#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ১৪
আজ এমন একটা ঘটনা নিজের কানে শুনতে হবে জানা ছিল না শিশিরের। খবরটা পাওয়ার পর থেকেই প্রচণ্ডভাবে কষ্ট পাচ্ছে শিশির। শিহাবের এই অকাল মৃত্যুর ঘটনা প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে শিশিরের হৃদয়কে। কিছুতেই নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারছে না শিশির। গত সপ্তাহ আগেও যার সাথে কত কথা হয়েছে আজ সেই মানুষটাই পৃথিবীতে নেই ভাবতেই হৃদয়টা ভেঙে-চূড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেই স্কুল লাইফ থেকে দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব। শিহাব একটু রগচটা টাইপের ছেলে হলেও শিশির অনেক শান্ত। যখনই শিহাব কোনো কারণ বশত রেগে যেত শিশির কোনো টুশব্দটি করতো না। নয়তো বন্ধুত্ব সেই কোন আগেই ভেঙে যেত। কখনো কোনো কিছু একতরফা ঠিকে থাকে না। হোক সেটা ভালোবাসা বন্ধুত্ব। কেউ একজন এক ধাঁচের হলে অন্যজনকে অন্য ধাঁচের হতে হয়। নয়তো সম্পর্কগুলোতে অকালেই মরিচা ধরে। কিন্তু শিশির কখনো এই স্পর্কতে মরিচা লাগতে দেয়নি। শিরিনা বেগমের আফসোসের অন্ত নেই। সেই ছোটবেলা থেকে দুইবন্ধুর কত ভাব। এমন একটা নাদুস-নুদুস ছেলে চলে গেছে ভাবতেই ভিষণ কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। শিশিরকে তিনি কখনো এতটা কষ্ট পেতে দেখেননি। আজ শিহাবের মৃত্যুর খবর শুনে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো। যেটা বড় হওয়া অব্দি কখনো শিরিনা বেগমের চোখে পড়েনি। ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বাণীও ছিল না ওনার। আজ ইফতারিতেও কিছুই খেল না শিশির।
একদিকে প্রিয় বন্ধুকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে বিন্দুকে কী জবাব দিবে সব মিলিয়ে মাথাটা প্রচণ্ডভাবে ধরে আছে। ইফতারি শেষে নামজ পরে বাড়িতে এসে লুঙ্গিটা চেঞ্জ করেই একটা প্যান্ট আর টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে রওনা হলো শিহাবদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। না জানি শিহাবের মায়ের কী অবস্থাই না হয়েছে। ছেলেদের তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসেন। সবাই ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসেন। তবে সবার বহিঃপ্রকাশ একরকম হয় না। তবে শিহাবের মায়ের ছেলেদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ বরাবরই ভিন্নরকম। কী করে নিজেকে সামলাচ্ছেন জানা নেই শিশিরের। একটু গিয়ে সান্ত্বনাও তো দেওয়া দরকার। শিশিরকে রেডি হতে দেখেই শিরিনা বেগম বললেন,
–শিশির তুই কী কোথাও বেড়ুচ্ছিস?
–হ্যাঁ মা। একটু শিহাবদের বাসায় যাই। দেখে আসি আন্টির কী অবস্থা। জানি না উনি কেমন আছেন। ছেলেরা ওনার প্রাণ।”
–আল্লাহ ওনার সহায় হোক। যা গিয়ে একটু সান্ত্বনা দিয়ে আয়। মায়ের মন বলে কথা। এত বড় ছেলে চলে গেলে মায়ের যে কেমন লাগে সেটা শুধু মায়েরাই জানে। বুঝি না আল্লাহ কেন এই অকাল মৃত্যু দেয়”
বলতে বলতেই একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলে এগিলেন নিজের রুমের দিকে।
সাহেলা বেগম মাগরীবের নামাজ সেরেই বারবার শিহাবের বাবার নাম্বারে ডায়াল করছেন। কিন্তু কিছুতেই ফোনটা লাগছে না। সিয়াম সাহেলা বেগমের পাশেই বসে ছিল। মায়ের এমন কপাল কুঁচকানো দেখে বললো,
–মা কী হয়েছে?”
–তোর বাবা,শিহাব দু’জনেই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। এদের বাপ-ছেলের কাণ্ডজ্ঞান নেই।”
কথার মাঝেই কেউ একজন কলিংবেল চাপলো। বিরক্তভরা কণ্ঠে সিয়ামকে বললেন,
–দেখতো কে এসেছে।”
সিয়াম সদর দরজার কাছে এগিয়ে যেতেই তিনিও সিয়ামের পিছু পিছু আসলেন। শিশিরকে দেখেই মৃদু হেসে বললেন,
–কেমন আছো?”
–আসসালামু আলাইকু আন্টি। আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
–আল্লাহ ভালো রাখছেন। আফায় কেমন আছে?”
–মায় ভালো আছেন। ”
–আসো ভেতরে এসে বসো।
শিশিরে এসে সোফার ওপর বসলো। তবে শিশিরের কাছে ব্যাপরটা বেশ জটিল লাগলো। এমন একটা মৃত্যুর সংবাদ শুনেও কী করে শিহাবের মা এতটা স্বাভাবিক আছেন সেটাই খেব ভাবাচ্ছে তাকে। তবে কী কোনো কিছু লুকানো হয়েছে ওনার কাছে থেকে।
শিশিরের ভাবনার মধ্যেই সাহেলা বেগম থমথমে গলায় বললেন,
–দেখো না শিহাবের কাছে আর ওর বাবার কাছে সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু দু’জনেরই ফোন বন্ধ। কও এমন ফোন বন্ধ থাকলে চিন্তা লাগে না। দুইজন মানুষ এমন দূর দেশে থাকে যদি ফোন না করে তহন কেমন লাগে।”
এ পর্যায়ে শিশির কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে বললো,
–আন্টি আপনি শিহাবের সাথে কবে কথা বলেছেন? ”
–গত দুইদিন আগে। ওর সাথেও বলেছি ওর বাবার সাথেও বলছি। দুইদিন হয়ে গেল বাপ-বেটা কেউই কল করতাছে না। এখন আজ আমিই দিলাম তাও ফোন বন্ধ। মনটা কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগতাছে। ছেলেটাকে বিদেশে পাঠানোর কোনো মনই ছিল না আমার। সব শিহাবের বাপের জন্য হয়েছে। এত বড় বাড়ি শুধু দুইটা মানুষ থাকি। কেমন লাগে কও? ও থাকতো তখন এত খারাপ লাগেনি। বাড়িটা তখন বেশ গরম থাকতো। ও সারাক্ষণই মা মা করতো। মা এটা রান্না করো,ওটা রান্না করো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার। শিহাবের বাপকে এত করে বলছি তুমি দেশে এসে বিজনেস করো কিন্তু আমার কোনো কথাই শুনলো না। এখন ছেলেটাকেও নিজের কাছে নিয়ে গেছে। মনটা কেমন যেন ওদের কাছে পরে আছে। সারাক্ষণ ভয় হয়। বিদেশের বাড়ি আল্লাহ না করুক কখন কোন বিপদ হয় বলা তো যায় না। ছেলেটাকে এত করে বলছি বিয়ে করে বউকে রেখে যা আমার ভালো লাগবে তবুও রাজী হলো না। ওর শখ নিজে কামাই করবে সেই টাকা দিয়ে বিয়ে করবে তাই বিয়েটাও করলো না। এক হিসেবে ভালোই হয়েছে বাড়িতে বেকার ছিল সেখানে গিয়ে কাজে লেগে পরেছে। আচ্ছা তোমরা দু’জনে কথা বলো আমি আসছি।”
শিশিরের যা বোঝার তা বুঝা হয়ে গেল। সাহেলা বেগম এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না। শিহাবের বাবাও কী করে ফোন রিসিভ করবে, উনি তো নিজেই হসপিটালের বেডে শুয়ে আছেন। ভাবতেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো শিশিরের বুক চিড়ে। শিশিরকে খবরটা দিয়েছিল শিহাবের এক কাজিন। সেও শিহাবের বাবার সাথে একই কোম্পানিতে আছে। শিশির ফোনটা পকেট থেকে বের করে বিকেলে যে শিহাবের নাম্বারে ফোন করেছিল সেই নাম্বারে ডায়াল করতেই টের পেল ফোন বন্ধ। হয়তো তর চাচাতো ভাই ইচ্ছে করেই ফোনটা বন্ধ রেখে দিয়েছে। যাতে সবাই শিহাবের খোঁজ না করতে পারে। সাহেলা বেগমকে সত্যিটা না জানানোর পেছনেও একটা বড় কারণ আছে যেটা শিশিরের অনুমান। আধেও এটাই মেইন কারণ কি না জানা নেই শিশিরের। শিহাবের পরে ওর এক বোন ছিল। সেই বোন যখন এসএসসি পরীক্ষা দেয় তারপরই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরে। ডাক্তারের কাছে নিলে ক্যান্সার ধরা পরে। এই রোগ ধরা পরার পর বেশিদিন বাঁচেনি শিহাবের সেই বোন। চেষ্টাও করতে পারেনি। একদম লাষ্ট স্টেজে এসে রোগটা ধরা পরে। এর কিছুদিন পরেই মেয়েটা মারা যায়। মেয়ে মারা যাওয়ার পর পুরো এক সপ্তাহ সেন্সলেস হয়ে হসপিটালের বেডে পড়ে ছিলেন শিহাবের মা। ওইজন্যই হয়তো শিহাবের বাবা নিজের ভাইস্তাকে বলে দিয়েছেন শিহাবের মাকে এই বিষয়ে কিছু না জানাতে। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা বড়সড় দম নিলো শিশির। ওর পাশেই সিয়াম বসে ছিল। সিয়ামের পিঠে হালকা একটা চাপড় দিয়ে বললো,
–কী সিয়াম বাবু, পড়াশোনা কেমন চলছে?”
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
–জাতি কী তোমার থেকে এবারো ভালো রেজাল্ট আশা করতে পারে?”
–ইনশাআল্লাহ। দোয়া করবেন ভাইয়া।”
–অবশ্যই। ভালো মতো পড়ালেখা করবা। তাহলেই দেখবা কী সুন্দর ভালো রেজাল্ট করেছো।”
ওদের কথার মাঝখানেই সাহেলা বেগম ট্রেতে করে চিকেন কাটলেন নিয়ে হাজির হলেন।
–আন্টি আবার কষ্ট করে এসব করতে গেলেন কেন?”
–আরেহ কষ্ট কিসের। ফ্রিজে আগেই তৈরী করে রেখেছি এখন শুধু ভেজে নিয়ে আসলাম। শিহাব এই চিকেন কাটলেট খুব পছন্দ করতো। নাও খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে।”
শিশির এক টুকরো হাতে নিয়ে খেতে লাগলো। খাবার যেন গলা দিয়ে নামছে না। মনে হয় কোনো কাঁটা যুক্ত খাবার খাচ্ছে। শিশির শুধু বারবার ভাবছে সাহেলা বেগম খবরটা শোনার পর ঠিক কী রকম করবেন। খাওয়ার মাঝখানেই বিন্দুর ফোন আসলো শিশিরের ফোনে। বিন্দুর কল পেয়ে খাবার গলায় আটকে গেল। সাহেলা বেগম তাড়াতাড়ি পানি এগিয়ে দিলেন। শিশির কল কেটে পানি খেয়েই উঠে দাঁড়ালো।
–আন্টি আমি আসছি এখন।”
–সে কী আমি চা বসিয়েছি। এক সাথে ডিনার করে যাবে।”
–না আন্টি আজ সম্ভব না। অন্য একদিন এসে খেয়ে যাবে।”
এরপর দ্রুত পায়ে শিশির শিহাবদের বাড়ি ত্যাগ করলো। শিশিরকে কল কাটতে দেখো বিন্দু আবারও কল করলো। এবারেও শিশির কল কেটে দিলো। শিশিরের পুরো শরীর কাঁপছে। কী করে বিন্দুকে এই ভয়ংকর খবরটা দেবে। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে বিন্দু কিভাবে সামলাবে নিজেকে এসব আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে। আর চোখের কোণ বেয়ে জল পরছে। একটা রিক্সা ডেকে শিশির রিক্সায় উঠলো আজ বাইক চালাতে ইচ্ছে করছিল না তাই রিক্সায় করেই এসেছে। রিক্সায় উঠেই বিন্দুর নাম্বারে ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে সহসাই বিন্দুর উত্তেজনাপূর্ণ কণ্ঠ কানে ভেসে আসলো।
–কী হলো শিশির ভাই সেই কখন থেকে কল করে যাচ্ছি কাটছেন কেন?”
শিশির থমথমে গলায় বললো,
–আসলে একটু বিজি ছিলাম। তা কী বলবে বলো?”
–শিহাবের কাছে ফোন করেছিলেন?”
–হু।”
এ পর্যায়ে শিশির কণ্ঠস্বরটা বেশ অস্বাভাবিক লাগলো বিন্দুর। অজানা একটা ভয় এসে পুরো শরীর নাড়িয়ে দিলো । ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
–কী বলেছে ও?”
–কিছু বলেনি। বলার মতো পরিস্থিতিও তো নেই। বলবে কী করে?”
এ পর্যায়ে মেজাজটা চরমে পৌঁছে গেল বিন্দুর। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
–এসব অদ্ভুত কথাবার্তা না বলে ডিরেক্টলি বলেন কী হয়েছে। আমি শুনতে চাই ও আপনাকে কী বলেছে।”
এ পর্যায়ে শিশিরের ক্রন্দন কণ্ঠ কানে বাজলো বিন্দুর।
–ওই তো বেঁচে নেই। তাহলে ও কী করে বলবে। গত দুইদিন আগে অফিস থেকে ফেরার পথে শিহাবের বাইক এক্সিডেন্ট হয়। ও সেই স্পটেই মারা যায় ওর বাবা পেছনের সিটে বসেছিলেন। ওনার অবস্থায়ও খুব বেশি ভালো না।”
বিন্দু আর কিচ্ছু শুনতে পারলো না। দুই কানে শুধ ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ডাক শুনতে লাগলো। হাত থেকে ফোনটা খাটের নিচে পড়ে গেল। সহসাই এক গগনবিদারী চিৎকার দিলো বিন্দু। পাগলের মতো নিজের মাথার চুল দু’হাতে টানতে লাগলো। এলোপাথাড়ি কিল,ঘুষি দিতে লাগলো নিজের বুক বরাবর।
শিশির হ্যালো হ্যালো করেতেই টের পেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আবারও বিন্দুর ফোনে ট্রাই করতে লাগলো এখন ফোন বন্ধ আসছে। একটা ভয় এসে দানা বাঁধলো,
“বিন্দু কিছু করে বসবে না তো?”
ইফতার শেষে নামজ পড়ে সাজেদা বেগমের রুমে সময় কাটাচ্ছিল বিধু। মায়ের মনটাও তো ভালো নেই। তাকেও তো একটু সঙ্গ দিতে হয়। সহসা বিন্দুর এমন চিৎকার শুনে দৌড়ে আসলেন সাজেদা বেগম আর বিধু। সাজেদা বেগম রুমের ওপর পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। পরিস্থিতি আজ তাকে মেয়ের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। বিধু এসে ধরলো বিন্দুকে।
–কী হয়েছে আপু, তুই এমন করছিস কেন?”
–শিহাব! আমার শিহাব নেই বিন্দু। আমাকে একা রেখে চুপিচুপি চলে গেছে। একটাবারও আমার কথা ভাবলো না আমি কী নিয়ে বাঁচবো। ওকে ছাড়া কী করে বাঁচবো আমি।”
বিধু বোনের এমন পাগলামো দেখে জোর করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। অন্যদিকে দরজার ওপাশে চোখের জল ফেলছেন অভাগী মা!
বিন্দু কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। পাগলের মতো প্রলাপ বকছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। মনে হয় গলা ফেটে রক্ত বের হবে বিধুও ব্যর্থ বিন্দুকে সামলাতে। এক সময় সেন্স হয়ে পড়ে গেল বিন্দু। এখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না সাজেদা বেগম দৌড়ে এসে মেয়ের মাথায় তেল-পানি দিতে লাগলেন। পুরো শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বিধুও হাতে-পায়ে তেল মালিশ করছে। আফসোসর অন্ত নেই সাজেদা বেগমের তার এত সুন্দর মেয়ের জীবনটা কী থেকে কী হয়ে গেল!
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি সবার কাছে থেকে। ধন্যবাদ।
চলবে,,,,,,,,,,