শ্রেয়সী #লেখাঃKhyrun Nesa Ripa #পর্বঃ১৯

0
395

#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ১৯

সাজেদা বেগমের রাগে শরীর পুরো থরথর করে কাঁপছে। এত বড় অন্যায় করার পরেও কী করে এই রকম একটা কাজ করার সাহস পায় ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। ইচ্ছে করছে শিশিরের সামনেই টেনে এনে দুই গালে ঠাটিয়ে দুই চড় মারতে। সাজেদা বেগমকে এতটা টেনশনে পরতে দেখে শিশির শান্ত গলায় বললো,
–আন্টি প্লিজ এতটা উত্তেজিত হবেন না। এমনিতেই আপনার স্বাস্থ্য ভালো না।”
–তুমি আমার স্বাস্থ্যের কথা ভাবলে কী হবে আমার পেটের সন্তানেরই তো কিছু যায় আসে না।”
বলতে গিয়েই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন সাজেদা বেগম। বিধু এসে ওর মায়ের পাশে বসে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
–মা অযথা মন খারাপ করো না। আপু ফিরে এসেছে এটাই অনেক।”
সাজেদা বেগম রেগে গিয়ে বললেন,
–তোরা তো বাপ-মায়ের মরণ চাস। কয়েক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হয়তো তুইও এমন কাণ্ড করে বসবি। আল্লাহ কেন এমন অজাত-কুজাত সন্তান মানুষকে দেয় বুঝি না। ”
শিশির চুপচাপ মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। বলার মতো এই মুহূর্তে কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। সাজেদা বেগম কাপড়ে নাক-মুখ মুছে শিশিরের উদ্দেশ্যে বললেন,
–তা শিশির তোমার মায়ের যেহেতু পছন্দ হয়েছে আমি আর একদম লেট করতে চাই না। বিয়েটা এই সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে যাক। জানো আমার হইছে যত মরণ। ওর বাপে সারাদিন উঠতে বসতে আমাকে কথা শুনায়। বলে আমার জন্য নাকি ও এত খারাপ হইছে। আমি কখনো মেয়েদের স্বাধীনতাকে সাপোর্ট দেই না। ঘরের থেকে বাহির হওয়া মানেই বিপদ মাথায় নিয়া বাহির হওয়া। কেমনে যে কী করছে কিছুই মাথায় আসতেছে না। আমি একটু কিছুও জানতে পারলাম না।”
–থাক আন্টি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন এসব বাদ দিয়ে কীভাবের সামনের দিকে ভালো হবে সেটাই দেখা উচিত। পেছনের কথা যত ভাববেন তত কষ্ট বাড়বে তার চেয়ে ভুলে যাওয়াই ভালো।”
সাজেদা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–ও যা করছে তা ভোলার মতো না। ও আমার আরও ওর বাপের অন্তরে পুরা দাগ পরায়া দিছে। এই দাগ কখনো মুছবো না। তুমি এখন যত তাড়াতাড়ি পারো বিয়েটা করে ফেলে তোমার কাছে নিয়ে গিয়ে তোমার বউ তুমি সামলাও আমি একটু শান্তি পাই। ওর চিন্তায় আমার ঘুমও হারাম হয়ে গেছে।”
–আচ্ছা আন্টি আমি ফোনে আপনাকে জানিয়ে দেব। তাহলে এখন উঠি?”
–আচ্ছা। ভালোভাবে যাইও।”
–আসসালামু আলাইকুম।”
–ওয়ালাইকুম সালাম।”

ঈদের আর মাত্র নয়দিন বাকি। মার্কেটে প্রচুর ভিড়। সব মিলিয়ে খুব ব্যস্ত সময় পাড় করছেন সাজেদ আলী। অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতে হয় ওনাকে। সব দায়দায়িত্ব তো আর কর্মচারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাহলে ব্যবসা লাটে উঠবে। সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো থাকলেও এরা আরও একধাপ এগিয়ে কীভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে হয় সেটা ভালো করেই জানে। বিস্বস্ত তেমন কেউই নেই যে যার ওপর একটু ভরসা করবে। আজ বাড়ি ফিরেছেন সবার জন্য শপিং নিয়ে। রিদিকে ডেকেই শপিংগুলো সব রিদির হাতে দিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকলেন। রিদি আর সাজেদা বেগম শপিংগুলো দেখতে লাগলেন। দুইটা জর্জেটের থ্রি-পিচ আর একটা শাড়ি। রিদি থ্রি-পিচ গুলো দেখেই মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। রিদিকে এভাবে হাসতে দেখে সাজেদা বোগম হাসার কারণ জানতে চাইলেন।
–মা দেখেছো বাবা আপুর উপর রাগ করে আছেন ঠিকই কিন্তু মেয়ের জন্য ঠিকই পোশাক আনতে ভুলেননি।”
সাজেদা বেগম ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
–রাগ না। মানুষটার মনে কষ্ট জমে আছে। কখনো যে তার আদরের বড় মেয়ে এত বড় দূর্ঘটনা ঘটাতে পারে এটা ওনার জানাই ছিল না। কেউ না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝি মানুষটাকে। সেদিন রাতে দেখি একা একা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কাঁদতেছে আমাকে দেখেই আড়াল করলো আমিও আর বুঝতে দেয়নি যে আমি দেখে ফেলেছি৷ মানুষটা খুব কষ্ট পাইছে।”
রিদির মনটাও খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভেবে নিলো নিজে কখনো এই মানুষ দু’টোকে কষ্ট দেবে না। কখনোই এই প্রেম নামক পীড়ায় জড়াবে না নিজেকে।”
ঘড়িতে তখন একটা বাজে৷ তখনও কেউ ঘুমোয়নি। রিদি জেগে জেগে পড়ছিল। সাজেদ আলী না আসা অব্দি একদিনও ঘুমোয় না সে। বাবা আসবে তারপর ঘুমাবে। রিদি থ্রি-পিচ দু’টো নিয়ে বিন্দুর ঘরে গেল। বিন্দু ঘুমিয়ে পড়েছে স্বাস্থ্যটা একদমই ভালো যাচ্ছে না একে তো কিছুই খেতে পারছে না তার ওপর রোজা রাখে। তাই শরীরটা একটু বেশিই ক্লান্ত।
–আপু।”
–হু। ”
–ওঠ। দেখ বাবা কত সুন্দর ড্রেস আনছে। তোর আর আমার জন্য।”
বিন্দু তাড়াতাড়ি চোখ মেলে উঠে বসলো। বিন্দুর সামনে দুইটা ড্রেস রাখা একটা গোলাপী আর একটা সাদা। সাদা ড্রেসটার দিকে নজর পড়তেই ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলো বিন্দুর চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠলো মুহূর্তেই। বাবা রাগ করে কথা না বললে কী হবে? মেয়ের পছন্দের কালার ড্রেস আনতে ভুলেনি। বিন্দুর সবচেয়ে প্রিয় রঙ সাদা৷ সাদা রঙের হাজারটা ড্রেস পরলেও মনে হয় মন ভরবে না। আলতো করে ড্রেসটার ওপর হাত বুলালো। হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলো বিধুকে,
–বাবা কোথায়?”
–মায়ের রুমে।”

আজ বাবাকে খুব দেখতে মন চাইছে৷ কয়েকদিন হয়ে গেল বাবার মুখটা দেখা হয় না। একদম রাত করে বাড়ি ফিরে সাজেদ আলী আসার আগেই তো ঘুমিয়ে পরে। আবার সকালে ঘুম ভাঙার আগেই দোকানে চলে যান তাই আর দেখা হয় না। বিন্দু তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে মায়ের রুমের কাছে গেল। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে এক পলক বাবাকে দেখে নিলো। আগে পাশে বসে কথা হাসি-মশকরা করতো আজ নিমেষেই কত দূরে সরে গেল। চুপচাপ আবার নিজের রুমে এসে শুয়ে পরলো। বিধুও বোনের পাশে শুয়ে পরলো৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জনে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল।

–একটা কথা বলতে চাইছিলাম আপনাকে।”
–বলো?”
–আপনাকে তো বলছিলাম শিশিরের মা আসছে এখন ওনারা চায় গতকাল এসে এনগেজমেন্টটা সেরে ফেলতে।”
–এনগেজমেন্টের কী দরকার এক সাথে বিয়ে হয়ে গেলেই তো হয়। ”
–হু তাও ঠিক। কিন্তু ওনারা চাইছেন আগামীকাল আসতে। এখন আপনি কী বলেন?”
–আমি আর কী বলবো? বিয়ে যত তাড়াতাড়ি হবে ততই ভালো৷ আগামীকাল এনগেজমেন্ট হলে তো বিয়ে কবে হবে? সে ব্যপারে কিছু বলেছে?”
–হু। বলছে তার দুইদিন পরই।”
–ওহ্। তা ফ্রিজে কী কী আছে? বাজার করা লাগবে কী কিছু?
–গরুর গোস্ত আছে। পোলাউয়ের চাল আছে, ইলিশ মাছও আছে। স্যালাড এর জন্য শসা, টমেটো এসব লাগবে আর সবজি করবো চিংড়ি মাছ দিয়ে চিংড়ি মাছ আর সবজি লাগবে আর রোস্টের জন্য মুরগী লাগবে আর দধি লাগবে।”
–আচ্ছা যা যা লাগে বিধুকে দিয়ে লিস্ট করিয়ে রেখো৷ আমি এক ফাঁকে এসে বাজার করে দিয়ে যাব। আর চেইন আর আংটিটা বিধুর পছন্দ হয়েছে?”
–হুম। আমারও খুব পছন্দ হইছে। চেইনটা কত আনার মধ্যে নিছেন?”
–এক ভড়ির উপরে আছে। আর আংটিটা পাঁচ আনা। ভাবছি কালকেই সেরওয়ানী আর ছেলের মায়ের কেনেকাটাটা করে রাখবো। এছাড়াও তো বিন্দুর সাথে হাবিজাবি দেওয়া লাগবে। লেপ-তোসকও বানাইতে দিছি।”
–ভালোই করছেন সময়ও তো নাই হাতে। আচ্ছা বিন্দুর হাতের চুড়িগুলো কত আনা দিয়ে নিছেন?”
–দুইটা দুই ভড়ি। মেয়ে যা করছে তার জন্য সে ভুগবে তাই বলে তো আমি আর মেয়েকে ঠকাতে পারি না। মেয়ে তো আমারই। দোষ করলেও আমার মেয়ে আর ভালো করলেও আমারই মেয়ে৷ পরের বাড়িতে কথা শুনবে এটা তো আমি হতে দিতে পারি না।
–হু।”

দু’জনে মিলে কথা বলতে বলতেই সেহরীর টাইম হয়ে গেছে। একসাথে সেহরী খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পরলো।

পরদিন শিশিরের বাড়ি থেকে শিশিরের মাসহ আরও আত্মীয়স্বজন এসে বিন্দুকে আংটি পরিয়ে আশির্বাদ করে গেলেন। সবার সামনে না চাইতেও মুখে হাসি ধরে রাখতে হয়েছে বিন্দুকে। সাজেদা বেগম বারবার মেয়েকে এ ব্যাপারে বলে দিয়েছেন যেন কিছুতেই মুখ গোমড়া করে না রাখে।

অবশেষে এলো সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। শিশির নিজের পছন্দ মতো বিন্দুর জন্য সাদা বেনারসি কিনেছে। যেটাতে সাদা আর গোলাপী কম্বিনেশন। শিশিরের বাড়ির একটা মেয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। সম্পর্কে শিশিরের মামাতো বোন হয়।
–বাহ্ ভাবি! খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। তবে যাই বলো শিশির ভাইয়া কিন্তু হীরের টুকরা ছেলে। কপাল আছে তোমার। কত যে লাইন মারতে চেয়েছি ওর সাথে পাত্তাই দিলো না। অবশ্য ভাইয়ারও পছন্দ আছে বলতে হয়।”

বিন্দু একটু লাজুক হাসলো। ঠোঁটে হাসি ফুটালেও বুকের ভেতরে চলছিল এক প্রগাঢ় ভাংচুর। শিশিরের সত্যিই আজ অনেক ভালো লাগছে এভাবে তার ভালোবাসাকে নিজের করে পাবে সত্যিই ধারণার বাহিরে ছিল তার। চেয়েছিল নিজের মনের মধ্যেই নিজের ভালোবাসাটাকে লুকিয়ে রাখতে যেখানে বন্ধু তার ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসে সেখানে সে কী করে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করবে? হয়তো এটা বিধাতারই ইচ্ছা ছিল তাই এমনটা হয়েছে। কবুল বলতে গিয়েই ঘোমটার আড়ালে কেঁদে ফেললো বিন্দু। বিয়ে নামক রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করতে গিয়েও হাতটা অনবরত কাঁপতে লাগলো। যেখানে আজ শিহাব থাকার কথা ছিল সেখানে আজ অন্য কারো সাথে এক নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে সে।
বিধু এসে বিন্দুর কাঁধে হাত রেখে আস্তে করে বললো,
–আপু প্লিজ সবাই দেখছে তোকে। কান্নাটা থামা।”

আজকে সবাই বিন্দুদের বাসায় চলে এসেছে আসরের ওয়াক্তের সময়। বাবুর্চি দিয়েই রান্না করা হয়েছে। শিশিরের বাড়ি থেকে বিশ-পঁচিশ জনের মতো এসেছে। আর সবাই খেয়ে-দেয়ে বিয়ে পরিয়ে তবেই বউ নিয়ে ফিরবে।

সব বাঁধা পেরিয়ে অবশেষে বিন্দু বাঁধা পরলো শিশির নামক এক নতুন বন্ধনে। সবশেষে এলো বিদায় বেলা। কান্নায় ভেঙে পরলেন সাজেদা বেগম। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলেন। রিদিও কাঁদছে। সাহেদ আলীর চোখেও পানি টলমল করছে তবুও কোনোরকমে চোখের পানি ধরে রেখেছেন। মাকে ছেড়ে বাবাকে চোখের সামনে দেখতেই বিন্দু ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবার বুকের মাঝে। কাকুতি করে বলতে লাগলো,
–বাবাগো তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। না জেনে-বুঝে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমাকে তুমি মাফ করে দিও।”

শিশিরের খুব মন খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে না এই পরিবারটাকে এভাবে কাঁদিয়ে তাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে। কিন্তু এটাই তো নিয়ম কিছুই যে করার নেই।

গাড়ির মধ্যে বিন্দু কেঁদেই যাচ্ছিলো। শিশির বিন্দুর হাতটা ধরতেই এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here