#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫৮
আফনান লারা
.
বাবার একটা জরুরি কাজ মনে আসায় তিনি ভেতরের রুমে চলে গেছেন।এদিকে জুথি কাছে এসে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,’তখন না চলে গেলেন?আবার আসার মানে কি?আর বাবাকে কি বললেন যেন?আমি আপনার খোঁজ নেইনা?আমি অকৃতজ্ঞ?? ‘
মৃদুল মুচকি হেসে বললো,’আসলে সেটা না।তোমার বাবার সামনে একটু নিজেকে দায়িত্ববান,কেয়ারিং সাজালাম।তার মেয়ে তো আমায় বোঝেনা।
কেমন অকৃতজ্ঞ সে সেটাকে একটু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম’
জুথি কোমড়ে হাত রেখে বললো,’যাবেন আপনি?’
মৃদুল উঠে দাঁড়িয়ে চুলগুলোকে ঠিক করে দিয়ে হালকা কেশে বললো,’আবার আসবো!
বারান্দা!!!খোলা কাঠিবিহীন চুল!!ঐ বিনা লিপস্টিকের ঠোঁট!’
জুথি ধাক্কা মেরে ওকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে ফেলেছে।
এরপর দম ফেলে মুচকি হাসলো সে।ওকে পাগল বলে রুমে ফেরে গেছে।
—
অর্ণবের রুমের পাশে যে সরু বারান্দাটা আছে সেটার বর্ণনা তো দেওয়াই হলোনা।সেটার গ্রিল আবার ছাদ থেকে ফ্লোর ছুঁই ছুঁই।অর্ণব কুসুমের হাত ধরে ওকে সেখানে নিয়ে এসে বললো গ্রিল দিয়ে পা বের করে পা ঝুলিয়ে বসতে।কুসুমের কাছে ব্যাপারটা শুরুতে কেমন লাগলেও ওর কথামতন সেরকম করে দেখলো আসলেই অনেক ভাল লাগে।অর্ণব নিজেও ওর পাশে বসলো তবে সে পা ঝোলাতে পারেনি।কুসুমের পা চিকন বলে গ্রিল দিয়ে ঢুকেছে।কিন্তু অর্ণবের গেলোনা।তাই সে গোল হয়ে বসে পড়লো।
দুজনেই চুপ এখন।রাতের আকাশে কোটি তারার গেট- টুগেটার বসেছে।নিচে তারা দুজন দর্শনার্থী। তারা দেখা অনেক হওয়ায় কুসুম তেমন মনযোগে দেখছিলনা।কিন্তু অর্ণব গভীর মনযোগে দেখছে তারাগুলো।পড়াশোনার চাপে অনেকদিন তারা দেখা হয়না তার।
মোট কথা আকাশের দিকেই তাকানো হয়না।আর আজ তাকিয়ে মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটা সে দেখছে।ওকে চুপ করে থাকতে দেখে কুুসুম বললো,’আপনি গান পারেন?’
‘নাহ।ভাঙ্গা গলায় আবার গান!গাছের পাতা ঝরে যাবে’
‘গেয়ে দেখুন পাতা এত সহজে ঝরবেনা’
‘শীতকাল শেষ।বসন্তের শুরু।পাতা সব ঝরে নতুন উঠছে।এখন গাইলে গাছ আমার গলাট স্বরকে দোষ দেবে’
কুসুম ফিক করে হেসে ফেললো।ওর হাসি দেখে অর্ণব হাত বাড়িয়ে ওর নাকের উপর রেখে বললো,’এত জোরে হাসবেনা।নাক থেকে কয়েক মিনিট আগে রক্ত ঝরেছিল মনে আছে?’
‘হুম।কেন ঝরেছিল জানেননা?’
‘নাহ।বাদ দাও ওসব,তারা দেখো।দেখবে নিজেকে তারার খুব কাছে মনে হয় যেন ছোঁয়া যাবে এমন।দেখো দেখো’
কুসুমের চোখ ছিল অর্ণবের দিকে।ওর কথার উত্তরে সে বললো,’জানি।এই তারা আমি আরও অনেক দেখেছি।হয়ত আপনি আমার মতন করে প্রতিদিন দেখেন না।দেখবেনই বা কি করে।সময় পেলেই তো ফোন নিয়ে বসেন।অথচ যারা ফোন চালায় না তারা প্রকৃতির সব কিছু উপভোগ করে।যেমন ধরুন এই তারা।শেষ কবে দেখেছিলেন হয়ত আপনার মনে নেই।কিন্তু ফোন দেখেছিলেন বড় জোর এক ঘন্টা আগে’
অর্ণব কুসুমের দিকে ফিরে বললো,’আমার ফোন ধরাতে হিংসে হয় তোমার?তোমাকে হিংসা কে শিখিয়েছে?’
‘হিংসা কেন করতে যাবো?কেউ শেখায়নি।কিছু স্বভাব ভেতর থেকে তৈরি হয়।কেউ শেখাতে হয়না।যেমন ধরুন আমার নাকের রক্ত মুছে দেওয়া,আমার মাথা টিপে দেওয়া এগুলো কি কেউ শিখিয়েছিল আপনাকে?কিন্তু আপনি করছেন।’
‘তর্কে আমি ফেল।চলো খাবে’
‘আমি পরে খাবো।খিধে নেই বললেই চলে।যেকোনো সময়ে বমি এসে যাবে’
অর্ণব উঠে চলে গেলো বাবা মাকে খেতে ডাকতে।কুসুম পেছনে তাকিয়ে তাদের সবাইকে খেতে দেখছে।বাহিরে থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে আছড়ে পড়ছে বারবার।অর্ণবের বন্ধুসুলভ আচরণ কুসুমের কেমন যেন হজম হচ্ছেনা।তার মনে হয় তার অসুস্থতার জের ধরে অর্ণব তাকে পছন্দ করছে।এমনিতে তো সে কখনওই ওকে পছন্দ করতো না,সহ্যই করতে পারতোনা আর সে কিনা এখন কত যত্ন নেয়।
সে চেয়েছিল অর্ণব মন থেকে তাকে পছন্দ করুক,সুখে দুঃখে পাশে থাকুক।কিন্তু এভাবে পাশে থাকা তার কাছে অসহ্যকর লাগে মাঝে মাঝে।অসহ্যকর লাগে নিজের রোগের প্রতি।সে তো এমনটা চায়নি।
সে চেয়েছিল অর্ণব তার মোহে পড়ে মন থেকে ভালবাসবে তাকে, আপন করে নেবে।
কিন্তু এটা তো তার উল্টোটা হচ্ছে।এমনটা কেন হয়!
‘রোগের বাহানা দিয়ে আমি তার মনে জায়গা নিতে চাইনা।কোনোদিনও না।এটাতে তো ভালবাসা প্রকাশ হচ্ছেনা।একজন রুগীর সেবা সবাই করে।এটা তো স্বাভাবিক।কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা আমার মাথায় বিষের মতন লাগে।রোগটা যেন আজই ভাল হয়ে যায়।তারপর দেখবো উনি সত্যি সত্যি আমার দায়িত্ব পালন করতে চান নাকি পরিস্থিতিতে পড়ে এমনটা করে যাচ্ছেন’
যখনই সে উঠে দাঁড়ালো ঠিক তখনই অর্ণবের মা এসে দাঁড়ালেন সেখানে।হাতে এক প্লেট খাবার।তিনি নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দিতে এসেছেন।শুরুতে কুসুম অনেক মানা করলেও তার জোরাজুরিতে হার মেনে গেলো।
ওকে পেট পুরে খাইয়ে দিয়ে তবে তিনি ছাড়লেন।
রাতে পান সুপারি খেতে খেতে তারা আবার তাদের রুমে চলে যাবার পর অর্ণব নিজেও একটা পান নিয়ে এসে বসেছে কুসুমের পাশে।কুসুম বললো সেও একটুখানি খাবে।অর্ণব দিতে চাইলোনা কিন্তু ওর আগ্রহ দেখে পানের অর্ধেকটা দিয়েছে।কুসুম পান চিবোতে চিবোতে বললো,’আমি এর আগেও খেয়েছি, যখন বাড়িতে ছিলাম তখন।জর্দা দিয়ে,মাথা ঘুরতো অনেক।এখানে জর্দা আছে?’
‘তোমায় সামলাবে কে?আমি পারবোনা’
‘আমাকে সামলাতে হবেনা।আমি সোজা হয়ে শুয়ে পড়বো’
‘দরকার নেই।চুপচাপ মুখে যেটা আছে ওটা চিবাও।কোনো জর্দা পাবেনা’
কথাটা বলে অর্ণব নিজের মুখেই জর্দা দুই চিমটি পুরে দাঁত কেলিয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে।
কুসুম গাল ফুলিয়ে তার পানের চিবানো অংশটা ফেলতে বাহিরে গেছে।ফিরে এসে দেখলো অর্ণব মরার মতন বিছানায় শুয়ে আছে।দুই হাত দিয়ে বিছানার চাদর খাঁমছে ধরে চোখ বড় বড় করে উপরের ছাদ দেখছে।কুসুম এগিয়ে এসে বললো,’ঘুরছে মাথা?পান ফেলে দেন।আচার খাবেন একটু?’
‘সরো তুমি!ছাদ ঘুরতেছে।ভেঙ্গে মাথায় পড়বে এখন।সরো সরো’
কুসুম ওর কাছে বসে কপালে হাত দিয়ে বললো,’জর্দা বেশি খেয়েছেন এই পান গিলিয়েন না।ফেলে দিন, নাহলে অবস্থা আরও খারাপ হবে’
অর্ণব মাথা ঘুরিয়ে কুসুমের দিকে তাকিয়ে বললো,’কোঁকড়া চুলের মেয়েটা এতগুলো কেন!একটারে সামলাইতে আমার রফাদফা হয়ে যায়, এখানে এতগুলো কেন!সরো তুমি ছাদ ভেঙ্গে পড়বে’
কুসুম হাসবে নাকি কাঁদবে তা বুঝতে পারছেনা।অর্ণব বিছানার চাদর রেখে ওর হাতটা খাঁমছে ধরেছে এবার।এত খারাপ লাগবে জানলে জীবনেও মুখে দিতোনা সে। ছোটবেলায় নাকি একবার পাউরুটির সাথে মিশিয়ে জেলির মতন করে খেয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছিল ওকে। সেই ঘটনার কথা তার মনে নেই,মা বাবা বলেছে ওকে।এখন নিজেকে ম্যাচিউর মনে করে সে তাই জর্দা মুখে পুরেছে তাও বেশি করে।কুসুম হাত ছাড়াতে গিয়েও পারলোনা।অর্ণব নখ চামড়াতে ঢুকিয়ে খামঁছে ধরে আছে।চোখ বন্ধ করে কুসুমকে চলে যেতে বলছে সে শুধু।
এদিকে ওর হাত যে শক্ত করে ধরে আছে সেটা সে নিজেও জানেনা।কয়েক মিনিট পর জর্দার রেশ শেষ হতেই সে উঠে বসলো।কুসুম গালে হাত দিয়ে ওর হুশ ফেরার অপেক্ষা করছিল।অর্ণব যখন টের পেলো সে ওর হাত চেপে রেখেছে তখন সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিয়েছে।কুসুম নিজের হাতটা ধরে দেখে বললো,’আমাকে খেতে দেননি।এরপর নিজে খেলেন কেন?’
অর্ণব চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।পান খাওয়ায় লাল টুকটুকে হয়ে আছে ওর ঠোঁটজোড়া।আজ সেই লাল জবা ফুল অনেক মিস করছে সে।এখন কানে জবা ফুল হলে যেন সব কিছু পূর্ণতা পেতো।কুসুম ওকে ওমন করে চেয়ে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে বললো,’ঘুমাবেননা?কুলি করে আসেন নাহলে সারা রাত মাথা ঘুরাবে’
অর্ণব চুপচাপ রোবটের মতন হেঁটে চলে গেছে ওয়াশরুমের দিকে।কুসুম বিছানার চাদর টেনেটুনে এক কোণায় গিয়ে বসে বসে নিজের হাতটা দেখছিল।ব্যাথা পেয়েছে তবে কেন যেন অনেক ভালো লাগা কাজ করছে।
হাত মুখ ধুয়ে অর্ণব পুনরায় বিছানায় এসে শুয়ে আছে।কুসুম পাশেই বসে ছিল।শুরুতে তার কখনও ঘুম আসোনা।ড্রিম লাইটের আলোয় সে অর্ণবের দিকে চেয়ে বসেছিল।অর্ণব চোখ বুজে আছে।তার যে ঘুম এসেছে তা নয়।সেও জেগে তবে নিরব।
প্রতিদিন শুরুতে কুসুমের বসে থাকার একটা অন্য কারণ আছে, সেটা হলো অর্ণবের গায়ের গন্ধটা বসে বসে নেওয়া।শুয়ে থাকলে যেন ঠিকঠাক ভাবে উপভোগ করা যায়না তাই বসে বসে গন্ধটা নেবে।এই মানুষটা জানেওনা তার তায়ের গন্ধে কত জোর।এত জোর যে মাঝে মাঝে অনেক ইচ্ছে হয় জড়িয়ে ধরে ঘুমের নেশায় মত্ত হয়ে যেতে।খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছা হয় কিন্তু সেটা সম্ভব না।
তবে গায়ের গন্ধ পাবার সৌভাগ্য হয়েছে এটাই বা কম কিসের?
জীবনে কুসুম যেটাই পেয়েছে সেটাকেই আপন করে নিয়েছে। কমতিগুলোকে বড় করে দেখেনি।যেটা পেয়েছে সেটাতে ঐ কমতির ভরণপোষণ খুঁজে নেয় সবসময়।
অর্ণব হঠাৎ মাথা তুলে বললো,’কি??ঘুমাবেনা?নাকি অন্ধকারে ওমন ফ্যালফ্যাল করে সারারাত ধরে আমায় দেখে যাবে?’
‘আমার তো প্রথমেই ঘুম আসেনা।আপনি ঘুমান।একটা সময়ে আমিও ঘুমাবো’
‘শোও।শুয়ে পড়লে ঘুম আপনা আপনি এসে যায়।এত টালবাহানা করতে হবেনা তোমায়’
কুসুম অর্ণবের ধমক শুনে ওর পাশে শুয়ে পড়েছে।অর্ণব একটা হাত নিয়ে ওর মাথার উপর দিয়ে বালিশের ওপারে রাখলো।কুসুমের এবার কেমন কেমন লাগা শুরু হয়ে গেলো।সে সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে পারছেনা আর।কি যেন তাকে বারবার করে খোঁচা মেরে বলছে উঠে বসতে।অর্ণব আগে কখনও এমন করেনি বলে হঠাৎ করে এটা নিতে পারছেনা সে।এদিকে অর্ণব এমন ভাব ধরে আছে যেন এটা কিছুইনা।সিম্পল একটা ব্যাপার
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/