শ্রেয়সী লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা পবঃ৪৩

0
411

শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পবঃ৪৩

শিশির আর শিহাব পাশাপাশি দু’জন বসে আছে রাস্তার পাশের একটা পুলের ওপর। শিহাবের রাগে পুরো গা থরথর করে কাঁপছে। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে শিশিরকে খুন করতে।
–দেখ শিহাব হয়তো তুই আমাকে ভুল বুঝতে পারিস কিন্তু ওই সিচ্যুয়েশানে আমি বিন্দুকে সব ধরণের বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্যই এটা করেছি। এছাড়া আমার আর কিচ্ছু করার ছিলো না।”
শিহাব হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো,
–শালা আমার সব কেড়ে নিয়ে এখন আসছিস মিনমিন করতে। তোর মিনমিনের নিকুচি করি আমি। আমার মেয়ে কোথায়?”
এবারে আরও একটা ধাক্কা! শিশির সবটুকু বলার আগেই শিহাব যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে আর যখন শুনবে মেয়েটাও ওর নয়, না জানি কী উল্টাপাল্টা ভুলটাই না বুঝবে। পুরো শার্ট ঘেমে একাকার। কপাল চুইয়ে চুইয়ে ঘাম ঝড়ছে শিশিরের। আর শিহাবের চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝড়ছে। শিশিরের সাহস হচ্ছে না শিহাবের চোখে চোখ মেলানোর। চোখ জোড়া রক্তিম আভা ধারণ করেছে শিহাবের। যেন এক্ষুণি আগুন ঠিকরে পড়বে আর সেই আগুনে জ্বলেপুড়ে সব কিছু ভস্ম হয়ে যাবে। শিশির হালকা কেসে বললো,

–শিহাব আমার পুরো কথা এখনও শেষ হয়নি।”
এই কথাটা বলে যেন শিশির খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে৷ শিহাব অগ্নিশর্মা হয়ে বললো,
–আর কী বলার আছে তোর? আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না তুই আমার বন্ধু হয়ে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবি এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার অগোচরে তুই বিন্দুকে ফুঁসলিয়ে বিয়েটা করেছিস। না হলে ও কখনও তোকে বিয়ে করতো না। ও শুধু আমাকে ভালোবাসতো আর এখনো ও আমাকেই ভালোবাসে।”
শিশির চুপচাপ বসে আছে। কোনো কথা নেই ওর মুখে৷ এটা তো সত্য বিন্দু শিহাবকেই ভালোবাসতো। তবে এখনও কী বিন্দু শিহাবকেই ভালোবাসে? বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে শিশিরের! বুকটা ভারী হয়ে গেছে। একটু কান্না করলে বোধহয় হালকা লাগতো। আচ্ছা বিন্দু কী সত্যিই চলে যাবে? শিহাবের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়লো শিশিরের।
–আমার মেয়ে কোথায় শিশির?”
কিছুটা অপ্রস্তুতভাবেই শিশির বলে ফেললো,
–ও ভালো আছে।”
–যা করেছিস করেছিস এখন আমার বাচ্চা আর বউকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোর। এতদিন ওদের খেয়াল রেখেছিস সেই জন্য আমি তোর সব ঋণ শোধ করে দেব।”
–এসব কী বলছিস তুই শিহাব? বিন্দু আমার বউ, কণা আমার মেয়ে।”
–বাহ্! ভালোই তো “শিশিরের বিন্দু কণা ” কার বউ আর কার মেয়ে আর তুই মিলিয়ে নাম রাখিস। তোর কাণ্ড দেখে আমি অবাক না হয়ে পাড়ছি না। আর কী বললি? কণা তোর মেয়ে? তুই কী ওকে জন্ম দিয়েছিস? যে ও তোর মেয়ে হবে?”
শিশির গলার কাছে কথাটা এসেও আটকে গেছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে কণা শুধু আমার মেয়ে। ওরা দু’জনই আমার! শুধুই আমার! আর কারও না!”
কিন্তু এমন কিছুই বলতো পারলো না শিশির। সময়ের কাছে আজ বড় অসহায়। বন্ধুর এমন দুর্দিনে তাকে কেন যেন আর কষ্ট দিতে মন চাইছে না।
–শোন শিশির আমি এক্ষুণি তোদের বাসায় যাব আর আমার মেয়ে আর বউকে নিয়ে চলো আসবো।”
–শিহাব আমার কথাটা তো শুনবি আগে।”
–কিচ্ছু শোনার নেই। যা বলতে চেয়েছিস বলেছিস আর কিচ্ছু শোনার মতো অবস্থায় নেই আমি।”
শিশির দেখলো শিহাব অনেকটা ওভার রিঅ্যাক্ট করছে বাধ্য হয়ে শিশির বললো,
–ওকে ফাইন! তোর মেয়ে তোর বউ তুই নিয়ে যা। তবে হ্যাঁ তার আগে আমার একটা কথা রাখতে হবে। তুই আজ আমাদের বাসায় যেতে পারবি না। গতকাল আমি বিন্দুকে আর কণাকে নিয়ে আসবো আর ও যদি স্ব-ইচ্ছায় তোর সাথে যেতে চায়। আমি আটকাবো না। প্রমিজ করলাম তোকে।”
–বলছিস তো?”
–হুম। যদি বিন্দু যেতে চায় তোর সাথে সত্যিই আমি ওকে আটকাবো না।”
–চাইবে না মানে, আলবাত চাইবে। শুধু তুই দেখে নিস। ও এখনও শুধু এই আমাকেই ভালোবাসে।”
কথা শেষ করেই শিহাব ক্রাচে ভর দিয়ে চলে যেতে লাগলো। পেছনে আসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে শিশির। সত্যিই কী বিন্দু ওকে ছেড়ে চলে যাবে? তাহলে ও কী নিয়ে থাকবে? কাকে ঘিরে বাঁচবে?

মাথায় কিচ্ছু কাজ করছে না শিশিরের। স্কুলেও যেতে মন চাইছে না এখন এমনিতেই অনেকটা লেট হয়ে গেছে তার ওপর ফোনটাও এই মুহূর্তে ওপেন করতে মন টানছে না।যদি বিন্দু এই মুহূর্তে কল দেয় তাহলে নির্ঘাত শিশির কেঁদে ফেলবে। একটা কথাও ঠিক মতো বলতে পারবে না। শিশির খানিকটা সময় চুলগুলো দু’হাতে টেনে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। এরপর ঢুলুঢুলু পায়ে এগিয়ে চললো স্কুলের দিকে। প্রিন্সিপাল স্যার কথা শুনাতে গিয়েও থমকে গেলেন শিশিরের চোখ-মুখ দেখে। শিশিরের চোখ জোড়া ভয়ংকর লাল দেখাচ্ছে মনে হয় খুব কেঁদেছে। এলোমেলো মাথার চুল। হাতে-পায়ে যেন কোনো শক্তি নেই। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে শিশিরকে। প্রিন্সিপাল স্যার এগিয়ে গেলেন শিশিরের পিছু পিছু। শিশির লাইব্রেরিতে ঢুকে বেখেয়ালি ভাবেই একটা চেয়ার টেনে বসলো।যেটা প্রিন্সিপাল স্যারের চোখ এড়ালো না। প্রিন্সিপাল স্যার ফ্যানের সুইচ অন করে দিয়ে শিশিরের পাশের একটা চেয়ারে বসলেন। শিশির প্রিন্সিপাল স্যারকে দেখেই বললো,
–স্যরি স্যার আমি লেট করে ফেলেছি আজ।”
শিশির কথাগুলো কেমন লেগে লেগে যাচ্ছে। প্রতিটা কথায় জড়তা মিশে আছে। প্রিন্সিপাল স্যার সে কথার জবাব না দিয়ে নরম সুরে বললেন,
–শিশির কী হয়েছে তোমার?”
আচমকাই শিশির হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললো। দু’হাতে অস্থির হয়ে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে। প্রিন্সিপাল স্যার বেশ ভরকে গেলেন এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন শিশিরের সামনে। শিশির পানিটুকু খেয়ে খানিকটা সময় চুপ থেকে বললো,
–স্যার আমার জীবনের ভালো সময়গুলো বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে।”

দুপুরেও শিশির বাড়িতে এলো না। সে নিয়ে সবার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তার ওপর ফোনটাও বন্ধ। সব মিলিয়ে সবাই খুব চিন্তায় আছে। বিন্দু তো প্রতি মিনিটে মিনিটে শিশিরের ফোনে ট্রাই করে চলেছে। এমনিতেই সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোনটা নিচে পেয়েছিলো তাও আবার খণ্ড খণ্ড অবস্থায় তাছাড়া ল্যাপটপটাও খুলে রেখেছিলো। কোনো কিছুই আপাতত মাথায় ঢুকছে না বিন্দুর। তবে এটা বেশ বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে শিশিরের। রাত দশটার সময় বাড়িতে পা রাখলো শিশির। বাড়িতে আসা মাত্রই শিরিনা বেগম অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিলো। কিন্তু শিশির একটু টু-শব্দও করলো না। নিজের রুমে নির্বিঘ্নে চলে এলো। বিন্দু কণাকে রিদির কাছে দিয়ে সেও রুমে আসলো। শিশির শার্ট,প্যান্ট কিছুই চেঞ্জ না করে বিছানার ওপর হাত-পা মেলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। পা গুলো খাটের নিচে ঝুলছে। বিন্দু এসে ফ্যানটা ছেড়ে দিলো। পাশে বসলো নিঃশব্দে। গলার স্বর নরম করে বললো,
–কী হয়েছে আপনার?”
শিশির চোখের পাতা মেলে বিন্দুর দিকে তাকালো। ভেতরটায় কেমন যেন হু হু করে উঠলো শিশিরের। শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিন্দুর দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে। বিন্দুও শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে। শিশিরের চোখে অনেক অনেক ভয়! কাউকে ধরে রাখার আঁকুতি! বিন্দু আবারও প্রশ্ন করলো,
–কী হয়েছে?”
শিশির চোখ সরিয়ে নিলো। চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। এই জল একদম বিন্দুকে দেখানো যাবে না। তাহলে যে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে শিশির। চোখের জল লুকানোর জন্য শিশির সেখান থেকে ওয়াশরুমের দিকে যেতে নিলো। তখনই বিন্দু খপ করে শিশিরের হাতটা ধরে ফেললো।
–কী হয়েছে আগে আমাকে বলবেন তারপর ওয়াশরুমে ঢুকবেন। আর ওইদিকে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার দিকে ফিরুন৷ সারাটাদিন আমি পাগলের মতো আপনার ফোনে ট্রাই করেছি। এত কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ হয়? কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি ধারণা আছে আপনার?”
শিশির ধরা ধরা গলায় বললো,
–এত ভয় পাওয়ার কী আছে। মরে তো আর যাইনি!”
বিন্দুর মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল। ধমক দিয়ে বললো,
–অন্যায় করেছেন কোথায় স্যরি বলবেন, তা না উল্টো মরার কথা বলছেন? মরেই দেখুন না। হাত-পা বেঁধে তারপর মারবো আপনাকে। আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার বুঝি খুব শখ হয়েছে?”
এবারে আর সহ্য করতে পারলো না শিশির বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো।
–বিন্দু তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? বিশ্বাস করো তোমাকে ছাড়া, কণাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারবো না। আমি নির্ঘাত মরে যাব।”
বিন্দু আশ্বাস দিয়ে বললো,
–কোথায় যাব আমরা বলুন তো? আপনিই তো আমাদের সব। তাহলে আপনাকে ছেড়ে কী করে যাব বলুন?”
শিশির বিন্দুকে ছেড়ে বিন্দুর পাশে বসলো। বিন্দুর ডান হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে কোনো রকম ভণিতা না করেই বললো,
–বিন্দু শিহাব ফিরে এসেছে। ও মরেনি, ও বেঁচে আছে। অনেকদহন যাবৎ ও কোমায় ছিলো।”

পুরো পৃথিবী ঘুরতে লাগলো বিন্দুর এ কী শুনছে সে। এটা কী কোনো স্বপ্ন? না না এটা কী করে স্বপ্ন হবে? এই তো শিশির ওর হাত নিজের মুঠোয় ধরে রেখেছে। হাত-পা ঝিনঝিন করছে বিন্দুর। চোখে-মুখে যেন অন্ধকার দেখতে লাগলো। শিশির আবারও বলতে শুরু করলো,
–শিহাবের ধারণা আমি তোমাকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছি। ও এখনো বিশ্বাস করে তুমি ওকে ভালোবাসো। আর ও মনে করে কণা ওর মেয়ে। ও চায় তোমাদেরকে ওর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। ও আমার কোনো কথাই শুনতে চায় না। আজ এ বাড়িতে তোমাকে আর কণাকে এসে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। এই বিন্দু সত্যিই কী তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? বিশ্বাস করো আমি কোনো ছল-ছাতুরি করিনি। আমি তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিলো। তারপর তোমাকে যখন আমি ভালোবাসি বললাম তুমি তখন ভয় পেয়েছিলে আর আমি তখন তোমাকে বলেছি, আমি মজা করে তোমাকে ভালোবাসি বলেছি। কিন্তু সেটা সত্যি নয় আমি সেদিন যে তোমাকে ভালোবাসি বলেছি সেই কথাটা সম্পূর্ণ সত্য বলেছি। খুব ভালোবাসি তোমায়। কিন্তু তাই বলে আমি কোনো মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তোমাকে বিয়ে করিনি বিন্দু। ”

বিন্দু এখন সব ভাবনার ঊর্ধ্বে। শিশিরের এসব কথা নিয়ে ভাবার মতো সময় নেই ওর। এখন তো ওকে অন্য কিছু ভাবতে হবে। শিশিরের হাতটা ছাড়িয়ে শিশিরকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো। শিশির এত কথা জিজ্ঞেস করলো বিন্দু একটা কথারও জবাব দিলে না। তার জবাব তো সে সঠিক সময়ে দেবে। শিশির ওয়াশরুম থেকে এসে জিজ্ঞেস করলো,
–এই বিন্দু কিছু বলো প্লিজ। না হলে আমি শান্তি পাব না।”
–কিছু বলার নেই। তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে আসুন সবাই একসাথে খাব।”
শিশির বিন্দুর ভাবমূর্তি কিছুই বুঝতে পারছে না। বিন্দু এতটা স্বাভাবিক কী করে আছে সেটাও শিশির বুঝতে পারছে না । এই বিন্দুকে বড্ড অচেনা লাগছে শিশিরের। খাবার টেবিলে বসেও কী সুন্দর চুপচাপ খেয়ে নিলো বিন্দু কিন্তু শিশিরের খাওয়া আটকে গেছে। বারবার বিন্দুর দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু বিন্দুর মধ্যে যেন কোনো ভাবান্তরই নেই। ঘুমাতে এসেও বিন্দু শিশিরের বুকে বরাবরের মতোই মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। চিন্তাটা আরও বেড়ে যাচ্ছে শিশিরের। তবে কী সত্যি সত্যিই বিন্দু কালকে চলে যাবে? তাহলে আজ এমন কেন করছে?
–বিন্দু একটু কথা ছিলো।”
বিন্দু শিশিরের বুকে চুমু এঁকে বললো,
–এখন কোনা কথা নয়৷ চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ুন। বেশি কথা বললে কিন্তু…”
শিশির ভয়ে চুপসে গেল। আর কোনো কথা মুখ থেকে বের হলো না।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here