#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ১৩
এত সুন্দর হাসি-খুশি পরিবারটায় যেন এক গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। কারো মুখে হাসির ছোঁয়া নেই। সাজেদা বেগম সারাক্ষণই কান্না করেন। কখনো রাঁধতে বসে, কখনো কোরআন তেলাওয়াত করতে গিয়ে কখনো বা মোনাজাতে। সব মিলিয়ে বাড়ির পরিবেশ একটা দম বন্ধকর পরিবেশে রুপ নিয়েছে। সাহেদ আলীও একদম চুপচাপ৷ যেন নিজের বাড়িতে নিজে চোরের মতো থাকেন। সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে দোকানে চলে যান আবার রাতে বাসায় পা রাখেন। বিধুর সাথেও তেমন কথা বলেন না। আর বিন্দুও সারাদিন কান্নাই করতে থাকে। এসবের মধ্যে সব থেকে বেশি অসহ্য লাগছে বিধুর। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও চলে যেতে। এই অসহ্য পরিবেশ থেকে একটু মুক্তি পেতে। কারোই মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বিন্দুর বাবা-মা দু’জনেই নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছেন প্রায়। সাজেদা বেগম মনের কষ্টটা কান্না করে হলেও কিছুটা দূর করতে পারেন। কিন্তু সাহেদ আলী তো কাঁদতেও পারেন না। ভেতরটা ওনার পুরো জর্জরিত হয়ে আছে।
বিন্দু এই কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার পণ করেছে নিজেকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। এই মুখ নিয়ে কী করে ওর বাবার সামনে দাঁড়াবে। কিন্তু কিছুতেই সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এমনিতেই একটা বড়সড় পাপ করে বসে আছে। নিজের ভেতর একটা ছোট্ট প্রাণ ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। কী করে এত পাপের বোঝা বইবে বিন্দু। ইহকালেও শান্তি নেই পরকালেও এই পাপ থেকে নিস্তার পাবে না। কারণ আত্মহত্যা করা যে মহাপাপ। তাও আবার একসাথে দুইটা প্রাণ কী করে সে হত্যা করবে? নিজের তো ক্ষমতা নেই কাউকে জীবন দেওয়ার তাহলে কোন অধিকারে অন্যের জীবন নিবে সে৷ সব ভেবে একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা হওয়ার হবে অন্তত কিছুতেই বিন্দু আত্নহত্যা করবে না। এমন খারাপ পরিস্থিতিও এটা ভেবে স্বস্তি লাগছে বিন্দুর,বিধু এখনো পুরো দমে বোনকে সাপোর্ট করে যাচ্ছে। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও বিধু সম্পূর্ণ কেয়ার করছে। ভাত খাইয়ে দেওয়া,ঔষধ খাইয়ে দেওয়া, চুল বেঁধে দেওয়া বিন্দুকে সঙ্গ দেওয়া সব মিলিয়ে বিধুর কাছে চির ঋণী হয়ে গেল বিন্দু। সাজেদা বেগম প্রতিদিনই বকতে থাকলেও। রাতে একবার হলেও মেয়েকে চোখের দেখা দেখে যান। কপালে হাত দিয়ে দেখেন জ্বর আছে কি না। যেটা বিন্দুর চোখ এড়ায় না। এই ব্যাপারগুলো আরোও বেশি কষ্ট দেয় বিন্দুকে। কী করে সে এত ভালো মানুষগুলোকে কষ্ট দিতে পারলো!
রান্নার যোগাড়যন্তর করছিলেন সাজেদা বেগম। হঠাৎই বিধুকে ডাকলেন।
–বিধু, এই বিধু।”
–হ্যাঁ মা,আসছি।”
–ওরে জিজ্ঞেস কর কার সাথে এই কুকর্ম করছে। সেই ছেলেকে আসতে বল। তার সাথেই বিয়ে দিয়ে মুক্তি হই। আমার আর এসব ভাল্লাগেনা৷ আর সেই ছেলে যদি বিয়ে করতে অস্বীকার করে তাহলে তো বাচ্চা নষ্ট করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। অহন জিজ্ঞেস কর কী করতে চায়। আর জ্বালইতে না কইস আমারে। তোর বাবার কাছে আমি ঘেঁষতেও পারি না। এই ব্যাপারে কথা তুললেই কেমন রাগ দেহায়। মনে হয় সব দোষ আমার। আল্লাহ আমারে নেয় না কেন বুঝি না। বড় মাইয়্যা নিয়া আমার কত শখ ছিল। বড় কইরা বিয়ার অনুষ্ঠান করুম। কিছুই হইলো না। তার আগেই মাইয়্যা কুকর্ম কইরা বইসা আছে।
বিধু এসে কথগুলো বলতেই আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়লো বিন্দু। একটা পাপ করে বসে আছে এখন আবার বাচ্চাটা নষ্ট করে আরও পাপের বোঝা কিছুতেই বাড়াতে চায় না। ওদিকে শিহাবকে এতগুলো টেক্সট করলো অথচ একটা রিপ্লাইও দিলো না। এত কী কাজ নিয়ে বিজি ভেবে পাচ্ছে না বিন্দু৷ মারাত্মক খারাপ সময় পাড় করতাছে। কবে যে আল্লাহ এসব থেকে মুক্তি দিবে সেই দিন গুনছে। বিন্দু সব শুনেও চুপ করেই রইলো। কিছুই বলার মতো মুখ নেই তার।
শিশির সবে স্কুল থেকে ফিরে এসে টিউবওয়েলের পানিতে গোসল করে ঘরে পা রাখলো। রমজানের কয়েকদিন আগে থেকেই ঘরের কাজ শুরু করে দিয়েছে। আরও পরে ঘর করার ইচ্ছে থাকলেও এখন তাড়াতাড়িই করতে হচ্ছে। কারণ রিদির জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে ব্যাংকার। রিদিকে পছন্দ হয়েছে। সবই পছন্দ হয়েছে কিন্তু ঘরের অবস্থা ভালো নেই দেখে পাত্রপক্ষ মনমন করছে। যার কারণেই তাড়াহুড়ো করে এই ঘর করা। ঈদের পরপরই তাহলে বিয়েটা হয়ে যাবে। শিশির ঘরে ঢুকতেই রিদি ফোন নিয়ে এগিয়ে আসলো।
–ভাইয়া কে যেন অনেকক্ষণ পর্যন্ত কল দিতাছে।”
শিশির ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা একটা নম্বর থেকে কল এসেছে। ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই কারো জড়ানো কণ্ঠ কানে ভেস আসলো।
–বিন্দু?”
–হ্যাঁ।”
–কেমন আছো?”
–আল্লাহ ভালো রাখছে। আপনি কেমন আছেন?”
–আমিও ভালো আছি৷ এখন শরীরের কী অবস্থা? জ্বর কমছে?”
–অনেকটাই। ভাইয়া একটা কথা ছিল।”
–বলো?”
–আপনার সাথে শিহাবের কথা হয়?”
–গত সপ্তাহে হয়েছিল৷ আর হয়নি।”
–দেখুন না আমি অনেকগুলো টেক্সট করলাম, কল করলাম কিন্তু ওর কোনো রেসপন্স পাচ্ছি না। ও কী কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছে কি না তাও বুঝতে পারছি না।”
–আচ্ছা মন খারাপ করো না। আমি ওর কাছে কল দিয়ে তোমাকে জানাচ্ছি।”
শিশির কল কেটে দিয়েই কল করলো শিহাবকে। দুইবার রিং হতেই কেউ একজন ফোন রিসিভ করলো। কিন্তু যা শুনলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শিশির। হাত থেকে ফোনটা ছুটে গিয়ে নিচে পড়ে গেল। চোখ দু’টো উপচে জল গড়াতে লাগলো। পুরো শরীর যেন কাঁপতে কাগলো। রিদি শিশিরের এমন অবস্থা দেখে দৌড়ে এসে ধরলো শিশিরকে।
–ভাইয়া কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?”
শিশির কিছু বলতে পারলো না। শুধু নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।
ওদিনে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ এখনো বিন্দুর ফোনে শিশিরের কল এলো না। অপেক্ষা সত্যিই অনেক কষ্টের। কখন যে শিশির কল করবে সেই আশায় ফোন নিয়ে বসে আছে মেয়েটা।
ভালো না লাগলে আর দেব না।
চলবে,,,,