশ থেকে শিহাবের বাবা( আসলাম সাহেব) বেশ ভয়ার্ত গলায় বললেন,
–এত রেগে কথা বলছো কেন?”
–তো কী করবো? তুলশি পাতা দিয়ে পুজো করবো নাকি? কতটা মাস হয়ে গেল আমি আমার ছেলেটার সাথে কথা বলতে পারি না। যত বারই তোমাকে জিজ্ঞেস করি তখনই বলো ও বিজি থাকে। কিসের এত ব্যস্ততা ওর? আমি যে মা আমার প্রাণটাও তো পুড়ে। একটু ওর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য অস্থির অস্থির লাগছে আর তোমার কোনো হেলদোলই নাই।”
আসলাম সাহেব আরও একটু গলার স্বর মিহি করে বললেন,
–সালু এত রাগে না প্লিজ।”
–দেখো এখন ঢং করবা না একদম। বুড়ো বয়সে আমার এসব পিরিত ভাল্লাগেনা। আমি আছি আমার জ্বালায় আর উনি আসছেন পিরিত দেখাইতে। শিহাব কোথায় এক্ষুণি ওকে ফোনটা দাও কথা বলবো আমি। কতদিন ওর সাথে কথা বলি না।”
–আসলে সালু ও তো আমার কাছে নাই।”
–দেখো আজ কোনো এক্সকিউজ আমি মানবো না। আজ আমি আমার ছেলের সাথে কথা বলবোই বলবো। এট এনি কস্ট।”
আসলাম সাহেব ভরকে গিয়ে বললেন,
–আজ বলতেই হবে?”
–হবে মানে হবেই।”
–আসলে একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”
আসলাম সাহেবের কথা শুনেই বুকের মধ্যে একটা অজানা ভয় নাড়া দিলো। সাহেলা বেগম উত্তেজিত হয়ে বললেন,
–কী সমস্যা? ”
–শিহাব এক্সিডেন্ট করেছে।”
–হোয়াট! কখন?
–আরও মাস কয়েক আগে।”
সালেহা বেগম কেঁদে দিয়ে বললেন,
–আর সেই কথা তুমি আমাকে এখন বলছো! আমার ছেলেটা কেমন আছে?”
আসলাম সাহেব ধরা ধরা গলায় বললেন,
–ভালো নেই সালু! আমাদের ছেলেটা একদম ভালো নেই। মাথায় ইনজুরি হয়েছে৷ সেই থেকে এখনো ও কোমায় আছে। তোমাকে জানাইনি তুমি টেনশ করবে তাই। ভেবেছি ও সুস্থ হয়ে যাবে তারপর জানাবো।”
সালেহা বেগম ফোনের মধ্যেই হাউমাউ করে কাঁদছে।
–তুমি আমার ছেলেকে কেন নিলে? আমার কাছ থেকে। আমার ছেলেটা এখনো কোমাতে আর তুমি আমাকে সেই কথা এখন বলছো? তুমি ওর কী ট্রিটমেন্ট করাচ্ছো যে এখনো জ্ঞান ফেরে না ওর?”
–সালু আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি। এখন একমাত্র আল্লাহ ভরসা। তুমি ওর জন্য বেশি বেশি দোয়া করো। যাতে আমাদের ছেলেটা সুস্থ হয়ে যায়। তোমাকে শিশির কিছু বলেছে?”
–নাহ্। ও তো দু’বার এসে শিহাবের খোঁজ করে গেল।”
–ওহ্! এখন রাখছি কেমন। আর অযথা কান্নাকাটি করবে না।”
সালেহা বেগম কিছুই বললেন না। শুধু চোখ থেকে অনর্গল পানিই পরে যাচ্ছে। সিয়াম সবটাই শুনলো মাকে এসে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদছে। ভাইটা যে তাকে খুব ভালোবাসে। সে ভাইয়ের এমন করুণ দশা সত্যিই মেনে নেওয়া খুবই কষ্টদায়ক।
নতুন অতিথির আগমনে শিশিরদের বাড়ির সবাই বেজায় খুশি৷ কাল খবরটা শোনার পর থেকেই বিন্দুর খেয়াল রাখতে সবাই ব্যস্ত। কিন্তু বিন্দু এত কিছুর মাঝে ভাবছে অন্য কথা। সবাই এত খুশি কেন? শিশির কী সত্যিটা বলেছে নাকি অন্যকিছু। শিরিনা বেগম খাটের ওপর পা বিছিয়ে সুপারি কাটছেন ছোরতায়। চোখে-মুখে লেগে আছে খুশির আমেজ। বেশ ফুরফুরে মেজাজে ডাকলেন রিদিকে নিজের ঘরে।
–হ্যাঁ, মা বলো?”
–তোর ফোনটা নিয়ে আয় তো।”
–কেন?”
–বেয়ানকে সুখবরটা জানাতে হবে তো।”
রিদির নিজের রুম থেকে ফোনটা এনে ডায়াল করে শিরিনা বেগমের হাতে দিলো।
–আসসালামু আলাইকুম।”
–ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন?”
–আল্লাহ ভালো রাখছে। আপনি কেমন আছেন?”
–ভালো। বেয়ান একটা সুসংবাদ আছে।”
সাজেদা বেগম নামাজের পাটিতেই বসে জিকির করছিলেন। ফোন বাজতেই বিধু এসে দিয়ে গেল। শিরিনা বেগমের কথায় একটু
নেড়েচেড়ে বসলেন।
–তা কী সুসংবাদ বেয়ান?”
–আরেহ আপনি নানি হচ্ছেন। ”
কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন সাজেদা বেগম। মুখ থেকে সতস্ফুর্তভাবে বেরিয়ে আসলো
–আলহামদুলিল্লাহ!”
যখন আগে শুনেছিলো বিন্দু মা হবে তখন কতই না সাফ-সাফান্তর করেছিলো৷ আর আজ কত খুশি লাগছে। সত্যিই বৈধ সম্পর্কের মতো মনে হয় কোনো কিছুতেই সুখ নেই। যদিও থাকে তবে সেটা সাময়িক। কখনোই সেই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
বিধুও কান উঁচিয়ে রেখেছে। ফোনে কী কথা হচ্ছে শোনার জন্য। কথাটা শুনেই বিধু খুশিতে ওর মাকে জিড়িয়ে ধরলো। সাজেদা বেগমের দু’চোখ দিয়ে পানি উপচে পড়ছে। কতই না মেয়েটাকে মেরেছিলো বকেছিলো। আজ কেন যেন ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে একটু চোখের দেখা দেখতে। কাথা শেষ করেই ফোন রাখলো সাজেদা বেগম। কাপড়ে চোখ-মুখ মুছে বিধুকে বললো,
–চল কাল তোর আপুকে গিয়ে দেখে আসি। মেয়েটা নাকি কিছুই খেতে পারে না। ”
বিধু হাসিহাসি মুখ করে বললো,
–মা আমার যে কী খুশি লাগছে তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। দাঁড়াও আপুর সাথে কথা বলে নেই।”
সন্ধ্যার নামজ পড়েই বিছানায় শুয়ে আছে বিন্দু। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। রিদি এসে চা সাধলো, পেঁয়াজু সাধলো কিছুই খেল না। পেট নাকি ভরা ভার লাগছে। খেলে যদি বমি হয় তাই না করে দিলো। ফোনের শব্দে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতরে নিলো।
–হ্যালো।”
ফোনের ওপাশ থেকে কনগ্রাচুলেশন শুনেই কিছুটা ভরকে গেল বিন্দু। নিজেকে একটু ধাতস্থ করেই বললো,
–হঠাৎ কনগ্রাচুলেশন কেন?”
–কারণ আমি আম্মা হবো তাই!”
বিন্দু নিজের কৃতকার্ম সম্পর্কে অবগত। কথাটা শুনেই জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–সেটা তো সেই বহু আগের ঘটনা৷ হঠাৎ এভাবে অভিনন্দন জানানোর কী আছে?”
–অনেক কিছুই আছে। এখন শোন তোর ছেলে-মেয়ে যাই হোক। তোকে মা বলবে আমার আমাকে আম্মা বলবে। নো আন্টি নো খালামনি। আপু জানিস ভাবতেই ভালো লাগছে তোর বাবুটা আমাকেও আম্মা ডাকবে।”
বলেই বেশ উচ্চস্বরে ফোনের ওপাশে হাসতে লাগলো বিধু। প্রাণ খেলা সেই হাসি! বিন্দু মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাসির শব্দ শুনছে আর বোনের পাগলামি দেখে হাসছে। কিন্তু সেই হাসিতে কী যেন একটা নেই৷ বড্ড প্রাণহীন একটু টুকরো হাসি! যে হাসি কেউ স্ব-চোক্ষে দেখলে হয়তো কারো হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে!
সাজেদা বেগম মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলেন।
–কী রে কেমন আছিস?”
–আসসালামু আলাইকুম। মা কেমন আছো?”
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
–তোর শরীরটা ভালো আছে?”
–আমার আবার কী হবে? ভালোই তো আছি।”
বিন্দুর বলা এই কথাটায় ভেতরে প্রচণ্ড ঝড় তুললো সাজেদা বেগমের। মেয়ের বলা এই কথার মাঝে কোথাও যেন অভিমানের এক টুকরো সুর বাজছে।
সাজেদা বেগম আবেগপূর্ণ গলায় বললেন,
–কত ভালো আছিস সে তো জানিই। একদম নাকি খেতে পারিস না। খালি বমি করিস।”
বিন্দু একটু হেসে বললো,
–আরেহ এমন কিছু না। তুমি যে কী বলো।”
–বেয়ানই তো একটু আগে ফোন করে বললো। নয়তো তো জানাই হতো না। তুই তো কিছুই বলিস না।”
বিন্দুর খুব কান্না পাচ্ছে। আজ মা সবচেয়ে বড় সঙ্গী হতে পারতো। শরীরটা এত খারাপ তবুও কাউকে বলতে পারছে না। কী করে বলবে সে,পেটে তো পাপ ধারণ করে বসে আছে। তাই নিজের কষ্ট নিজেকেই বয়ে বেড়াতে হবে। বিন্দু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললো,
— মা জানোই তো সবকিছু। তবুও কেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছো। একটা অবৈধ পাপ জন্ম দিচ্ছি। এখন খারাপ লাগুক আর ভালো লাগুক সেটা আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে। সবাইকে ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজের খারাপ লাগরা খবর জানান দেবার মতো তো কিছুই নেই।”
সাজেদা বেগম নিশ্চুপ কাঁদছেন। তার মেয়েটা বড্ড অভিমানী হয়ে গেছে। সত্যিই এই কয়েকটা মাস একটুও মেয়েটাকে বোঝার চেষ্টা করেননি তিনি। ছেলে-মেয়ে কোনো ভুল করলে সেটা তাকে সঙ্গ দিয়ে বন্ধুর মতো মিশে সেই ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হয় অথচ তিনি এমন কিছুই করেননি। সারাক্ষণ শুধু তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। দূর দূর করে তারিয়ে দিয়েছেন নিজের ছাঁয়ার আঁচল থেকে।
–তোকে মেরেছি বকেছি তাই আমার ওপর রাগ করে আছিস তাই না?”
–আরেহ না মা। তোমরা বাবা-মায়েরা কী কখনোই সন্তানের খারাপ চাইবে!”
–এখন বুঝিস না। যখন মা হবি তখন বুঝবি। সন্তানের জন্য তাদের ঠিক কী রকম লাগে। আমাকে ভুল বুঝিস না মা। তুইও আমার জাগায় থাকলে ঠিক এমনটাই করতি। একবার আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবিস।”
–হুম মা ঠিকই বলেছো। কিন্তু মা বিশ্বাস করো কিভাবেই যেন নিজের অজান্তে আমি এই পাপে জড়িয়ে গেছি। আমি কখনোই ভাবিনি আমি এমন কিছু করবো!”
–যাক যেটা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। এখন যে আছে বা যারা আছে তাদের সাথে সুখে-দুঃখে কিভাবে বাকিটা জীবন পার করবি সেটাই ভাব।”
–হুঁ।”
কথা শেষ করেই কান্নায় ভেঙে পরলো বিন্দু। আজ কতদিন পর তার মা একটু ভালো করে কথা বলেছে। যেন এই কথাগুলো শোকের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার করা একটা ভুল জীবন থেকে অনেকগুলো সুখের দিন কেড়ে নিয়ে গেছে! আর কখনো সে ভুল করবে না। অবশ্য ভুল কখনো কখনো জীবনের জন্য শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই শিক্ষা থেকেই বিন্দুর এই প্রতিশ্রুতি! জীবনে সে একজন ভালো মা হয়ে ঠিক দেখাবে। ভালো বউ হতে না পারুক একজন ভালো মা তো হতে পারবে!
চলবে,,,,,,,