#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫
মাধুর্যের গলার আরো কাছে নিয়ে আসা হয় তলোয়ারটি। ধারালো তলোয়ারে হালকা কেটে যায় মাধুর্যের গলা। লাল বর্ণের রক্তে রঙিন হতে শুরু করে মাধুর্যের ওড়না। তা দেখে অনুভব হঠাৎই সবার মাঝে ঘুরতে শুরু করে। তার নাগাল পাওয়াই যাচ্ছে না। অন্যদিকে অরুণ বুঝতেই পারছে না এখানে ঠিক কি হচ্ছে? ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ অরুণের পেছনে এসে থেমে তাকে পেছন থেকে এক হাত দিয়ে জাপ্টে ধরে নিজের তর্জনী আঙ্গুলের ধারালো নখ অরুণের গলার কাছে ধরে অনুভব। ঘটনা এতোটাই দ্রুত ঘটে যে অরুণের কিছু করার থাকে না। নিজের ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে ভড়কে যায় কিং অলক। মাধুর্যের চুলের মুঠি ধরে টেনে বলে…..
–“পাগলামো কেন করছিস প্রিন্স অনুভব? তোর এই পাগলামোর ফল তোর প্রাণের প্রিয় বউকে দিতে হতে পারে।”
–“এই একই কথা আমি তোকেও বলতে পারি ওয়ারওল্ফ কিং অলক। আমার মাধুর্যের গলায় তলোয়ার ধরার প্রতিদান তোর ছেলেকে দিতে হতে পারে। আমার নখ কোনো ছুরির থেকে কম কাজ করবে না। শুধু একটা নখ গলায় চালিয়ে দিলে তোর ছেলের খেল খতম।”
এবার কিং অলক ভড়কে যায়। তলোয়ার আলগা করে দেয় সে।
–“ন…না। এমনটা ক..করবি না তুই।”
–“তাহলে ছেড়ে দে মাধুর্যকে।”
অলক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ও চাইছে না মাধুর্যকে ছেড়ে দিতে। তবুও আস্তে আস্তে তলোয়ার সরিয়ে নিতে থাকে মাধুর্যের কাছ থেকে। এতোক্ষণ ঘোরের মাঝে ছিল মাধুর্য। এ এক নতুন অনুভব। তার দিকেই চোখ ছিল মাধুর্যের। তার চোখজোড়া সবুজ নয় লাল। এটা মাধুর্যের মনে ভয় জাগাচ্ছে। অনুভবের এ কি হলো? হুঁশ ফিরতেই সে আঙ্গুল ছড়িয়ে দিতেই নখ অনুভবের মতোই তীক্ষ্ণ ধারালো এবং বড় হয়ে উঠল। কিং অলকের হাতে এক আঁচড় দিয়ে এক ঝটকায় দূরে চলে এলো সে। মধুরিমা এতোক্ষণ নিজের মেয়ের মৃত্যুর ভয়ে কাঁপছিল। মেয়েকে পেয়ে তৎক্ষনাৎ বুকে জড়িয়ে নিল।
–“ছাড়। এখন আমার ছেলেকে ছেড়ে দে।”
অলক কে ভয় পেতে দেখে অনুভব হাসে। তার হাসিটাও আজ কেমন জানি ভয়ানক। অরুণ নিজেকে ছাড়ানোর পুরো দমে চেষ্টা করে গেলেও অনুভবের কাছে হার মানছে সে। কারণ অনুভব যেমন একদিকে ভ্যাম্পায়ার তেমন ওর মাঝে যেমন শয়তান সত্তার প্রবেশ ঘটেছে ও আরো শক্তিশালী এবং হিংস্র হয়ে উঠেছে। অরুণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে….
–“আমাকে ছেড়ে দে অনুভব। নয়ত তোর ভালো হবে না।”
অনুভব সেই কথার কর্ণপাত করে না। অরুণকে টেনে নিয়ে মাধুর্যের কাছে আসে অনুভব। মাধুর্যের কানে কানে কি যেন একটা বলে। তাতে মাধুর্যও সম্মতি জানায়। অনুভব মাথা তুলে বলে…..
–“কিং অলক, আমাদের এখান থেকে যাওয়ার রাস্তা ক্লিয়ার করে দে। কেউ যেন আমাদের স্পর্শ অবধি না করে। তাহলে তোর ছেলে আর শেষ।”
–“না তুই কিছু করবি না। ছেড়ে দে অরুণকে।”
–“ওকে ছেড়ে দিলে তো তুই আমাদের ছাড়বি না। তাই ওকে এখন ছাড়ছি না। আমার রাস্তা পরিষ্কার করে দে।”
কিং অলক একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়েন। নিজের দলের সবাইকে সরতে ইশারা করতেই সরে যায়।
অনুভব বাঁকা হেসে হুট করেই অরুণের মাথা ধরে দেওয়ালের সঙ্গে আঘাত করে। মাথায় আঘাত পেয়ে হালকা আর্তনাদ করে সেখানেই জ্ঞান হারায় অরুণ। অনুভব ব্যঙ্গ করে বলে….
–“সো স্যাড ওফ ইউ কিং অলক! এতো কিছু করেও লাভ টা কি হলো? সেই তো পরাজিত হতে হলো।”
অনুভবের কথায় রাগে কটমট করে এগিয়ে আসতে নেয় অলক। কিন্তু অনুভব ইশারাই থামিয়ে দেয়।
–“এগিয়ে আসার মোটেও চেষ্টা করবি না। তোর এই নাদান ছেলেকে মারতে এক সেকেন্ডও লাগবে না। এমনিতেও ওর সঙ্গে তো আমার পুরোনো হিসেব বাকিই আছে।”
অনুভব চোখ দিয়ে মাথা নাড়িয়ে মাধুর্যকে ইশারা করে তাকে মা-বাবা নিয়ে বেরিয়ে যেতে। অনুভবের কথা মতো বেরিয়ে যায় মাধুর্য তার মা-বাবাকে নিয়ে। অরুণকে কাঁধে তুলে অনুভবও চোখের পলকেই হাওয়া হয়ে যায়। রাগে নিজের চুল ছিঁড়ার ইচ্ছে করে কিং অলকের। হুংকার দিয়ে নিজের হাতে থাকা তলোয়ার দিয়ে সামনে থাকা এক ওয়ারওল্ফকে আঘাত করে বসে। লাল চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে রক্তমাখা মেঝের ওপর।
ভোরের আলো ফুটেছে। সূর্য উঠবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। মধুরিমা ও মুহিবকে একটা ঘর দেখিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘরে আসে মাধুর্য। ঘরে ঢুকতেই অনুভবকে আবারও যন্ত্রের মতো বসে থাকতে দেখতে পায় মাধুর্য। খানিকটা অবাক হয় সে। অনুভবের মাঝে মাঝে কি হচ্ছে? সে আস্তে করে এগিয়ে গিয়ে অনুভবের পাশে বসে। নরম সুরে ডেকে ওঠে….
–“অনুভব!!”
অনুভব কোনো জবাব দেয় না। মাধুর্য কি করবে ভেবে পায় না। অবাক চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। মিনিট দুয়েক বাদে অনুভব একা একা নড়েচড়ে ওঠে। মাধুর্যকে নিজের পাশে দেখে বলে ওঠে…..
–“তুমি কখন এলে?”
–“কেন তুমি বুঝতে পারোনি?”
অনুভব এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে বুঝতেই পারেনি মাধুর্য এসেছিল। অনুভবের গাল হালকা স্পর্শ করে মাধুর্য। তার নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে হৃদয়ে দোলা লাগে অনুভবের।
–“কি হয়েছে তোমার? আমার মনে হয় তোমার মাঝে যত বাজে শক্তির প্রবেশ ঘটেছে এটা তারই প্রভাব। এখন কি করা উচিত আমার মোটেও বোধগম্য হচ্ছে না। বিষয়টা মহারাজ কে জানানো প্রয়োজন।”
অনুভব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে….
–“এবারেও যদি বলা হয় আমার থেকে খারাপ শক্তি বের করতে তোমাকে অর্ধেক শক্তি অর্পণ করতে হবে তখন কি করবে?”
–“আমার শক্তি অর্পণ করব।”
অনুভব বিষম খেয়ে তাকায়। এতোকিছুর পরেও কত সহজেই ও নিজের শক্তি দেওয়ার কথাতে কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেল। অনুভব থমথমে গলায় প্রশ্ন করে ওঠে….
–“এতোকিছুর পরেও?”
–“উঁহু! কীসের এতোকিছুর পরেও? যা ইচ্ছে হয়ে যাক। তোনার জন্য আমাকে যা করতে হবে আমি এক কথায় করতে প্রস্তুত। আমি এক বড় ভুল করেছি আগের বার। তোমাকে ভুল বুঝে আপনাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম। এবার তা মোটেও হচ্ছে না।”
–“এতো কেন ভালোবাসো আমায়?”
মাধুর্যের কান গরম হয়ে যায়। অতঃপর মিষ্টি হাসে সে।
–“এই ভালোবাসা হয়ত তোমার থেকেই শেখা। তুমিই তো প্রথম থেকে আমায় চেয়েছো। তোমারই ভালোবাসার প্রেমে পড়েছি আমি। তারপর তোমাকেই ভালোবেসে ফেলেছি।”
–“তোমার মাঝে এমন কিছু আছে যা আমাকে বার বার কাছে টানে। মন চায় তোমায় ছুঁয়ে দেখতে। মনে হয় তোমায় দেখে হয়ত আমি কাটিয়ে দিতে পারব সারাজীবন নির্দ্বিধায়। এটা যদি ভালোবাসা হয়। তাহলে প্রথম থেকেই তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।”
মাধুর্য নুইয়ে পড়ে। হয়ত কিছুটা লজ্জায় আর কিছুটা ভালো লাগায়। অনুভব উঠে পড়ে। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ এনে পরম যত্নে লাগিয়ে দেয় মাধুর্যের গলার মাছে। সেখানে বেশ খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়েছে।
ব্যান্ডজ লাগানোর সময় অনুভবের চোখমুখের রিয়েকশন দেখে হাসি পেয়ে যায় মাধুর্যের। সে এমনভাবে মুখ করে রেখেছে যেন ব্যাথা সে পেয়েছে আর কষ্ট টাও হচ্ছে তার।
–“খুব ব্যাথা পেয়েছো না?”
–“না তো। তাছাড়াও আমাদের আঘাতের দাগ তো তাড়াতাড়ি সেড়ে যায় না? এটার কি প্রয়োজন?”
–“প্রয়োজন আছে। এই আঘাতের দাগ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে মাধুর্য। এটাকে দেখলে শুধু মনে পড়ছে ৪৯ বছরের আগের ঘটনাটা। আজও তেমনই অনুভূত হয়েছিল যেমনটা আগে করেছিলাম। ওই তলোয়ার যখন তোমার গলার সামনে ধরেছিল। যেন আমার নিঃশ্বাস আটকে গেছিল। দম ফেলতে পারিনি।”
কথাটুকু বলেই ছোট্ট করে চুমু একে দেয় মাধুর্যের আঘাত লাগা জায়গাটিতে। মাধুর্য কেঁপে উঠে খামচে ধরে বিছানার চাদর। চোখ খুলে ঘাড় বাঁকা করে মুখ ভেঙিয়ে বলে….
–“কি লাভ হলো ব্যান্ডেজ দিয়ে? ভিজিয়ে দিলেন তো!”
অনুভব মাথা চুলকায়। সত্যিই তো চুমু দিতে গিয়ে ভিজিয়ে ফেলেছে। অতঃপর তড়িঘড়ি করে আরেকটা চুমু খায় সে।
–“কিছু করার নেই। সরি।”
মাধুর্য লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে অনুভবকে আলতো ধাক্কা দিয়ে উঠে গিয়ে উঠে গিয়ে অনেকটা দূরে দাঁড়ায়। সদ্য সূর্য ওঠার মিষ্টি রোদ এসে পড়ে মাধুর্যের ওপর। রোদ তীব্র না হলেও লাল হয়ে যায় মাধুর্য। এই দৃশ্যটা অনুভবের কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাধুর্যকে। তার হাত বিচরণ করতে থাকে মাধুর্যের সারা হাতে। হাত ধরে ঘুরিয়ে দেয় সে মাধুর্যকে। মাধুর্য লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারে না। অনুভবের নীল চোখজোড়ার দিকে তাকালে যেন সে মরেই যাবে! অনুভব মিটমিট করে হেসে তার থুঁতনি তুলে তার নাকে নাক ঘষতে থাকে অনুভব। মাধুর্য চোখ খিঁচে বন্ধ করে। নাক সরিয়ে নিজের ঠোঁটজোড়া মাধুর্যের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে কানে লতিতে আলতো চুমু খায় অনুভব। শিরশির করে ওঠে মাধুর্যের সারা শরীরে।
–“এই শয়তানের মাঝ থেকে শয়তানকে নিজের ভালোবাসায় মুছে দিতে তৈরি তো?”
মাধুর্য ঢোক গিলে পিটপিট করে তাকায়। তারা কাছে আসতে থাকে একে ওপরের। অনুভবের এতো বছরের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয়। তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে থাকে।
মাধুর্যের যখন ঘুম ভাঙে তখনও সকাল প্রায় সাড়ে আটটা। অনুভবকে পাশে না দেখে তেমনটা অবাক হয় না সে। কারণ অনেকটাই সকাল হয়েছে। হয়ত অনুভব নিচে গিয়েছে। মাধুর্য দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে একবারে নিচে গেল। সবাই খেতে বসেছে। রায়মা ও এলিনা সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। মাধুর্যকে দেখে রায়মা খাবার রেখে হাসিমুখে বলে ওঠে….
–“আরে মাধুর্য, শুনলাম তোমার বাবা-মা এসেছে। তাদের নাকি তুমি খুঁজে পেয়েছো। এলিনা বলল।”
–“হ্যাঁ মণি মা। আর দুঃখিত মহারাজ। আপনার অনুমতি না নিয়েই আমি….”
প্রলয় সিনহা থামিয়ে দেন মাধুর্যকে। খাবার ছেড়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়েন উনি। এগিয়ে আসেন মাধুর্যের দিকে। তার মাথায় হাত রাখতেই প্রলয়ের দিলে এক দৃষ্টিতে তাকায় মাধুর্য।
–“এতে অনুমতি নেওয়ার কি আছে? এই বাড়িটা তো তোমারও। অবাক হচ্ছো বুঝি? এলিনা আমাকে সবটাই বলেছে। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি তুমি হলে আমার ছেলের যোগ্য স্ত্রী এবং আমার ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের পরবর্তী মহারানী!”
মাধুর্য আজ অনেকটাই খুশি। মহারানী হতে পারবে সেটা ভেবে নয়। গতকালকেই সে প্রলয়ের চোখে ছেলেকে হারানোর ভয় দেখে কষ্ট পেয়েছিল। আজ সেই চোখে তারই প্রতি ভালোবাসা দেখে ভালো লাগছে মাধুর্যের। সে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু তার কন্ঠস্বর কাঁপছে। তবুও কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে….
–“আপনি যে কোনোদিন আমাকে মেনে নেবেন সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। ব্যাস আমি আর কিছু চাই না মহারাজ।”
–“এটা কি হলো? মহারাজ? শ্বশুড়মশাই কে মহারাজ বলে?”
মাধুর্য বোকার মতো হেসে জবাব দেয়।
–“বাবা।”
–“এখন তুমি তোমার মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে এসো। উনারা তো এখনো আসেন নি।”
মাধুর্য মাথা নাড়িয়ে চলে যায় ওপরে তার মা-বাবাকে ডাকতে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কপাল কুঁচকে অনুভবকে দেখার আশায় পেছন ফিরে তাকায় মাধুর্য। নাহ অনুভব তো খাবার টেবিলের আশেপাশেও নেই। আবারও ঘরেও নেই গেলো সে? হঠাৎ করে মনে পড়ে তার অরুণের কথা। সে দ্রুত উঠে যায় সিঁড়ি দিয়ে। করিডোরের শেষ প্রান্তের ঘরে বেঁধে রাখা হয়েছিল অরুণকে। পা চালিয়ে দ্রুত যায় সেই ঘরে। দরজাটা হাট করে খোলা রাখা আছে। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার। লাল বর্ণের রক্তের বন্যা দেখে রক্ত পান করার বাসনা জাগলেও সামলে নিয়ে ভেতরে ঢোকে মাধুর্য। ভেতরে ঢুকতেই কাঁপতে শুরু করে সে। চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে….
–“এসব কি করছ তুমি অনুভব?”
চলবে…… 🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।