#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫১
আফনান লারা
.
কুসুম আগের মতন মাথা নাড়িয়েছিল।দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেয়ে অর্ণব গিয়ে দরজা খুলেছে।জাহান হাতে করে রাতের খাবার নিয়ে এসেছে।কুসুম যেতে পারবে নাকি পারবেনা তাই ভেবে খাবার তারা উপরে পাঠিয়ে দিলো।অর্ণব ট্রেটা নিয়ে টেবিলে এনে রাখলো।কুসুম বিছানায় বসে দেখছিল সব।অর্ণব সেখানে থেকে জিজ্ঞেস করলো এখন খাবে কিনা।কুসুম খেতে মানা করে দিয়েছে।
অর্ণব তাই খাবারগুলো ঢেকে রেখে নিচে বসে ভাবতে লাগলো এখন টিভি হলে মন্দ হতোনা।সময় কাটানো যেতো।টাকা জমাতে হবে টিভির জন্য।কুসুম মাথা বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল ও কি করছে ওখানে।কিন্তু দেখছেনা কিছুই।
হাতে হিসাব নিকাশ করে অর্ণব আবার ফেরত চলে আসলো।কুসুমের পায়ের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’তোমার পায়ে মনে হয় মচ লেগেছে।’
এটা বলেই পা মুঠো করে ধরলো সে।কুসুম চিৎকার করে সরে গেলো।অর্ণব ওর পা আরও শক্ত করে ধরে আটকে বললো,’এ্যাই নড়বেনা।আমি শুধু পায়ের মচ সরিয়ে ফেলবো।তুমি কি চাওনা ঠিক হতে?তোমাকে কি কোলে করে নিয়ে ওয়াশরুমে যাব আমি?তুমি চাও সেটা?’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে না জানালো।কথার ছলে অর্ণব কুুসুমের পা ধরে উল্টো দিকে মোচরাতেই কুসুম এক চিৎকার দিয়ে আবার চুপ হয়ে গেছে।সাথে গেছে তার পায়ের ব্যাথাটাও।
পা ধরে হেসে দিলো সে।অর্ণব ভেংচি কেটে চলে গেছে আবার।
কুসুম নিচে নেমে অর্ণবের পিছু পিছু যাওয়া ধরতেই মনে হলো বমি আসছে।ওদিকে না গিয়ে ওয়াশরুমেই চলে গেছে সে।
ইদানিং শরীর বেশ দূর্বল লাগে।অর্ণবকে বলা দরকার বলে মনে হয়।পরে মনে হয় কম খাওয়া দাওয়ার কারণে দূর্বলতা ঝেপে বসেছে।
ওয়াশরুম থেকে বের হবার পরেই কুসুম দেখলো অর্ণব আগে থেকে কোমড়ে হাত রেখে ওর অপেক্ষা করছিল।ও বের হবার পর বললো,’রেডি হয়ে নাও।আমরা হসপিটাল যাচ্ছি।কুমিল্লার ডাক্তারের স্লো মোশন রেসাল্ট আমার চাইনা।
আজ এখানকার ডাক্তার দেখাবো।কাল রিপোর্টে দেখবো কি আসে।চলো আমার সাথে’
‘নাহ।আমি ঠিক আছি।কম খাই বলে হয়ত এমন দূর্বল হয়ে পড়েছি।
বেশি খেলে ঠিক হয়ে যাব’
‘বেশি খেতে পারছো কই?খাওয়ার আগেই তো বমি করে ফেলতেছো।আমি আর অপেক্ষা করতে পারবোনা।অসুখ ঘরে পালার জিনিস না। এটা তোমার রোগ।ঔষুধ খেলে সেরে যাবে।রেডি হতে বলেছি,রেডি হবা।এত কথা বলার কোনো মানে আছে?’
‘অনেক রাত হয়ে গেছে।আচ্ছা কাল সকালে যাব আমরা’
‘কাল আমার রেসাল্ট দিবে।আমাকে সারাদিন ভার্সিটিতে থাকতে হবে।তাই বলছি এখন চলো।রিপোর্ট দরকার হলে আমি আসার আগে নিয়ে আসবো কাল।ডাক্তার কেও দেখিয়ে নেবো।’
কুসুম মাথা নাড়লো।এক কাপড়েই অর্ণবের সঙ্গে নামলো রাস্তায়।অর্ণব একটা পানির বোতল কিনে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।বাসায় পানির গ্লাস নেই।যাবার পথে গ্লাস ও কিনতে হবে।
কুসুম বোতলের অর্ধেক পানি খেয়ে নিয়েছে এই টুকু সময়েই।একটা সিএনজি নেওয়ার পর অর্ণব কুসুমের থেকে পানির বোতল নিয়ে নিজেও পানি খেলো।
অনেকটা সময় লেগে যাচ্ছে হসপিটাল অবধি আসতে আসতে।কুসুমের সেসময়টুকুতেই ঘুম এসে গেছে।অর্ণবের ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমায় সে।
অর্ণব ভাবছিল অন্য কিছু।এমন রোগের কথা এর আগে সে শোনেনি।খেতে গেলে বমি পায়,অতিরিক্ত বমি ভাব,সারাক্ষণ মাথা ধরা।এসব কিসের লক্ষণ?
হসপিটাল আসতে আসতে রাত এগারোটা বেজে গেছে।অর্ণব কুসুমকে জাগিয়ে তুলে নামতে বললো।ভাঁড়া দিয়ে ওর হাত ধরে হসপিটালের ভেতরের দিকে গেলো সে।একজন নামকরা ডাক্তারের সিরিয়াল নিয়েছে।অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে।রুগীর লম্বা লাইন।
কুসুম বসে বসে হাই তুলছে।অর্ণবের মনে হলো হয়ত ওর খিধে লেগেছে।ক্যানটিন থেকে একটা স্যান্ডুইচ কিনে এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিলো আর অন্য হাতে সুপারির টুকরো তিনটে।বললো বমি আসলে সুপারি মুখে পুরে নিতে।
‘আপনি খাবেননা?’
‘খিধে নেই।’
অর্ণব এবার হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে গেলো।ঠাণ্ডায় গা কাঁপছে কুসুমের।হাসপাতালে সব খানে এসি অন করা।আঁচল টেনে কাঁধ ঢেকে নিলো সে।আশেপাশে সব রোগী আর তাদের পরিবারের মানুষজন।সবাই অপেক্ষা করছে ডাক্তারের।
রাত বারোটা দুই মিনিটে এসে কুসুমের সিরিয়াল ডাকা হলো।৭৬।
অর্ণব কুুসুমকে নিয়ে ঢুকেছে রুমে।ডাক্তারকে সালাম দিয়ে দুজনে বসলো।ডাক্তার কুসুমের থেকে জানতে চাইলেন ওর কি সমস্যা। সে পুরোটাই বললো।খাওয়ায় অরুচি,সকাল থেকে রাত অবধি মাথা ধরা,অতিরিক্ত বমি আসা। বমির কারণে খেতে না পারা,চুলে হাত দিলেই অনেকগুলো চুল উঠে আসা।
ডাক্তার সব শুনে বেশ কয়েকটা টেস্ট দিলেন।এরপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললেন,’লক্ষণ ভাল দেখছিনা।যত্ন নিবেন উনার।রিপোর্ট আসা পর্যন্ত কিছু বলতেও পারছিনা।মেন্টালি স্ট্রং থাকবেন আশা করি’
ডাক্তার উঠে তার প্রাইভেট রুমে চলে গেছেন।অর্ণব প্রেসক্রিপশন নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বের হতে হতে ভাবলো এসব বলার কারণ কি হতে পারে।
গলা শুকিয়ে গেছে তার।কুসুমকে বললো পানি দিতে।সে খালি বোতল দেখিয়েছে।প্রেসক্রিপশনটাকে রিসিপশানে দিয়ে অর্ণব কুসুমকে বললো নার্সের সাথে যেতে।ও পানি খেয়ে ফিরবে।কুসুম তাই নার্সের সাথে চলে গেলো।
টেস্ট করাতে করাতে বেজে গেলো রাত ১টা।অর্ণব আর কুসুম এবার গাড়ী খুঁজতে খালি পথে হেঁটে চলেছে।কুসুম মাথার চুলগুলো বারবার করে কানের পেছনে গুজতে গুজতে বললো,’আমার কি হয়েছে বুঝলাম না।ডাক্তার এত ভয় দেখালো কেন?’
‘কিছু হয়নি।ডাক্তাররা ওমন বলে।’
‘তাহলে আপনার মন খারাপ কেন ওতো?’
‘কই মন খারাপ?সিএনজি পাচ্ছিনা তাই মুড অফ’
‘সেটা মানে কি?’
‘মন খারাপ’
‘আমার বলা মন খারাপ আর আপনার বলা মন খারাপ আলাদা জিনিস?মানে মুড অফের অর্থ যে মন খারাপ সেই মন খারাপ আর আমার বলা মন খারাপ আলাদা?’
‘তোমার বমি পাচ্ছেনা এখন?মাথায় যন্ত্রনা করছেনা?’
‘আমি অসুখের কথা মনে করলে কিংবা অসুখের বাস্তব কোনো রুপ দেখলে তারপর বুঝি আমার অসুখ।তার আগে বুঝিনা।এখনও তাই’
অর্ণব হাত বাড়িয়ে সিএনজি একটা থামালো।তিনশ টাকার ভাড়া পাঁচশ চাইতেছে।পাঁচশ ছাড়া যাবেইনা।অর্ণব বাদ দিয়ে আবার হাঁটা ধরলো।আকাশে চাঁদ নেই।চিকন চাঁদ এত জলদি গায়েব হয়ে যায়।কতবার করে কুসুম আকাশের দিকে তাকিয়েছিল।এত সুন্দর একটা সময়ে চাঁদ থাকলে সোনায় সোহাগা হয়ে যেতো।
‘আফসোস, আমার বেলায় একটার কমতি থাকবেই থাকবে।”
অর্ণব হঠাৎ ফুটপাতের কিণারায় বসে গেলো।কুসুম ওর দেখাদেখি নিজেও বসেছে।
গায়ে ফু দিয়ে চুলগুলোকে টেনে ধরে অর্ণব বললো,’হাঁপিয়ে গেলাম।আজ অনেক পরিশ্রম হয়েছে’
‘আমারও মুড অফ’
অর্ণব কুসুমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।কুসুম হেসে বললো,’কেন মুড অফ শুধু আপনার হয়?’
‘রোগীর কত পাগলামি!’
কুসুম আর কিছু বললোনা।নতুন কেনা পানির বোতলটা নিয়ে ঘুরাতে লাগলো।সামনে দিয়ে রিকশা চলছে।অনেক সময় পর যাচ্ছে প্রাইভেট কার ও। কিন্তু সিএনজির দেখা মিলছেনা।কুসুমের শীত করছে আরও বেশি করে।বারবার অর্ণবের গা ঘেঁষে বসছিল সে।অর্ণব শেষে ঠিক করলো পাঁচশ হলেও সেটাতেই রাজি হবে।বেশি রাত বাহিরে থাকা ঠিক হবেনা।উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় হাঁটা ধরেছে সে।কুসুম ও ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটা চালু রেখেছে।অনেক সময় হাঁটার পর একটা সিএনজি পেলো তারা।কিন্তু আশ্চর্য হলো ঐ সিনএজি ছয়শ ছাড়া যাবেনা।এ দেখি আগুন দাম।অর্ণব মনে মনে নিজেই নিজেকে বকছে।কেন তখন ঐ সিএনজিটাকে যেতে দিল তাই ভেবে।বাধ্য হয়ে ছয়শতেই রাজি হলো।কুসুমকে নিয়ে উঠে পড়লো তাতে।গাড়ীতে উঠে ফোনে একটা গেমস খেলছিল সে সময় কাটাতে।কুসুম সেসময়টায় ওর বাম হাতের আঙ্গুল ধরে ধরে দেখছিল।বিষয়টা সে খেয়াল করেনি।
কুসুম যখন বুঝতে পারলো অর্ণব খেয়াল করছেনা তখন সে হাতটাকে নিয়ে নিজের মাথায় রাখলো।অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়ে ওর দিকে চেয়ে বললো,’ওমন করছো কেন?’
‘মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন একটু?’
ওর এমন অদ্ভুত আবদার শুনে অর্ণব চুপচাপ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারও গেমসে নজর রেখেছে।কুসুম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।অনেক কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা।কিসের যেন বাধা এসে থামে সামনে।বলতে চেয়েও হয়ে ওঠেনা।
কুসুম অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়েই ছিল।পলক ফেলছিলনা।
গাড়ীর ধাক্কায় হুশ ফেরার পর সিটে পিঠ ঠেকাতে গিয়ে খেয়াল করলো অর্ণবের হাত গিয়ে গ্রিল ধরেছে সিএনজির।সে অবাক চোখে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অর্ণব বললো,’পেছনে কিসের যেন বাক্স।তুমি হয়ত পিঠে ব্যাথা পাবে তাই হাত দিয়েছি।ওমন ভূত দেখার মতন চেয়ে থাকতে হবেনা’
—-
জুথি বারান্দায় একটায় বিনব্যাগে বসে চোখ বন্ধ করে স্যাড সং শুনছিল।রুম অন্ধকার,বারান্দা অন্ধকার।আলো বলতে দূরের ল্যাম্পপোস্টের।হঠাৎ কিসের যেন আওয়াজ লাগলো কানে।চোখ মেলে উঠে দাঁড়ালো সে।রেলিংয়ে হাত রেখে নিচে তাকিয়ে ভালো করে দেখলো।কিন্তু কোনো কিছুর দেখা মিললোনা।তাই কানে আবারও ইয়ারফোন গুজে যেইনা সে পেছনে ফিরতে গেলো সামনে গোটা দেহের একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক চিৎকার করা ধরলো সে।ঠিক তখনই পাশের মানুষটা ওর মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,’আমি মৃদুল’
জুথি হাত দিয়ে মৃদুলের বুকে কয়েকটা কিল ঘুষি মেরে দিয়েছে।মৃদুল হেসে ওর মুখ থেকে হাত সরালো।
জুথি ইয়ারফোন খুলে বললো,’আপনি এখানে কেন?তাও এ সময়ে?দূরে থাকতে বলেছিলাম।এত কাছে আসতে বলিনি’
‘কি করবো,তোমার ব্লক খেয়ে ঘুম আসছিলনা।বেশি থাকবোনা।জাস্ট এক ঘন্টা’
‘এক ঘন্টা!এতকাল কি করবেন আপনি?’
‘তুমিও ছ্যাঁকা খেয়েছো।আমিও খেয়েছি।সুতরাং রাত কত সময় জেগে থাকা হলো তা আমাদের দুজনের মাঝে একজনেরও ভাবার কথা না।
আর কি করবো জানতে চাইতেছো?তো শোনো,প্রথমে তোমার বাবার রুম টপকে রান্নাঘরে গিয়ে নুডুলস বানাবো।তারপর কফি।তারপর গান শুনাবো তোমায়।কয়েক মিনিট অসহ্যকর জ্বালাতন করবো তোমায়।তারপর একটা সুন্দর অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে মৃদুল, মৃদুল হাওয়ায় বিলীন হয়ে যাবে।তখন তুমি চাইবে আর একটিবার সেই অনুভূতির সাথে মিশে যেতে।কিন্তু মৃদুল আসবেনা।’
জুথি ব্রু কুঁচকে বললো,’কেন আসবে না?’
‘কারণ তুমি আমায় দূরে থাকতে বলেছো তাই’
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/