#তবু_সুর_ফিরে_আসে
২৬ তম পর্ব
নওশাদ কোথায় খুঁজবে হেরা কে বুঝতে পারছে না ! ওরা গাড়ি নিয়ে বসুন্ধরার আশেপাশটা খুঁজেছে ! শোয়েব মোবাইল এ ছবি দেখিয়ে আশেপাশে র দোকান গুলোতে জিজ্ঞাসা করেছে ! এখন এই মুহূর্তে ভাটারা থানায় ওসির সামনে বসে আছে ওরা ! জিডি করেছে ! পুলিশের তোড়জোড় শুরু হয়েছে ! গুলশান জোনের ডিসি ফোন দিয়েছিল তাকে । আশ্বাস দিচ্ছে সবাই ! নওশাদ ওর সকল ক্ষমতা দিয়ে হেরা কে খোঁজার চেষ্টা করছে !
নিশাল একটু পর পর ফোন দিচ্ছে,
হ্যালো নিশাল !
পাপা আন্টিকে পেয়েছো ?
এখনো পাইনি !
পাপা প্লিজ তাড়াতাড়ি খুঁজে নিয়ে এসো ! আনারের মা বলছিল, আন্টির শরীর খারাপ ছিল !
চেষ্টা করছি বাবা , তোমার আন্টিকে না নিয়ে বাসায় আসব না ! তুমি চিন্তা করো না !
আমার খুব খারাপ লাগছে পাপা !
আল্লাহ কে ডাকো আমরা চেষ্টা করছি !
নওশাদ ফোনটা কেটে ওসির রুমের বাহিরে এসে দাঁড়ালো !
বাহিরে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে আজ ! এত ঠান্ডার ভেতরে মেয়েটা কোথায় আছে ? ও তো একটুও ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না ! আজ কয়দিন সারারাত কাশছে ! নিশাল বলল, শরীর খারাপ ছিল ! হেরা তুমি কোথায় ? প্লিজ চলে এসো আমি তোমাকে কখনো কারো সঙ্গে কোথাও যেতে দিব না !
আল্লাহ তুমি দয়া করো ! আমি তো একবার একজনকে হারিয়েছি আর কাউকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না ! নওশাদ চোখ বন্ধ করে আছে।
রেজোয়ান এসে নওশাদের পাশে দাঁড়ালো !
নওশাদ চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করছে !
চা খাবি ?
না কিছু খাব না !
আমি ভুল করেছি রেজোয়ান ওকে একটা মোবাইল দেয়া উচিত ছিল ! জিনিস টা কিভাবে আমার মাথা থেকে মিস হয়ে গেল এতদিন বুঝলাম না!
বীথি এতটা কেয়ার লেস কিভাবে হলো আমি বুঝতে পারছি না নওশাদ !
নওশাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, রেজোয়ান কেয়ারফুলি কেয়ারলেস বলে একটা কথা আছে ঘটনা সেটা কিনা দেখ !
কি বলতে চাইছিস তুই ?
আমি এখন কিছুই বলতে চাইছি না , আগে হেরা কে খুঁজে পাই নওশাদ নিজের চুল গুলো আঙ্গুল দিয়ে টেনে ধরলো !
রেজোয়ান নওশাদের পিঠে হাত রাখলো , চিন্তা করিস না সবাই চেষ্টা করছে ! এত সহজ নাকি একটা মানুষ হারিয়ে যাওয়া!
সুমনা কান্নাকাটি করছে ফোন দিয়ে ! তোরা সবাই ভেঙে পড়লে হবে ?
নওশাদ চোখ বন্ধ করে আছে !
নিশাল তার ফুপি আর ফুপার সঙ্গে বসে আছে ড্রয়িং রুমে ! তার চাচিরাও এসেছে ! এলিন, নাহিন অস্থির হয়ে আছে ! আর আনারের মা তো কখন থেকে কেঁদে ই যাচ্ছে!
বুবু কি ঘটনা ঘটে গেল দেখেন ,নাদিয়া বলে উঠলো ?
জান্নাত আজমী রেগে বললেন,সব বাবুর দোষ ! বীথির সঙ্গে যেতে দেয়াই উচিত হয়নি ওর ! সরি নিশাল তোমার খালাকে নিয়ে বলছি কথাটা কিন্তু না বলে পারলাম না ! ও অনেক অস্থির ! কিভাবে আবার বাসায় চলে এলো ? যখন খুঁজে পাচ্ছে না সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিতো বাবুকে !
আমিও বুঝলাম না বুবু বীথি ভাইয়াকে ফোন দিবে না সঙ্গে সঙ্গে ?
সেটাই ওর বুদ্ধি দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেছি নাদিয়া !
কি অবস্থা এখন ওদিকে নাদিয়া?
দুলাভাই আরমান ফোন দিয়েছিল ভাইয়ার অবস্থা খারাপ ! খুব আপসেট হয়ে গেছেন ! পুলিশ রেব লাগিয়ে তোলপাড় করছে ভাইয়া।
নাদিয়া আমার ভাই টার কপাল টাই খারাপ ! দুঃখ তার পিছু ছাড়ে না ! এত বছর পর একটু সুখের মুখ দেখার আগেই এখন না জানি কি ঘটনা ঘটে গেছে ! আল্লাহ তুমি হেফাজত করো মেয়েটার জান্নাত আজমী আতংকিত হয়ে বললেন !
যে সুন্দরী , কম বয়সী মেয়ে দেশের যা অবস্থা না জানি কি হয়েছে , আমার তো ভেবেই হাত পা কাঁপছে বুবু !
মিলা তুমি মুখটা দয়া করে বন্ধ করো , বাচ্চা একটা ছেলে আছে এখানে জান্নাত আজমী ছোট ভাইয়ের বউয়ের কথায় ফোঁস করে উঠলেন !
জ্বি বুবু !
নিশাল উঠে নিজের রুমে চলে গেল !
তোমরা একটু খেয়াল করবে না নিশাল কে ছেলেটা মুখ শুকনো করে অস্থির হয়ে আছে !
সরি বুবু !
আমি এসে দেখি নামাজ পড়ছে ! আনারের মা বলল খুব টেনশন করছে !
ভাইয়ার নাম্বার ভাবি জানে না এটাই সবচেয়ে অবাক লাগছে বুবু !
অবাক লাগার কিছু নেই ওর প্রয়োজন হয়নি নাম্বার টিপে ফোন দেয়ার ! বিয়ে হয়েছে দুই মাস হয়নি এখনও এত কিছু জানার প্রয়োজন ও হয়নি হয়তো ওর ! হেরা তো সারাক্ষণ বাসায়ই থাকে । আমার গাধা ভাই বউকে একটা মোবাইল ও কিনে দেয়ার কথা মাথায় আনেনি । এই বুদ্ধি আর বিচক্ষণতা নিয়ে এত বড় বিজনেস দাঁড় করিয়েছে সে!
যুথী এসে ঢুকলো তখন ! ওকে দেখে সবাই চুপ করে গেল !
স্লামালাইকুম বুবু !
হুম !
কি হয়ে গেল বলুন তো !
কি আর হবে তোমার বোন মেয়েটাকে নিয়ে গেছে আর ফিরে এসেছে শূন্য হাতে !
এভাবে কেন বলছেন বুবু ও তো ইচ্ছে করে ওকে হারিয়ে রেখে আসেনি ! ও ই বা কেমন না বলে কোথায় চলে গেল ! দুলাভাই কোথায় ?
কোথায় আর থাকবে বউ হারিয়ে গেছে যার সে দিশেহারা হয়ে খুঁজছে ! সে নিশ্চয়ই পায়ের উপর পা তুলে ঘরে বসে থাকবে না। জান্নাত আজমী যুথীকে দেখে খুব বিরক্ত!
নিশাল কোথায় ?
ও নিজের ঘরে , মিলা বলল!
যুথী বলল,দেখো তো মিলা বীথি ঐদিকে কাঁদতে কাঁদতে শেষ হচ্ছে ! ওর বর বকছে ওকে !
জান্নাত আজমী দীর্ঘ শ্বাস ফেলল !
আনারের মা দৌড়ে এসে দাঁড়ালো , ফুফুআম্মা ভাইয়া কানতেছে নিজের ঘরে !
যুথী উঠে দাঁড়াতে নিলো !
তুমি বসো আমি দেখছি ! জান্নাত আজমী নিশালের ঘরের দিকে ছুটে গেলেন !
নিশাল পড়ার টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে!
নিশাল বাবা আমার কি হয়েছে ?
ফুপি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে !
আন্টিকে পাওয়া যাবে তোমার পাপা খুঁজছে সোনা !
আমার পাপার জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব ! পাপা সব সময় কেন কষ্ট পায় ?
তুমি চিন্তা করো না দেখবে পাপা তোমার আন্টিকে নিয়েই বাসায় আসবে ! তোমার পাপার অনেক ক্ষমতা বাবা ! পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে তোমার আন্টিকে !
তুমি জানো না আন্টি খুব ইনোসেন্ট কিছুই বুঝে না কেউ খারাপ কিছু করতে চাইলেও বুঝবে না !
নাদিয়া, মিলা আর যুথী এসে ঢুকলো নিশালের ঘরে !
নিশাল ওদের দেখে চোখ মুছলো !
বাবা তুমি এভাবে কাঁদলে পাপাকে কিভাবে সাহস দিবে ?
আমি পাপার কাছে যাব ফুপি এখনই !
আরে না মাথা খারাপ তোমার, পাপা কোথায় কোথায় দৌড়াচ্ছে এখন ! অনেক রাত ও হয়ে গেছে বাবা, এখন এমন পাগলামী করে না ! জান্নাত আজমী নিশাল কে জড়িয়ে ধরে আছে !
যুথী নিশালের মাথায় হাত রাখলো , কিছু খেয়েছো নিশু বেবি ?
প্লিজ খালামনি যাও এখান থেকে আমার কিছুই ভালো লাগছে না ! আমি খাব না কিছু ! যাও !
এটা কেমন কথা !
জান্নাত আজমী বললেন,যুথী প্লিজ যাও আমি দেখছি বললাম তো ! তোমরা ওদিকে গিয়ে বসো আমি আসছি !
জ্বি বুবু!
ওরা সবাই রুম থেকে বের হয়ে এলো !
মিলা মন খারাপ করে বলল, মেঝভাবি নিশাল কে দেখে আমার খারাপ লাগছে ! কদিনেই বড় ভাবির জন্য কত ফিলিংস হয়ে গেছে ওর !
হুম ! মা নেই বড় ভাবি মায়ের মত আদর দিচ্ছে ফিলিংস তো হবেই মিলা ! সব হলো মায়া বুঝলে !
ও সব কিছু না মিলা নিশালের মনটা ওরকম নরমই যুথী বলল!
যুথী আর কথা বলো না বুবু শুনলে দশটা কথা শুনিয়ে দিবে তোমাকে ! ভাইয়া ঢাকা শহর তোলপাড় করে দিচ্ছে ভাবিকে খুঁজে! নওশাদ আজমীর স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তিনি কি করতে পারেন জানো ? দোয়া করো যেন ভালোয় ভালোয় খুঁজে পায় ! চার ঘণ্টা হয়ে গেছে !
নওশাদ ওসির রুমে বসে আছে ! কোন খবরই পাওয়া যাচ্ছে না ! এদের সিস্টেম টাই ওর পছন্দ হচ্ছে না ! বিভিন্ন সোর্স থেকে খবর বের করার চেষ্টা করছে কিন্তু সময় তো চলে যাচ্ছে! পুলিশের প্রথম কথা কিডন্যাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ! নওশাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়ার জন্যই কেউ কাজটা করেছে ! পুলিশ সেই ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে !
নওশাদ কি করবে সে বুঝতে পারছে না ! সে একটা মিনিটও ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারছে না ! এত অস্থির লাগছে।
ওসির রুম থেকে বের হয়ে সে গেটের সামনে সিঁড়ির কাছে দাড়ালো ! রেজোয়ানও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ! আরমান, ফারহান , শোয়েব, নওশাদের অফিসের সব ডিপার্টমেন্টের হেড রা চলে এসেছে ! সবাই চোখ মুখ শুকনো করে তাদের চেয়ারম্যানের সামনে ঘোরাঘুরি করছে !
নওশাদ বলল,এরা সবাই এসেছে কেন এত রাতে ?
রেজোয়ান বলল,আমি বলেছিলাম চলে যেতে ওরাও টেনশন করছে !
কি হবে টেনশন করে আমি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি এখন !
প্লিজ নওশাদ এভাবে বলিস না !
কি আর বলব বল!
বাসা থেকে আরমানের কাছে ফোন দিয়েছে। নিশাল খুব কান্নাকাটি করছে ! ভয় পেয়ে গেছে ! ওর সঙ্গে কথা বলবি ?
এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ,আর বলবই টা কি ?
নওশাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ! শান্ত একটা চাঁদ আকাশে । হেরার মুখটাও তো এমন শান্ত, সিগ্ধ চাঁদের মত ! মনে মনে নওশাদ বলল,কোথায় আছো হেরা তুমি ? আমি তোমাকে এতটা কষ্ট দিচ্ছি তুমি চলে এসো, এসে আমাকে বকা দাও যা খুশি করো তাও চলে এসো !
নওশাদ যখন চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে তখন থানার ঠিক সামনে দুটো রিক্সা এসে থামলো ! একটা রিক্সায় দুটো মেয়ে আর পিছনের রিক্সায় দুটো ছেলে !
সবাই থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকছে ! মাথায় ঘোমটা দেয়া মেয়েদের মধ্যে একজন হেরা । ওকে ধরে ধরে হাঁটছে আর একটা মেয়ে !
সিঁড়ির কাছে আসতেই নওশাদ কে দেখে হেরা সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো ! হাতে যা ছিল সব ফেলে ছুটে গেল নওশাদের দিকে !
হঠাৎ চিৎকার শুনে নওশাদ তাকিয়ে দেখে ওর দিকে ছুটে আসছে হেরা !
নওশাদ দুই পা এগিয়ে যাওয়ার আগেই ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো হেরা ! নওশাদ জড়িয়ে ধরলো ! কিছু একটা বলতে চাইছে তার আগেই অজ্ঞান হয়ে গেল হেরা !
নওশাদ হেরা কে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে !
রেজোয়ান একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল দৃশ্য টা দেখে ওর চোখেও পানি চলে এসেছে!
শোয়েব , আরমান, ফারহান , নওশাদের অফিসের লোকজন তাকিয়ে দেখছে নওশাদ বাচ্চাদের মত কাঁদছে হেরা কে বুকে জড়িয়ে !
ফরহানই প্রথম নওশাদের পাশে এসে দাঁড়ালো ! ভাইয়া ভাবি বেহুঁশ হয়ে গেছে !
ও চলে এসেছে ফারহান হেরা চলে এসেছে!
ভাবি কে শক্ত করে ধরো পড়ে যাবে !
নওশাদ একাই হেরা কে কোলে তুলে থানার বারান্দায় নিয়ে এলো !
হেরার সঙ্গে থাকা মেয়েটি বলে উঠলো, উনার মনে হয় শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে !
ততক্ষণে ওসি সহ থানার লোকজন ছুটে এসেছে !
আপনারা কি উনার বাসার লোক , মেয়েটি বলে উঠলো ?
নওশাদ বলল,আমি ওর হাজব্যান্ড !
থ্যাংকস গড আপনিই নওশাদ আজমী! উনি কারো নাম্বার, বাসার ঠিকানা কিছুই বলতে পারছিলেন না ! আমরা বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম !
আপনারা কোথায় পেলেন ওকে ?
আমরা পাইনি আমার আম্মা হঠাৎ দেখেন উনি বাসার সামনে বসে কাঁদছেন। খুব অসুস্থ ছিলেন উনি । তখন সাড়ে নয়টার মত হবে, আমরা তখন কেউ বাসায় ছিলাম না । একটা বিয়ে তে গিয়েছিলাম । একটু আগে বাসায় ফিরে উনাকে দেখি । উনি কারো ফোন নাম্বার বলতে পারছেন না ! বাসা কোথায় সেটাও বলতে পারছেন না ! ভয়ে উনি কাঁদছেন খালি ! শুধু বললেন উনার হাজব্যান্ডের নাম নওশাদ আজমী আর একটা গাড়ির নাম্বার বলতে পারছেন ! ইনফেক্ট উনি কথাই বলতে পারছেন না বারবার ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছেন । এখনো গায়ে প্রচন্ড জ্বর এবং শ্বাস কষ্ট হচ্ছে উনার !
ফরহান বলল,ভাইয়া আগে ভাবিকে হসপিটালাইজড করতে হবে জলদি ! পালস খুব কম !
ওসি সাহেব বলে উঠলো, স্যার আপনারা উনাকে হসপিটালে নিয়ে যান থানার কাজ পরেও দেখা যাবে ।
নওশাদ হেরা কে কোলে করেই গাড়িতে উঠালো ! শোয়েব বাহার কে এপোলো তে যাওয়ার নির্দেশ দিল ! ফাস্ট বাহার !
বাহার গাড়ি উড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ! যেভাবে প্রথম দিন নওশাদ উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল হেরাকে কুষ্টিয়া থেকে !
হসপিটালের কেবিনে অক্সিজেন মুখে লাগিয়ে শুয়ে আছে হেরা ! ডাক্তাররা ওষুধ দিয়েছে ! স্যালাইন চলছে ! নওশাদ ওর মাথার কাছে বসে আছে !
বাসায় খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বুবু, নিশাল , নাদিয়া, মিলা রওনা হয়ে গেছে হসপিটালে আসার জন্য ! রেজোয়ান নওশাদের ঘাড়ে হাত রাখলো ! তুই এখন কিছু খেয়ে নে ?
কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না দোস্ত !
এটা কেমন কথা নওশাদ !
প্লিজ রেজোয়ান। আমি ভাবছি ওকে যদি না পেতাম ঐ ভদ্রমহিলা যদি ওকে বাসায় আশ্রয় না দিতো ? উনার ছেলে, মেয়ে গুলো যদি বুদ্ধি করে থানায় নিয়ে না আসতো আমি কোথায় পেতাম হেরা কে ? আর সবচেয়ে বড় কথা আমার আজ রাতে ব্যাঙ্কক চলে যাওয়ার কথা ছিল আমি যাওয়ার পর যদি ঘটনাটা ঘটতো তখন কি হতো ?
এখন সব ঠিক হয়ে গেছে এখন এত আপসেট কেন তুই ?
রেজোয়ান আমি ওকে প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম আমি এটা মানতে পারছি না !
নওশাদ একটা কথা বলব যদিও এখন বলাটা ঠিক হচ্ছে না, একটা মানুষকে যখন অধিকার দিতে হয় তাকে তার পূর্ণ অধিকার টুকুই দিতে হয় তা না হলে আশেপাশের লোকজন বিভিন্ন সুযোগ নেয় সেই মানুষটিকে ছোট করতে ! আশাকরি বুঝতে পেরেছিস !
নওশাদ হেরার শান্ত হাতটা ধরলো ! নিজের গালের সঙ্গে লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল, সরি হেরা আমাকে ক্ষমা করে দাও ! সব আমার জন্য হয়েছে !
ফারহান এসে ঢুকলো কবিনে ! ভাইয়া,
হুঁ , বল !
ভাবিকে তো এখানে রাখতে হবে তুমি বাসায় চলে যাও এখানে নার্সরা আছে ! আর আনারের মা কে নিয়ে আসছে ওরা ও থাকুক রাতে !
না আমি থাকব আর কাউকে লাগবে না ফারহান!
ভাইয়া এখন তো ভাবি ঘুমাচ্ছে !
আমি ওকে আর কারো ভরসায় ছেড়ে দিব না নওশাদ কঠিন গলায় বলল !
ভাইয়া প্লিজ ছেলেমানুষি করো না !
ফারহান প্লিজ এটা নিয়ে আর কথা হবে না !
ফারহান বাদ দাও ওকে থাকতে দাও , রেজোয়ান বলল!
ঠিক আছে!
কিছুক্ষণ পর রেজোয়ানের পিছনে পিছনে বুবু, নিশাল বাকিরা ঢুকলো !
এত মানুষ এই সময়ে এখানে থাকতে দিবে না ,জাস্ট পাঁচ মিনিট পর চলে যেতে হবে কিন্তু, ফারহান বলল।
বুবু এসে নওশাদের মাথায় হাত রাখলো !
নওশাদ চুপ করে বসে আছে ! নিশালও এসে পাপার কাছে দাড়ালো !
তোর ছেলে সে কি কান্না বাবু ! ওর পাপার জন্য খুব খারাপ লাগছে ,পাপা কেন সব সময় কষ্ট পায় !
নওশাদ ছেলের মাথায় হাত রাখলো !
পাপা এখন কেমন আছে আন্টি ?
গায়ে জ্বর ! চিন্তা করো না ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে!
বুবু হেরার মাথায় হাত রাখলো ! আমি বাসা থেকে যখন যাই তখন হাসি মুখে আমাকে বিদায় দিলো বলল, রাতে চলে আসবেন কিন্তু থাকবেন না বুবু !
আর এখন কি অবস্থায় দেখছি ওকে !
ফারহান বুবুকে ধরে আছে ! তোমরা আর ভিড় করো না বাসায় যাও !
মেঝভাবি , মিলা তোমরা বুবুকে আর নিশাল কে দিয়ে বাসায় চলে যাও !
পাপা তুমি খেয়েছো কিছু ?
আমাকে নিয়ে টেনশন করো না বাবা আমি ঠিক আছি ! এখন বাসায় যাও কালকে তোমার আন্টিকে নিয়ে আসা যায় কিনা দেখি !
তুমি থাইল্যান্ডে যাচ্ছো না তো ?
না এখন আমি কোথাও যাচ্ছি না ! তোমার আন্টিকে রেখে কোথাও যাব না এখন!
ঠিক আছে !
কিছুক্ষণ থেকে সবাই বাসায় চলে গেল ! ফারহান সবাই কে বিদায় দিয়ে নওশাদের পাশে এসে দাঁড়ালো !
ও একবারও চোখ খুলে তাকাচ্ছে না কেন ?
ভাইয়া ওষুধের জন্য ঘুমাচ্ছে ভাবি !
তুই বাসায় চলে যা ।কালকে আসলেই হবে যা এখন রেস্ট নে !
তুমি রেস্ট নিবে না ?
আমি ওর পাশে আছি সমস্যা নেই তুই যা আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না !
ঠিক আছে ! ফোন দিও ভাইয়া ! ফারহান চলে গেল !
নওশাদ ওয়াস রুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো ! হেরার কোন নড়াচড়া নেই ! নওশাদ ওর পাশে এসে বসলো ! গায়ের কম্বল টা ঠিক করে দিল ! ঘুমন্ত মুখাটার দিকে তাকিয়ে নওশাদের চোখ ভিজে উঠছে! সিসিটিভির ফুটেজ টার কথা মনে পড়ছে তার কতটা অসহায়ের মত তাকাচ্ছিলো হেরা ! আমার ভুলে তুমি এত বড় কষ্ট টা পেলে হেরা ! সরি !
বন্ধ করা চোখ দুটোতে চুমু খেল নওশাদ! তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে এখন থেকে, কারো সঙ্গে যেতে দিব না কোথাও !
সারারাত নওশাদ হেরার হাতটা ধরে পাশে বসে রইলো !
সকালে ডাক্তার এসেছে যখন, তখন ও হেরা অচেতন ! গায়ের জ্বর কমেছে !
এত ঘুমাচ্ছে কেন ও ?
ডাক্তার বললেন,উনি খুব দূর্বল হয়ে গেছেন তাই এভাবে ঘুমাচ্ছে ! আজকের দিনটা দেখি !
দুই দিন হেরা হসপিটালে রইলো জ্বর কমে যেতেই ফারহান ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলো ! এই দুই দিনে হেরা কিছুই খায়নি এবং কারো সঙ্গে কোন কথাও বলেনি !
নওশাদ পরদিন দুপুরে একবার ডেকেছে ! কিন্তু চোখ খুলে আবার ঘুমিয়ে গেছে ! নওশাদ অস্থির হচ্ছে দেখে ফারহান বুঝিয়ে বলেছে বেশি উইকনেস এর জন্য ঘুমাচ্ছে তুমি অযথা চিন্তা করছো ভাইয়া !
নিশাল এসেছিল দেখতে , অনেকক্ষণ হেরার মাথার পাশে বসে থেকে বাসায় ফিরে গেছে ! হেরা তখনও ঘুমিয়ে ছিল !
নওশাদ এই দুই দিন হেরার সঙ্গে ই আছে । গতকাল সন্ধ্যায় রেজোয়ান একরকম জোর করেই বাসায় নিয়ে গিয়েছিল ওকে । সুমনার কাছে হেরাকে রেখে নওশাদ রেজোয়ান কে নিয়ে বাসায় এসেছিল ড্রেস চেঞ্জ করেই আবার হসপিটালে ফিরে গেছে !
আজ সকাল থেকে হেরা তাকাচ্ছে কিন্তু কোন কথা বলছে না এখনো !
দুপুরের দিকে হেরা চোখ খুলে দেখে, নওশাদ তার মাথার কাছে বসে আছে ! হেরা তাকাতেই সুন্দর করে হাসলো !
ঘুম ভাঙল তোমার ! কখন থেকে অপেক্ষা করছি কখন তুমি উঠবে !
আমরা একটু পর বাসায় ফিরে যাব ! উঠে বসবে ?
হেরা তাকিয়ে আছে কিছুই বলল না !
ফারহান ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে এলেই আমরা চলে যাব !
নওশাদ হেরার মুখের উপর ঝুঁকে এলো , তুমি আমার সঙ্গে অনেক রাগ করেছো তাই না ! সরি হেরা !
হেরা তাকিয়ে আছে কিছুই বলছে না ! নওশাদ ওর মাথায় হাত রাখলো । বাসায় চলো তোমার জন্য দারুন একটা জিনিস অপেক্ষা করছে বাসায় !
হেরা চোখ বন্ধ করলো !
বিকেলে নওশাদ আর ফারহান হেরা কে বাসায় নিয়ে এলো ! হেরা হাঁটতেই পারছে না উইকনেস এর জন্য ! নওশাদ ধরে ধরে গাড়ি থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল ! তারপর নিজেই কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে তুলল ! লিভিং রুমের সোফায় বসিয়ে দিলো ! বুবু, এলিন, নাহিন এমনকি শোয়েব সবাই হেরাকে ঘিরে আছে ! বাসার সব কাজের লোকজন হেরাকে দেখতে উপরে এসে হাজির হয়েছে!
আনারের মা হেরার পায়ের কাছে বসে কাঁদল কিছুক্ষণ !
আনারের মা কান্নাকাটি বন্ধ কর তোমার আম্মাকে জুস টুস কিছু খেতে দাও !
জ্বি ফুফুআম্মা বলেই আনারের মা দৌড় দিল রান্নাঘরের দিকে !
এলিন, নাহিন হেরা কে জড়িয়ে ধরে আছে ! কত ভয় পেয়েছিলাম জানো বৌমনি !
নাহিন অনেক কেঁদেছে তোমার জন্য !
আর তুমি মনে হয় কাঁদো নি এলিন , নাহিন বলল!
হুম বাড়িতে কান্নাকাটি র একটা রোল পড়েছিল হেরা , বুবু বলল!
হেরা আমার দিকে তাকাও !
হেরা বুবুর দিকে তাকালো !
এখন শরীর ভালো লাগছে ?
হেরা মাথা হালকা ঝাকালো !
নওশাদ দূরে সোফায় বসে তাকিয়ে আছে হেরার দিকে ! কোন কথা নেই মুখে পাথরের মত চোখ নিয়ে দেখছে !
ভাইয়া ওষুধ সব কি বুঝিয়ে দিব তোমাকে ?
প্রেসক্রিপশনে লিখা আছে না , তাতেই হবে আমি খাইয়ে দিব !
ওষুধের প্যাকেটের গায়েও স্টিকার লাগানো আছে কখন কতটুকু !
তাহলে তো হলোই ! তুই চা খেয়ে রেস্ট নে !
আমি ঠিক আছি, তুমি দুই দিন কোন রেস্ট নাও নি প্লিজ তুমি রেস্ট নাও । ভাবি ঠিক আছে এখন!
ঠিক নেই ফারহান ! দেখছিস না কথা বলছে না কোন !
একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দুই চার টা দিন এরকম চুপচাপ থাকবে তারপর ঠিক হয়ে যাবে ! সবাই স্বাভাবিক ব্যবহার করলেই ঠিক হয়ে যাবে! তুমি পাশে থাকো ভালো লাগবে ভাবির !
নওশাদ ফারহানের দিকে তাকালো শুধু !
নওশাদ শোয়েব কে কাছে ডাকলো !
জ্বি মামা ?
জিনিস এসেছে ?
হ্যাঁ সেট করাও হয়ে গেছে , গিয়ে দেখেন একটু !
বাবু তোর অফিসের লোকজন , বন্ধুবান্ধব এত এত ফ্লাওয়ারবুকে পাঠিয়েছে হেরার জন্য , বুবু বললেন !
জানো বৌমনি আজকে সকাল থেকে বাসা ভরে গেছে ফ্লাওয়ারবুকেতে এত সুন্দর সুন্দর ফুল , এলিন এক্সাইটেড হয়ে বলল!
এলিন ফিসফিস করে হেরার কানের কাছে বলল, তোমার ঘরে দারুন সারপ্রাইজ আছে আজ ! একটা ভাইয়ার দেয়া আর বাকিটা আমার আর নাহিনের !
হেরা ওদের কারো কথায় কোন কিছু বলছে না শুধু তাকিয়ে আছে !
নিশাল কোথায় বুবু ?
তাইতো রে বাবু একদম ভুলে গেছি ও ঘুমাচ্ছে বলেছিল তোরা আসলে ডেকে দিতে !
আনারের মা যাও ডাক দাও তোমার ভাইয়াকে বলো তার বাবা আর মা চলে এসেছে !
থাক বুবু ঘুমাক ও !
না না রাগ করবে হেরার জন্য অপেক্ষা করছিলো !
আনারের মা নিশালকে ডাকতে গেছে !
নওশাদ উঠে এসে হেরার পাশে দাঁড়ালো , রুমে যাবে এখন নাকি এখানে থাকবে ?
হেরা মুখে কিছু বলল না , শুধু উঠে দাঁড়াতে নিলো নওশাদ হাত বাড়িয়ে ধরলো ওকে ! আমি ধরছি !
বাবু যা তোরা রুমে যা রেস্ট নে !
হ্যাঁ বুবু !
নওশাদ নিজের রুমের দরজার কাছে এসে হেরার কানে কানে বলল , হসপিটালে বলেছিলাম না তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি রুমে ঢুকলেই দেখবে !
নওশাদ হেরা কে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল কিন্তু দরজা খুলে সে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেল !
নওশাদ হেরার জন্য নতুন বেড কিনে এনেছে ! হেরা বেড দেখে অবাক হলো! মুখে যদিও কিছু বলল না কিন্তু ওরা দুজন সবচেয়ে বেশি অবাক হলো পুরো ঘর ফ্লাওয়ারবুকে , মোম , ফেয়ারি লাইট দিয়ে এলিন আর নাহিন খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে দেখে ! রঙ বেরঙের আলোতে রুমটা যে এভাবে সাজানো থাকবে নওশাদ বুঝেনি ! ও একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে !
তোমাকে অবাক করতে গিয়ে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেছি হেরা ! মেয়ে গুলো তো দেখি এলাহি কান্ড করে বসে আছে !
নওশাদ হেরা কে বিছানায় নিয়ে বসালো !
বেডটা পছন্দ হয়েছে তোমার ?
আর আগেরটা পলিশ করিয়ে যত্ন করে রেখে দিব নিশাল আর ওর বউ এর জন্য ! নওশাদ হাসছে।
হেরার বসে থাকতে খারাপ লাগছে ও কাত হয়ে শুয়ে পড়ল !
নওশাদ কমফোর্টার টা গায়ে দিয়ে দিল ! আরাম করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি !
দরজায় নক করার শব্দে নওশাদ তাকালো ! নিশাল এসেছে বোধহয় !
পাপা আসব?
এসো।
এসো বাবা ! এই যে তোমার আন্টিকে নিয়ে এসেছি !
সরি আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম ! নিশাল হেরার কাছে গিয়ে বসলো ! কপালে হাত দিয়ে বলল, এখন শরীর কেমন তোমার ?
হেরা তাকিয়ে আছে কোন কথা বলছে না !
তুমি নাকি কারো সঙ্গে কথা বলছো না , আমার সঙ্গেও কথা বলবে না ?
নওশাদ গায়ের শার্টটা খুলতে খুলতে নিশালকে দেখছে !
আমার খুব খারাপ লাগছে তুমি আমার জন্য গিফট কিনতে গিয়ে এত বড় বিপদে পড়লে ! তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি সারাজীবন গিল্ড ফীল করতাম ! সব আমার জন্য হয়েছে আমি জানি ! নিশাল ওদের অবাক করে দিয়ে কেঁদে দিল!
নওশাদ নিশালের কাছে এসে দাঁড়ালো , না বাচ্চা তোমার জন্য কিছু হয়নি !
আমি জানি পাপা তুমি মামনি দুজনেই আমার জন্য কষ্টটা পেলে !
নিশাল হেরার হাত ধরলো তুমি সুস্থ হয়ে উঠো মামনি ! হেরা উঠে বসে নিশালের হাতটা ধরলো ! ওর চোখ দিয়েও পানি পড়ছে !
নওশাদ নিশালের ঘাড়ে হাত রাখতেই নিশাল পাপাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো !
সরি পাপা ! আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম !
নওশাদের কাছে অদ্ভুত লাগছে সে এক নতুন নিশাল কে দেখছে ! ছেলেটার মন এত সফট ও বুঝতেই পারেনি কখনো !
( চলবে )