#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২২
আফনান লারা
.
স্টেজের সামনে চটের বস্তার উপরে বসে আছে বেশিরভাগ মানুষ।সবার হাতে একটা করে হাতিয়ার।স্টেজটা নামেই মনে হয় স্টেজ।ফুল দিয়ে তো সাজিয়েছে ভেতরে যাবার গেটটা।স্টেজে শুধু রঙ বেরঙের বেলুন লাগানো।সেখানে বসে আছে তিনজন।একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলে লুঙ্গি পরা,সে বেলুন হাতে পাশের জনের সঙ্গে কিসব বলছে।পাশের জন হলো কিশোর বয়সী একটা ছেলে।সেও একই বেশে।তাদের ঠিক পেছনে একজন বসে আছে।মাথায় বরের টুপি না পরলে অর্ণব জানতোইনা এটা বর।দেখে ডাকাত ছাড়া কিছু মনে হচ্ছিলো না প্রথমে। কিন্তু টুপিটা বলে দিচ্ছে হ্যাঁ এটা বর।তুমি ভুল ভাবছো এতক্ষণ।
অর্ণবকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা লোকটা ওকে ধরে একটা কাঠের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন,’জানি না কি জন্যে আইলা এহানে।তয় তোমারে যাইতে দেয়া যায়না।বিয়া অই গেলে যাইও।কে জানে তুমি আবার যদি পুলিশে খবর দিয়া আমাগো বিয়ার আসর খারাপ করো?’
অর্ণব চুপ করে বসে রইলো।সেই মেয়েগুলোর দল থেকে একটা মেয়ে হাতে করে মিষ্টি একটা আর সন্দেশ একটার বাটি অর্ণবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হেসে চলে গেছে আবার।অর্ণবের গলা দিয়ে তার নিজের ঢোক যাচ্ছেনা, এই মিষ্টি তো লাঠি দিয়ে ঠেলা মারলেও গলা দিয়ে যাবেনা।বাটি হাতে বসে সে শুধু সেই বরকে দেখছে।আশ্চর্যের বিষয় হলো বর নিজেও একটা বড়সড় হাতিয়ার নিয়ে বসে আছে।ডাকাত নাকি দস্যু তাই ভাবছিল সে ঠিক সেইমূহুর্তে ওর সামনে দিয়ে গেলো তিনজন বয়স্ক দস্যু।তারা ঐ বালক দুটোকে স্টেজ থেকে উঠিয়ে বরের পাশে বসলেন ঠেসেঠুসে।
অর্ণব এবার তাদের দেখছে।তাদের মাঝে একজন জোর গলায় বললেন,’কনে তৈরি তো নিয়ে আসোনা এদিকে।পর্দা টাঙানো হচ্ছে।এত দেরি করা যাইবোনা।পুলিশ আসতে কতক্ষণ? ‘
দুটো ছেলে ভেতর থেকে লাল রঙের শাড়ী একটা এনে স্টেজের পাশে লম্বা করে টাঙিয়ে দিলো।তারা চলে যাবার পর ভেতর থেকে লীলাবালি গানটা আরও জোরে ঘাড়ো করে শোনা যাচ্ছিল।সবাই এদিকেই আসছে এখন।
অর্ণব কৌতূহল নিয়ে লাল শাড়ীটার দিকে তাকিয়ে আছে।বিয়েতে আসলে সবার আকর্ষণ থাকে বর আর বধুর প্রতি।অর্ণবের ও হয়েছে ঠিক তাই।
একজন হুজুর ও এসেছেন।তার চেহারা দেখে মনে হলো তাকে জোর করে এনে বসিয়ে রেখেছে ঠিক কোণায়।তিনি বারবার অর্ণবকে দেখছিলেন।তার চোখ যেন বলছে, বাবা আমারে বাঁচাও!
কনে কে শাড়ীর ওপাশে এনে বসানো হয়েছে।সে আসার দশ সেকেন্ডের ভেতর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললো,’আমি এই বিয়ে করবোনা।আপনারা আমায় মেরে ফেলুন তাও আমি বিয়ে করবোনা’
এই দুটো লাইন শুনে অর্ণবের চোখ গেলো সেদিকে।কণ্ঠটা অনেক চেনা লাগলো।এতই চেনা যে দেখে নিশ্চিত হবার সময় হয়ে দাঁড়ালো এখন।আওয়াজটা পেয়েই সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।সোজা শাড়ীটার কাছাকাছি যাওয়া ধরতেই দু একটা ছেলে এসে ওর বুকে হাত ধরে থামিয়ে চুপ করে থাকলো।অর্ণব শাড়ীটার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।
হুজুর দোয়া করে বরবেশে যে বসে আছে তাকে কবুল বলতে বললেন। সে কবুল বলার পর্ব শেষ করার পর এবার কনের পালা আসলো।
ওপারের মেয়েটা আবার চেঁচামেচি করে বললো,’সে মরে গেলেও তাকে যেটা বলতে বলেছে সেটা সে বলবেনা’
এবার বরবেশে যে বসে ছিল সেই ডাকাতের মতন দেখতে ছেলেটা স্টেজ থেকে নেমে দাঁড়ালো।হাতিয়ারটা এক পাশে রেখে পর্দাটা টান দিয়ে সরিয়ে নিচু হয়ে বসে থাকা কনের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,”তুই বিয়ে করবিনা?? তোর……!!!বল কবুল।নাহলে তুই আজ মরবি!!”
অর্ণব ছেলেটার পিঠের কারণে মেয়েটাকে দেখছেইনা।ঐছেলেগুলোর চোখের আড়াল হয়ে পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে।যাকে নিচে বসে থাকতে দেখলো কনের বেশে তাকে দেখে মাথাটা ঘুরে গেছে ওর।
এ যে কুসুম!!
লাল রঙের সুতির শাড়ী পরা মাথায় সোনালী রঙের ঘোমটা।চোখের পানি তার বাঁধ মানছিলনা।গালে হাত দিয়ে ভয়ার্ত চেখে সামনের ছেলেটাকে দেখছিল সে’
অর্ণবের আর বুঝতে বাকি নেই যে ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে এখানে।আশেপাশে ওর পরিবারের একটা মানুষকে সেও দেখলোনা,তারমানে এটাই নিশ্চিত!
কুসুম গাল থেকে হাত সরিয়ে রাখালের পাশে তাকাতেই অর্ণবকে দেখে ওর কান্না বন্ধ হয়ে গেলো মূহুর্তেই।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।এই মানুষটা এখানে কেন?উনার তো ঢাকায় থাকার কথা।এই জায়গায় তো তার ভুলেও আসার কথা নয়।
রাখাল হনহনিয়ে গিয়ে বাহিরে থেকে একটা চিকন গাছের ঢাল ভেঙ্গে এনে বললো,’বল কবুল বল!!’
কুসুম কাঁপছে ভয়ে।কিন্তু চোখ তার অর্ণবের দিকে এখনও।
ওকে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে প্রতিটা মানুষ।মুন্নি তিয়াজি কুসুমের মুখ টিপে ধরে ঘুরিয়ে বললো,’পরপুরুষকে এমন করে দেখে কেউ? বেহায়া মাইয়া!!চিনস নাকি এরে?তোর কিছু হয়?’
কুসুম কাঁপা ঠোঁটে জবাব দিলো,’আমি এনাকে চিনিনা’
রাখাল ততক্ষণে ঢাল দিয়ে একটা ঘা বসিয়ে দিয়েছে কুসুমের হাতে।বললো,’শেষবার কইতাছি কবুল বল।নাহলে আজ তোরে মাইরা আমি জেলে যামু গা’
অর্ণবের প্রচুর রাগ হলো।রাখালের হাত থেকে ছোঁ মেরে ঢালটা নিয়ে সেটাকে ফেলে পাশেই সাজিয়ে রাখা মোটা গাছের একটা ঢাল তুলে ছুঁড়ে মারলো রাখালের গায়ে বরাবর।এরপর চেঁচিয়ে বললো,’কাপুরুষ! ‘
সবাই হাতিয়ার তাক করে ধরলো অর্ণবের দিকে।রাখাল মাটিয়ে পড়ে তাকিয়ে আছে।সেখানে পড়ে থেকে বললো,’এরে কে এনেছে এখানে?মেরে বিদায় করো এখান থেকে।আমার বিয়েতে আমি কোনো জুটঝামেলা চাইনা!’
অর্ণবকে একসাথে তিনজন মিলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
অর্ণব কুসুমের দিকে তাকিয়ে বললো,”কুসুম কিছু তো বলো!’
আমির তিয়াজি থামতে বললেন ঐ তিনজনকে।তারপর কুসুমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন অর্ণবকে ও চেনে কিনা।কারণ অর্ণব তার নাম জানলো এটা তো স্বাভাবিক না।
কুসুম আবারও বললো সে অর্ণবকে চেনেনা।
আমির তিয়াজি রাখালকে নিচ থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে বললেন,’চুপচাপ ওখানে বোসো।মেয়ের মুখ থেকে কবুল কেমনে বাহির করতে অয় সেইটা আমাগো নারীদের জানা আছে’
রাখাল রাগের চোখে কুসুমকে দেখতে দেখতে বসলো।একটা মেয়ে এসে ওকে বাতাস করা শুরু করে দিছে।সে হলো কূর্নি।
অর্ণব কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।এমন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে কুসুম একদিন ও বাঁচবেনা।যে বিয়ের আগে এমন অমানবিক আচরণ করে সে তো বিয়ের পরে আরও বেশি!!
আর ও কি আমায় বাঁচাতে মিথ্যা বলছে?’
অর্ণব নিজের গা থেকে ঐ তিনজনের হাত ছুটাতেই পারছেনা।ওর চাহনি দেখে কুসুম বুঝতে পেরেছে এখন সে গন্ডগোল করে বসবে, আর এটাতে ওর মৃত্যু নিশ্চিত।তাই অর্ণবকে বাঁচাতে সে কবুল বলতে মুখ খুলতেই অর্ণব তার আগেই চিৎকার করে বললো,’ও আমার স্ত্রী’
সবাই চোখ বড় করে অর্ণবের দিকে তাকালো।রাখাল উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আমির তিয়াজি এগিয়ে এসে বললো,’কি কইলা তুমি??’
-“হ্যাঁ।আমরা বিবাহিত।কুসুম আমার বিয়ে করা বউ’
সবাই আবার কুসুমের দিকে তাকালো।কুসুম অর্ণবকে বাঁচাতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘না।উনি মিথ্যা বলছেন।আমরা বিবাহিত নই’
আমির তিয়াজির ইশারায় অর্ণবের হাত ছেড়ে দিয়েছে ঐ তিনজন।অর্ণব এগিয়ে এসে বললো,’কি বললে?তোমার মাথা ঠিক আছে?তুমি জানো এখানে কি হচ্ছে?সজ্ঞানে আছো তুমি?আমাকে আমার কথা বলতে দাও’
আমির তিয়াজি অর্ণবের হাত টেনে ধরে কুসুমের সামনে থেকে সরিয়ে এনে বললেন,’আমাগো ঘরের হবু বউ মিছা ক্যান কইবে??তুমি কোথা থেকে উড়ে আসছো মিছা কথা রটাইতে??কিসের বিয়ে হইছে তোমাদের??তাহলে সেটা কুসুম অস্বীকার কেন করছে?’
.
অর্ণবের মাথা কাজ করছেনা।সে কুসুমকে বাঁচাতে কথাগুলো বলছে আর কুসুম কিনা একের পর এক ভুলভাল বলে সব কিছুতে পানি ঢেলে দিচ্ছে। এমন সিচুয়েশনে ফেললো যে সবাইকে বিশ্বাস করানো কঠিন হয়ে যাবে।অর্ণব নিজের কপাল টিপে ধরে বললো,’আমি আমার বউয়ের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই।ও আসলে আমার সাথে রাগ করে আছে তাই এসব বলছে’
-‘কিসের একান্তে কথা?তুমি যে ওর জামাই তা আমরা কি করে বিশ্বাস করতাম?যা বলার আমাদের সামনে বলো’
-‘না সামনে বলা যাবেনা।আচ্ছা ঐ জায়গায় বলি?আপনারা দেখেন’
অর্ণব কুসুমের হাত খপ করে ধরে একটু দূরে নিয়ে আসলো।তারপর ফিসফিস করে বললো,’তোমার মাথা গেছে?আমি তোমাকে বাঁচাতে চাইছি আর তুমি সব কিছু অস্বীকার কেন করছো?’
রাখাল এগিয়ে যাওয়া ধরলো সেদিকে।আমির তিয়াজি ওকে থামালেন।
কুসুম সবার দিকে একবার তাকিয়ে অর্ণবের দিকে ফিরে বললো,’এত বড় মিথ্যা কেন বলবেন?আপনি জানেন উনারা কত মারাত্মক?উনারা দস্যু!আপনি ভালোই ভালোই চলে যান’
-‘আমি যাচ্ছিনা’
রাখাল আমির তিয়াজির হাত সরিয়ে ওদের দুজনের মাঝখানে এসে বললো’কুসু? তুই ওর বউ?’
কুসুম আবার বললো আমি উনাকে চিনিনা।উনাকে আপনারা চলে যেতে বলেন।
অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে আছে।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার।
শেষে বাধ্য হয়ে কুসুমের গালে চড় একটা বসিয়ে দিয়ে হাত টেনে ধরে ধমকিয়ে বললো,’আমারে চিনো না তুমি?এক বছর আগে আমারে বিয়া করো নাই তুমি?সব ভুলে গেছো??আবার মনে করিয়ে দিতাম?হুমমম?আর বলবা মিথ্যা??আরও কয়েকটা মারবো??’
কুসুম গালে হাত দিয়ে চুপ করে তাকিয়ে আছে।চড় খেয়ে জন্মের মিথ্যা বলবার স্বাদ মিটে গেছে।
রাখাল রেগেমেগে অর্ণবকে ঝাঁকিয়ে বললো,”তোর এত বড় সাহস তুই আমার বউরে মারস!’
অর্ণব রাখালকে ধাক্কা মেরে আবারও মাটিতে ফেলে দিয়ে বললো,’তোর এত বড় সাহস তুই আমার বউরে বিয়ে করার আগেই মারছস!’
চলবে♥
মেঘ বলেছে বৃষ্টি নামবে অর্ডার লিংক
https://www.facebook.com/Bookshelfsc/