#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০
অন্ধকার রাজমহলের বাইরে কালো রঙের গাছের পেছনে লুকিয়ে আছে ভাবনা। মনের মাঝে এক রাশ ভয় নিয়ে থাকলেও তা প্রকাশ করছে না সে। কথায় আছে, ভয়কে মনে যত জায়গা দেবে ততই তুমি পিছিয়ে যাবে।
এই ওয়ারওল্ফ রাজ্যে সবকিছুই ভয়ানক। কোথাও কোনো সুন্দর পরিবেশ নেই। গাছপালা, লতাপাতা দিয়ে ভর্তি। গাছপালার রঙ যে সবুজ হয় তাও নেই এখানে। এটা কালো রাজ্য। কালো রাজ্যে সবটা কালো এবং অশুভ হবে এটাই স্বাভাবিক। ওর সঙ্গে কিং প্রলয় আসতে চাইলেও বাঁধা দেয় ভাবনা। সে কিং কে বুঝিয়ে বলেছে, উনার মাঝে যদি একবার শয়তান সত্তা প্রবেশ করে তাহলে রাজ্যের ক্ষতি হবে। আর সৈন্য নিয়ে গেলেও এতে কাজের ব্যাঘাত ঘটবে। এই জায়গাটি কালো জাদু তে ভরা। সেকারণেই এতো দিনে কোনো ভ্যাম্পায়ার সাহস করেনি এখানে এসে যুদ্ধ করে এদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার।
আশেপাশে তাকিয়ে ভাবনা খুঁজতে থাকে রাজমহলের ভেতরে ঢোকবার রাস্তা। কোনো উপায় খুঁজে পায় না সে। উদাস হয়ে পড়ে ভাবনা। তৎক্ষনাৎ কয়েক হাত দূরে থাকা একজন ওয়ারওল্ফকে দেখে মাথায় বুদ্ধি আসে ওর। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে থাকে সে। ওয়ারওল্ফটি তার শব্দে গাছের কাছে ছুটে আসে। সঙ্গে সঙ্গে কৌশলে নিজের আসল রুপ বের করে হামলা করে ভাবনা। সেখানেই মেরে ফেলে ওয়ারওল্ফকে। পড়ে নেয় ওয়ারওল্ফের পোশাক তার পোশাকের ওপরে। তারপর নিরাপদে ঢুকে যায় রাজমহলে।
রাজমহলে ঢুকতেই গা শিউরে ওঠে ওর। এটা রাজমহল নাকি মৃত্যুমহল? আশেপাশে শুধু কঙ্কাল আর ভয়ানক দৃশ্য। শুকনো ঢক গিলে চলতে লাগে সে। লুকিয়ে-চুরিয়ে অনুভবকে বন্দি করে রাখার ঘরটা খুঁজে বের করে সে। নিজের শক্তি নিয়ে মেরে ফেলে সেই ঘরের সামনে থাকা পাহারা দেওয়া ওয়ারওল্ফদের। ভেঙে ফেলে দরজা। তার সামনে ভেসে ওঠে দেয়ালে ঠেস লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকা অনুভব। তার হাতে পায়ে শিকল বাঁধা। চোখ ছলছল করে ওঠে ভাবনার। যেন কতদিন পর মানুষটাকে প্রাণ ভরে দেখতে পাচ্ছে সে। অথচ, অনুভবকে গতকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। মাত্র এক দিন হয়েছে সে ভাবনার চোখের আড়াল হয়েছে। ভালোবাসার মানুষ চোখের আড়াল হলে বুঝি এমনই হয়?
ভাবনা একপ্রকার অস্থির হয়ে গিয়ে অনুভবের পাশে বসে পড়ে। অনুভবের গাল আলতো করে ধরে বলে….
–“প্রিন্স! চোখ খোলো। দেখো আমি এসেছি।”
আধো আধো চোখে তাকায় অনুভব। তার চোখজোড়া ভয়ানক লাল হয়ে রয়েছে। তার নীল রঙের মনোমুগ্ধকর চোখের মনির কোনো হদিসই নেই। মূহুর্তের জন্য ভড়কে যায় ভাবনা। অনুভবের চোখমুখ আস্তে আস্তে শক্ত হতে থাকে। যেন সে রাগছে। অসম্ভব রাগ ঘিরে ধরছে তাকে। ভাবনাকে ধাক্কা দিয়ে বসে সে। ভাবনা ছিটকে পড়ে যায়। ছলছল নয়নে তাকায় অনুভবের দিকে। তার সঙ্গে এটা কি করছে অনুভব। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে ওঠে….
–“প্রি…প্রিন্স!”
–“কে প্রিন্স? কীসের প্রিন্স? কে আমি? কে তুমি?”
মুখটা না চাইতেও হা হয়ে যায় ভাবনার। তখনই তার মনে পড়ে এই রাজ্যের কথা। এখানে শয়তানের উপাসনা করা হয়। নিশ্চয় এটা তারই প্রভাব। কিছু না ভেবেই ভাবনা দৌড়ে এসে অনুভবকে জড়িয়ে ধরে। অনুভবের শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে যায়। ধীরে ধীরে তার চোখজোড়া শিথিল হয়ে আসে। লাল থেকে নীল বর্ণে পরিণত হয় তার চোখজোড়া।
–“ভাবনা, তুমি এখানে কেন এসেছো? তোমার অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে তা কি তুমি জানো?”
ভাবনার কোনো ভাবান্তর হয় না। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অনুভবের হাত পায়ে থাকা শিকল খুলতে। নিজের সর্বস্ব শক্তি লাগিয়ে ব্যর্থ হয় সে। এরই মাঝে একটা ভয়ানক কন্ঠ ভেসে আসে তাদের কানে।
–“চাবি এখানে। কেন শুধু শুধু নিজের নরম তুলতুলে হাতকে কষ্ট দিচ্ছো বলো তো?”
থেমে যায় ভাবনার হাতজোড়া। ভয় এবং রাগ দুটোর সংমিশ্রণের দৃষ্টি নিয়ে তাকায় ভাবনা। একটা সুন্দর গড়নের পুরুষকে দেখতে পায় সে। সুন্দর হলেও তাকে দেখে মটেই সুবিধার মনে হয় না ভাবনার। অনুভব দাঁতে দাঁত চেপে বলে….
–“এভাবে বেঁধে রেখেছিস কেন? একবার ছেড়ে দিয়ে দেখ তোর একদিন কি আমার একদিন। কাপুরুষের মতো আমাকে বেঁধে রেখেছিস যাতে হামলা না করতে পারি।”
ওয়ারওল্ফ প্রিন্স অরুণের বেশ রাগ হয়। ফোঁস ফোঁস করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে সে। ভাবনা উঠে দাঁড়ায়। নিজের দুই হাত বাড়িয়ে জোরে ধাক্কা দেয় অরুণকে। তার শক্তিতে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে অরুণ। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় সে। এই সাধারণ ভ্যাম্পায়ারের এতো শক্তি যে তার মতো শক্তিশালী ওয়ারওল্ফকে ছুঁড়ে ফেলে দিল? ভাবতেই হতবাক হয়ে যাচ্ছে সে। তবুও নিজেকে সামলে উঠে বলল….
–“এই শিকলের চাবি আমি স্বাচ্ছন্দ্যে তোমায় দিয়ে দিতে পারি যদি তুমি আমার একটা শর্ত মানো!”
–“কীসের শর্ত?”
–“খুবই সহজ শর্ত। আমার কাছে নিজেকে সপে দাও। আসলে কি বলো তো, তোমার রুপে প্রথম দেখাতেই পাগল হয়ে গিয়েছি। বিশ্বাস করো তোমাকে কাছে চাইছে এই মন। তুমি চাইলে বিয়েও করতে পারি।”
ঘৃণায় চোখমুখ জড়িয়ে আসে ভাবনার। অনুভব রাগের চরম সীমায় পৌঁছায় তার সামনে তারই প্রেয়সীকে এভাবে নোংরা প্রস্তাব। এটা কে মানতে পারে? সে উঠে দৌড়ে আসতে নেয়। তবে শিকলের কারণে পারে না। উম্মাদের মতো চিৎকার করতে থাকে সে। ভাবনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে…..
–“উনি এমন করছেন কেন? এমন তো ছিলেন না? রাগ হবে স্বাভাবিক কিন্তু এতো অস্বাভাবিক রাগ কি করে হতে পারে?”
–“এইযে সুন্দরী, আমার কাছে এতো ভাবার সময় নেই। তুমি রাজি তো?”
–“আপনার থেকে চাবি নিতে নিজেকে সপে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার মতো শয়তানে মুখে আমি থুথু দিই। আমি নিজেকে একজনের কাছেই সমর্পণ করতে চাই সেটা হচ্ছে প্রিন্স অনুভব।”
কথাগুলো বলে এগিয়ে এসে ঝড়ের গতিতে চাবি টেনে নেয় ভাবনা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাবিটা ভাবনার হাতে চলে যায়। সে অনুভবের কাছে যেতে নিলে হাত ধরে বসে অরুণ।
–“আমার চোখের দিকে তাকাও সুন্দরী!”
ভাবনার তার চোখের দিকে তাকায়। অরুণ নিজের চোখ লাল করে সম্মোহিত করার চেষ্টা করে ভাবনার। তবে সব বিফলে যায়। ভাবনা নিজের চোখজোড়া সবুজ রঙে পরিণত করতেই অরুণের চোখ জ্বলে ওঠে। অরুণ ছেড়ে দেয় ভাবনার হাত। ও ভেবে পায় না এই মেয়ের মাঝে কি এমন শক্তি রয়েছে যা ওর কালোজাদুকে বিফল করে দিল? ভাবনা দ্রুততার সঙ্গে শিকলটা খুলে দেয়। অনুভব নিজের রুপ ধারণ করে আক্রমণ করতে নেয়। তবে ভাবনা বাঁধা দেয়। অনুভবের অবস্থা ঠিক নেই। সেদিন চলে আসে অনুভবকে নিয়ে ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে।
রাজ্যে হইচই নামে। প্রিন্স ফেরত এসেছে সুস্থ ভাবে এটা কি কম বড় কথা? কিন্তু অনুভবের হুটহাট করে রেগে যাওয়া ভাবনাকে বেশ ভাবায়। এমন তো সে ছিল না। তবে কি হলো? কিং প্রলয়ের সাথে বিষয়টা আলোচনা করার পর অনুভবকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজ্যের সব থেকে জ্ঞানী এবং বয়স্ক ব্যক্তির কাছে। যার কাছে সবকিছুর জ্ঞান রয়েছে অন্তত বেশি। ভালোভাবে ওই ব্যক্তি বলে ওঠেন….
–“অনুভবের মাঝে শয়তান সত্তা প্রবেশ করেছে। তাই আমাদের মতো ধৈর্যশীল জীবের মতো আচরণ করতে পারছে না সে। এমনকি নিজের বেশ খানিকটা শক্তি খইয়ে এসেছে সে। এমন চলতে থাকলে ওর মাঝে ভালো সত্তা হারিয়ে যাবে।”
চিন্তার ভাঁজ পড়ে কিং প্রলয়ের কপালে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলেন….
–“এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কি আপনি জানেন? যদি জেনে থাকেন তবে বলুন।”
বয়স্ক ব্যক্তিটি অনেক ভাবনাচিন্তা করেন। হুট করে ভাবনাকে দেখে প্রশ্ন করে বসেন….
–“তুমিও তো সেই রাজ্যে গিয়েছিলে। তোমায় দেখে তো মনে হচ্ছে না তোমার মাঝে শয়তান সত্তা প্রবেশ করেছে বলে। এটা কি করে সম্ভব?”
–“তা আমিও জানি না। শুধু জানি আমার উচিত ছিল প্রিন্সকে সেখান থেকে নিয়ে আসা এবং আমি তাই করেছি।”
–“কিন্তু আমি জানি তোমার মাঝে কেন বাজে সত্তা জায়গা পায়নি। তুমি অনন্য ভ্যাম্পায়ার। যেই শক্তি প্রিন্স অনুভবের পাবার কথা ছিল সেই শক্তি পেয়েছে ভাবনা। অনুভব শক্তি না পেলে অন্য কারো মাঝে সেই শক্তি প্রবেশ করবে সেটা নিশ্চয় তোমার জানা কিং প্রলয়??”
কিং প্রলয় মাথা নাড়িয়ে তাকান।
–“ভাবনার মাঝে সেই শক্তি রয়েছে নিঃসন্দেহে যেই শক্তি কোনো ওয়ারওল্ফের কালো জাদু ধ্বংস করতে পারে। কোনো ওয়ারওল্ফ যদি তোমার ওপর কালোজাদু করার চেষ্টা করে সে সেই কালোজাদুর শক্তি হারিয়ে বসবে খানিকক্ষণের জন্য। এটাই তোমার বিশেষত্ব!”
বয়স্ক ব্যক্তিটি গড়গড় করে বলতে থাকেন কথাগুলো। সেসব শুনে নিজের দিকে তাকায় ভাবনা। সব শেষে সে জানতে পারে অনুভবকে নিজের অর্ধেক শক্তি দান করলে তবেই অনুভব আগের মতো হয়ে উঠতে পারে। তার পুরোপুরি আগের মতো হতে গেলে তাদের বিয়ে হতে হবে। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনই কাটাতে পারে সেই শয়তান সত্তা।
ভাবনা কিছু না ভেবে এক কথায় রাজি হয়ে যায় নিজের অর্ধেক শক্তি দিতে। সবাই তাকে বার নার ভাবতে বলে এই বিষয় নিয়ে। সে ভাবে না। সে এটাও জানে শক্তি দেওয়ার পর পরিপূর্ণ শক্তি আবার সে তখনই পাবে যখন মহাপূর্ণিমা আসবে। চাঁদের আলোতে তার শক্তি পরিপূর্ণ হবে। ততদিন সাধারণ ভ্যাম্পায়ারের মতো তাকে বাঁচতে হবে। তবুও সে রাজি অনুভবের জন্য।
অনুভবকে সে শক্তি দান করে। আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয় সে। তবে ভাবনার এই শক্তি কমে যাওয়ার সুযোগ নেয় ওয়ারওল্ফ রাজ্যের কিং অলক এবং প্রিন্স অরুণ।
–“আমাকে অবজ্ঞা করার হিসাব ভাবনা নামক মেয়েটিকেই চুকাতে হবে। আমি শয়তান! আমাকে কেউ কি করে মানা করতে পারে বাবা?”
চিল্লিয়ে বলে অরুণ। কিং অলক চোখ রাঙানি দিয়ে বলে….
–“তো কি করবি এখন?”
–“আমি খবর পেয়েছি। কিছুদিনের জন্য ভাবনা সাদারণ ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছে। এটারই সুযোগ নেব আমি। ও যার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চায় তাকে দিয়েই মারব। তবে সে নিজে মারবে না। মারব আমি। ভাবনা ভাবে তাকে অনুভব মেরেছে। ভ্যাম্পায়ারের চোখে নিজের কালোজাদু দিয়ে রুপ পাল্টে ধোঁকা দিতে পারব না। তবে ভাবনাকে তো সম্মোহিত করতে পারব! সম্মোহিত করে ওকে এটা বোঝাব আমিই প্রিন্স অনুভব। ওকে মারলে অনুভব দুর্বল হয়ে পড়বে এটাও জানি। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে।”
একদিন, ভাবনা নিজের মাকে কাজে সাহায্য করতে ব্যস্ত ছিল। ইতিমধ্যে কে জানি এসে তাদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ায়। ভাবনা উঠে দরজা খুলতেই তার হাতে একটা চিরকুট তুলে দিয়ে যায় রাজমহলের একজন কাজে সাহায্যকারী। চিরকুট টা পড়ে দেখে অনুভব তাকে ডেকেছে নিজের ঘরে। এতো রাতে অনুভব তাকে ডেকেছে ভাবতেই লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে ভাবনা। খুব বেশি রাত হয়েছে তাও তো নয়। রাত প্রায় সাড়ে আটটা। মাকে কোনোভাবে ইনিয়েবিনিয়ে বলে সে চলে যায় রাজমহলে। অনুভবের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে….
–“তুমি কেন এতো রাতে আমায় ডেকেছো হু? ভুলে যাচ্ছো এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি?”
কথার উত্তর না পেয়ে আশেপাশে তাকাতেই তার চোখ কেউ চেপে ধরে। ভাবনা প্রথমে অনুভব মনে করলেও পরে মনে হয় এই মানুষটা অনুভব হতে পারে না। অস্বস্তি লাগতে শুরু করে তার। চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নেয় অজ্ঞাত ব্যক্তি। অজ্ঞাত ব্যক্তির চোখের দিকেই প্রথমে চোখ যায় তার। লাল চোখজোড়া দেখে মাথা ঘুরতে লাগে তার। অরুণ রহস্যময় হেসে বলে….
–“বলো, আমি প্রিন্স অনুভব।”
ভাবনা রোবটের মতো তালে তাল মিলিয়ে বলে….
–“তুমি প্রিন্স অনুভব।”
–“আমিই তো তোমাকে অনেক ভালোবাসি তাই না?”
ভাবনা মাথা দুলিয়ে ছোট্ট করে উত্তর দেয়….
–“হু!”
চারিদিকে অন্ধকার। ভাবনার জীবনেও অন্ধকার নেমে এসেছে। সেটা তার জানা নেই। চাঁদের আলো পড়ছে ভাবনার ওপরে।
–“তাহলে এবার মরো তোমার ভালোবাসার হাতে।”
অরুণ নিজের হাতের তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয় ভাবনার পেটে। সঙ্গে সঙ্গে কুকিয়ে ওঠে ভাবনা। পড়ে যায় কাতরাতে কাতরাতে। তবে ও এখনো সম্মোহিত। সামনের মানুষটিকেই অনুভব ভাবছে সে। সে আটকা আটকা গলায় বলে….
–“তু…তুমি এমনটা কি করে ক…করতে পারো আমার সাথে? ব্যাস একবার তু…তুমি বলো এসব মিথ্যে। তুমি আমাকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত কর নি। বি….বিশ্বাস করো আমি সব ভুলে যাব। আমি তোমার কথা মে…মেনে নেব।”
অরুণের হাসির শব্দ আরো বাড়ে। হালকা নিচু হয় সে। নিষ্ঠুরের মতো ভাবনার গাল চেপে ধরতেই নিজের রক্তমাখা হাতটা দিয়ে আঁকড়ে ধরে অরুণের হাত। অরুণের হৃদয় কাঁপে না। ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় ভাবনাকে। হার হিম করা কন্ঠে বলে……
–“কি করে ভাবলে তুমি? তোমার মতো সাধারণকে আমি ভালোবাসব? কে আমি জানো? প্রিন্স আমি। রাজকুমার যাকে বলে বাংলা ভাষায়। একজন প্রিন্স হয়ে সে তোমাকে কি করে ভালোবাসবে? তোমার শক্তি শেষ। তুমিও শেষ। বিদায়!”
ভাবনার মুখ থেকে আর কিছু বের হয় না। কিছু বলার নেই তার। সে শুধু এক ভাবে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে সে। তাহলে কি শক্তির জন্য অনুভবের মনে ঈর্ষা তৈরি হয়েছিল? সবই অবিশ্বাস্য। হঠাৎ ঘোর কেটে যায় তার। কানে আসে তীক্ষ্ণ পায়ে শব্দ। অরুণ বেরিয়ে যায়। অনুভব ছুটে আসে। ছাঁদে ছিল সে। হঠাৎ একটা বাজে অনুভূতি হয় তার। ভয় ঝেঁকে বসে। বুকে তীব্র যন্ত্রণা হয়। সেই মূহুর্তে তার মনে পড়ে সেদিনের কথা। যেদিন ভাবনা তাকে অর্ধেক শক্তি অর্পণ করেছিল। সেদিন বয়স্ক ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তোমাদের অনুভূতি এক হয়ে গেল। তোমরা অনুভব করবে একে অন্যের কষ্ট গাঢ় ভাবে।’
ছুট লাগায় অনুভব। নিজের রুমে আসতেই ভাবনার রক্তমাখা দেহ দেখে থমকে যায় সে। সবটা দুঃস্বপ্ন মনে হয় তার। চোখ কচলে আবার তাকায় ক
ফ্লোরের দিকে। নাহ, সবটা সত্যি! রক্তে ভেসে যাচ্ছে আশপাশটা। কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে ভাবনার মাথা নিজের হাঁটু ওপর নিয়ে চিৎকার দেয় অনুভব। চিৎকারে সকলে ছুটে আসে। এসেই সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ভাবনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করে চলেছে।
–“আমি মরতে চাইনি। কেন মারলে আমায়? মেরে ফেললে। বিশ্বাসঘাতকতা করে কি পেলে তুমি? কেন করলে এতোসব অভিনয়? তোমার অভিনয়ে ভুলেছি আমি। আমি তো অভিনয় করিনি। সত্যিকারের ভালোবেসেছি। এই ভালোবাসার ফল কি এতোটাই বিষাক্ত যে প্রাণ কেঁড়ে নিল?”
পেটে হাত দিয়ে গোঙাতে শুরু করে ভাবনা। অনুভবের মাথায় কিছুই আসছে না। একে তো ভাবনার এই অবস্থা তার ওপর ভাবনা তাকে ভুল বুঝছে।
–“তুমি ভুল বুঝছো। আমি তোমাকে কেন মারব? আমি তোমাকে মারতে পারিনা। তোমার মাঝে লুকিয়ে আছে আমার প্রাণ। তুমি চলে গেলে আমি নিষ্প্রাণ হয়ে যাব।”
ভাবনার হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে অনুভব। তার কন্ঠে হারিয়ে ফেলার ভয়। কম্পন এবং যন্ত্রণায় মাখা তার প্রতিটা কথা।
–“খুনি তুমি। শুধু মানুষের নও ভালোবাসার খুনি তুমি। মেরে ফেলেছো। মেরে ফেলেছো আমায়। সৃষ্টিকর্তা যদি আবার চায়। তবে আমি আবার ফিরব। মনে রেখো।”
–“আবার ফিরব মানে? কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি তোমার কিছু হতে দেব না। তোমাকে অনেক ভালোবাসি ভাবনা। তুমি যেও না দয়া করে যেও না।”
কে শোনে কার কথা? ভাবনা শুধু তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। ভুল বুঝে মৃত্যুবরণ করে সে। অনুভব পাগলের মতো ডাকতে থাকে তার প্রেয়সীকে।
–“এই ভাবনা! ভাবনা! তাকাও। আমার দিকে তাকাও না। চোখ খোলো। আমার আদেশ তুমি চোখ খোলো।”
খোলে না চোখ ভাবনা। কিং প্রলয় এসে হালকা বসে বলেন….
–“ও আর নেই অনুভব। কেন মারলি ওকে?”
অনুভব হতভম্ব হয়ে তাকায়। তার বাবাও তাকে বিশ্বাস করছে না। আশেপাশের সকলে তাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখছে। এরই মাঝে ঘটে ভাবনার মায়ের আগমন। তার মেয়েকে এভাবে দেখে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি। চোখ থেকে অনবরত গড়িয়ে পড়তে থাকে পানি। নিজের মেয়ের মৃত্যু দেখা এতোটাই সহজ? ধপ করে বসে পড়েন উনি।
–“সোনা! তোর মা কষ্ট পাচ্ছে। ওঠ না মা। হেসে আমার রাগ ভাঙিয়ে দে। কষ্ট গুঁড়িয়ে দে। তোর মা তোকে ছাড়া এক কদমও চলতে পারে না রে মা।”
হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন ভাবনার মা। রাজ্যের সকলেই প্রায় ততক্ষণে এসে গেছে। সকলে অনুভবকে দোষারোপ করতে থাকে। ভাবনার মা চোখের পানি মুছে এক পর্যায়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় অনুভবের দিকে।
–“যে তোমাকে নতুন প্রাণ দিল। যে তোমাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসলো তার সঙ্গে এমনটা করলে? মেরে ফেললে আমার মেয়েকে? কি করে পারলে? স্বার্থপর ছেলে। আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।”
হম্বিতম্বি হয়ে এসে অনুভবের কলার ধরে ঝাঁকাতে থাকেন উনি। অনুভব নিরুত্তর। কি বলবে? এতোক্ষণ ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলেছে সে খুন করেনি। তবুও কেউ শোনেনি তার কথা। কিং প্রলয় এসে ছাড়িয়ে নেন ভাবনার মাকে। মেয়ে হারানোর শোকে উনি উত্তেজিত হয়ে বলেন….
–“আমার মেয়েকে মেরে তুমি নিস্তার পাবে না অনুভব। আমি মা হয়ে তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি। প্রাণ থেকেও তুমি নিষ্প্রাণ হয়ে থাকবে। তোমার সময় এখানেই থেমে যাবে। তোমার সময় এগুবে না আর।”
অনুভব ছলছল নয়নে তাকায়। প্রলয় কিং হুংকার দিয়ে বলেন…..
–“এসব কি বলছেন আপনি? আমার ছেলেকে অভিশাপ দিতে পারেননা আপনি।”
–“একশবার পারি। হাজারবার পারি।”
অনুভব হাঁটু গেঁড়ে বসে মাথা নত করে শান্ত গলায় বলে….
–“আমি মেনে নিচ্ছি আপনার অভিশাপ। যেখানে আমার ভালোবাসার মৃত্যু হয়েছে সেই সঙ্গে ভাবনা আমার ভালো থাকা কেঁড়ে নিয়ে গিয়েছে। তখন আমিও থাকতে চাই না।”
কিং প্রলয় আকাশ থেকে পড়েন। অনুভব আরো বলে….
–“তবে আমাকেও নির্দোষ প্রমাণ করবার সুযোগ দিতে হবে।”
–“সুযোগ তুমি তখনই পাবে যখন ভাবনার জন্ম দ্বিতীয়বার হবে। কারণ একজন মা অভিশাপ দিয়েছে তোমায়। ভাবনা আবারও ফিরবে। তবে নিজের অন্য রুপ নিয়ে ফিরবে। অন্য রুপকেই তোমায় চিনে নিতে হবে। আমার মেয়েকে তুমি সত্যি ভালোবেসে থাকো তো চিনতে পারবে তাকে। আজকের পর তুমি ৪৯ বছর তোমায় ঘুমন্ত অভিশাপে কাটিয়ে দিতে হবে। তুমি রাজি?”
অভিজ্ঞ এবং বয়স্ক ব্যক্তি শক্ত গলায় বললেন কথাগুলো। কিং প্রলয় বারণ করলেও অনুভব বলল…
–“আমি রাজি।”
–“৪৯ বছর পর ভাবনা নিজে তোমায় অভিশাপ মুক্ত করবে নিজের অজান্তে। ওর ভাগ্য ওকে আবারও ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে টেনে নিয়ে আসবে।”
সেদিনের পর থেকে সেই অভিশাপ নিয়েই জীবিত হয়েও মৃত হয়ে কাটায় অনুভব। শুধু তার প্রেয়সীকে আবারও পাওয়ার জন্য। #অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা পূর্ণ করার জন্য।
বর্তমান….
মাধুর্যের গাল বেয়ে পানি পড়ে। চিকচিক করতে থাকে গালের পানি।
–“বিশ্বাসঘাতকতা যে করল সেই কি না ভাগ্যক্রমে আমার স্বামী! আমার ভাগ্যে এবারও কি মৃত্যু লিখা আছে?”
চলবে….🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। এই গল্পকে বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করবেন না। এটি কল্পনার ভিত্তিতে তৈরি।